সড়কে মৃত্যুর মিছিল: প্রয়োজন সর্বাত্মক সতর্কতা

আলী রেজা
| আপডেট : ২৭ জানুয়ারি ২০২৪, ১৩:০৯ | প্রকাশিত : ২৭ জানুয়ারি ২০২৪, ১৩:০২

প্রতিদিন সারা দেশে সড়ক দুর্ঘটনার কবলে পড়ে মারা যাচ্ছে মানুষ। এদের সংখ্যা কম নয়। অনেকে গুরুতর আহত হচ্ছে। আহতদের সংখ্যা আরো বেশি। একজন সুস্থ-সবল লোক সড়ক দুর্ঘটনার শিকার হয়ে মুহূর্তেই পঙ্গু হয়ে যাচ্ছে। এদের অনেকেই আর স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারছে না। পঙ্গুত্ব বরণ করে নিতে হচ্ছে সারা জীবনের জন্য। সড়ক দুর্ঘটনা রোধে নানা সচেতনতামূলক প্রচার-প্রচারণা ও সরকারের পক্ষ থেকে নেওয়া বিভিন্ন পদক্ষেপ তেমন কোনো কাজেই আসছে না। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহণ কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) প্রণীত আইন ও নীতিমালা, নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা) আন্দোলনের সচেতনতামূলক নানা কর্মসূচি ও পরিবহণ সংশ্লিষ্টদের সাবধানতা সত্ত্বেও সড়ক দুর্ঘটনার সংখ্যা বেড়েই চলছে। ‘টঙ্গীতে ট্রাকচাপায় পোশাক শ্রমিকের মৃত্যু, ঝিনাইদহে কাজে যাওয়ার পথে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ২, ময়মনসিংহে ট্রাক-পিকআপের মুখোমুখি সংঘর্ষে নিহত ৩, ট্রাকের নিচে চাপা পড়ে প্রাণ গেল ২ মোটরসাইকেল আরোহীর, মুক্তাগাছায় ট্রাকচাপায় মা-মেয়েসহ নিহত ৪, কুড়িগ্রামে নসিমনের সঙ্গে মোটরসাইকেলের ধাক্কায় বাবা-ছেলে নিহত, রাস্তা পার হতে গিয়ে প্রাণ গেল দুই পথচারীর’- সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ হওয়া এগুলো আমাদের চিরচেনা সড়ক দুর্ঘটনার খবর। যারা নিয়মিত সংবাদপত্র পড়েন কিংবা টিভি সেটের সামনে বসেন তাদের কাছে এ ধরনের খবর নতুন নয়। সংবাদপত্র হাতে নিলে কিংবা টেলিভিশন সেটের সামনে বসলে সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে এ রকম খবরের শিরোনাম চোখে পড়বেই। বিআরটিএ সূত্রে জানা গেছে ২০২৩ সালে সংঘটিত ৫ হাজার ৪৯৫টি সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছে ৫ হাজার ২৪ জন ও আহত হয়েছে ৭ হাজার ৪৯৫ জন। এ বছরের শুরু থেকেই প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে যে হারে সড়ক দুর্ঘটনার খবর আসছে তাতে দুর্ঘটনা কমিয়ে আনা সম্ভব হবে বলে মনে হচ্ছে না। তবে যেকোনো উপায়েই হোক- সড়ক দুর্ঘটনা কমিয়ে আনা জরুরি।

বর্তমানে দেশের সড়ক পরিস্থিতির যথেষ্ট উন্নতি হয়েছে। বেশিরভাগ মহাসড়ক চার লেনে উন্নীত হয়েছে। আন্তঃজেলা সংযোগ সড়কগুলোর অবস্থা আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে অনেক ভালো। সারা দেশে অসংখ্য বাইপাস ও আন্ডারপাস নির্মাণ করা হয়েছে। ঝুঁকিপূর্ণ মোড়গুলো সংস্কার করে অনেকটা সোজা করা হয়েছে। অধিক যানবাহন চলাচলের রাস্তাগুলোর মাঝখানে স্থায়ী কিংবা অস্থায়ী ডিভাইডার তৈরি করা হয়েছে। ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে গতি নিয়ন্ত্রণের জন্য সড়ক ও জনপথ বিভাগ প্রয়োজনীয় গতিনিয়ন্ত্রক সাইনবোর্ড ব্যবহার করেছে। এই সবকিছুই আগের তুলনায় এখন অনেক উন্নত ও দৃশ্যমান করা হয়েছে। সন্দেহ নেই, নিরাপদ যান চলাচল ও দুর্ঘটনা রোধ করার লক্ষ্যেই এসব উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। তবুও সড়ক দুর্ঘটনা কমিয়ে আনা সম্ভব হচ্ছে না। এ বিষয়ে অধিক কার্যকর আরও কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করা যায় কি না- সড়ক সংশ্লিষ্টদের তা ভেবে দেখতে হবে।

শীতকালে সড়ক দুর্ঘটনা বেড়ে যাওয়ার একটি কারণ হলো ঘন কুয়াশা। অনেক সময় ঘন কুয়াশায় ঠিক মতো রাস্তা দেখা যায় না। গাড়ির হেড লাইটের আলো অস্পষ্ট হয়ে যায়। প্রচণ্ড শীতে কখনো কখনো চালকের শারীরিক ও মানসিক অবসাদ অবস্থার তাৎক্ষণিক পরিবর্তন হয়ে যাওয়াটাও অসম্ভব কিছু নয়। কিছুদিন যাবৎ প্রচণ্ড শীত ও ঘন কুয়াশার ফলে যে সব দুর্ঘটনা ঘটছে সেগুলোর মধ্যে মুখোমুখি সংঘর্ষের ঘটনাই বেশি। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এই মুখোমুখি সংঘর্ষ ঘটছে বাসের সঙ্গে ট্রাকের কিংবা বাস ও ট্রাকের সঙ্গে লেগুনা, সিএনজি, অটোবাইক, নসিমন-করিমন জাতীয় ধীরগতির যানবাহনের। বাংলাদেশে এখনো অনেক মহাসড়কে দ্রুতগতির যানবাহন ও ধীরগতির যানবাহনকে একই লেনে চলতে দেখা যায়। মোটর-সাইকেল বেপরোয়াভাবে সব লেন ধরেই চলাচল করে। এ কারণে একদিকে মহাসড়কের শৃঙ্খলা নষ্ট হয় অন্যদিকে দুর্ঘটনা বেড়ে যায়। সব যানবাহনকেই নিজ নিজ লেন ধরে চলার আইনগত বাধ্যবাধকতা রয়েছে। কিন্তু চালকরা অনেকেই সে আইন মানছেন না। দ্রুত গন্তব্যে পৌঁছার জন্য সুযোগ বুঝে অন্য লেনে চলে যাচ্ছেন এবং ঝুঁকি নিয়ে ওভারটেকিং করছেন। সড়কে শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত ট্রাফিক বিভাগকেও এ বিষয়ে খুব একটা তৎপর থাকতে দেখা যায় না। এতে চালকরা প্রায়ই বেপরোয়া আচরণ করে। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেতেই হবে। সড়কে মৃত্যুর মিছিল কারো কাম্য হতে পারে না।

এ কথা স্বীকার করে নেওয়া যায় যে, চালকদের যথাযথ প্রশিক্ষণ ও আইন মেনে চলার প্রবণতা তৈরি হলে সড়ক দুর্ঘটনা কমিয়ে আনা সম্ভব। এর জন্য কঠোরভাবে বিদ্যমান আইনের প্রয়োগ ঘটাতে হবে এবং প্রয়োজন হলে নতুন আইন তৈরি করতে হবে। আইন অমান্যকারী চালকদের লাইসেন্স বাতিল এবং লাইসেন্সবিহীন চালকদের শাস্তির আওতায় আনতে হবে। লাইসেন্সবিহীন চালকদের নিয়োগকারী মালিককেও জবাবদিহিতার আওতায় আনা জরুরি। যানবাহন চলাচলে শৃঙ্খলা রক্ষার বিষয়টি দেখভাল করার দায়িত্বে নিয়োজিত ট্রাফিক পুলিশ তাদের দায়িত্ব সততার সঙ্গে পালন করছেন কি না- সেটাও একটি প্রশ্ন। পরিবহণ সংশ্লিষ্টরা সব সময় বলে থাকেন- টাকা খাওয়ার জন্য ট্রাফিক পুলিশ গাড়ি থামায়। অনেক সময় তাদের টাকা লেনদেনের বিষয়টি চোখেও পড়ে। পুলিশকে টাকা দিয়ে যদি ফিটনেসবিহীন গাড়ি ও লাইসেন্সবিহীন ড্রাইভার রাস্তায় যাত্রী নিয়ে চলাচলের সুযোগ পায় তাহলে সেটা অত্যন্ত দুঃখজনক বিষয়। এ ব্যাপারে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কঠোর নজরদারি প্রয়োজন। সড়ক দুর্ঘটনা রোধ একটি সমন্বিত বিষয়। এ বিষয়ে সরকার, পরিবহণ মালিক, পরিবহণ শ্রমিক, যাত্রী ও পথচারী- সকল পক্ষের সচেতনতা প্রয়োজন।

গণপরিবহণে চলাচলের ক্ষেত্রে যাত্রীদেরও কিছু আচরণবিধি মেনে চলতে হয়। চলন্ত অবস্থায় চালকের সঙ্গে কথা না বলার নির্দেশনা থাকলেও অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, এক শ্রেণির যাত্রী সে নির্দেশনাকে থোরাই কেয়ার করেন। অনবরত অশালীন ভাষায় গতি বাড়ানোর কথা বলতে থাকেন। চালকের অদক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। অন্য কোনো গাড়ি ওভারটেক করে গেলে চালককে ওভারটেক করতে প্ররোচিত করেন। এতে চালকের মনোযোগ নষ্ট হয় এবং চালক বেপরোয়া ওঠে। এ অবস্থায় কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে সংশ্লিষ্ট যাত্রীও তার দায় এড়াতে পারেন না। এ কথা অস্বীকার করা যায় না যে, যাত্রীদের সঙ্গে গাড়ির চালক ও অন্য স্টাফদের আচরণ যত ইতিবাচক হবে গাড়িটি তত নিরাপদে গন্তব্যে পৌঁছবে।

একটি দুর্ঘটনা সারা জীবনের কান্না- এটা শুধু স্লোগান বা কথার কথা নয়। যে পরিবারের একমাত্র কর্মক্ষম মানুষটি সড়ক দুর্ঘটনার শিকার হয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন কিংবা পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন সে পরিবার আর কখনো পূর্বের অবস্থায় ফিরে যেতে পারে না। আজকাল অনেক সড়ক দুর্ঘটনায় দেখা যায় একই পরিবারের একাধিক সদস্য কিংবা প্রায় সব সদস্য মারা যাচ্ছে। এ অবস্থায় পরিবারটিই বিলুপ্ত হয়ে যায়। শিল্পায়ন ও নগরায়ণের এই যুগে জীবিকার তাগিদে বেশিরভাগ মানুষ স্থায়ী ঠিকানায় বসবাস করতে পারেন না। কর্মসংস্থানের জন্য দেশে-বিদেশে ছুটে বেড়াতে হয়। অনেকেরই কর্মস্থল থেকে বাসস্থানে নিয়মিত যাতায়াত করতে হয়। পায়ে হেঁটে যাতায়াতের যুগ এখন আর নেই। এখন চলাচল মানেই যানবাহনে চলাচল। দুর্ঘটনার ঝুঁকি নিয়েই সবাইকে পথ চলতে হয়। ফলে সড়ক দুর্ঘটনা রোধে সর্বোচ্চ সতর্কতা ও প্রয়োজনীয় সকল পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। এ ব্যাপারে আইনের প্রয়োগ যেমন কঠোর হওয়া দরকার তেমনি জনসচেতনতাও বাড়াতে হবে।

সড়ক দুর্ঘটনা কমিয়ে আনার জন্য দ্রুতগতির ও ধীরগতির যানবাহনের আলাদা লেনে চলা নিশ্চিত করতে হবে। সিএনজি, অটোবাইক ও মোটরসাইকেল নির্ধারিত লেনে চলছে কি না- সে বিষয়টি কঠোর নজরদারিতে রাখা প্রয়োজন। এ ব্যাপারে ট্রাফিক পুলিশের সঙ্গে হাইওয়ে পুলিশ দায়িত্ব পালন করতে পারে। হাইওয়েতে নিষিদ্ধ ঘোষিত নসিমন-করিমন-ভটভটি জাতীয় যানবাহন যাতে কোনোভাবেই চলতে না পারে সে ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরি। প্রায়ই দেখা যায়, আইন অমান্য করার দায়ে মোটরসাইকেল আটক করা হয়। শুধু মোটরসাইকেল নয়, আইন অমান্যকারী যেকোনো যানবাহন নিকটবর্তী থানায় আটক করা প্রয়োজন। যাত্রীদের সঙ্গে পরিবহণ শ্রমিকদের আচরণগত দিকটি আইন করে সংশোধন করা সম্ভব না হলেও একটি আচরণবিধি জারি করা যেতে পারে। চলন্ত অবস্থায় চালকের সঙ্গে কথা বলার বিষয়টি নিয়ন্ত্রণ করার জন্য চালকের আসনটি এমনভাবে ঘেরাও থাকা দরকার যাতে চালক কোনো যাত্রীর দৃষ্টিগোচর না হয়।

সড়ক দুর্ঘটনা রোধে পথচারীদের সতর্কতা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। রাস্তা পারাপারের সময় বেশিরভাগ সাধারণ মানুষ দুর্ঘটনার শিকার হন। প্রায়ই দেখা যায়, একটু দূরত্বের কারণে কিংবা একটু কষ্ট হবে বলে অনেকে ফুটওভার ব্রিজ ব্যবহার করেন না। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যানবাহনের ফাঁক-ফোকর দিয়ে রাস্তা পার হয়ে যান। সিগনালে গাড়ি থামা পর্যন্তও অপেক্ষা করেন না। যারা সড়কের পাশ দিয়ে চলাচল করেন তাদের ক্ষেত্রেও সাবধানতা অবলম্বন করতে দেখা যায় না। অনেকে ফুটপাত ব্যবহার না করে মূল রাস্তা ধরে চলেন। এতে দুই ধরনের দুর্ঘটনা ঘটে। কখনো পথচারীকে বাঁচাতে গিয়ে যানবাহনটিই দুর্ঘটনায় পতিত হয়। আবার কখনো যান ও যাত্রীদের বাঁচাতে গিয়ে পথচারীদের বাঁচানো সম্ভব হয় না। উন্নত বিশ্বের বড়ো বড়ো শহরে দেখা যায় পথচারী পারাপারের জন্য সড়কে বিশেষ স্থান নির্দেশ করা থাকে। পথচারীরা কেউ নির্দিষ্ট স্থান ব্যতীত অন্যস্থান দিয়ে রাস্তা পার হন না। চালক নির্দিষ্ট স্থানে গিয়ে আগে পথচারী পারাপারের সুযোগ দেন। হাত তুলে চলন্ত গাড়ির সামনে দিয়ে রাস্তা পারাপারের কথা তারা চিন্তাও করতে পারেন না। আমাদের শহরগুলোতে এ ধরনের সংষ্কৃতি গড়ে তোলা দরকার। এ ব্যাপারে চালক, যাত্রী ও পথচারী- সবাইকে সংযত হতে হবে।

আলী রেজা: কলেজ শিক্ষক, লেখক ও পিএইচডি গবেষক,ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ স্টাডিজ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :