সৌহার্দপূর্ণ আলোচনায় শিক্ষার্থীদের আন্দোলন নিষ্পত্তি হোক
একটি শান্তিপূর্ণ আন্দোলন কীভাবে সহিংস-আন্দোলনে রূপ নিতে পারে তার জ¦লন্ত প্রমাণ হলোআনিসুর রহমান খান চলমান কোটাবিরোধী বা কোটা-সংস্কার আন্দোলন। আর একটি আন্দোলনও যেকোনো মূল্যবান সম্পদের মতো দুর্র্র্বৃত্তদের দ্বারা ছিনতাই হয়ে যেতে পারে তারও প্রমাণ শিক্ষার্থীদের এই আন্দোলন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালসহ দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীর কোটা-সংস্কার নিয়ে একটি শান্তিপূর্ণ আন্দোলনই করে যাচ্ছিল। প্রথমত সরকার এই আন্দোলনকে পাত্তা দেয়নি, পরে তারা এই আন্দোলন ভয়াবহ রূপ নিলে তা সমাধান করতে এমন কোনো উদ্যোগ নেই যা করেনি। বলা যায় শেষ পর্যন্ত সরকারের সকল দাবি মেনে নেওয়ার পরও এখনো আন্দোলন শেষ হয়ে যায়নি। আন্দোলন থেকে সৃষ্ট নতুন নতুন ইস্যু নিয়ে তারা এখনো রাস্তা দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। এটা কবে কখন কোন দাবি মেনে নেওয়ার মধ্য দিয়ে চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হবে তাও বুঝা যাচ্ছে না। এরই মধ্যে দুই শতাধিক মানুষের প্রাণহানিসহ যে পরিমাণ ধ্বংসযজ্ঞ চালানো হয়েছে বিভিন্ন স্থাপনা ও সম্পদে তার বিশাল ক্ষতি কোনোদিনই পূরণ হবার নয়।
গত জুলাই মাসের দ্বিতীয়ার্ধে রাজধানীসহ সারা দেশে যে পরিমাণ ধ্বংসযজ্ঞ চালানো হয়েছে তা এক কথায় অবর্ণনীয়। পেশাদার দুস্কৃতিকারীদের সুপরিকল্পিত প্রক্রিয়া ছাড়া এ ধ্বংসযজ্ঞ বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়। সরকার তার সর্বশেষ শক্তি সেনাবাহিনী মোতায়েন করে, কারফিউ জারি করে পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু জানমালের যে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে তা আর কখনোই পূরণ করা সম্ভব নয়। বিভিন্ন সরকারি স্থাপনায় ভাঙচুর চালিয়ে, অগ্নিসংযোগ করে যে ধ্বংসযজ্ঞ ঘটানো হয়েছে তা দেশের অর্থনীতিকেও থমকে দিয়েছে। নির্দিষ্ট একটি দাবিতে সংগঠিত নিয়মতান্ত্রিক ছাত্র আন্দোলনে এ ধরনের ধ্বংসযজ্ঞ চালানো সম্ভব নয় বলে মনে করছেন অভিজ্ঞমহল। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, ছাত্র আন্দোলনে অনুপ্রবেশকারী সরকারবিরোধী একটি গোষ্ঠী এসব নাশকতার জন্য দায়ী। জামাত-শিবির ও বিএনপির প্রতিই সরকার অঙ্গুলি নির্দেশ করছে। সরকারের এ অভিযোগ অমূলক নাও হতে পারে। কারণ সরকারের প্রতি চাপপ্রয়োগকারী যেকোনো আন্দোলনে সরকারবিরোধী পক্ষ যুক্ত হবেÑ এটাই স্বাভাবিক। অন্যদিকে কোটাবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মুখপাত্রগণ বলেছেন, তারা কোনো নাশকতার সঙ্গে যুক্ত নন এবং কোনো নাশকতার দায় তারা নিবেন না। এ কথায় যুক্তি আছে। অনুপ্রবেশকারী গোষ্ঠী নাশকতা করলে নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনকারী ছাত্রসমাজ তার দায় কেন নিবেন? অবশ্য সরকারও ছাত্রসমাজকে দায়ী করছেন না। আন্দোলনে অনুপ্রবেশকারী দুর্বৃত্তদেরকেই সরকারের পক্ষ থেকে দায়ী করা হচ্ছে। কারা এই দুর্বৃত্ত? উপযুক্ত তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে তাদেরকে খুঁজে বের করে বিচারের আওতায় নিয়ে আসার চ্যালেঞ্জ এখন সরকারকে গ্রহণ করতে হবে।
সর্বশেষ জাতীয় নির্বাচনের পর থেকে বিরোধীপক্ষ সরকার পতনের আন্দোলন করে আসছিল। জামাত-শিবির ও বিএনপিসহ সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো সরকারকে চাপসৃষ্টিকারী যেকোনো তৎপরতায় সমর্থন দিয়ে আসছিল। সাধারণ শিক্ষার্থীদের কোটা সংস্কার আন্দোলনে বিএনপি প্রকাশ্যেই সমর্থন জানিয়েছে। এসব বিবেচনায় জামাত-শিবির-বিএনপিসহ সমমনা দলগুলো সাম্প্রতিক নাশকতায় দায় এড়িয়ে যেতে পারে না। তাই বলে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে বিরোধীপক্ষকে ঘায়েল করার অভিপ্রায় নিয়ে ঢালাওভাবে গ্রেফতার করাও ঠিক হবে না। ক্ষমতাসীন দলেও দুস্কৃতিকারী দুর্বৃত্ত আছে। তাদের নির্যাতন-নিপীড়ন ও দুর্নীতিতে সাধারণ মানুষ এখন দিশেহারা। ক্ষমতাসীন দলে থাকা এসব দুর্বৃত্তদেরও বিচার করতে হবে। কোটা সংস্কার আন্দোলনে ছাত্রলীগের যে কোণঠাসা অবস্থা লক্ষ করা গেছে তাতে একটি কথা পরিষ্কার যে, সাধারণ ছাত্ররা এখন ছাত্রলীগকে আর সমীহ বা পছন্দ করছে না।
প্রথম থেকেই শিক্ষার্থীদের কোটা-সংস্কার আন্দোলন চলাকালীন বিভিন্ন মহল থেকে প্রশ্ন ওঠেছে যে- ৫৬% সরকারি চাকরিই যদি কোটা দ্বারা পূরণ করা হয় তাহলে দেশের অগণিত মেধাবীদের অবস্থান কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়। তারা সারাজীবন কষ্ট স্বীকার করে বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রি অর্জন করে যদি অপেক্ষাকৃত কম মেধাবীর নিকট এসে শেষ পর্যন্ত হেরে যায় তাহলে তাদের মধ্যে এই ক্ষোভ তৈরি হওয়াই কি স্বাভাবিক নয়। বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে প্রথম শ্রেণির একটি সরকারি চাকরিকে ধরা হয় সর্বোচ্চ প্রাপ্তি হিসেবে। সরকারি এই মহার্ঘ্যরে বিপরীতে একজন শিক্ষার্থী জীবনভর কঠোর পরিশ্রম করে সেই যোগ্যতাও হয়তো অর্জন করলো কিন্তু বাঁধ সাধে যদি কোটা পদ্ধতি তাহলে তার সারা জীবনের সমস্ত কষ্ট স্বীকারের আর কী দাম রইলো। এই সবকিছু মিলে দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষার্থীদের মধ্যে যে চাপা ক্ষোভ বিরাজ করছিল তারই বিস্ফোরণ এই কোটা-সংস্কার আন্দোলন। কিন্তু অতীব দুঃখের বিষয় যে- প্রথমাবস্থায় সরকার পরোক্ষভাবে যেমন করে এই আন্দোলন ব্যর্থ করে দেবার চেষ্টা করেছে তাতে সরকারের এই কাজের ফল আরো বিপরীত দিকে চলে গিয়েছে। পুলিশ ও ছাত্রলীগ কর্মীদের দ্বারা সরকার আন্দোলনকারীদের ওপর যে প্রক্রিয়ায় নির্যাতন চালিয়ে শিক্ষার্থীদের শান্তিপূর্ণ আন্দোলনকে ভণ্ডুল করার চেষ্টা করা হয়েছিল তাতে সরকার-পক্ষীয় বুদ্ধিজীবী অর্থাৎ খাস আওয়ামী লীগের লোকরাও বিষয়টিকে অত্যন্ত ন্যক্কারজনক বিষয় হিসেবে প্রতিপন্ন করছে। আসলে কোনোভাবেই সরকারের শিক্ষার্থীদের এই ন্যায়সংগত আন্দোলনটিকে দমনপীড়ন দ্বারা ভণ্ডুল করার চেষ্টা ঠিক হয়নি। এটা সরকারের যে সম্পূর্ণই অদূরদর্শিতার ফল তা এখন সকলেই অনুধাবন করতে সমর্থ হচ্ছে।
আন্দোলনের এক পর্যায়ে গত ১৮ই জুলাই, বিক্ষোভকারীরা জরুরি পরিষেবার যানবাহন ব্যতীত দেশব্যাপী সম্পূর্ণ বন্ধের ডাক দেয়। এসময় রাজধানীর বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী এবং মাধ্যমিক স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের সাথে যোগ দেয়। পরিস্থিতি খারাপ হওয়ার সাথে সাথে বাংলাদেশের আইনমন্ত্রী গণমাধ্যমের সামনে উপস্থিত হয়ে ঘোষণা দেন যে- সরকার আন্দোলনকারীদের সাথে আলোচনা করতে প্রস্তুত। তা সত্ত্বেও শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সংঘর্ষ অব্যাহত থাকে।
বিরোধী দল বিএনপি ও জামায়াত ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে মিল রেখে বিক্ষোভ করার ঘোষণা দিলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। এভাবেই শিক্ষার্থীদের কোটা সংস্কার আন্দোলনকে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর ক্যাডাররা ছিনতাই করে। এর ফলে যারা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির চেষ্টা করেছিল তারা সফল হয়। ছাত্র আন্দোলনকে ব্যবহার করে তারা সরকারবিরোধী আন্দোলনের পালে হাওয়া দিতে চেয়েছিল। তারা দেশের অনেক ক্ষতি সাধন করলেও সরকার পতন ঘটাতে তারা ব্যর্থ হয়েছে। তারা আবারও যে মরণ কামড় দেওয়ার চেষ্টা করবে তা বলাই বাহুল্য। গত বৃহস্পতিবার এক সরকারি প্রজ্ঞাপনে রাষ্ট্রবিরোধী বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী এবং তাদের সকল অঙ্গ সংগঠনকে বাংলাদেশের রাজনীতিতে নিষিদ্ধ করেছে সরকার। এখানেও যে তারা আবার মরণ কামড় দেওয়ার চেষ্টায়ই থাকবে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তারা তাদের আশ্রয়দাতা বিএনপিসহ নতুন নতুন প্লাটফরম তৈরির চেষ্টা চালাবে। এটাকে রোধ করতে হবে। দেশের শত্রু ও দেশবিরোধী এই গোষ্ঠীকে সামাজিকভাবেও প্রতিরোধ করতে হবে। আর সরকারের প্রতি অনুরোধ করছি যেন তারা শিক্ষার্থীদের সাথে আলোচনায় বসে চলমান সংকটকে নিরসন করে। আমি বিশ্বাস করি, যেকোনো গঠনমূলক আলোচনার মাধ্যমে যেকোনো ধরনের সমস্যাই সন্তোষজনক সমাধানে পৌঁছাতে পারে।আনিসুর রহমান খান: কলাম লেখক, গীতিকবি ও সংগঠক