‘কেফিয়াহ’ এক টুকরো কাপড় থেকে ফিলিস্তিনি প্রতিরোধের প্রতীক হয়ে উঠল যেভাবে

আন্তর্জাতিক ডেস্ক, ঢাকা টাইমস
 | প্রকাশিত : ০৬ ডিসেম্বর ২০২৩, ১৮:১৯

ফিলিস্তিনি স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাসের সঙ্গে গত ৭ অক্টোবর সংঘাত শুরু হওয়ার পর গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলের বোমা হামলার কারণে ফিলিস্তিনে মৃত্যু ও ধ্বংসের অনেক গল্প বেরিয়ে এসেছে। ফিলিস্তিনে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য সারা বিশ্ব জুড়ে চলছে বিক্ষোভ ও মিছিল। আর ফিলিস্তিনি জনগণের পক্ষে এসব মিছিলে বিক্ষোভকারীদের ঐতিহ্যবাহী কেফিয়াহ নামক বিশেষ ধরনের স্কার্ফ পরতে দেখা যায়।

ফিলিস্তিনের প্রতি সমর্থন জানাতে কেউ এই স্কার্ফটি তাদের গলায় জড়ায়, কেউবা মাথায় বাঁধে। এই স্কার্ফ অন্যান্য কাপড়ের চাইতে এতটাই আলাদা যে চাইলে এর থেকে নজর সরানো কঠিন। এ কারণে এই স্কার্ফটির গুরুত্ব সাধারণ সুতির কাপড়ের চাইতে অনেক অনেক বেশি।

বেশিরভাগ ফিলিস্তিনিদের কাছে কেফিয়াহ হল তাদের সংগ্রাম ও প্রতিরোধের প্রতীক। এটি এক ধরনের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক হাতিয়ার যা গত ১০০ বছরে ক্রমশ প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে। এমনকি এই স্কার্ফকে ফিলিস্তিনের "বেসরকারি পতাকাও" বলা হয়।

কিন্তু কেফিয়াহ কোথা থেকে এসেছে? এই বিশেষ স্কার্ফের পেছনের গল্প কী? কখন এটি এতটা প্রতীকী হয়ে উঠল এবং আজ এই স্কার্ফ কতটা গুরুত্বপূর্ণ?

কেফিয়াহর উদ্ভব

এই পোশাকের উৎপত্তি ঠিক কোথায় তা একদম নিশ্চিত করে বলা যাবে না। অনেক ইতিহাসবিদদের মতে, এই স্কার্ফ ব্যবহারের চর্চা শুরু হয়েছিল খ্রিস্টীয় সপ্তম শতাব্দীতে ইরাকের কুফা শহর। সেই শহরের নাম থেকেই স্কার্ফটির নাম হয়ে যায় কেফিয়াহ।

কারও কারও মতে এই স্কার্ফ আরও প্রাচীন আমল থেকে ব্যবহার হয়ে আসছে। সম্ভবত ইসলাম বিস্তার লাভের আগেও কেফিয়াহর অস্তিত্ব ছিল। সত্য যাই হোক না কেন, বাস্তবতা হল সময়ের সাথে সাথে বছরের পর বছর ধরে কেফিয়াহর ব্যবহার বেড়েছে। তবে এর পেছনের কারণ সাংস্কৃতিক বা রাজনৈতিক নয়, বরং বাস্তবিক কারণে এর ব্যবহার বেড়েছে।

বিংশ শতাব্দীর শুরুতে, কৃষক এবং আরব বেদুইনরা (যাযাবর আরব) সূর্যের প্রচণ্ড তাপ, গরম বাতাস, মরুভূমির বালি এবং ঠাণ্ডা থেকে নিজেদের রক্ষা করার জন্য কেফিয়াহ পরিধান করতেন। অবশ্য শহরগুলোয় ফিলিস্তিনিদের এই স্কার্ফ তেমনটা পরতে দেখা যায় নি।

শহুরে মানুষেরা আরও বেশি ‘কেতাদুরস্ত ও মার্জিত’ পোশাক পরতে পছন্দ করতেন। সে সময় শহরে 'ফেজ' নামক লাল রঙের টুপি পরার প্রথা প্রচলিত ছিল, যা কিনা টারবুশ নামেও পরিচিত। এই টুপিটি কিছুটা ঝুড়ির মতো যার মাঝ বরাবর একটি ট্যাসেল ঝোলানো থাকে।

এই টুপিটি মূলত অটোমান সাম্রাজ্যের শাসক দ্বিতীয় মাহমুদের শাসনামলে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। কিন্তু অনেক গবেষণায় দেখা গেছে, ১৯৩০-এর দশকে ফিলিস্তিনি সমাজে কেফিয়ার একটি আলাদা অর্থ হয়। তখন থেকে কেফিয়াহর গুরুত্ব বাড়ার সাথে সাথে এর ব্যবহারও দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে।

