ঘুণে ধরছে দাম্পত্য সম্পর্ক, খুন হচ্ছে জীবনসঙ্গী

তানিয়া আক্তার, ঢাকা টাইমস
  প্রকাশিত : ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১০:১৬| আপডেট : ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১৫:৪১
অ- অ+

রাজশাহীর রডমিস্ত্রি রুবেল। বছর সাতেক আগে বিয়ে করেন ঝর্না আক্তার লিপিকে। একমাত্র ছেলেকে নিয়ে বাস করতেন নগরীর কাটাখালীর মাসকাটাদীঘির পূর্বপাড়া গ্রামে। স্বামী-স্ত্রী-সন্তান এই ত্রিভুজ বন্ধনে কাটছিল সুখের সংসার। কিন্তু সেই সংসার ভাঙতে হানা দিলো সর্বগ্রাসী মাদক। নেশার তাড়নায় বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা থেকে করতে থাকেন ঋণ। বাড়তে থাকে ঋণের বোঝা। সময়মতো ঋণ শোধ করতে না পারায় ঝেঁকে বসে হতাশা।

রুবেল-লিপির সংসারে কলহ ঘিরে থাকে সারাক্ষণ। তুচ্ছ ঘটনায় স্ত্রীর ওপর শুরু হয় শারীরিক নির্যাতন। একপর্যায়ে পরকীয়ার সন্দেহের তীরও ছোঁড়া হয় স্ত্রীর দিকে। একদিন কলহের সর্বোচ্চ মাত্রা বাড়িয়ে মারধর করে তাড়িয়ে দেন স্ত্রীকে। বিতাড়িত স্ত্রী ঠাঁই নেয় বাবার বাড়িতে। ঘটনা হয়তো এখানেই শেষ হতে পারতো। তবে গড়াতে থাকে ভিন্ন দিকে। এর দিনকয়েক পরেই শ্বশুরবাড়ি হাজির রুবেল। দায়ভার কাঁধে নিয়ে বাড়িতে নিয়ে আসেন স্ত্রীকে।

সেদিন রাতে ঘড়ির কাঁটা যখন ৯টায়, স্বাভাবিক সময়ের মতো স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে ঘুমাতে গেলেন। রাত গভীর হয়। ঘুমের কোলে ঢলে পড়ে প্রকৃতি। কিন্তু মাদকের নেশায় মত্ত রুবেলের খুনের নেশা উদ্রেক হয়। প্রথমে ঘুমন্ত মা ও বোনকে তালাবদ্ধ করে আটকে নেন। শাবল নিয়ে খুন করেন স্ত্রীকে। রক্তাক্ত লাশ ফেলে রেখে আত্মগোপন করেন এক বন্ধুর বাসায়। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। র‌্যাবের প্রযুক্তিজ্ঞানের কাছে হেরে যান রুবেল। গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে শুরু হয় তার বন্দিজীবন। যে সঙ্গীকে জীবনভর সঙ্গে রাখার অঙ্গীকার করে ঘরে তুলেছিলেন; নিজ হাতে পৃথিবী থেকে বিদায় করে বরণ করে নিলেন একাকীত্ব। এদিকে মা-বাবার কারও সান্নিধ্য ছাড়াই অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে উঠতে থাকে ওই দম্পতির একমাত্র সন্তান।

দেশের কোথাও না কোথাও প্রতিবছরই স্বামী কর্তৃক স্ত্রী কিংবা স্ত্রী কর্তৃক স্বামী হত্যার ঘটনা ঘটে। চলতি বছরের প্রথম মাসেও এমন একাধিক ঘটনার সাক্ষী হয়েছে দেশ।

বেসরকারি সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্যানুযায়ী, গত বছর ২০৭ জন নারী স্বামীর হাতে খুন হয়েছেন। আর চলতি বছরের প্রথম মাসে ১৫ জন নারী হত্যার শিকার হয়েছেন স্বামীর হাতে।

