জাতিসংঘে ভুল তথ্য দিয়ে আমন্ত্রণপত্র, অতঃপর মানবপাচার, মিলল চমকপ্রদ তথ্য

সিরাজুম সালেকীন, ঢাকাটাইমস
| আপডেট : ২৪ মে ২০২৩, ১১:৩৫ | প্রকাশিত : ২৪ মে ২০২৩, ০৯:২৮

জাতিসংঘ সদর দপ্তরে ভুয়া তথ্য দিয়ে বিভিন্ন কনফারেন্সে (সভায়) যোগদানের জন্য আমন্ত্রণপত্র চাইতো ‘প্রটেকশন ফর লিগ্যাল অ্যান্ড হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশন’ নামের একটি বেসরকারি সংস্থা। বিভিন্ন ব্যক্তির নামে আমন্ত্রণপত্র পাওয়ার পর ভুয়া কাগজপত্র দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ভিসার আবেদন করতেন তারা। এভাবে যুক্তরাষ্ট্রে লোক পাঠিয়ে সংস্থাটি জনপ্রতি বিপুল অর্থ হাতিয়ে নিতো। দীর্ঘদিন ধরে জাতিসংঘ সদর দপ্তরের সঙ্গে জালিয়াতি করে আসছিল আন্তর্জাতিক এই মানবপাচারকারী চক্র।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনী জানিয়েছে, কথিত মানবাধিকার সংস্থা ‘প্রটেকশন ফর লিগ্যাল অ্যান্ড হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশন’ নিজেদের জাতিসংঘের ইকোনমিক ও সোশ্যাল কাউন্সিলের স্পেশাল কনসালটেটিভ স্ট্যাটাস বলে দাবি করতো। অবৈধ পন্থায় ২০১৯ সাল থেকে জালিয়াতির মাধ্যমে তারা যুক্তরাষ্ট্রে লোক পাঠিয়ে বিপুল অর্থ হাতিয়ে নিয়েছে। অথচ বাস্তবে এটি নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠান।

ঢাকাস্থ যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস এ ধরনের জালিয়াতির বিষয়টি বুঝতে পেরে গত ২১ মে গুলশান থানায় একটি মামলা করে। ওই মামলায় তদন্ত করতে গিয়ে এই প্রতারক চক্রের পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)।

আরও পড়ুন>> বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদারে আগ্রহী কাতার

আরও পড়ুন>> হাতিরঝিলে রাজউকের হাঁসে কতটা লাভ হলো জীব বৈচিত্র্যের?

গ্রেপ্তারকৃতরা হলেন- মহিউদ্দিন জুয়েল, মো. উজ্জ্বল হোসাইন ওরফে মুরাদ, এনামুল হাসান, শাহাদাদ এবং হাদিদুল মুবিন। এদের মধ্যে মহিউদ্দিন জুয়েল এলএলবি করেছেন। আর উজ্জ্বল মাস্টার্স পাস, এনামুল হাসান এসএসসি, শাহাদাদ অনার্স এবং হাদিদুল মাস্টার্স সম্পন্ন করেছেন। তাদের কাছ থেকে তিনটি পাসপোর্ট, ভিজিটিং কার্ড, এনওসি এবং পাঁচটি মোবাইল জব্দ করা হয়েছে। কথিত মানবাধিকার সংস্থাটির (প্রটেকশন ফর লিগ্যাল অ্যান্ড হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশন) চেয়ারম্যান পরিচয় দিতেন মহিউদ্দিন আর উজ্জ্বল প্রতিষ্ঠানের নির্বাহী কর্মকর্তা পরিচয়ে সব কার্যক্রম চালাতেন।

এর আগে গত এপ্রিলে ‘কথক একাডেমির’ নামে ভুয়া তথ্য-উপাত্ত দিয়ে জাতিসংঘ কনফারেন্সে যোগদানের নামে ‘১২ লাখে যুক্তরাষ্ট্রে পাচার’ চক্রের তিনজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস জালিয়াতির বিষয়টি বুঝতে পেরে গুলশান থানায় একটি মামলা করে। ওই মামলা তদন্ত করতে গিয়ে প্রতারক চক্রের সন্ধান পায় ডিবির সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগ। তখন ডিবি জানায়, চক্রের হোতা আবুল কাশেম কথক একাডেমির সিইও পরিচয়ে প্রতারণা ও মানবপাচারের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তার কথক একাডেমির কোনো রেজিস্ট্রেশন নেই। ২০০৮ সাল থেকেই কাশেম বিভিন্ন ধরনের প্রতারণায় জড়িত। ২০১২ সাল থেকে ১০-১২ লাখ টাকার বিনিময়ে ভুয়া তথ্য দিয়ে ভিসা পাইয়ে যুক্তরাষ্ট্র, জার্মান, জাপান, ইতালি, দুবাই, ফ্রান্সসহ বিভিন্ন উন্নত দেশে প্রায় ৮০ জনকে পাচার করেন তিনি।

ডিবির অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার (এডিসি) জুনায়েদ আলম সরকার ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘বিভিন্ন আন্তর্জাতিক কনফারেন্সে যোগদানের কথা বলে জাতিসংঘ সদর দপ্তরে ভুয়া তথ্য দিয়ে ইমেইল পাঠিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা সংগ্রহকারীদের বিরুদ্ধে দূতাবাস কর্তৃপক্ষ চলতি মাসে একটি মামলা করে। ওই মামলা তদন্ত করতে গিয়ে পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করা হয়।’

প্রতারকদের এ ধরনের কাজে বহির্বিশ্বে দেশের ভাবমূর্তি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে উল্লেখ করে এই ডিবি কর্মকর্তা বলেন, ‘প্রতারকদের কারণে দেশের সুনাম ক্ষুণ্ণ হচ্ছে। বিশেষ করে যারা সঠিকভাবে যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা প্রাপ্তির আবেদন করেন তারা নানাভাবে বাধার সম্মুখীন হন। পাসপোর্টে জাল ভিসা বা সিল ব্যবহার করা দেশের আইনে অপরাধ। তাই এ ধরনের কাজ থেকে বিরত থাকতে হবে।’

যেভাবে চলছিল অভিনব প্রতারণা:

ডিবি সূত্র জানিয়েছে, অবৈধ পন্থা অবলম্বন করে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক কনফারেন্সে যোগদানের কথা বলে জাতিসংঘ সদরদপ্তরে ভুয়া তথ্য যুক্ত করে ইমেইল পাঠাতো চক্রটি। প্রতারণার মাধ্যমে আমেরিকার ভিসা সংগ্রহ করা এ চক্রের পাঁচজনকে গ্রেপ্তারের পর জানা যায়, নাম সর্বস্ব সংস্থা ‘প্রটেকশন ফর লিগ্যাল অ্যান্ড হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশন’-এর আড়ালে টাকার বিনিময়ে ২০১৯ সাল থেকে মিথ্যা তথ্য ব্যবহার করে আমেরিকা, ফ্রান্সসহ অন্যান্য দেশে মানবপাচার করে আসছিলেন তারা।

অভিযুক্তরা জানিয়েছে, তাদের পরিচালিত প্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য ভুক্তভোগীরা আসতেন। প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান মহিউদ্দিন জুয়েল বিরোধ নিষ্পত্তির আড়ালে কৌশলে তাদের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তুলতেন। এরপর ইউরোপ-আমেরিকাসহ বিভিন্ন দেশে পাঠানোর প্রলোভন দেখিয়ে বিপুল পরিমাণ অর্থ নিতেন।

যে প্রক্রিয়ায় লোক পাঠানো হতো:

চক্রের সদস্যরা জাতিসংঘ অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিষদের বিভিন্ন কনফারেন্সসহ অন্যান্য কনফারেন্সের বিজ্ঞপ্তিগুলোর নিয়মিত খোঁজখবর রাখতেন। কনফারেন্সগুলোর বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ পাওয়া মাত্রই তারা ‘প্রটেকশন ফর লিগ্যাল অ্যান্ড হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশন’-এর বিভিন্ন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা পরিচয়ে কনফারেন্সে যোগ দিতে জাতিসংঘ সদরদপ্তরে ই-মেইল করতেন। গ্রেপ্তারকৃত এনামুল হাসান প্রতিষ্ঠানের ডেপুটি ডাইরেক্টর, শাহাদাদ কমিউনিকেশন অফিসার, হাদিদুল মুবিন উপ-পরিচালক পরিচয়ে জাতিসংঘ সদরদপ্তরে ‘আদিবাসী ইস্যু’ অনুষ্ঠানে (১৭ থেকে ২৮ এপ্রিল এবং ৪ মে) অংশগ্রহণের কথা জানান। পরবর্তী সময়ে জাতিসংঘ থেকে আমন্ত্রণপত্র নেন। আমেরিকার ভিসা পেতে ঢাকাস্থ দূতাবাসে তাদের প্রতিষ্ঠানের নামে জালিয়াতি করে তৈরি করা কাগজপত্র দাখিল করেন। এসময় তারা আমেরিকার ভিসা পেতে আবেদন করেন, যা সম্পূর্ণ জালিয়াতির আশ্রয় নিয়ে করা হয়।

এসময় ‘প্রটেকশন ফর লিগ্যাল অ্যান্ড হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশন’ জাতিসংঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিষদের স্পেশাল কনসালটেটিভ স্ট্যাটাস দাবি করেন। পরে দূতাবাস বুঝতে পারে তারা মানবপাচার চক্রের সদস্য। এরপরই থানায় অভিযোগ দায়ের করা হয়।

ডিবি পুলিশ বলছে, আসামিদের প্রতারণার মাধ্যমে উপার্জন করা অর্থের পরিমাণ এবং সেগুলো কোথায় কোথায় বিনিয়োগ করা হয়েছে নাকি বিদেশে পাচার করা হয়েছে, এসব বিষয়ে তদন্ত চলছে।

(ঢাকাটাইমস/২৪মে/এসএস/এফএ)

সংবাদটি শেয়ার করুন

বিশেষ প্রতিবেদন বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন এর সর্বশেষ

কথায় কথায় মানুষ পেটানো এডিসি হারুন কোথায়? থানায় ছাত্রলীগ নেতাদের মারধরের তদন্ত কোথায় আটকে গেল?

মজুত ফুরালেই বাড়তি দামে বিক্রি হবে সয়াবিন তেল

কোন দিকে মোড় নিচ্ছে ইরান-ইসরায়েল সংকট

ছাদ থেকে পড়ে ডিবি কর্মকর্তার গৃহকর্মীর মৃত্যু: প্রতিবেদনে আদালতকে যা জানাল পুলিশ

উইমেন্স ওয়ার্ল্ড: স্পর্শকাতর ভিডিও পর্নোগ্রাফিতে গেছে কি না খুঁজছে পুলিশ

জাবির হলে স্বামীকে বেঁধে স্ত্রীকে জঙ্গলে ধর্ষণ, কোথায় আটকে আছে তদন্ত?

নাথান বমের স্ত্রী কোথায়

চালের বস্তায় জাত-দাম লিখতে গড়িমসি

গুলিস্তান আন্ডারপাসে অপরিকল্পিত পাতাল মার্কেট অতি অগ্নিঝুঁকিতে 

সিদ্ধেশ্বরীতে ব্যাংক কর্মকর্তার মৃত্যু: তিন মাস পেরিয়ে গেলেও অন্ধকারে পুলিশ

এই বিভাগের সব খবর

শিরোনাম :