কঠিন সময়ে মেয়র খোকনের বর্ণাঢ্য যাত্রা

আলম রায়হান
| আপডেট : ১৫ নভেম্বর ২০২৩, ১১:১০ | প্রকাশিত : ১৪ নভেম্বর ২০২৩, ১৫:০৪

বরিশালের মেয়র হিসেবে আবুল খায়ের আব্দুল্লাহ ওরফে খোকন সেরনিয়াবাত আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু করেছেন আজ মঙ্গলবার, ১৪ নভেম্বর। তাঁর বর্ণাঢ্য যাত্রা হয়েছে কঠিন সময়ে পাহাড় সমান প্রত্যাশা পূরণের চাপ নিয়ে। অনুন্নত এবং নামসর্বস্ব একটি সিটি কর্পোরেশনের প্রধান সমস্যা হচ্ছে অর্থের জোগান। এ সমস্যায় বরিশাল নিমজ্জিত। গত পাঁচ বছর যে সংকট ছিল প্রকট। তবে এদিক থেকে নতুন মেয়র অনেকটা ভাগ্যবান। বলা চলে মেয়র হিসেবে তার সূচনা হয়েছে সোনার চামচ মুখে নিয়ে। মেয়রের মসনদে তার আসীন হওয়ার আগেই জানা গেল, বরিশাল নগরীর জন্য প্রায় ৮শ কোটি টাকার থোক বরাদ্দ দিয়েছেন সদাশয় সরকার।

এদিকে গত পাঁচ বছরে সরকারের পক্ষ থেকে কানাকড়িও বরাদ্দ পাওয়া যায়নি বলে জনশ্রুত আছে। এর ‘কারণ ও উদ্দেশ্য’ অনেক গভীরে বলে মনে করা হয়। যেকোনো অনুন্নত সংস্থার জন্য অর্থের অভাব খুবই নিদারুণ সংকট। এরপরও সদ্য বিদায়ী মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহ নানান কৌশলে নগরবাসীর প্রত্যাশা পূরণের চেষ্টা করেছেন। তিনি আয় থেকে ব্যয় নির্বাহের অসাধ্য সাধন করেছেন। এ ক্ষেত্রে তার সাফল্য কিংবদন্তীসম। আর দুর্নীতিতে নিমজ্জিত বরিশাল সিটি কর্পোরেশনকে গ্রহণযোগ্য মাত্রায় তুলে আনার অসাধ্য সাধন এবং নগরীর দৃশ্যমান কিছু উন্নয়ন টেকসই মাত্রায় করার ক্ষেত্রে অনন্য দৃষ্টাস্ত স্থাপন করে গেছেন সেনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহ। যতটুকু কাজ হয়েছে তার মান নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে তার সমকক্ষ আর কোনো মেয়রকে বিবেচনা করা হয় না বলে মনে করেন অনেকেই। পাশাপাশি নানান কৌশলে নগরীকে নাগরিক বান্ধব হিসেবে প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহ অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। কিন্তু তার আমলে প্রধান সংকট ছিল সরকারের কাছ থেকে বরাদ্দ না পাওয়া। ফলে প্রধানমন্ত্রীর ভাইপুত হিসেবে তিনি তার ক্যারিশমা দেখাতে পারেননি। উল্টো অর্থ সংকটে হাবুডুবু খেতে খেতেই তার কেটেছে পুরো মেয়াদ। ফলে উন্নয়নের ক্ষেত্রে তিনি জনপ্রত্যাশা পূরণ করতে পারেননি। অই এক গান আছে না, ‘নাতি খাতি বেলা গেল, শুতে পারলাম না!’

এদিকে সরকারি বরাদ্দ প্রেক্ষাপটে বিসিসির নতুন মেয়র চাঁদ কপাল নিয়ে গদিনশিন হয়েছেন বলে মনে করা হচ্ছে। এ নিশ্চয়ই আনন্দ সংবাদ। কিন্তু আশঙ্কার দিকও আছে। তা হচ্ছে সরকারি বরাদ্দের বিপুল অঙ্কের অর্থ যথাযথভাবে ব্যবহারের ক্ষেত্রে আবুল খায়ের আবদুল্লাহ কী সফল হবেন? এ ক্ষেত্রে যে দক্ষতার প্রয়োজন তা তার নিজের এবং বরিশাল সিটি কর্পোরেশনের আছে? অনেকের বিবেচনায় এ এক মিলিয়ন ডলার প্রশ্ন!

গত পাঁচ বছরে দেশের সিটি কর্পোরেশনগুলোর উন্নয়নের দিক থেকে মডেল হিসেবে রাজশাহী সিটি কর্পোরেশনকে বিবেচনা করা হয়। কেবল ইট-পাথরের উন্নয়ন নয়, পরিবেশগত উন্নয়নের মডেল হিসেবেও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে রাজশাহী সিটি কর্পোরেশন। ফলে রাজশাহীর তাপমাত্রা কমেছে অন্তত চার ডিগ্রি। এ সিটির মেয়র এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন। ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর কারাগারে শহীদ মোহাম্মদ কামারুজ্জামানের পুত্র তিনি। বরিশাল সিটি কর্পোরেশনের নতুন মেয়র আবুল খায়ের আবদুল্লাহও পঁচাত্তরের থিংকট্যাংকের নীল নকশায় ১৫ আগস্ট শহীদ আবদুর রব সেরনিয়াবাতের পুত্র। এবং তিনি নিজেও গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। প্রাণে বেঁচেছেন ঘটনাচক্রে। শহীদপুত্র হিসেবে খায়রুজ্জামান লিটন এবং আবুল খায়ের আবদুল্লাহ একই কাতারের। কিন্তু পার্থক্য হচ্ছে, একজন ছিলেন রাজনীতিতে এবং অপরজন ছিলেন ব্যবসায়। তাও নিজের নগরী বরিশালে নয়, খুলনায়। যে কারণে ১২ জুন মেয়র নির্বাচনের সুবাধে নগরবাসী আবুল খায়ের আবদুল্লাহকে দৃশ্যত চিনলেও বোধগম্য কারণেই নগরবাসীকে তিনি সেই অর্থে এখনো চেনেন না। অবশ্য চেনার কথাও নয়। বিশেষ করে মেয়র নির্বাচনে মনোনয়ন পাওয়ার পর তার চারদিকে যারা জুটেছেন তাদের মধ্যে বেশ কয়েকজন ‘ঘুঘু স্বভাবের’ ব্যক্তি আছেন। এমিবা প্রবণতার এই মানুষগুলোকে আসলে চেনা কঠিন। ফলে নির্বাচনের সময় কেউ কেউ আবুল খায়ের আবদুল্লাহকে ‘অন্ধের হাতি’ দেখিয়েছেন বলে রটনা আছে। আর ঘটনা হচ্ছে, নির্বাচনি প্রচারণায় অনেক ক্ষেত্রেই আওয়ামী রাজনীতি করা ব্যক্তিদের বাড়ি এড়িয়ে তাকে নেয়া হয়েছে পাশের বাড়িতে।

কারো কারো মতে, নির্বাচনের সময় মিসগাইড করার বিষয়টি আবুল খায়ের আবদুল্লাহর কাছে পরবর্তীতে কমবেশি ধরা পড়েছে। আর দিবালোকের মতো পরিষ্কার হয়েছে তার স্ত্রীর কাছে। এরপরও সমস্যা হচ্ছে, তিনি নিজে প্রচলিত অর্থে রাজনৈতিক প্রবণতার মানুষ নন। ফলে বরিশাল নগরের রাজনীতিতে তিনি হয়তো খুব বেশি অবদান রাখতে পারবেন না। যেমন পারেননি সদর আসনের সংসদ সদস্য ও পানি সম্পদ প্রতিমন্ত্রী কর্নেল (অব.) জাহিদ ফারুক শামীম।

এই বাস্তবতার পরও আবুল খায়ের আবদুল্লাহ হয়তো অন্যরকম সাফল্যের দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারবেন। তা হচ্ছে নগরের উন্নয়ন। কারণ সরকারের তরফ থেকে তার অর্থের অভাব হবে না। যার বড় রকমের আলামত সবার কাছে স্পষ্ট হয়েছে ৯ নভেম্বর। কিন্তু এরপরও প্রশ্ন থেকে যায়। তা হচ্ছে, কতটা দক্ষতার সাথে তিনি এই অর্থ ব্যয় এবং ব্যবহার করতে পারবেন? তিনি কী উন্নয়নের নামে নগরীর খালগুলো হত্যা করে বক্স কালভার্ট নির্মাণ করবেন। যা করেছেন প্রয়াত শওকত হোসেন হিরণ। নগরবাসীর কাছে স্পষ্ট, বরিশাল নগরীর জনভোগান্তির অন্যতম কারণ হচ্ছে, রাস্তা বন্ধ করে মার্কেট এবং খাল পঙ্গু করে মার্কেট নির্মাণ। এর চেয়েও ভয়াবহ হচ্ছে, খাল হত্যা করে বক্স কালভার্ট বানানো। তিনি সড়কের লিপস্টিক উন্নয়ন করার পথে হাঁটবেন কি না তাও এক বড় প্রশ্ন। যে কাজ করার ক্ষেত্রে শীর্ষস্থানীয় নাম আহসান হাবিব কামাল। সবাই জানেন, মেয়র কামালের সময় সংস্কার করা রাস্তা বছর না ঘুরতেই বসন্ত রোগীর চেহারার মতো হতো। নতুন মেয়র কী বিগত দিনের ধারায় হাঁটবেন? এ প্রশ্ন অতি প্রকট!

অতীতের বাস্তবতায় বরিশালের নতুন নগরপিতা আবুল খায়ের আবদুল্লাহকে কেন্দ্র করে অনেক প্রশ্ন সচেতন মহলে ঘুরপাক খাচ্ছে। এসব প্রশ্নের উত্তরের জন্য কিছুদিন অপেক্ষা করতেই হবে। তবে দীর্ঘ সময়ের জন্য নয় নিশ্চয়ই। কারণ একটি প্রবচন আছে, ‘সকালের সূর্যই বলে দেয়, দিনটি কেমন যাবে।’ ইংরেজিতে গালভরা উচ্চারণ, ‘মর্নিং শোজ দ্য ডে। দেখা যাক, নগরপিতা আমাদের কোথায় নিয়ে যান। অথবা তিনি নিজে কোথায় যান! পর্যবেক্ষক মহল মনে করেন, মেয়র হিসেবে তার যাত্রা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। এবং তার সাফল্যের সম্ভাবনা এবং ব্যর্থতার আশঙ্কা মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠের মতো। দুটোর অবস্থানই কাছাকাছি। যা নির্ভর করে আওয়ামী লীগ সরকারের ধারাবাহিকতার ওপর। আগামী মেয়াদেও আওয়ামী লীগ সরকার অব্যাহত থাকলে আবুল খায়ের আবদুল্লাহ হয়তো ঢাকার মেয়র আনিসুল হকের কাছাকাছি সফল হলেও হতে পারেন। অন্যথায় কোথাকার জল কোথায় গিয়ে গড়ায় তা বলা কঠিন।

লেখক: আলম রায়হান, জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :