ভাষার অর্থনীতি, ভাষার বিকাশ

ফকির ইলিয়াস
 | প্রকাশিত : ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০২:৫৮

ভাষা যখন জীবিকার কাজে লাগে, তা তখন অধিক প্রয়োজনীয় হয়ে ওঠে। বাংলা ভাষা নিয়ে প্রজন্মের প্রত্যয় দেশে দেশে বাড়ছে। বাংলা ভাষা নিয়ে আমাদের গর্বের পরিধি বাড়ছে। বাড়ছে এ জন্যে, এই ভাষা দেশে-বিদেশে এখন আমাদের জীবিকার বাহন হিসেবে কাজে লাগতে শুরু করেছে।

একটি ভাষা সেই জাতির অন্যতম শক্তি। ভাব বিনিময়ই শুধু নয়, প্রজন্ম বেড়ে উঠে সেই ভাষার আধিপত্যে তার মাতৃ-পিতৃ ছায়ায়। সেই ভাষায় সে জেনে যায় তার ইতিহাস। একটি ভাষা যেকোনো জাতির কাছেই সমাদৃত। সে ভাষার জনগোষ্ঠী যত বড়ো কিংবা যত ছোটোই হোক। যুক্তরাষ্ট্রের একজন বিশিষ্ট ভাষাবিজ্ঞানী ড. জেভিন বেকন বলেন, একটি ভাষা হচ্ছে একটি জাতির মুখ্যশক্তি। ভাষা মানুষের প্রথম এবং শেষ আশ্রয়। কারণ জন্ম নিয়েই সে নিজ মায়ের ভাষায়, মায়ের আদর স্নেহ পায়। আবার মৃত্যুর সময় নিজ মাতৃভাষায়ই শেষ আরাধনাটুকু করে যায়।

আজকের বিশ্বে সে ভাষাই তত বেশি শক্তিশালী, যে ভাষার যে রাষ্ট্রের অর্থনীতি যত বেশি চাঙা­ তা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। তার কারণ কী? কারণ হচ্ছে শক্তিশালী ভাষাভাষি মানুষরাই বিশ্ব নিয়ন্ত্রণ করছে। অগ্রসরমাণ প্রজন্মের শক্তি সঞ্চিত হলেই স্বীকৃতি মিলছে নিজ ভাষার। যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক শহরের প্রধান প্রধান হাসপাতালে সাইনবোর্ড ঝুলছে, ‘আমরা বাংলায় কথা বলি’। নিউইয়র্কের বোর্ড অফ এডুকেশন তাদের প্রতিটি নোটিশে এখন সংযোজন করে নিয়েছে বাংলাভাষা। নির্দেশিকায় স্থান পাচ্ছে বাংলায় নিয়মাবলি। তার কারণ প্রায় পনেরো হাজারেরও বেশি বাংলা ভাষাভাষি ছাত্রছাত্রী এখন লেখাপড়া করছে নিউইয়র্কের মাধ্যমিক-উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোতে। এখন এখানে ‘বাংলা কারিকুলাম’ চালু করে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য শিক্ষার প্রচেষ্টা চলছে।

বিশ্বে একই রাষ্ট্রে বিভিন্ন ভাষা চালু থাকার উদাহরণও দেখি আমরা। ভারতের কথাই ধরা যাক। কেরালা কিংবা তামিলনাড়ু অঙ্গরাজ্যের মাতৃভাষা আর কলকাতার মাতৃভাষা এক নয়। দুটি রাজ্যের দু’জন নাগরিকের রাষ্ট্রভাষা যদিও ‘হিন্দি’ কিন্তু এই দুই অঙ্গরাজ্যে তা কি মানতে দেখা যায়? না, যায় না। বরং এই দুই অঙ্গরাজ্যের নাগরিকরা মিলিত হয়ে যান এক ভাষায়। আর তা হচ্ছে ইংরেজি। ইউরোপ-আমেরিকার বিভিন্ন মাল্টিকালচারাল কোম্পানি তাদের শোরুম খুলেছে মুম্বাই, দিল্লি, পুনা কিংবা কেরালার ট্রিচুর ডিস্ট্রিক্টে। সেখানে ভারতীয় রিপ্রেজেনটেটিভদের বলা হয়েছে, ফোনের জবাব দিতে হবে ইংরেজিতে। কারণ ক্লায়েন্ট সবাই ইউরোপ-আমেরিকার। ভাষার প্রতিপত্তি এভাবেই দখল করে নিয়েছে বিভিন্ন উপনিবেশ। অর্থনীতিই হয়ে ওঠেছে মুখ্যশক্তি। এমনকি বদলে দেওয়া হয়েছে সেখানকার প্রতিনিধিদের নামও। ‘রাজেশ’ হয়ে গিয়েছে ‘রেন্ডি’, ‘মনিষা’ হয়ে গিয়েছে ‘মনিকা’। এ বদল শুধু প্রতীকী কারণের। এই সঙ্গে জড়িত ‘মাল্টিকমপ্লেক্স বিজনেস অ্যান্ড মার্কেটিং।’

বিভিন্ন দেশেই আজ একটি বিষয় লক্ষ করা যায়, তা হচ্ছে শুদ্ধ এবং কথ্যভাষার দ্বন্দ্ব। যুক্তরাষ্ট্রে আঞ্চলিক কিংবা কথ্যভাষায় বিভিন্ন র‌্যাপ সংগীতে এমনভাবে বাণীবদ্ধ করা হয়, যার মাঝে মধ্যে অশ্লীল, অশোভন কিছু শব্দও ঢুকিয়ে দেওয়া হয় খুব কৌশলে। এসব গান পারিবারিক আবহে, মাতা-পিতা-স্ত্রী-পুত্র-কন্যা নিয়ে বসে শোনার মতোই নয় বলা যায়। তারপরও এসব রেপ সংগীতের সিডি বাজারে আসছে মিলিয়ন-মিলিয়ন। এরও কারণ একটাই, বাণিজ্যিক মুনাফা অর্জন এবং তা সম্ভবও হচ্ছে।

॥ দুই ॥

কবি অক্টাভিওপাজ এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘আমি লিখি আমার মাতৃভাষায়। বাজারজাতকারীরা তা ইংরেজিতে তর্জমা করে মুনাফা লুটে। নোবেল কমিটির কাছেও ইংরেজি ভাষার গুরুত্ব বেশি। তা না হলে তারা ইংরেজি ছাড়া অন্য ভাষায় প্রতিষ্ঠিত কবি-লেখকদের ব্যাপারে অন্তিমে এসে আগ্রহী হবে কেন?’

পাজের ক্ষোভ বাজারি মুনাফাখোরদের প্রতি। কিন্তু সে ক্ষোভ যতই তীব্র হোক না কেন, ভাষা বাণিজ্যকারীরাই পৃষ্ঠপোষকতা পায় বিভিন্ন সরকারের, রাষ্ট্র শাসকদের। এই মুনাফালাভের লোভ তো লেখকরাও সংবরণ করতে পারেন না!

এই আদান-প্রদান বাংলাদেশ-পশ্চিমবঙ্গের মাঝেও হতে পারে। ভারতের স্যাটেলাইট চ্যানেল ঢাকায় চললে, বাংলাদেশের স্যাটেলাইট চ্যানেলও কলকাতায় চলা দরকার।

সাহিত্য এবং ভাষার বিশ্বায়নের সমকালে তা কি আটকে রাখা যাবে? দোষ যে কলকাতা রাজ্য সরকারের নেই, তা আমি বলছি না। তারাও ঢাকার বাংলা টিভি চ্যানেলগুলোকে কলকাতায় ঢুকতে না দিয়ে একক রামরাজত্ব বহাল রাখতে চাইছেন। কিন্তু হালে তা কি সম্ভব হবে? বিবিসি, সিএনএন-এর ওয়ার্ল্ড সার্ভিস দখল করে নিয়েছে এবং নিচ্ছে স্যাটেলাইট আকাশ। তাহলে বাংলা ভাষাভাষি দুই দেশবাসীর এত দ্বিধা কেন? এই দ্বিধা দূর হলে বাংলা ভাষার শক্তিই বাড়তো বিশ্বব্যাপী।

