সচিত্র সতর্কবাণী ৯০ শতাংশ করার দাবি
৯৬ শতাংশ সিগারেটের প্যাকেটে নেই উৎপাদন তারিখ, টিসিআরসি বলছে কর ফাঁকির চেষ্টা
পণ্য মোড়কজাতকরণ বিধিমালা ২০২১ এবং ভোক্তা অধিকার আইন অনুসারে কোনো পণ্যের মোড়কে উৎপাদনের তারিখ দেওয়া বাধ্যতামূলক হলেও সিগারেট কোম্পানীগুলো এই আইন একেবারেই মানছে না।
৫৯ শতাংশ ধোয়াবিহীন তামাকজাত দ্রব্যের (জর্দা ও গুল) মোড়কে উৎপাদনের তারিখ পাওয়া গেলেও বিড়ি ও সিগারেটের প্যাকেটে সেই হার মাত্র ৩ শতাংশ।
উৎপাদনের তারিখ না উল্লেখ না করে তামাক কোম্পানীগুলো কর ফাঁকির সুযোগ নিচ্ছে। পাশাপাশি তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন অনুযায়ী নিধার্রিত সময়ে সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্কবাণী প্রদান না করার সুযোগও নিচ্ছে তারা।
মঙ্গলবার সকালে রাজধানীর গুলশানের হোটেল অ্যারিস্টোক্র্যাট ইন-এ ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভির্সিটির ‘টোব্যাকো কন্ট্রোল এন্ড রিসার্চ সেল (টিসিআরসি) ও বাংলাদেশ তামাক বিরোধী জোট’—বাটার আয়োজনে ‘তামাকজাত দ্রব্যের সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্কবাণী বাস্তবায়ন বর্তমান অবস্থা’ শীর্ষক এক গবেষণার ফল প্রকাশ অনুষ্ঠানে বক্তারা এসব দাবি জানান।
বাংলাদেশ তামাক বিরোধী জোটের ভারপ্রাপ্ত সমন্বয়কারী এবং প্রত্যাশা মাদক বিরোধী সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক হেলাল আহমেদ এর সভাপতিত্বে প্রধান অতিথি ছিলেন ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির উপ—উপাচার্য প্রফেসর ড. গনেশ চন্দ্র সাহা।
বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ ক্যান্সার সোসাইটির সভাপতি অধ্যাপক ডা. গোলাম মহিউদ্দিন ফারুক, সিটিএফকের গ্রান্ট ম্যানেজার মো. আব্দুস সালাম মিয়া।
টোব্যাকো কন্ট্রোল এন্ড রিসার্চ সেলের (টিসিআরসি) প্রজেক্ট ম্যানেজার ফারহানা জামান লিজার সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধে গবেষণার বিষয়বস্তু তুলে ধরেন সদস্য সচিব ও প্রকল্প পরিচালক এবং ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির সহযোগী অধ্যাপক মো. বজলুর রহমান।
মো. বজলুর রহমান বলেন, ‘তামাক নিয়ন্ত্রণের নানা পদ্ধতির মধ্যে তামাকজাত দ্রব্যের মোড়কে সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্কবাণী প্রদান অন্যতম। ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইন ২০০৫ (সংশোধনী ২০১৩) এর ধারা ১০ অনুযায়ী সকল তামাকজাত দ্রব্যের মোড়কের উভয়পাশের মূল প্রদর্শনী তলের উপরিভাগের ৫০ শতাংশ এলাকা জুড়ে তামাকের স্বাস্থ্য ক্ষতি সম্পকৃত সচিত্র সতর্কবার্তা প্রদান করতে হবে। কিন্তু আইনের এই নির্দেশনা মানছে না সিগারেট কোম্পানীগুলো।’
তিনি জানান, টোব্যাকো কন্ট্রোল এন্ড রিসার্চ সেল (টিসিআরসি) তামাকজাত দ্রব্যের মোড়কের সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্কবাণী পরিপালনের বর্তমান অবস্থা খতিয়ে দেখতে গত ২০২৩ সালের নভেম্বর মাস থেকে ২০২৪ সালের এপ্রিল মাস পর্যন্ত দেশের ৮টি বিভাগের বিভাগীয় শহর থেকে ২৭২টি তামাকজাত দ্রব্যের মোড়ক সংগ্রহ করে। মোড়ক থেকে প্রাপ্ত তথ্য সংগ্রহের মাধ্যমে একটি গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করে টিসিআরসি।
এ সময় প্রধান অতিথির বক্তব্যে প্রফেসর ড. গনেশ চন্দ্র সাহা বলেন, ‘তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনে উৎপাদিত পণ্যের মোড়কে উৎপাদনের তারিখ এবং উৎপাদনকারী কোম্পানির নাম ঠিকানা প্রদান বাধ্যতামূলক করা উচিত। বিদেশী ব্র্যান্ডগুলো তামাকপণ্য আমদানি করে বাংলাদেশে বিক্রি করতে হলে তাদেরকেও আমাদের তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন মেনে প্যাকেজিং করতে হবে।’
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে অধ্যাপক ডা. গোলাম মহিউদ্দিন ফারুক বলেন, ‘তামাকজাত দ্রব্যের মোড়কে সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্কবাণী তামাক নিয়ন্ত্রণের অন্যতম হাতিয়ার। কিন্তু তামাকজাত পণ্যের মোড়কের ভিন্নতা, মানহীন মোড়ক, সাইজের ভিন্নতা, সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্কবাণী প্রদানের উপযুক্ত মোড়ক না থাকা, এসকল সমস্যার একমাত্র সমাধান হতে পারে স্ট্যান্ডার্ড প্যাকেজিং। সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্কবাণীর সঠিক বাস্তবায়নে স্ট্যান্ডার্ড প্যাকেজিং প্রবর্তন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।’
সভাপতির বক্তব্যে হেলাল আহমেদ বলেন, ‘তামাক কোম্পানীগুলো প্রতিনিয়ত আইন লঙ্ঘন করছে। তারা তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন ভঙ্গ করছে। প্যাকেজিং আইন লঙ্ঘন করছে। ধোঁয়াবিহীন তামাকের ব্যবহার বাংলাদেশের কালচারের সঙ্গে মিশে আছে। এর ব্যবহার কমাতে সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্কবাণী বড় ভূমিকা রাখতে পারে। এক্ষেত্রে মোড়কে এই সতর্কবাণীর পরিমাণ ৫০ শতাংশ থেকে বৃদ্ধি করে ৯০ শতাংশ করা অত্যন্ত জরুরি।’
সিটিএফকের গ্রান্ট ম্যানেজার আব্দুস সালাম মিয়া বলেন, ‘সমস্যা উদ্ঘাটন ও সমাধানের জন্য গবেষণা করা প্রয়োজন। সিদ্ধান্ত নিতে হলে গবেষণা করতে হবে। আজকের এ গবেষণার ফল সরকারকে তামাক নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করবে। তামাক নিয়ন্ত্রণে এ ধরনের গবেষণা ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা অনুযায়ী ২০৪০ সালের মধ্যেই বাংলাদেশকে তামাক মুক্ত করা সম্ভব বলে আশা করছি।’
বিশেষ অতিথি হিসেবে আরও উপস্থিত ছিলেন ডেভেলপমেন্ট এক্টিভিটিস অব সোসাইটি (ডাস্)—এর টিম লিড আমিনুল ইসলাম বকুল, এইড ফাইন্ডেশনের প্রকল্প পরিচালক শাগুফতা সুলতানা, ব্যুরো অফ ইকোনমিক রিসার্চ এর প্রকল্প ব্যাবস্থাপক হামিদুল ইসলাম হিল্লোল এবং ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির রিসার্চ এবং পাবলিকেশন সেলের অতিরিক্ত পরিচালক প্রফেসর মো. আব্দুল বাসেদ।
উত্থাপিত গবেষণায় দেখা গেছে— ৮৫ শতাংশ তামাকপণ্যের মোড়কে সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্কবাণী পাওয়া গেছে। এরমধ্যে মাত্র ২৬ শতাংশ মোড়কে পঞ্চাশ শতাংশ এলাকা জুড়ে সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্কবাণী মুদ্রণ করা হয়েছে। তবে ৭৬ শতাংশ মোড়কের উভয়পাশে এই সতর্কবাণী মুদ্রণ করা হয়নি।
এছাড়াও ৭ শতাংশ মোড়কে ছবির সঙ্গে লিখিত বার্তা প্রদান করা হয়নি, ৭২ শতাংশ মোড়কের লিখিত সতর্কবাণী কালো জমিনে সাদা অক্ষরে মুদ্রিত হয়েছে।
অন্যদিকে বিড়ির ৮০ শতাংম মোড়কেই সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্কবাণী ব্যান্ডরোল দিয়ে ঢেকে থাকতে দেখা গেছে এবং ২৫ শতাংশ মোড়কে “শুধুমাত্র বাংলাদেশে বিক্রয়ের জন্য অনুমোদিত” মর্মে বাণী প্রদান করা হয়েছে। তবে কোনো সিগারেটের কার্টনেই সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্কবাণী পাওয়া যায়নি।
এছাড়া ৩৩ শতাংশ তামাকজাত পণ্যের মোড়কে ভ্যাট রেজিস্টেশন নাম্বার পাওয়া গেছে, ৯ শতাংশ মোড়কে ট্রেড লাইসেন্স নাম্বার ছিল, ৫১ শতাংশ মোড়কে উৎপাদনের তারিখ ছিল।
অনুষ্ঠানে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ, সাংবাদিক, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং বাংলাদেশে তামাক নিয়ন্ত্রণে কর্মরত বিভিন্ন সংগঠনের প্রতিনিধি ও বিশেষজ্ঞগণ উপস্থিত ছিলেন।
(ঢাকাটাইমস/৩০ এপ্রিল/এমএইচ/এসআইএস)