১৯৩০-এর দশকে, ফিলিস্তিনি অঞ্চলগুলো ব্রিটিশ শাসনের অধীনে ছিল। অটোমান সাম্রাজ্যের পরাজয়ের পর লিগ অফ নেশনস ফিলিস্তিনসহ মধ্যপ্রাচ্যের বেশিরভাগ অঞ্চলের প্রশাসনিক ক্ষমতা ব্রিটেনকে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। ফিলিস্তিন ১৯২০ থেকে ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত ব্রিটিশ ম্যান্ডেটের অধীনে ছিল। এই সময়কালে, ব্রিটেনের আধিপত্য স্থানীয় ফিলিস্তিনিদের মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি করে। কারণ তাদের ধারণা ছিল যে ব্রিটিশরা ইহুদি রাষ্ট্র গঠনের রাজনৈতিক আন্দোলন জায়নবাদী বা ইহুদিবাদী প্রকল্পকে সমর্থন করছে।

ইউরোপে যখন ইহুদিদের ওপর অত্যাচার বেড়ে যায়, তখন থেকে বিপুল সংখ্যক ইহুদি বসতি স্থাপনকারী ইউরোপ থেকে মধ্যপ্রাচ্যে আসতে শুরু করে। তখন থেকে ওই অঞ্চলে জাতীয়তাবাদী আরবদের বিদ্রোহ শুরু হয়, যা "মহান আরব বিদ্রোহ" নামে পরিচিত।

এই বিদ্রোহ ১৯৩৬ থেকে ১৯৩৯ সাল পর্যন্ত তিন বছর স্থায়ী হয়েছিল এবং এই সময়কালে এই অঞ্চলে ব্যাপক সংঘাত- সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে। ওই সংগ্রামে কেফিয়াহ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

ইতিহাসবিদ জেন টাইনানের সারা বিশ্বে কেফিয়াহর রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক গুরুত্ব নিয়ে গবেষণা করেছেন। তিনি বলেন, ‘ফিলিস্তিনিরা ব্রিটিশদের উপস্থিতির কারণে খুব হতাশ হয়ে পড়ছিল। তখন কারা কারা প্রতিরোধ করছিল তাদের চিহ্নিত করা সম্ভব ছিল না। এতে বিদ্রোহীদের পক্ষে চলাফেরা করা ও তাদের কার্যকলাপ চালানো সহজ হয়ে যায়। তখন থেকে কেফিয়াহ বেশ প্রয়োজনীয় হয়ে ওঠে। এবং এই স্কার্ফটি ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষকে বিভ্রান্ত করার কৌশলের অংশ হয়ে ওঠে।’

১৯৩৮ সালে, বিদ্রোহী নেতারা শহরে বসবাসকারী সমস্ত আরবদের কেফিয়াহ পরিধান করার নির্দেশ দেন। বলা হয় যে ব্রিটিশরা পরে এই স্কার্ফটি নিয়ে এতটাই বিচলিত হয়েছিল যে তারা কেফিয়াহ নিষিদ্ধ করার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু তারা তাতে সফল হয়নি।

আ সোশিও পলিটিকাল হিস্ট্রি অফ কেফিয়াহর লেখক অনু লিঙ্গালার মতে, কেফিয়াহ একটি কার্যকর সামরিক কৌশলের অংশ ছিল, কিন্তু এটি ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ প্রদর্শনের প্রতীকও হয়ে ওঠে। তার মতে, ‘তিনি বলেছেন যে ১৯৩৮ সালে এই স্কার্ফটি ফিলিস্তিনি সংস্কৃতিতে গুরুত্ব পেয়েছে। একে ফিলিস্তিনি সংস্কৃতির একটি টার্নিং পয়েন্ট হিসাবেও বিবেচনা করা হয়।’

"কারণ তাদের নিজেদের মধ্যে ভেদাভেদ থাকলেও নতুন বসতি স্থাপনের বিরুদ্ধে জাতীয়তাবাদী অভিযানে তারা সব পার্থক্য ভুলে ঐক্য প্রতিষ্ঠা করেছে।”

জেন টাইনানের মতে, সেই সময় থেকে কেফিয়াহ ফিলিস্তিনিদের অধিকার, আত্মনিয়ন্ত্রণ, ন্যায়বিচার, ঐক্য এবং সংহতির একটি দৃশ্যমান প্রতীক হয়ে ওঠে।

কেফিয়াহ কী?

প্রকৃতপক্ষে, কেফিয়াহ বিভিন্ন রঙ এবং ডিজাইনের হয়। এরমধ্যে সাদা-কালো কেফিয়াহ ফিলিস্তিনিদের মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয়। এর তিনটি বৈশিষ্ট্য রয়েছে। সেগুলো হল: জলপাই পাতা, লাল রং ও কালো রেখা।

জলপাই পাতা হল এই এলাকার জলপাই গাছের প্রতীক এবং এই পাতা তাদের জমির সাথে শহরের সংযোগকে প্রতিনিধিত্ব করে। লাল রঙ ফিলিস্তিনি জেলেদের এবং ভূমধ্যসাগরের সাথে তাদের সংযোগকে প্রতিনিধিত্ব করে। আর কালো রেখা ফিলিস্তিনের প্রতিবেশী অংশীদারদের সাথে ঐতিহ্যবাহী বাণিজ্য পথের যোগাযোগকে প্রতিনিধিত্ব করে।

প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশনের সভাপতি এবং পরে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের প্রেসিডেন্ট ইয়াসির আরাফাতকে কেফিয়াহ ছাড়া খুব কমই দেখা যেত।

কেফিয়াহ কীভাবে বৈশ্বিকভাবে জনপ্রিয় হয়ে উঠল? ১৯৩০ সালের বিদ্রোহের পর, কেফিয়াহ ফিলিস্তিনি জাতি পরিচয়ের একটি অপরিহার্য এবং অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে ওঠে।

ইতিহাসবিদদের মতে, এই আন্দোলন 'নাকবা' অর্থাৎ ‘মহা বিপর্যয়’-এর পরে গতি লাভ করে। ওই সংঘাতের ফলে লাখ লাখ ফিলিস্তিনিকে জোরপূর্বক উচ্ছেদ করা হয়। সংঘাত থেকে পালাতে গিয়ে অসংখ্য মানুষ বাড়িঘর ছেড়ে বাস্তুচ্যুত হয়ে পড়ে। এর ফলশ্রুতিতে ১৯৪৮ সালের ১৪ই মে গঠিত হয় ইসরায়েল।

'নাকবা'কে ফিলিস্তিনের ইতিহাসে সবচেয়ে দুঃখজনক দিন বলে বিবেচনা করা হয়। কিন্তু কেফিয়াহ ১৯৬০ সাল পর্যন্ত বৈশ্বিকভাবে তেমন একটা পরিচিত হয়ে ওঠেনি।

বৈশ্বিক স্তরে, কেফিয়াহ ব্যাপকভাবে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে ইয়াসির আরাফাতের কারণে। যিনি নিজেই ফিলিস্তিনি প্রতিরোধের মুখ হয়ে উঠেছিলেন। কেফিয়াহ ছাড়া ইয়াসির আরাফাতের ছবি খুব কমই দেখা যায়। সিরিয়া, জর্ডান ও লেবাননে যুদ্ধ করার সময় তিনি এটি পরেছিলেন।

১৯৭৪ সালে যখন তিনি জাতিসংঘে ফিলিস্তিনিদের অধিকারের পক্ষে বক্তৃতা দিয়েছিলেন, সে সময় তিনি কেফিয়াহ পরেছিলেন। ২০ বছর পর যখন তাকে অসলোতে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়, তখনও তাকে এই স্কার্ফ পরা অবস্থায় দেখা যায়।

জেন টাইনানের মতে, যেকোনো রাজনৈতিক বিবৃতি দেওয়ার সময় তিনি কেফিয়াহ পরতেন। তিনি তার ডান কাঁধে এই স্কার্ফটি ত্রিভুজাকার আকৃতিতে বিশেষভাবে ভাজ করতেন যা ১৯৪৮ সালের আগের ফিলিস্তিনের মানচিত্রের মতো মনে হতো।

বর্তমানে গাজা উপত্যকায় চলমান যুদ্ধের কারণে সাম্প্রতিক সময়ে এর তাৎপর্য আবারও প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে।ফিলিস্তিনি প্রতিরোধের প্রতীক হিসেবে কেফিয়াহও গুরুত্ব বেশ তাৎপর্যপূর্ণ এবং ফিলিস্তিনের সমর্থকরা নীরবে বা জোরালোভাবে তাদের সংহতি প্রকাশে কেফিয়াহ পরিধান করে।

প্রসঙ্গত, এই স্কার্ফটি নানা সময়ে বিতর্কের মুখেও পড়েছিল। যার কারণে বিশ্বের কিছু দেশে কেফিয়াহ নিষিদ্ধ করা হয়। যেমন জার্মানির রাজধানী বার্লিনের কিছু স্কুলে কেফিয়াহ পরা নিষিদ্ধ ছিল। সূত্র: বিবিসি

(ঢাকাটাইমস/০৬ডিসেম্বর/এমআর)

সংবাদটি শেয়ার করুন

আন্তর্জাতিক বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :