জেনে নিন যে কারণে পুঁজিবাজারে এখনও লাইফ ইন্স্যুরেন্স খাতের অফুরান সম্ভাবনা

রুদ্র রাসেল, ঢাকা টাইমস
  প্রকাশিত : ১০ জুন ২০২৩, ১৮:৪২
অ- অ+

দেশের পুঁজিবাজারে বীমা খাতের দাপট চলছে। পুঁজিবাজার বিশ্লেষক এবং খাতসংশ্লিষ্ট অনেকেই মনে করেন জীবন বীমা খাতের জয়যাত্রা বেশ কিছুদিন ধরেই অব্যাহত আছে। বীমা কোম্পানিগুলোর শেয়ারদরেও উল্লম্ফন চলছে।

কেন?

বিশ্লেষকরা বলছেন, এই খাতে অনেক পুঁজির বিনিয়োগ রয়েছে। দেশের ১৮ কোটি মানুষকে বীমার আওতায় আনতে নানামুখী উদ্যোগ গ্রহণ করেছে সরকার। বীমা বাধ্যতামূলক করার পরিকল্পনাও রয়েছে সরকারের।

এ লক্ষ্যে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করার জন্য টাঙ্গাইল জেলার মধুপুর, ঘাটাইল এবং কালিহাতি উপজেলায় একটি পাইলট প্রকল্পের আওতায় ইতোমধ্যে পরীক্ষামূলকভাবে স্বাস্থ্য বীমা কার্যক্রম চালু করা হয়েছে। পরবর্তীতে এ কার্যক্রম দেশব্যাপী ছড়িয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে।

এছাড়া উন্নত দেশের আদলে কৃষি বীমা সম্প্রসারণের কাজ চলছে। সাধারণ বীমা করপোরেশন ছাড়াও অক্সফাম নামের একটি প্রতিষ্ঠান হাওর অঞ্চলে কৃষি বীমা সম্প্রসারণে কৃষকদের আগ্রহী করতে কার্যক্রম চালাচ্ছে।

বীমা গ্রাহকদের আস্থা অর্জনে ‘ইউনিফাইড মেসিজিং সিষ্টেম (ইউএমপি) পদ্ধতি চালু করেছে সরকার। আর বীমা ব্যবসায় তুলনামূলকভাবে অন্য ব্যবসার চেয়ে বিনিয়োগের পরিমান কম লাগে। ২০০-৪০০ কোটি টাকা বিনিয়োগেই বীমা প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করা সম্ভব। এসব কারণগুলো পুঁজিবাজারে বীমা খাতে আশা জাগার পেছনে কাজ করছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

বর্তমান সময়ে বীমা ব্যবসা অর্থনৈতিক উন্নয়নে বিশ্বব্যাপী ব্যাপক প্রসার লাভ করেছে জানিয়ে বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স একাডেমির পরিচালক এস এম ইব্রাহিম হোসাইন ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘দেশের বীমা খাতে একটি সম্ভাবনা জেগে উঠেছে। শেয়ারবাজারেও বীমা কোম্পানিগুলো চাঙ্গা হয়েছে। বাড়ছে বিনিয়োগও।’

‘বিপদ বা ঝুঁকি থেকে রক্ষায় আর্থিক সুরক্ষা বীমার মাধ্যমে নিশ্চিত হওয়ার বিষয় সম্পর্কে আগের চেয়ে বেশি মানুষ জানতে পারছে। মানুষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে বীমা খাতে আগের তুলনায় মানুষের আগ্রহ বেড়েছে।’

এস এম ইব্রাহিম হোসাইন ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘বীমা দাবির টাকা পাওয়ার বিষয়ে যে অস্পষ্টতা মানুষের ভেতর কাজ করছিল, সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগ ও কার্যকর পরিকল্পনার মধ্য দিয়ে গ্রাহকের সেই অস্পষ্টতা অনেকটা দূর করা সম্ভব হয়েছে।’

ইন্স্যুরেন্স একাডেমির প্রধান জানান, বর্তমান সরকার বীমা দিবস, বীমা মেলা ও বিভিন্ন সেমিনার-সিম্পোজিয়ামের মাধ্যমে বীমা সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করছে। মানুষ বীমা সম্পর্কে সঠিক ধারণাটি পাচ্ছেন। সব মিলিয়েই বীমা খাতে এক ধরনের সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে। বাড়ছে বিনিয়োগও। এ খাতে আরও অর্থনৈতিক সম্ভাবনা লুকিয়ে আছে, সেগুলোরও জাগরণ ঘটাতে হবে।

এই বীমা বিশেষজ্ঞ ঢাকা টাইমসকে আরও বলেন, ‘দেশের মানুষের গড় আয়ু বেড়েছে। বৃদ্ধ বয়সে মানুষ চিকিৎসাজনিত যে আর্থিক অনিশ্চয়তায় ভোগে সেই ঝুঁকি থেকে বীমার মাধ্যমে নিরাপদ থাকা সম্ভব। এই ধারণাগুলো মানুষের মধ্যে ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ছে। এটিও বীমা খাত চাঙ্গা হওয়ার একটি কারণ।’

খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ব্যবসায়ী, পেশাজীবী, শ্রমজীবীসহ সমাজের সকল স্তরের মানুষ বীমার মাধ্যমে উপকৃত হচ্ছে। বীমা ছাড়া মানুষের জীবন, সম্পদ ও ব্যবসা-বাণিজ্য ঝুঁকির সম্মুখিন। উন্নত বিশ্বে বীমার সাহায্য ছাড়া মানুষ চলতে পারে না।

বাংলাদেশেও বীমার প্রতি মানুষের আস্থা জন্মাতে শুরু করেছে। দেশের মানুষ আগে এ বিষয়ে সচেতন ছিল না। বীমার প্রতি মানুষের অনাগ্রহ দূর করতে সরকার যেসব পদক্ষেপ নিয়েছে, তার সুফলও আসতে শুরু করেছে।

জানা গেছে, বীমা খাতে আরও উন্নয়ন ঘটাতে সরকার, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ, বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স একাডেমিসহ সকল বীমা প্রতিষ্ঠান একযোগে কাজ করছে।

ইতোমধ্যে সরকার বীমা শিল্পের উন্নয়নের জন্য বিশ্ব ব্যাংক ও নিজস্ব আর্থিক সহায়তায় বাংলাদেশের বীমা খাত উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নিয়েছে। এ প্রকল্পের মাধ্যমে বাংলাদেশে বীমা শিল্পের উন্নয়নের জন্য নানামুখি আধুনিক ও যুগোপযোগী কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে।

বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, গত এক মাস ধরে পুঁজিবাজারে লেনদেনে বীমা খাতের দাপট দেখা যাচ্ছে। শুরুতে সাধারণ বীমার লেনদেন বেশি হলেও ইদানিং জীবন বীমায় হচ্ছে সিংহভাগ। তবে এত বেশি লেনদেন এর আগে দেখা যায়নি।

আর সপ্তাহের শেষ কর্মদিবস গত বৃহস্পতিবার পুঁজিবাজারে দেখা গেল জীবন বীমা খাতের আধিপত্য। সবশেষ সপ্তাহের শেষ দিন সাধারণ বীমা খাতের ৪২টি কোম্পানিতে হাতবদল হয়েছে ৭০ কোটি ৫০ লাখ টাকা, যা মোট লেনদেনের ৭ শতাংশের কিছু বেশি।

ওইদিন বীমা খাতে যত কোম্পানির দর বেড়েছে, কমেছে তার চেয়ে বেশি সংখ্যায়। আটটির দর বৃদ্ধি, তিনটির অপরিবর্তিত থাকা আর ৩০টির দরপতনের মধ্যে একটির লেনদেন হয়নি। এদিন সব মিলিয়ে মোট লেনদেনের ৩৮ শতাংশ হয়েছে বীমা খাতে।

পুঁজিবাজারে এদিন সম্পন্ন হওয়া লেনদেনের ৩১ শতাংশেরও বেশি হয়েছে জীবন বীমা খাতের ১৫ কোম্পানিতে। ৩১০ কোটি ৪১ লাখ টাকার শেয়ার কেনাবেচা হয়েছে এ খাতে। প্রতিটি কোম্পানির শেয়ারের দরই বেড়েছে। সবচেয়ে বেশি লেনদেন হওয়া ১২টি কোম্পানির মধ্যে নয়টিই এ খাতের। এর মধ্যে ৫টি কোম্পানির দর বেড়েছে যতটা বাড়া সম্ভব ততটাই। আরও একটির দর বেড়েছে সার্কিট ব্রেকারের কাছাকাছি, ৯.৮৮ শতাংশ। আরও একটির দর ৮ শতাংশের বেশি, একটির দর ৭ শতাংশের বেশি, দুটির দর ৬ শতাংশের, একটির দর ৫ শতাংশের বেশি, তিনটির দর তিন শতাংশের বেশি এবং একটির দর বেড়েছে দুই শতাংশের বেশি।

দাম বাড়ার তালিকায় ছিল জীবন বীমা খাতের প্রগ্রেসিভ লাইফ, সোনালী লাইফ, চার্টার্ড লাইফ ইন্স্যুরেন্স, ট্রাস্ট ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স, ফারইস্ট লাইফ ইন্স্যুরেন্স। ন্যাশনাল লাইফ ইন্স্যুরেন্সের দর সার্কিট ব্রেকার ছুঁয়ে ১০ পয়সা কমে লেনদেন শেষ করেছে।

গত বুধবারও বীমা খাতের দলবেঁধে উত্থান হয়েছে। এদিনও লেনদেনের শীর্ষে ছিল বীমা খাত। এর মধ্যে আবার জীবন বীমা কোম্পানিতেই বিনিয়োগগকারীদের আগ্রহ বেশি। দর বৃদ্ধির শীর্ষ তালিকাতেও এ খাতের প্রাধান্য। সবচেয়ে বেশি দর বেড়েছে এমন ১০টি কোম্পানির ৯টি এবং ২০টি কোম্পানির ১৮টি এবং ৩০টি কোম্পানির ২৫টিই বীমা খাতের। মোট লেনদেনের ৩৪ শতাংশই হয়েছে এই একটি খাতে। এর মধ্যে জীবন বীমায় হয়েছে ২৩ শতাংশের বেশি, সাধারণ বীমায় ১১ শতাংশের কাছাকাছি।

জীবন বীমার ১৫টি কোম্পানির মধ্যে দর বেড়েছে ১৪টি, একটি হাতবদল হয়েছে আগের দিনের দরে। এসব কোম্পানিতে হাতবদল হয়েছে ১৭০ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৫টি কোম্পানির দর সার্কিট ব্রেকার ছুঁয়ে, আরও একটির দর ৯ শতাংশের বেশি, একটির দর ৮ শতাংশের বেশি, দুটি সাত শতাংশের বেশি, একটি করে কোম্পানির দর ৬, ৫, ৩ ও ২ শতাংশ বেড়েছে।

সাধারণ বীমায় বেড়েছে ৪০টি কোম্পানির দর। দুটি আগের দিনের দরে হাতবদল হয়েছে। লেনদেন হয়েছে প্রায় ৭৯ কোটি টাকা। এর মধ্যে সাতটি কোম্পানির দর বেড়েছে ৯ শতাংশের বেশি। তিনটির দর ৮ শতাংশের বেশি, দুটির দর ৭ শতাংশের বেশি, চারটি করে কোম্পানির দর ৬ ও ৫ শতাংশের বেশি, পাঁচটির দর বেড়েছে ৪ শতাংশের বেশি।

এ বিষয়ে বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের (আইডিআরএ) পরিচালক (নিবন্ধন ও ব্যবস্থাপনা) মো. জাহাঙ্গীর আলম ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘পাঁচ বছর আগে, এমনকি দুই বছর আগেও বীমা খাতে এতটা জাগরণ ঘটেনি। অবশ্য যখন যে প্রশাসন আসে তার ওপরও উন্নতি অনেকটা নির্ভর করে।’

আইডিআরএর বর্তমান চেয়ারম্যানের দক্ষ নেতৃত্ব বীমা খাতের বর্তমান অগ্রগতিতে ভূমিকা রেখেছে বলে মনে করেন সংস্থাটির পরিচালক জাহাঙ্গীর আলম।

ঢাকা টাইমসকে তিনি বলেন, ‘যত উন্নত দেশ আছে সেখানে বীমা অবশ্যাম্ভাবী। বীমা করার অর্থ হচ্ছে বিপদ-আপদসহ মানুষের যে ঝুঁকি থাকে, সেই সব ঝুঁকি ভাগ হয়ে যাওয়া। আইডিআরএ বীমা গ্রাহক ও কোম্পানি উভয়ের মঙ্গলের জন্য কাজ করে থাকে।’

‘বর্তমানে এ খাতের অভ্যন্তরীণ যে শৃঙ্খলা নিশ্চিত করা হয়েছে এবং মানুষকে ঝুঁকি ভাগ হয়ে যাওয়ার বিষয়টি নানামুখী প্রচারনার মাধ্যমে বোঝানো হচ্ছে। ফলে মানুষ বীমার প্রতি উৎসাহিত হচ্ছে। সেই কারণে অর্থনৈতিক খাতজুড়ে বীমার আরও সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে।’

জনবান্ধব বীমা খাত গড়তে এবং গ্রাহকের কল্যানে সরকারের লক্ষ্য অনুযায়ী আইডিআরএ কাজ করে যাচ্ছে বলেও জানান পরিচালক জাহাঙ্গীর আলম।

বীমা খাতে নতুন সম্ভাবনা উঁকি দিয়েছে বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিন্যান্স বিভাগের অধ্যাপক সাব্বির আহমেদ। তিনি ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘বীমা খাতে ইদানিং পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ বেড়েছে। তবে এই সম্ভাবনাকে ধরে রাখাই এখন চ্যালেঞ্জ। এটাকে কাজে লাগিয়ে বীমা খাতে বিশ্বের অন্য দেশগুলোতে যে অর্থনৈতিক অংশগ্রহণ তা দেশেও নিশ্চিত করার দিকে এগিয়ে যেতে হবে।’

অন্যদিকে, বীমা খাতসহ পুঁজিবাজারের সব খাতেই বিনিয়োগ বৃদ্ধি ও নিরাপদ বিনিয়োগ নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) কাজ করে যাচ্ছে বলে জানিয়েছেন নিয়ন্ত্রক সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মোহাম্মদ রেজাউল করিম।

তিনি ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘কমিশন পরিকল্পনামাফিক কাজ করে যাচ্ছে। এ খাতে বিনিয়োগকারীদের আস্থা বেড়েছে। এ কারণে বিনিয়োগ বেড়েছে।’

প্রসঙ্গত, ১৯৬০ সালের ১ মার্চ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তৎকালীন আলফা ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিতে কাজ শুরু করেন। এর ধারাবাহিকতায় বর্তমান সরকার প্রতিবছর ১ মার্চকে জাতীয় বীমা দিবস হিসেবে পালন করে আসছে।

(ঢাকাটাইমস/১০জুন/ডিএম)

google news ঢাকা টাইমস অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি ফলো করুন

মন্তব্য করুন

শীর্ষ খবর সর্বশেষ জনপ্রিয়
সব খবর
৫ আগস্ট গুলিবিদ্ধ তরুণ সালমানের পাশে তারেক রহমান 
যশোরে বাজার দখল নিয়ে দুই গ্রুপের সংঘর্ষে বিএনপি কর্মী নিহত  
Celebrating Mother’s Day: A Tribute to the Strength and Love of Working Mothers
বিদেশি বিশেষজ্ঞ এনে সংস্কারসহ পুঁজিবাজার উন্নয়নে পাঁচ নির্দেশনা প্রধান উপদেষ্টার
বিশেষ প্রতিবেদন তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা