বীরত্বগাথা

ধর্ম বিবেচনা করে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করিনি

তানিয়া আক্তার, ঢাকা টাইমস
| আপডেট : ১৬ ডিসেম্বর ২০২৩, ১৫:০৫ | প্রকাশিত : ১৬ ডিসেম্বর ২০২৩, ১৪:২২

বীর মুক্তিযোদ্ধা প্রসেনজিৎ তালুকদার- পার্বত্য চট্টগ্রামের বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের এই সাহসী মানুষটি ছাত্রাবস্থায় দেশমাতৃকার জন্য জীবন উৎসর্গ করার প্রত্যয় নিয়েছিলেন। বাংলার ভূমিজ সন্তান হিসেবে মুক্তি সংগ্রামে অংশগ্রহণের জন্য পরিবারের মায়া ত্যাগ করে পালিয়ে গিয়েছিলেন ভারতে। প্রশিক্ষণ শেষে দেশে ফিরে অস্ত্র হাতে লড়াই করেছেন। ঢাকা টাইমস তার কাছ থেকে জেনেছে যুদ্ধ দিনের লড়াই শেষে সেই বিজয়ের কথা-

‘আমার জন্ম ১৯৫৩ সালে। বাবা পাকিস্তান আর্মিতে ছিলেন। তাই জন্মের পরই বাবার কর্মসূত্রে পাকিস্তানের রাওয়ালপিন্ডি চলে যেতে হয়েছিল। সেখানে ছিলাম সাত বছর। পরে চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া উপজেলার সৈয়দবাড়ি গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষাজীবন শুরু। মাধ্যমিকে পড়ার সময় পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হই। ১৯৬৯ থেকে ’৭০ সালের নির্বাচন পর্যন্ত ঘটে যাওয়া গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা সম্পর্কে জানাশোনার পাশাপাশি সক্রিয় অংশগ্রহণের সুযোগও হয়েছিল।

এই রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট থেকে অনুপ্রেরণা পেয়েছিলাম। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চে বঙ্গবন্ধুর ভাষণের পর স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণের জন্য প্রস্তুতি নিতে শুরু করলাম। ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানিদের নিধনযজ্ঞ শুরুর পর মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে গেলে ক্লাস, পরীক্ষা বন্ধ হয়ে গেল। যারা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল তাদের খাবার সংগ্রহ করে পাঠাতে লাগলাম। যুদ্ধ চলাকালিন জুন-জুলাইয়ের দিকে প্রশিক্ষণ নেওয়ার জন্য তৈরি হই।

বাবা তখনও পাকিস্তানে ছিলেন। মা ও বোনের সঙ্গে ছিলাম আমি।

যুদ্ধের প্রশিক্ষণের জন্য ভারতে যাওয়ার বিষয়টি কাউকে জানাইনি। অস্ত্র প্রশিক্ষণ নিতে ভারতে যাওয়ার উদ্দেশ্যে এখনকার তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদের গ্রামে ফরেস্ট অফিসে জড়ো হচ্ছিল। বাড়ি থেকে পালানোর জন্য ফাঁক-ফোকর খুঁজছিলাম। এটা পরিবারের লোকজন বুঝে গিয়েছিল। তাই যাতে কোনোভাবেই পালিয়ে না যেতে পারি দাদিমা, মা ও বোন তখন গোপনে পাহাড়া দিত। এই পাহাড়ার মধ্যেও আগস্টের এক দুপুরে অল্প গুড়-চিড়া-মুড়ি, দাদিমার বাক্স ভেঙে ৩০ টাকা আর একটা হাতঘড়ি নিয়ে পালিয়ে গেলাম।

প্রায় দশদিন পাহাড়ি পথে হাঁটার পর ভারতে পৌঁছলাম। সেখানে শরণার্থী শিবিরে খেয়ে না খেয়ে কখনও আধ পেটে থেকে দিনাতিপাত করছিলাম। তারপর একদিন শুনলাম রিক্রুটিং সেন্টারে গেলাম। সেখানে ফিজিক্যাল ফিটনেস টেস্টে উত্তীর্ণ হওয়া অর্ধশতাধিক লোকের ক্যাম্পে তোলা হল। ক্যাম্পে প্রতিদিন ট্রেনিং নিতে থাকলাম। তারপর আগরতলার হরিনা ক্যাম্পে ১৫ থেকে ২০ দিনের মতো ফায়ারিং ট্রেনিংসহ নানা ধরণের ফাইনাল ট্রেনিং দেওয়া হল। অক্টোবরে দেশে ফিরে এলাম।

আমাকে দলনেতা হিসেবে সেলফ লোডিং রাইফেল এবং অন্যদের থ্রি নট থ্রি রাইফেল, লাইট মেশিনগান, ৫টি গ্রেনেডসহ কিছু বুলেট দেয়া হল। ভারত থেকে আমাদের যিনি আনতে গিয়েছিলেন তিনি বাংলাদেশ পুলিশের প্রাক্তন মহাপরিদর্শক খোদা বকশ চৌধুরী। তার সঙ্গে হেঁটে নিজের এলাকা রাঙ্গুনিয়ায় প্রবেশ করলাম।

ভারতে প্রশিক্ষণ নেয়ার সময় একবার জ্বরে আক্রান্ত হয়েছিলাম। এক সকালে আগরতলা যাওয়ার পথে গাড়ি স্টার্ট নিতে দেরি হচ্ছিল। তখন আমার বন্ধু প্রমোদ বড়ুয়ার সঙ্গে একটি দোকানে গিয়েছিলাম। সেখান থেকে পাউরুটি আর কলা নিলাম। একজন সত্তরোর্ধ্ব বৃদ্ধা ছিলেন সেই দোকানের দোকানি। যখন টাকা দিতে গেলাম তিনি টাকা নিতে চাননি। মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য এই যে তার ত্যাগ তা আমাকে বেশ মুগ্ধ করেছিল।

বাংলাদেশে ফিরে বর্তমানে চট্টগ্রাম ও রাঙামাটি রোডের পাশে এক হিন্দু জমিদার বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলাম। তারা জীবনবাজি রেখে অর্ধশতাধিক মানুষের প্রতিবেলা খাবার রান্না করাসহ সামগ্রিক আপ্যায়ন করেছিলেন। সেখানে আমাদের অভ্যর্থনা জানিয়েছিলেন নুরুল আলম। যিনি বঙ্গবন্ধুর লাশ দাফনের সময় সহায়তা করেছিলেন। আমাদের কমান্ডার এবং সাব কমান্ডার ছিলেন খোদা বকশ চৌধুরী। প্রথম দিকে ব্রিজ উড়িয়ে দেওয়া, চট্টগ্রাম থেকে রাঙামাটি যাওয়ার পথে পাকিস্তানি সেনাদের বাধা দেওয়াসহ নানান ধরণের বিষয়ে যুক্ত হয়েছিলাম।

তখন কর্ণফুলী পেপার মিলে কাগজ উৎপাদন হতো। কার্গো জাহাজে কাগজ নেয়া হতো। সেখানে পাকিস্তানিরা পাহাড়া দিত। দক্ষিণ রাঙ্গুনিয়ায় একটা ক্যাম্প ছিল আমাদের। তখন সালেহ আহমেদ আমাদের কমান্ডার ছিলেন। তিনিসহ কর্ণফুলীর দক্ষিণ পাড়ে একটা ফরেস্ট ক্যাম্প ছিল।

নভেম্বরের শেষ দিকে সেই জঙ্গলঘেরা পাহাড় থেকে গুলিবর্ষণ করতাম। কয়েকটি খন্ডযুদ্ধ হয়েছিল সেখানে।

কাপ্তাই জলবিদ্যুৎকেন্দ্রে বড় বড় বিদ্যুৎ টাওয়ার ছিল। সেই টাউয়ারগুলো থেকে পাকিস্তানি সেনারা বিদ্যুতের সুবিধা ভোগ করতো। তাই নভেম্বরের প্রথম দিকে বিদ্যুৎ সঞ্চালন নষ্ট করার পরিকল্পনা করলাম।

চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ার বিখ্যাত গুমাই বিলের মাঝখানে একটি বিদ্যুৎ টাওয়ার ফেলে দিতে সক্ষম হয়েছিলাম। এতে, বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল। সেই কাজটি অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। সেদিন ধনাঢ্য বড়ুয়া, সুজন বড়ৃয়া, সজল ও আমির হোসেনসহ অন্য সহযোদ্ধারা আমার সঙ্গে ছিলেন। একদল এক্সক্লুসিভ নিয়ে গিয়েছিল। কেউ পাহারা দিচ্ছিল। আমার দায়িত্ব ছিল এক্সক্লুসিভের তারে আগুন লাগানো। আমি অনেক দূরে গিয়ে দিয়াশলাই দিয়ে তারে আগুন লাগিয়ে দিই। এতে করে বৈদ্যুতিক খুঁটিটা খোদাই বিলে পড়ে গিয়ে বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল।

এছাড়া, কাপ্তাই উপজেলা থেকে রাঙামাটিতে যাওয়ার পথে একটা সংযোগ ব্রিজ ছিল। পাকিস্তানি সেনাদের যাতায়াত পথ ছিল সেই ব্রিজ। সেটি আমরা উড়িয়ে দিয়েছিলাম।

দেখতে দেখতে ডিসেম্বর মাস চলে এলো। রাঙ্গুনিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ে যেখানে পাকিস্তানি সেনারা বড় ঘাঁটি গড়েছিল, সেখানে আক্রমণের জন্য আমাদের চূড়ান্ত প্রস্তুতি নিয়েছিলাম।

ডিসেম্বরের ১০ বা ১১ তারিখের দিকে কমান্ডারের নির্দেশে আক্রমণের জন্য উত্তর রাঙ্গুনিয়ার একটি উচ্চ বিদ্যালয়ে রকেট লাঞ্চার বসিয়েছিলাম। কিছুদিন পর ১৬ ডিসেম্বর জানতে পারলাম, পাকিস্তানি সেনারা আত্নসমর্পণ করেছে। পরের দিন আমাদের দল রাঙ্গুনিয়া থানায় ফিরে অর্ধশতাধিক পাকিস্তানি দোসরদের খুঁজে বের করে পাহাড়ে নিয়ে গুলি করে মেরে ফেললাম।

মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রামে বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের অংশগ্রহণ চোখে পড়ার মতো বিষয় ছিল। কারণ চট্টগ্রাম অঞ্চলে বাঙালি মুসলিমের চেয়ে বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারী যুবকরা বেশি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল। আমরা সবাই বাঙালি। মাতৃভূমির জন্য লড়াই করাই ছিল একমাত্র পণ। তাই কে কোন ধর্মের অনুসারী তা বিবেচনা করিনি।

(ঢাকাটাইমস/১৬ডিসেম্বর/টিএ/বিবি)

সংবাদটি শেয়ার করুন

জাতীয় বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

জাতীয় এর সর্বশেষ

টাইম ম্যাগাজিনের ১০০ প্রভাবশালীর তালিকায় সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক

সব অনিবন্ধিত অনলাইন নিউজ পোর্টাল বন্ধ হবে: তথ্য প্রতিমন্ত্রী

সব বাধা অতিক্রম করে জনগণের জন্য কাজ করে যাচ্ছি: প্রধানমন্ত্রী

দেশে ১৩ শতাংশ মানুষ চোখের গ্লুকোমা সমস্যায় ভুগছে

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে আইওএমের কার্যকর ভূমিকা চায় বাংলাদেশ

সুন্দরবনের আগুন পুরোপুরি নিভেছে: পরিবেশ মন্ত্রণালয়

জাহাজে হজযাত্রী পরিবহনের বিষয়টি ‘ইনকারেজ’ করছে না সৌদি: ধর্মমন্ত্রী

জিসিসির সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের নবদিগন্ত উন্মোচন

আইএমএফের ঋণের তৃতীয় কিস্তি নিয়ে আশাবাদী সরকার

জনগণকে নিরপেক্ষভাবে সেবা দিতে পুলিশ সদস্যদের নির্দেশ আইজিপির

এই বিভাগের সব খবর

শিরোনাম :