॥ তিন ॥

গেল দুই দশক ধরে বাংলাদেশে একটি সাহিত্যকর্ম আমাকে বেশ আপ্লুত করছে। আর তা হচ্ছে বিভিন্ন ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর ভাষা নিয়ে সংস্কৃতি সাহিত্য নিয়ে আগ্রহ দেখাচ্ছেন রাষ্ট্রের আপামর মানুষ। মণিপুরী, গারো, হাজং, মারমাসহ বিভিন্ন ভাষাভাষি তরুণ সাহিত্যিকরা এগিয়ে এসেছেন। তারা সেসব ভাষার কবিতা, কথাসাহিত্য বাংলায় অনুবাদ করে বাংলা সাহিত্যের মূলধারায় প্রতিষ্ঠিত করছেন। তা অনুমান হচ্ছে এভাবে ইংরেজিতেও। কোনো উপজাতির সাহিত্য, একটি রাষ্ট্রের রাষ্ট্রীয় ভাষার বাহু বলা যায়। কারণ সেসব ভাষাভাষি মানুষও একই রাষ্ট্রের প্রাণশক্তি।

বলছিলাম, একই রাষ্ট্রে বিভিন্ন আঞ্চলিক ভাষার কথা। কোনো অঞ্চলের কথ্য ভাষায় সাহিত্য রচিত হবে কি না; কিংবা হওয়া উচিত কি না তা নিয়েও চলছে নানা বিতর্ক। একটি কথা মনে রাখতে হবে, একই রাষ্ট্রের অভ্যন্তরেই একটি অঞ্চলের কথ্যভাষা অন্য অঞ্চলে সম্পূর্ণ অচল। এমন কিছু শব্দাবলি আছে যা অঞ্চলের ক্ষেত্রবিশেষে ভিন্ন অর্থও প্রকাশ করে। তাহলে সংগত কারণেই প্রশ্ন আসছে যিনি কোনো আঞ্চলিক কথ্যভাষায় গদ্য পদ্য লিখছেন, তিনি কি এ অঞ্চলের পাটক-পাঠিকাকে সামনে রেখেই তা লিখছেন। নাকি তার জাতীয় ভাষার পাঠক তার লক্ষ্যবিন্দু। আগেই বলেছি, ইংরেজিতে কথ্য অশ্লীল শব্দ ব্যবহার করে গান রচিত, গীত হচ্ছে পাশ্চাত্য। এর শ্রোতাও একটি গোষ্ঠী। বাজারি চাহিদাও রয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যেও ইংরেজি ভাষার বাচনভঙ্গি, উচ্চারণের ভিন্নতা প্রায়ই লক্ষ করা যায়। যেমন­ নর্থ ক্যারোলিনা, সাউথ ক্যারোলিনা, টেক্সাস কিংবা নিউইয়র্কের মানুষ একই বাচনভঙ্গিতে কথা বলেন না। সমকালের সঙ্গে তাল মিলিয়ে অগ্রসর হতে যত বেশি সম্ভব ভাষার দখল শিখতে পারাটাই কৃতিত্ব বলে আমি মনে করি। যুক্তরাষ্ট্রে বেড়ে ওঠা কোনো বাঙালি প্রজন্ম যদি বাংলাভাষা, সাহিত্য-সংস্কৃতির ওপর গবেষণা করে বাঙালি জাতিসত্তাকে বিশ্বে আরও উজ্জ্বল করতে পারে তা তো সবার জন্যই শুভ বার্তাবাহী।

আমার একজন প্রাক্তন সহকর্মী জাপান সরকারের একটি বৃত্তি নিয়ে টোকিও যাচ্ছেন। তিনি বললেন, তার প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে তাকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, তিনি সেখানে গিয়ে যোগদানের আগে যদি জাপানি ভাষা কিছুটা রপ্ত করে যান তবে তাকে বিশেষ সুযোগ-সুবিধা প্রদান করা হবে। যুক্তরাষ্ট্রে তার থাকাকালীন সময়েই তাকে ভাষা শিক্ষা দেওয়ার ব্যবস্খা করবে জাপানি ওই প্রতিষ্ঠান। বিশ্বমানবের কাছে নিজেদের ভাষা ছড়িয়ে দেয়ার এই যে চেষ্টা এবং চেতনা তা অনুসরণযোগ্য। আর এর সঙ্গে অর্থ রোজগারের বিষয় তো রয়েছেই।

আরেকটি সাম্প্রতিক উদাহরণ দেয়া যায়। একটি সংবাদ দেশে-বিদেশে ফলাও করে প্রচার করা হয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী, একজন অভিবাসী বাঙালি মহান একুশে, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে যুক্তরাষ্ট্র ডাক বিভাগের (ইউএসপিএস) অধীনে একটি ডাকটিকেট প্রকাশের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। এর প্রকৃত ঘটনাটি অন্যরকম। যুক্তরাষ্ট্রের কিছু লাইসেন্সধারী এজেন্ট রয়েছে যারা ডাকটিকিট প্রিন্ট করতে পারে। ডাক বিভাগের নিয়োগকৃত এসব এজেন্টের কাছে যে কেউ উপযুক্ত কারণ, শর্ত এবং আনুষঙ্গিক বিষয়াদি মেনে ডাকটিকিট প্রকাশের আবেদন করতে পারেন। তা তারা মেনে নিলে সাময়িকভাবে কম্পিউটার প্রিন্ট ডাকটিকিট প্রকাশের ব্যবস্থা করে। প্রধান শর্ত হচ্ছে লক্ষাধিক ডাকটিকিট এভাবে অনলাইনে বিক্রি করতে হবে। তা করতে পারলেই তারা ডাকঘরে ওই ডাকটিকিট বিক্রির উদ্যোগ নেবে। আসল কথা হচ্ছে অর্থ উপার্জন। অর্থ উপার্জনের উৎস করে দিতে পারলেই ভাষা সংস্কৃতি এখন আদৃত হচ্ছে বিশ্ববাজারে। তাই ভাষাকে টিকে থাকতে হচ্ছে এর সঙ্গে পাল্লা দিয়েই।

॥ চার ॥

একটি ভাষার মাধ্যমে মানুষ তার জীবনকে প্রকাশ করে। ভাষাকে বদলেও দেয় মানুষ। নিজের মতো করে কাজে লাগায়। ভাষা নিজে প্রকাশিত হতে পারে না। যুগে যুগে প্রজন্মের বুননের মধ্য দিয়েই একটি ভাষা ক্রমশ তার পরিপূর্ণতা লাভ করে। ভাঙে আবার গড়ে। আমরা লক্ষ করলে দেখবো তিরিশের দশকে যে আঙ্গিকে, যে অবকাঠামোতে বাংলা সাহিত্য রচিত হয়েছে, এই শূন্য দশকে তেমনটি হচ্ছে না। তার কারণ, বদলে গেছে বিশ্বের চারপাশ। বেড়েছে নিসর্গের নানা নির্মিতি। যোগাত্মক এবং বিয়োগাত্মক দুটি দিকেই পরিবর্তন ঘটেছে। এ পরিবর্তন মেনে নিয়েই এগুচ্ছে জীবন-সমাজ-সংসার। এর সমন্বয় সাধন করেই যাচ্ছে মানুষ। নিজেকে তৈরি করছে নিজস্ব আঙ্গিকে।

একটি ভাষাকে যারা নতুন নান্দনিকতায় রূপ দেন তারা হচ্ছেন সে ভাষার লেখক। লেখকরা প্রতিনিয়ত তাদের মননশীল চিন্তাটুকু ভাষার জন্য, ভাষার পাঠক-পাঠিকার জন্য রেখে যান। কিন্তু একটি ভাষার কাছে একজন লেখকের কি কিছুই চাওয়ার থাকে না? অবশ্যই থাকে। এ প্রসঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের খ্যাতিমান কবি মি. জেমস টেটস-এর একটি উক্তি প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেছিলেন, সব সৃজনশীল লেখকই চান মহাকালের মানুষ তার লেখাগুলো গ্রহণ করুক। প্রকৃতপক্ষে যে ভাষার মানুষ, যে জাতি তার সৃজনশীল লেখকদেরকে বেশি মূল্যায়ন করে সে প্রজন্ম ততে বেশিই উপকৃত হয় এবং এর ফল হয় সুদূরপ্রসারী।

এসব কথা বাঙালি জাতিও জানে নানাভাবে। জানেন রাষ্ট্রকর্তারাও। তারপরও কোথায় যেন এক ধরনের অবহেলা। কোথায় যেন এক ধরনের হীনম্মন্যতা। চেয়ার দখলের প্রতিযোগিতা! কেন এমন করা হয়? এ সব প্রশ্নের কোনো জবাব নেই।

ফেব্রুয়ারি মাস বাঙালির গৌরবের মাস। এ গৌরব রক্তের বিনিময়ে অর্জিত। মাসব্যাপী বইমেলার সংবাদটি এখন জানেন প্রায় গোটা বিশ্বের মানুষ। জানেন বিভিন্ন ভাষার লেখকরাও। তারপরও আমরা হতবাক হয়ে যাই, যখন দেখি বইমেলার মতো জ্ঞানার্জনের প্লাটফর্মটিও দখল করে নেওয়ার চেষ্টা হয়। বইমেলার উদ্বোধন, সম্মানিত লেখকদের ওপর ছেড়ে দেওয়া যায় না? প্রকৃত লেখক কখনোই রাজনীতি দ্বারা প্ররোচিত হন না। হতে পারেন না। সত্যের সপক্ষে, মানুষের সপক্ষে, মানবতার সপক্ষে কর্মই তার বড়ো পরিচয়। আর কোনো পরিচয় তার থাকার কথা নয়। তারপরও লেখকদেরকে দলীয়করণের প্রতিযোগিতা আমরা লক্ষ করি।

আমরা সংবাদ মাধ্যমে, বিভিন্ন গ্রন্থের প্রকাশনা অনুষ্ঠান দেখি। তাতে দেখা যায় অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি হয়েছেন কোনো মন্ত্রী, আমলা, শীর্ষ ব্যবসায়ী (নব্য মিডিয়া ব্যবসায়ীরাও যুক্ত হয়েছেন), কিংবা সমাজের অন্য কোনো ক্ষেত্রের ক্ষমতাবান। আমরা দেখি রাষ্ট্রের শীর্ষ কবি, লেখক, কথা সাহিত্যিকরা বসে আছেন দর্শক সারিতে। কেন এই জবরদখল?

এই মানসিকতা থেকে লেখক-পাঠকসহ সর্ব শ্রেণির সচেতন মানুষের বেরিয়ে আসা দরকার। মনে রাখতে হবে একটি প্রকাশনা উৎসব, কোনো জনসভা নয়। তাই তাতে কয়েক হাজার লোক সমাগমও আশা করা উচিত নয়। বিশ্বের শীর্ষ সেমিনার, সিম্পোজিয়াম, প্রকাশনা উৎসবগুলো, কয়েকশত মানুষের মাঝেই সীমাবদ্ধ থাকে। আর এই কয়েকশত মানুষই মূলত একটি সমাজের, একটি ভাষা বিনির্মাণের শীর্ষ নেতৃত্ব দিয়ে যান। একটি ভাষাভাষি মানুষ যখন একজন লেখককে একগুচ্ছ ফুল দিয়ে পুরস্কৃত করে। তখন তাই হয়ে উঠে লেখকের জীবনের শ্রেষ্ঠ পাওয়া। বাংলা ভাষা এবং সাহিত্য আর তার নিয়ন্ত্রকরা এ বিষয়ে বড়ো কৃপণ বলেই আমার কাছে মনে হয়।

বাংলাদেশে একটি মর্যাদাশীল পুরস্কার হচ্ছে ‘বাংলা একাডেমি পুরস্কার’। ১৯৬০ সাল থেকে এই পুরস্কার প্রবর্তন করা হয়। বাংলা একাডেমির ওয়েব সাইটে দেওয়া তথ্যানুযায়ী জানা যায় এর মধ্যে ১৯৮৫, ১৯৯৭, ২০০০ বছরে কোনো পুরস্কার দেওয়া হয়নি। দেশে কোনো যোগ্য লেখক ছিলেন না এ সময়? নাকি রাজনৈতিক কারণে এই বছরগুলোতে একাডেমি পুরস্কার দেওয়া হয়নি? কেন দেওয়া হয়নি এর সুনির্দিষ্ট এবং ব্যাখ্যা সংবলিত কোনো কারণ একাডেমির ওয়েব সাইটে নেই।

লক্ষ করলে আরো দেখা যাবে যারা পুরস্কার পেয়েছেন, তাদের মাঝে বেশকিছু লেখক-লেখিকা ইতিমধ্যেই পাঠক বিস্মৃত প্রায়। এ প্রজন্মের অনেকেই এদের নামটি পর্যন্ত জানেন না। তাদের লেখালেখি পড়াতো দূরের কথা। মহাকাল এভাবেই একজন লেখকের ভাগ্য নির্ধারণ করে দেয়।

কেউ হয়তো বলতে পারেন, বিশ্বখ্যাত নোবেল সাহিত্য পুরস্কার প্রবর্তিত হওয়ার পর পর্যন্ত, আজ অবধি যারা নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন তাদের সবার নাম কি আমরা মনে রেখেছি? এর উত্তর ‘হ্যাঁ’ অথবা ‘না’ দুটোই হতে পারে। নোবেল যারা পেয়েছেন, তারা বিভিন্ন দেশের মানুষ। বিভিন্ন ভাষাভাষি লেখক-কবি। আমরা কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে যেমন মনে রেখেছি, সে সব ভাষার কবি-লেখকরাও নিজ নিজ ভাষাভাষির কাছে সমানভাবে সমাদৃত। গোটা বিশ্বের সব ভাষাভাষি মানুষের সে খোঁজ নয়।

বাংলা ভাষার লেখক কবি যারা মেধার মূল্যায়নে (অবশ্যই রাজনৈতিক কোটাভিত্তিক পুরস্কার বিবেচ্য নয়) একাডেমি পুরস্কার পেয়েছেন, তাদের লেখাগুলো, গ্রন্থগুলো, নিয়মিত পুনঃপ্রকাশ করেনি বাংলা একাডেমি। যার ফলে তারা কালের গহ্বরে হারিয়ে যেতে বসেছেন। এটা খুবই যৌক্তিক কথা, শুধু একজন লেখককে কিছু অর্থ সম্মানি আর ক্রেস্ট-সনদ দিয়ে দিলেই জাতীয় দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না। ঐ লেখকের লেখাগুলো সংরক্ষণ, পুনর্মুদ্রণ, রক্ষণাবেক্ষণ এবং পাঠকের কাছে পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্বটুকুও পালন করতে পারে বাংলা একাডেমি, কৃতিত্বের সঙ্গে। এ ছাড়া বর্তমান তরুণ লেখকদেরকেও বিভিন্নভাবে পৃষ্ঠপোষকতা দিতে পারে জাতীয় এই প্রতিষ্ঠান ‘বাংলা একাডেমি’।

ভাবতে অবাক লাগে অনেক সাহিত্যিকও এখনো একাডেমি পুরস্কার পাননি। এমন কবি-লেখকদের তালিকা বেশ দীর্ঘই হবে যারা একাডেমি পুরস্কার পাওয়ার যোগ্যতা রাখেন কিন্তু এ যাবৎ পাননি। মেধাবৃত্তির বিবেচনায় একাডেমি পুরস্কার প্রদানে উদ্যোগী হবে বলেই জাতি আশা করে। মনে রাখতে হবে ভাষার প্রহরী লেখক-পাঠক-জনমানুষেরাই। রাষ্ট্র নায়করা এর পৃষ্ঠপোষকতা করেন, মৌলিক চেতনার আলোকেই।

ফকির ইলিয়াস: কলাম লেখক, সাংবাদিক ও কবি

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :