পিকে হালদারকে দেশে ফেরানোর চেষ্টা কি আদৌ আছে? কেন ধীরগতি?

নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা টাইমস
| আপডেট : ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১৩:৪৬ | প্রকাশিত : ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১২:৫০

এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংক ও রিলায়েন্স ফাইন্যান্স লিমিটেডের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রশান্ত কুমার হালদার ওরফে পিকে হালদারকে দেশে ফেরানোর চেষ্টা কি আদৌ আছে? কেন ধীর গতি? এমন প্রশ্নের জবাবে দুদক বলছে, তার বিরুদ্ধে ভারতের আদালতে একটি মামলা রয়েছে। ওই মামলা শেষ হলে তাকে ফিরিয়ে আনা যাবে।

পিকে হালদারের বিরুদ্ধে কাগুজে প্রতিষ্ঠান তৈরি করে চার হাজার কোটি টাকা ঋণ জালিয়াতির অভিযোগ রয়েছে। তিনি বর্তমানে ভারতের একটি কারাগারে বন্দি রয়েছেন। তাকে ফিরিয়ে আনার বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে চায় না পুলিশ।

পুলিশ সদর দপ্তরের একটি সূত্র জানায়, বিদেশ থেকে পলাতক আসামিদের ফিরিয়ে আনতে কাজ করে ইন্টারপোল। এই আন্তর্জাতিক সংস্থাটি ইতোমধ্যে অনেক আসামিকে ফিরিয়ে এনেছে। তবে বর্তমানে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের অলিখিত নিষেধাজ্ঞা রয়েছে এসব বিষয়ে গণমাধ্যমে কথা বলতে। তাই পিকে হালদারকে ফিরিয়ে আনার বিষয়ে ইন্টারপোল কী কাজ করেছে সেটা জানাতে রাজি নয় পুলিশ সদর দপ্তরের ইন্টারপোল শাখা।

এ ব্যাপারে বাংলাদেশ পুলিশ সদর দপ্তরের সহকারী মহাপরিদর্শকের (ইন্টারপোল) মুঠোফোনে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি ফোনটি রিসিভ করেননি।

২০২২ সালের ১৪ মে ভারতের এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি) পশ্চিমবঙ্গের রাজারহাটের গ্রিনটেক সিটি থেকে পিকে হালদার ওরফে প্রশান্ত কুমার হালদারকে গ্রেপ্তার করে। এছাড়া কোলকাতার বিভিন্ন জায়গায় তল্লাশি অভিযান চালিয়ে পিকে হালদারের পাঁচ সহযোগীকেও গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তারকৃতরা হলেন-পিকে হালদারের ভাই প্রাণেশ হালদার, স্বপন মিস্ত্রি ওরফে স্বপন মৈত্র, উত্তম মিস্ত্রি ওরফে উত্তম মৈত্র, ইমাম হোসেন ওরফে ইমন হালদার এবং আমানা সুলতানা ওরফে শর্মী হালদার। ওই বছরের ২১ মে অর্থ পাচারসংক্রান্ত আইন-২০০২ অনুসারে তাদের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। বাংলাদেশেও পিকে হালদারের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা হয়েছে। এসবের বিচারকাজও শুরু হয়েছে।

পিকে হালদারের মামলার বিচার চলছে ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-১০ এর বিচারক মোহাম্মদ নজরুল ইসলামের আদালতে।

চলতি বছরের ১৪ জুন অবৈধ সম্পদ অর্জন ও অর্থপাচারের অভিযোগে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) মামলায় পিকে হালদারসহ ১৪ জনের বিষয়ে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা দুদকের উপপরিচালক মো. সালাহউদ্দিনকে জেরা করেন আসামি পক্ষের আইনজীবী। তাকে জেরা করা এখনও শেষ হয়নি।

২০২০ সালের ৮ জানুয়ারি পিকে হালদারের বিরুদ্ধে মামলাটি করেন দুদকের উপপরিচালক মামুনুর রশীদ চৌধুরী। মামলাটি তদন্ত শেষে ১৪ জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট দাখিল করেন দুদকের উপপরিচালক সালাহউদ্দিন।

এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংকের সাবেক এই ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) পিকে হালদার মোট কত টাকা লোপাট করেছেন, তার নির্দিষ্ট হিসাব পেতে গত তিন বছরের বেশি সময় ধরে কাজ করছে দুদক। এ পর্যন্ত তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন দেশে তিন হাজার কোটি টাকা পাচারসহ ৪ হাজার কোটি টাকা লুটপাটের প্রমাণ পেয়েছে এ সংস্থাটি।

যদিও দুদক পিকে হালদার ও তার সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে ১০ হাজার ২০০ কোটি টাকা লুটপাটের অভিযোগ পেয়ে অনুসন্ধান শুরু করেছিল। তদন্তের এ পর্যায়ে চার হাজার কোটি টাকা লোপাটের প্রমাণ এসেছে দুদকের হাতে।

দুদক থেকে পাওয়া সবশেষ তথ্য অনুযায়ী, পিকে হালদার ও তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে মানিলন্ডারিংসহ অন্যান্য অভিযোগে ৫২টি মামলা করেছে দুদক। এর মধ্যে ৩৮টি মামলাই পিকে হালদারের বিরুদ্ধে। এসব মামলায় ৩ হাজার কোটি টাকা পাচারের অভিযোগ আনা হয়েছে।

ওই ৫২ মামলার মধ্যে প্রথম দায়ের করা মামলাটির বিচারকাজ চলছে। ২০২০ সালের ৮ জানুয়ারি ২৭৫ কোটি টাকা লোপাটের অভিযোগে মামলাটি দায়ের করা হয়। কিন্তু মামলার তদন্তে বেরিয়ে আসে পিকে ও পিকে সিন্ডিকেটের ৪২৬ কোটি টাকার জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জন ও বিভিন্ন ব্যাংক হিসাবে প্রায় ৬ হাজার ৮০ কোটি টাকা লেনদেনের তথ্য।

এরপর এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংক ও রিলায়েন্স ফাইন্যান্স লিমিটেডের সাবেক এমডি পিকে হালদারসহ মোট ১৪ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিলের অনুমোদন দেয় দুদক। এরপর ৪২৬ কোটি টাকার জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জন ও বিভিন্ন ব্যাংক হিসাবে প্রায় ৬ হাজার ৮০ কোটি টাকা লেনদেনের অভিযোগ এনে ২০২১ সালের নভেম্বরে আদালতে চার্জশিট দাখিল করা হয়। মামলাটির ১০৬ জন সাক্ষীর মধ্যে ১০২ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ হয়েছে। চলছে তদন্তকারী কর্মকর্তাকে আসামি পক্ষের আইনজীবীর জেরার পর্ব।

দুদকের একটি সূত্র জানায়, পিকে হালদারের বিরুদ্ধে হওয়া অধিকাংশ মামলার মধ্যে একটি মামলার চার্জশিট দেওয়া হয়েছে। বাকি মামলা তদন্ত পর্যায়ে রয়েছে।

দুদক পিকে হালদার ও তার পুরো চক্রটির বিরুদ্ধে জোরদার তদন্ত করছে। এই সময়ে তাদের যেসব সম্পদ তদন্তের আওতায় এসেছে তা আদালতের আদেশে ক্রোক করা হয়েছে।

এদিকে দুদকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, একটি কম্পিউটার ব্যবহার করেই পিকে হালদার ৩০টির বেশি কাগুজে প্রতিষ্ঠান তৈরি করে দেশের আর্থিক খাত থেকে লোপাট করেন ২০০০ কোটি টাকা। প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব না থাকলেও ভুয়া কাগজপত্র তৈরি করে তার মাধ্যমেই অতি সূক্ষ্ম চক্রান্তে ওই অর্থ লুট করা হয়। দুদকের প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, পিকে হালদার সিঙ্গাপুর, ভারত এবং কানাডায় চারশ কোটি টাকার বেশি পাচার করেছেন। কানাডার টরেন্টোতে মার্কেট কিনেছেন, বিলাসবহুল বাড়ি ক্রয় করেছেন।

দুদকের প্রতিবেদনে বলা হয়, ইন্টারন্যাশনাল লিজিং থেকে ঋণের নামে যাদের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান টাকা লুট করে, প্রায় একই মালিকানাধীন আরও প্রায় ৩০টি প্রতিষ্ঠান এফএএস ফাইন্যান্স, রিলায়েন্স ফাইন্যান্স এবং পিপলস লিজিং থেকে একই কায়দায় ঋণের নামে টাকা তুলে আত্মসাৎ করে। এসব ঋণের বিপরীতে মর্টগেজ নেই বললেই চলে। ফলে ঋণ পরিশোধ হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ।

ইন্টারন্যাশনাল লিজিং ও এফএএস ফাইন্যান্সের প্রায় ৩০টি কাগুজে প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে মর্টগেজ ছাড়াই প্রায় ২০০০ কোটি টাকা জালিয়াতিপূর্ণ ঋণ প্রদানের রেকর্ড পেয়েছে দুদক। আরবি এন্টারপ্রাইজ, জিএন্ডজি এন্টারপ্রাইজ, তামিম অ্যান্ড তালহা এন্টারপ্রাইজ, ক্রসরোড কর্পোরেশন, মেরিন ট্রাস্ট, নিউটেক, এমএসটি মেরিন, গ্রীন লাইন ডেভেলপমেন্ট, মেসার্স বর্ণসহ প্রায় ৩০টি অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠানের নামে ঋণ নিয়ে ভিন্ন খাতে এ অর্থ বের করে নেওয়া হয়েছে। পিকে হালদার, সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর চেয়ারম্যান, এমডিসহ প্রায় ৭৫ জনের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে এতে।

দুদকের ওই প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, কাগুজে-ভুয়া প্রতিষ্ঠানের নামে জালিয়াতি করে নেওয়া এসব ঋণের অর্থ নানা পর্যায় পেরিয়ে যোগ হতো পিকে হালদারের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে। পিকে হালদার বিভিন্ন কৌশলে নামে-বেনামে অসংখ্য কোম্পানি খুলে শেয়ারবাজার থেকে বিপুল পরিমাণ শেয়ার কেনেন এবং ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে ও পরে নিজের আত্মীয়, বন্ধু ও সাবেক সহকর্মীসহ বিভিন্ন ব্যক্তিকে পর্ষদে বসিয়ে ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস (আইএলএফএসএল), পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস, এফএএস ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড এবং বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স কোম্পানি (বিআইএফসি) নামের আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর নিয়ন্ত্রণ নেন। এসব কোম্পানি থেকে তিনি ঋণের নামে বিপুল অংকের টাকা সরিয়ে বিদেশে পাচার করেছেন।

অন্যদিকে পিকে ও পিকে সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে মামলার তদন্তকালে এখন পর্যন্ত ১২ আসামিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে জানা গেছে। তাদের মধ্যে উজ্জ্বল কুমার নন্দী, পিকে হালদারের সহযোগী শংখ বেপারী, রাশেদুল হক, অবন্তিকা বড়াল ও নাহিদা রুনাইসহ ১০ জন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। এ ছাড়া এক হাজার কোটি টাকা সমমূল্যের সম্পদ অবরুদ্ধ ও জব্দ করা হয়েছে। এর মধ্যে আদালতের মাধ্যমে ৬৪ জনের বিদেশ যাত্রায় নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়।

২০১৯ সালে ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানের মধ্যে দেশ থেকে পালিয়ে যান পিকে হালদার। এ সময় তার দুর্নীতি ফাঁস হলে অনুসন্ধান শুরু করে দুদক। একপর্যায়ে ২০২২ সালের ১৪ মে পিকে হালদারকে গ্রেপ্তার করে ভারতের কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা ইডি। একইসঙ্গে গ্রেপ্তার করা হয় তার ভাই প্রাণেশ হালদার, স্বপন মিস্ত্রি ওরফে স্বপন মৈত্র, উত্তম মিস্ত্রি ওরফে উত্তম মৈত্র, ইমাম হোসেন ওরফে ইমন হালদার এবং আমানা সুলতানা ওরফে শর্মী হালদারসহ বাকি অভিযুক্তদের।

২০২২ সালের ১১ জুলাই অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে কলকাতার আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেয় ইডি। অর্থপাচার আইন-২০০২ এবং দুর্নীতি দমন আইন-১৯৮৮’র বিভিন্ন ধারায় অভিযোগ গঠন করা হয়। বর্তমানে অভিযুক্ত পিকে হালদারসহ ৫ জন রয়েছেন ভারতের প্রেসিডেন্সি কারাগারে। আর এ মামলার একমাত্র নারী আসামি আমানা সুলতানা রয়েছেন দেশটির আলিপুর কেন্দ্রীয় কারাগারে।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে দুদকের আইনজীবী মো. খোরশেদ আলম খান ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘তার বিরুদ্ধে ভারতের আদালতে একটি মামলার বিচার চলছে। ওই মামলার বিচার শেষ হলে তাকে দেশে ফিরিয়ে আনা যাবে।’

(ঢাকাটাইম/২৭সেপ্টেম্বর/এএ/এফএ)

সংবাদটি শেয়ার করুন

বিশেষ প্রতিবেদন বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন এর সর্বশেষ

কোরবানির ঈদ সামনে, মশলার বাজারে উত্তাপ

প্রতিমন্ত্রীর শ্যালকের অপহরণকাণ্ড: ১৬ দিনেও গ্রেপ্তার হননি আলোচিত লুৎফুল হাবীব

মে দিবস বোঝে না শ্রমিকরা, জানে ‘একদিন কাজ না করলে না খেয়ে থাকতে হবে’

গামছা বিক্রেতা থেকে হাজার কোটি টাকার মালিক, মনে আছে সেই গোল্ডেন মনিরকে?

সোনার ধানের মায়ায় হাওরে নারী শ্রমে কৃষকের স্বস্তি

উপজেলা নির্বাচন নিয়ে কঠোর বার্তা দেবে আ. লীগ 

গরমে অতিষ্ঠ জনজীবন: চাহিদা বেড়েছে তরমুজের, ক্রেতা কম ডাবের

গাছ কাটার অপরাধে মামলা নেই 

কথায় কথায় মানুষ পেটানো এডিসি হারুন কোথায়? থানায় ছাত্রলীগ নেতাদের মারধরের তদন্ত কোথায় আটকে গেল?

মজুত ফুরালেই বাড়তি দামে বিক্রি হবে সয়াবিন তেল

এই বিভাগের সব খবর

শিরোনাম :