চলতি বছরের জানুয়ারিতে সংঘটিত ৮টি হত্যার ঘটনা বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, পরকীয়া সন্দেহে স্বামীর হাতে হত্যার শিকার হন তিন গৃহবধূ। স্বামীর মাদকাসক্তির প্রতিবাদ করা নিয়ে কলহ থেকে খুন হন দুই নারী। বাকি তিন নারী স্বামীর হাতে খুন হলেও হত্যাকান্ডের কারণ উদঘাটন হয়নি। পরিবার নির্ভরযোগ্য হওয়ার পরেও কেন এমন ঘটনা ঘটে- সে বিষয়ে বিশ্লেষকরা বলছেন, দাম্পত্যে এই হত্যাগুলো বেশিরভাগই সম্পর্ককেন্দ্রিক জটিলতার কারণে হয়ে থাকে। এছাড়া সম্পত্তি, মাদক এবং পরিস্থিতিগত কারণেও ঘনিষ্ট সম্পর্কগুলোতে হত্যার ঘটনাগুলো ঘটে। খুব দ্রুত শিল্পায়ন এবং বৈশ্বিক পরিবর্তনের কারণে সমাজের প্রথা ভেঙে যাচ্ছে। ফলে পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাবোধের অভাবের কারণে সম্পর্কের অবনতি ঘটে এবং একপর্যায়ে তা মারাত্নক রূপ নেয়। ফলে দাম্পত্যজীবনে পারস্পরিক যোগাযোগ বৃদ্ধি করা, একে অন্যের কথা মনোযোগ দিয়ে শোনা, পরস্পরের ইতিবাচক দিকগুলোর যথাযথ মূল্যায়নের প্রতি গুরুত্বারোপ করেছেন মনোবিদেরা।

সামাজিক অবক্ষয় ও অস্থিরতা

এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. জিয়া রহমান ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘একটা চিরায়ত সমাজ থেকে আধুনিক সমাজের দিকে যাচ্ছে বাংলাদেশ। যেকোনো সমাজের মাঝের সময়টায় এক ধরনের অস্থিরতা বিরাজ করে। আমাদের সমাজও পুরাতন এবং আধুনিকতার মাঝামাঝি অবস্থায় রয়েছে। ফলে সামগ্রিকভাবে এই সমাজেও অস্থিরতা বিরাজমান। প্রযুক্তির নানামুখী প্রভাবে পাশ্চাত্যের অনেক মূল্যবোধ এই সমাজেও ঢুকেছে। এগুলো আমাদের জীবন যাপনের পদ্ধতিতে পরিবর্তন আনার পাশাপাশি সম্পর্কের মিথষ্ক্রিয়ায়ও বড় পরিবর্তন আনছে। তাই সমাজে বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক বেড়ে সম্পর্কগুলো ক্ষণস্থায়ী হয়ে যাচ্ছে।’

এ বিষয়ে সমাজবিজ্ঞানী ড. এ এস এম আমানুল্লাহ ঢাকা টাইমসকে বলেন, আমরা এখন ফিউডাল সোসাইটি বা সামন্ত সমাজ থেকে নিউলিবারাল ক্যাপিটালিজম সোসাইটি বা নব উদার পুঁজিবাদী সমাজের দিকে অগ্রসর হচ্ছি। তবে একটা সমাজব্যবস্থা থেকে আরেকটি সমাজে পরিবর্তিত হতে গেলে কয়েকধরনের ধাপ অতিক্রম করতে হয়। কিন্তু আমরা সেই ধাপগুলো যথাযথ সময় নিয়ে অতিক্রম না করে খুব দ্রুত পার হয়ে যাচ্ছি। ফলে আমাদের সমাজেও ভাঙন শুরু। আমরাও একটা যুদ্ধে রয়েছি। যুদ্ধে নারী ও শিশুই বেশি শিকার হচ্ছে।

এ ধরনের হত্যাকাণ্ডে সামাজিক অস্থিরতাকে দায়ী মনে করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শান্তি ও সংঘর্ষ বিভাগের চেয়ারম্যান সাইফুদ্দীন আহমদ। তিনি ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘সমাজে অস্থিরতা বেড়ে গেছে। প্রযুক্তির কারণে মানুষ তার নিজস্ব পরিমন্ডলের বাইরে যোগাযোগের অনেক সুযোগ পাচ্ছে। স্বামী বা স্ত্রীর নানারকম সংযোগ তৈরি হওয়া অস্থিরতার একটা কারণ। এছাড়া মুহূর্তেই ক্লিক করে নতুন নতুন জগত দেখতে পাচ্ছে। সামনে নতুন বলে কিছু নাই। ফলে বেঁচে থাকার যে আগ্রহটা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। জীবনের যে তাৎপর্য বা বেঁচে থাকার যে আনন্দ সেটা উপভোগ করার আগ্রহ তৈরি হয় না।’

বিয়েবহির্ভূত সম্পর্ক

এসব হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শান্তি ও সংঘর্ষ বিভাগের চেয়ারম্যান সাইফুদ্দীন আহমদ ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘বিয়ে একটি ধর্মীয় চুক্তি। সৃষ্টিকর্তাকে সাক্ষী রেখে যার সঙ্গে বিয়ে বন্ধনে আবদ্ধ হয় তাকে হত্যা করতে গেলে ভয় পাওয়ার কথা। কারণ যদি মেরে ফেলা হয় তবে তার শাস্তি অবধারিত। কিন্তু ধর্মের প্রতি বিশ্বাস নড়বড়ে হয়ে গেলে হত্যার মতো অপরাধের সিদ্ধান্ত নিতে দ্বিধাবোধ করে না মানুষ। কিন্তু যেখানে দাম্পত্যজীবনে কাউকে ভালো না লাগলে সভ্যভাবে বিচ্ছেদেরও সুযোগ রয়েছে, সেখানে আক্রোশ রেখে হত্যার মতো অপরাধ কেন করতে হবে। তাই বিয়েকে শুধু আইন এবং প্রথার জায়গা থেকে না দেখে ধর্মকে নিজের মধ্যে ধারণ করলে এ ধরনের ঘটনা কমে আসবে।’

প্রযুক্তির নানামুখী সুযোগের হাতছানি দাম্পত্যজীবনে প্রভাব ফেলে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘দ্রুত সংযোগের সুবিধায় স্বামী বা স্ত্রীর বহির্গমনের পথও তৈরি হয়। তখন স্বামী বা স্ত্রী মনে করে তার পথ থেকে অন্যজনকে সরিয়ে দিতে হবে। এই সরিয়ে দেওয়া বা হত্যা করে ফেলার পেছনে হৃদয়ঘটিত ব্যাপারটি তো থাকেই। পাশাপাশি অনেক ক্ষেত্রে বস্তুগত প্রাপ্তির বিষয়টিও থাকে। এর ফলে একজন আরেকজনকে প্রতিপক্ষ মনে করে। এটি বর্তমানে মারাত্মক আকার ধারণ করছে।’

সুশাসনের অভাব

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. এ এস এম আমানুল্লাহ মনে করেন, ‘সমাজ থেকে রাজনৈতিক ও সামাজিক দায়বদ্ধতা হারিয়ে গেছে। এমনকি পরিবারের ভেতর নিজেদের মধ্যে আলোচনাও কমে গেছে। আরও অস্থিরতা সামনে রয়েছে।’

এ বিষয়ে আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) নির্বাহী পরিচালক ফারুখ ফয়সল ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘দেশের মানুষের আস্থাহীনতা একটা চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছে। এই আস্থাহীনতা এমন পর্যায়ে নেমেছে যে- পরিবারের মধ্যেই একে অন্যের প্রতি আস্থা রাখছে না। স্বামী ও স্ত্রীর মধ্যে আস্থাহীনতার পরিবেশ তৈরি হয়েছে। এই দোষটা দিতে চাই সামাজিক অবক্ষয়ের উপর। এই যে সামাজিক অস্থিরতা সেখান থেকেই এই হত্যাগুলো হচ্ছে।’

আসকের নির্বাহী পরিচালক আরও বলেন, ‘মানুষ একটি দুর্গতিপূর্ণ সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এখনকার যে পরিবেশের মধ্যে বসবাস করতে হচ্ছে সেখানে মানসিক সুস্থতাও হারিয়ে যাচ্ছে।ঘরের বাইরে যেমন দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, জীবন যাপনের নানা ধরনের অসুবিধা, সামাজিক ভাঙনের প্রভাবের কারণে নিজের ঘরের মধ্যে সবচেয়ে কাছের মানুষকে হত্যার মতো মানসিকতা তৈরি হচ্ছে। দাম্পত্য সম্পর্কে ফাটল ধরছে। এর থেকে উত্তরণের পথ হলো সমাজের সব সেক্টরে আস্থা ফিরিয়ে সহনীয় পর্যায়ে আনতে হবে। সেটা যতক্ষণ না পারছি এই অস্থিরতা বা অবক্ষয় আরও বাড়তে পারে।’

সম্পর্কে সহনশীলতা হ্রাস পাওয়া

স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কগুলো অভিযোজনের মাধ্যমে এগোয়। যখনই মতবিরোধ হয় সেখানে একে অন্যকে গ্রহণ করার ক্ষমতা থাকে না। সম্পর্কের প্রতি সহনশীলতা কমে যাওয়া বা একে অন্যকে গ্রহণ করার মানসিকতা ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে। পারস্পরিক মতবিরোধ হলে কীভাবে মোকাবিলা করবে সেই জীবনমুখী বিদ্যার অভাব দেখা দিচ্ছে মনে করেন মনোবিদ মেখলা সরকার।

জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এই মনোবিদ পেশাগত অভিজ্ঞতার কথা জানিয়ে ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘অল্পতেই উদ্বেগবোধ করা, মানসিক চাপ মোকাবিলা করার ক্ষমতা কম, নানা ধরনের অ্যাংজাইটি ডিসঅর্ডারে ভোগা- এমন সমস্যা যেসব দম্পতির রয়েছে তারা যদি সমস্যায় পড়েন তাহলে তারা এত বেশি উদ্বেগ প্রকাশ কওে, যা অনেকক্ষেত্রেই তাদের নিয়ন্ত্রণে থাকে না। ফলে সঙ্গীর সঙ্গে অনাকাক্ষিত ঘটনাগুলো ঘটিয়ে থাকে।’

ভাঙছে পুরাতন সামাজিক অনুশাসন

নতুন বছরের প্রথম মাসে যে ১৫ জন গৃহবধূ খুন হয়েছেন এসব হত্যাকাণ্ডের বেশিরভাগ পরিস্থিতিগত কারণে ঘটেছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

পরিস্থিতির কারণেসংঘটিত বিষয়গুলো মূলতসমাজের যে ছন্দ থাকে সেটি ভেঙে যাওয়ার কারণেই ঘটে বলে মনে করেন অধ্যাপক ড.জিয়া রহমান। তিনি বলেন,‘পুরাতন সামজিক অনুশাসন ভেঙে যাওয়ায় সমাজের গঠনও ভেঙে যাচ্ছে। এখন মানুষ যেহেতু খুব অস্থিরতার মধ্যে থাকায় নৈতিক জায়গাগুলো দুর্বল হয়ে যাচ্ছে। অস্থির মানুষ যেকোনো ঘটনায় আগ-পিছ চিন্তা করতে না পারায় হত্যার মতো ঘটনাগুলো ঘটছে।’

তবে স্ত্রী হত্যার ঘটনায় শুধুই পুরুষের প্রতি দোষারোপ করতে রাজি নন মনোবিদ ডা. মেখলা সরকার। তিনি বলেন, ‘স্বামী-স্ত্রীর নিজেদের মধ্যে সমঝোতার জায়গাটি যেভাবে বজায় রাখা প্রয়োজন সেই দক্ষতা অনেকেরই থাকে না বা প্রায়শই অভাব থাকে। এ ধরনের হত্যায় পরস্পরের প্রতি শুধু যে নারীর প্রতি পুরুষের শ্রদ্ধাবোধের ঘাটতি রয়েছে তা নয়, পুরুষের প্রতিও শ্রদ্ধারঘাটতি দেখা যায়। এছাড়াও পুরুষের মাদক গ্রহণ, হতাশা, অর্থনৈতিক অসচ্ছলতা, ব্যবসায় হঠাৎ লস হয়ে যাওয়া এসব যে পরিমাণ মানসিক চাপ তৈরি করে তা অনেকক্ষেত্রেই সে মোকাবিলা করতে পারে না। ব্যক্তি নিজেই কোনো অপরাধের সঙ্গে যদি দিনের পর দিন যুক্ত থাকে তবে সঙ্গীর সঙ্গে সেই অপরাধ ঘটাতে দ্বিধান্বিত হয় না।’

মানসিক চাপ মোকাবিলার ক্ষমতা কম পাশাপাশি উদ্বেগের বহিঃপ্রকাশ বেশি থাকাসহ মিডিয়ারও ভূমিকা রয়েছে বলে মনে করেন এই মনোবিদ। ডা. মেখলা সরকার ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘টিভিতে নাটক বা সিরিয়ালগুলোতে ক্রাইমের দৃশ্যগুলো দেখাচ্ছে। যেমন, রাগান্বিত হলে হত্যা করে ফেলছে। সুতরাং মানুষের মধ্যে যে নৃশংসতা রয়েছে সেটি অনেক বেশি সামনে নিয়ে আসছে। যখন এই বিষয়গুলো আমাদের সামনে চলে আসবে বা অনেক দেখতে থাকবো তখন একধরণের গ্রহণযোগ্যতা তৈরি হয়। এই নাটকগুলো নির্মাণের সময় কারও প্রতি এমন নৃসংশ হওয়া উচিত না বা কারও কোনো ধরণের ক্ষতি করা উচিত না-এমন বিষয়গুলো মাথায় রাখা হয়। কিন্তু যখনই এগুলো অহরহ দেখতে থাকবো তখন একধরণের গ্রহণযোগ্যতা তৈরি হয়ে যায়। ফলে নিজেদের মধ্যে যদি প্রবণতা থাকে তখন এই প্রবণতার বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে আমরা দ্বিধান্বিতবোধ করি না।’

সম্পর্কে অজ্ঞতা

সমাজে এ ধরনের ঘটনা ঘটার ক্ষেত্রে নিরক্ষরতা এবং অজ্ঞতাকেও দায়ী করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. এ এস এম আমানুল্লাহ ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘সমাজের অনেকগুলো সেক্টরের মধ্যে যথার্থ সামাজিকীকরণ এবং সংস্কৃতিতায়ন অনুপস্থিত। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আচার-আচরণ, জীবনগঠনের শিক্ষা দেওয়ার পরিমাণ কম। এখনো শিক্ষা কারিকুলামে এগুলো যুক্ত করা হয়নি। পরিবারে একে অন্যের সঙ্গে ভাবের আদান-প্রদান কীভাবে করতে হয় এবং সম্পর্কে কীভাবে যত্নশীল হওয়া যায় তা না শিখেই দাম্পত্য জীবনে প্রবেশ করে যাচ্ছে।’

এ এস এম আমানুল্লাহ বলেন, চলতি বছরে প্রকাশিত বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যানুযায়ী দেশে বাল্যবিবাহ অনেক বেশি পরিমানে বেড়ে যাচ্ছে। সুতারং এই অঞ্চলের বেশিরভাগ মেয়ে বাল্যবিয়ের শিকার হওয়ার কারণে তার নেগোশিয়েশন স্কিল বা যেকোনো বিষয়ে যথাযথ আলোচনা করতে পারার দক্ষতা অর্জনের আগেই তার বিয়ে হয়ে যাচ্ছে। ফলে মেয়েটি সংসার জীবনে গিয়ে খেই হারিয়ে ফেলে। যদিও এই নেগোশিয়েশন স্কিল ছেলেদেরও প্রয়োজন রয়েছে। কিন্তু যেহেতু পুরুষশাসিত সমাজ সেহেতু আইন, আদালত, সমাজ এমনকি পরিবারের বয়োস্করাও পুরুষের পক্ষেই চলে যায়। ফলে অল্পবয়সী মেয়েটির নেগোশিয়েশন দক্ষতা কম থাকায় সবার সঙ্গে পেরে উঠে না। বাল্যবিয়ে ছাড়াও নিরক্ষরতা আরেকটি বড় সমস্যা। যদি একটি মেয়ে অন্তত মাধ্যমিকের ধাপ অতিক্রম করে বিয়ে করে তবুও সে পৃথিবী সম্পর্কে কিছুটা ধারণা তৈরি হয়। কিন্তু মাধ্যমিকের আগেই যখন বিশাল সংখ্যক নারী শিক্ষার্থী ঝরে পড়ে তখন তারমধ্যে জীবন গঠনের শিক্ষাটা থাকে না।’

দাম্পত্য জীবনে সুন্দর সম্পর্ক এগিয়ে নেওয়ার পরামর্শ দিয়ে ডা. মেখলা সরকার ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘পারস্পরিক মতবিরোধ ও দ্বন্দ জীবনেরই অবিচ্ছেদ্য অংশ। এর ফলে যে মানসিক চাপগুলো কাজ করে সেগুলোও স্বাভাবিক। তবে মূল জায়গাটি হলো মানসিক চাপ মোকাবিলা করা। অনেকের মানসিক চাপ মোকাবিলা করার ক্ষমতা কম। সেক্ষেত্রে শৈশবে বেড়ে ওঠার সময় সন্তানদের বাবা-মা কিভাবে বড় করছে সেটি বেশ গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। পরিবারের সদস্য হিসেবে একজন শিশু যখন দেখে যে বাবা মায়ের মধ্যে পারস্পরিক সম্মানের চর্চা রয়েছে পরবর্তী সময়ে বড় হয়ে সে তার সঙ্গীকেও সম্মান দেয়। ফলে প্রথমেই পরিবারের শিক্ষার বিষয়টি আসে। কিন্তু যে পরিবারের সদস্যরা নিজেরাই শিক্ষিত না সেক্ষেত্রে তারা সন্তানকে কী শেখাবে। সেক্ষেত্রে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।

সম্পর্কে এমন অনাস্থা থেকে মুক্তি লাভের জন্য রাজনৈতিক এবং সামাজিক দায়বদ্ধতাকে নিশ্চিতকরণের পাশাপাশি সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বিপ্লবের প্রয়োজনও রয়েছে বলে মনে করেন সামাজিক বিশ্লেষককরা।

ড. এ এস এম আমানুল্লাহ ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘প্রথমেই স্বীকার করে নিতে হবে আমরা সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক উন্নয়নে পিছিয়ে আছি। এরপর রাজনৈতিক দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করতে হবে। এরপাশাপাশি দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা করে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বিপ্লব ঘটাতে হবে।’

দাম্পত্যজীবনে হত্যার মতো ঘটনা যারা ঘটায় ধরেই নেয়া যায় তারা মানসিকভাবে ভারসাম্যহীন অবস্থায় ছিলো। কারণ পারস্পরিক সম্পর্কের নিরন্তর বোঝাপড়ার উপর নির্ভরশীল দাম্পত্য জীবন। সেক্ষেত্রে মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কে স্বামী ও স্ত্রী দুজনেরই সুস্পষ্ট ধারণা থাকা এবং প্রয়োজনভেদে চিকিৎসা নেওয়ার চর্চাটি সবার থাকা উচিত। এছাড়া রাজধানী ও বিভাগীয় শহরাঞ্চলের পাশাপাশি গ্রামীণ জনপদেও মনোরোগ নিয়ে সচেতনতা না তৈরিতে গুরুত্বারোপ করা উচিত বলে মনে করেন মনোবিশ্লেষকরা।

মনোবিদ ডা. মেখলা সরকার বলেন, ‘এখন প্রত্যন্ত অঞ্চলেও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করতে দেখা যায়। পাশাপাশি মূলধারার গণমাধ্যমেরও মানসিক স্বাস্থ্য সচেতনায় বেশ ভূমিকা রাখতে পারে। যতবেশি প্রচার করবে তত বেশি প্রসার হবে। ক্রমাগত চেষ্টায় একটা সময় প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মধ্যে মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে সচেতনতা তৈরি হবে। কারণ গত পাঁচ থেকে দশ বছর ধরে শহরকেন্দ্রিক যে সচেতনতা তৈরি হয়েছে সেক্ষেত্রে মূলধারার গণমাধ্যম বড় ধরণের ভূমিকা রেখেছে। এদিকে দাম্পত্য জীবন যাদের রয়েছে তাদেরও মানসিক স্বাস্থ্যের জ্ঞান নেওয়ার বিষয়ে উদার হতে হবে।’

(ঢাকাটাইমস/২৫ফেব্রুয়ারি/টিএ)

google news ঢাকা টাইমস অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি ফলো করুন

মন্তব্য করুন

শীর্ষ খবর সর্বশেষ জনপ্রিয়
সব খবর
জিয়াউর রহমানের জন্মবার্ষিক উপলক্ষে গফরগাঁওয়ে কম্বল বিতরণ
রাশিয়ার ওপর উচ্চ মাত্রার কর-শুল্ক ও নিষেধাজ্ঞার হুমকি ট্রাম্পের
জুলাইয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ৯ দফাতে সরকারের পতনের দাবি ছিল না: জুয়েল
প্রয়োজনে এনটিআরসিএ’র মাধ্যমে একসঙ্গে নিয়োগ-এমপিওভুক্তি: শিক্ষা উপদেষ্টা
বিশেষ প্রতিবেদন তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা