শেখ হাসিনার সাড়ে ১৫ বছর: রাষ্ট্রপতির ক্ষমায় ফাঁসির আসামি মুক্তির মিছিল

আওয়ামী লীগের আমলে প্রাত্যহিক সন্ত্রাস, গুম-খুনের সঙ্গে যেন পাল্লা দিয়েছিল রাষ্ট্রপতির ক্ষমা। খুনের দায়ে ফাঁসির দণ্ড পাওয়া শীর্ষ সন্ত্রাসীরা এই ক্ষমা পেয়ে হাসতে হাসতে বেরিয়ে গেছে কারাগার থেকে। দেশের বিচারব্যবস্থা আর ন্যায্যতাকে উপেক্ষা করে রাষ্ট্রপতির ক্ষমার মিছিল লেগেছিল তখন।
তথ্যানুসন্ধান বলছে, স্বাধীনতার পর থেকে ১৯৮৭ সাল পর্যন্ত কোনো আসামি রাষ্ট্রপতির ক্ষমা পায়নি। এরপর ২০০৮ সাল পর্যন্ত ২০ বছরে মাত্র তিনজন ফাঁসির আসামি রাষ্ট্রপতির ক্ষমা পায়। কিন্তু শেখ হাসিনার মহাজোট সরকারের পাঁচ বছরে ২৮ জন ফাঁসির আসামির সাজা মওকুফ করেন রাষ্ট্রপতি।
২০১০ সালের সেপ্টেম্বরে এক গণক্ষমায় ২০ জন ফাঁসির আসামিকে মুক্তি দেন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান। নাটোরের যুবদল নেতা সাব্বির আহমেদ গামা হত্যা মামলায় সাজাপ্রাপ্ত এই কয়েদিদের প্রায় সবাই আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী।
অবশ্য ক্ষমার শুরুটা তার আগের বছর। ২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নিয়েই জিল্লুর রহমান জাতীয় সংসদের তৎকালীন উপনেতা সাজেদা চৌধুরীর ছেলে শাহাদাব আকবরকে ক্ষমা করেন। চার মামলায় পলাতক শাহাদাবকে ১৮ বছরের কারাদণ্ড এবং ১ কোটি ৬০ লাখ টাকা জরিমানা করেছিলেন আদালত।
লক্ষ্মীপুর জেলা বিএনপির নেতা আইনজীবী নুরুল ইসলাম অপহরণ ও হত্যা মামলায় আওয়ামী লীগ নেতা আবু তাহেরের ছেলে আফতাব উদ্দিন বিপ্লবের মৃত্যুদণ্ড দেন আদালত। গডফাদার বাবার মতোই সন্ত্রাসে হাত পাকানো এই বিপ্লব ২০১১ সালে আত্মসমর্পণ করলে বাবা তাহের ছেলের প্রাণভিক্ষা চান রাষ্ট্রপতির কাছে। জিল্লুর রহমান তার রাজনৈতিক জীবনে তাদের বাড়িতে অনেক গেছেন, তাদের আপ্যায়নও পেয়েছেন। মওকুফ হয়ে যায় বিপ্লবের মৃত্যুদণ্ডের সাজা।
এরপর ক্ষমার মালিক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ। ক্ষমা পান শীর্ষ সন্ত্রাসী জোসেফ। তার আরেক পরিচয়, সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদের ভাই তিনি। দুটি খুনের মামলায় তার যাবজ্জীবন ও মৃত্যুদণ্ডের সাজা মওকুফ করেন রাষ্ট্রপতি। ২০১৮ সালের ২৭ মে মুক্তি পান এই শীর্ষ সন্ত্রাসী।
এভাবে একের পর এক মৃত্যুদণ্ড মওকুফের ঘটনা দেশের ইতিহাসে আর নেই। সাবেক রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান একাই চার বছরে ক্ষমা করেন ২১ জন ফাঁসির আসামিকে।
আরেক সাবেক রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদও কম-বেশি বজায় রাখেন সেই ধারা। তথ্যানুসন্ধানে দেখা যায়, শেখ হাসিনা সরকারের টানা সাড়ে ১৫ বছরে রাষ্ট্রপতির বিশেষ ক্ষমা পাওয়া সবাই আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী।
আরও কিছু ক্ষমার কথা দেখা যাক। জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জ উপজেলার আবদুর রাজ্জাক হত্যা মামলার প্রধান আসামি ছাত্রলীগ নেতা আহসান হাবীব টিটুর যাবজ্জীবন সাজা মওকুফ করেন রাষ্ট্রপতি।
২০১৫ সালে ফরিদপুরের সদরপুর উপজেলা যুবলীগের সাবেক সভাপতি আসলাম ফকির রাষ্ট্রপতির ক্ষমায় মুক্তি পেয়ে আবার হত্যা মামলার প্রধান আসামি হন। এভাবে দলীয় বিবেচনায় রাষ্ট্রপতির ক্ষমা চলতেই থাকে।
রাষ্ট্রপতিকে এই ক্ষমতা দিয়েছে সংবিধানের ৪৯ অনুচ্ছেদ। আদালতের যেকোনো দণ্ড মওকুফ, স্থগিত বা কমানোর ক্ষমতা আছে রাষ্ট্রপতির। কিন্তু সেই ক্ষমতা এর আগে খুব কম সময়ই ব্যবহৃত হয়েছে দেশে।
নামে রাষ্ট্রপতির ক্ষমা হলেও আসলে এই ক্ষমা করার মালিক প্রধানমন্ত্রী। সংবিধানের ৪৯ নম্বর ধারায় যদিও রাষ্ট্রপতিকে এই ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে, একই সাথে ৪৮ নম্বর ধারায় প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শে এই ক্ষমতা প্রয়োগের নির্দেশনা আছে। প্রকৃতপক্ষে প্রধানমন্ত্রী ও প্রধান বিচারপতি নিয়োগ ছাড়া বাকি সব দায়িত্ব প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শে পালন করেন রাষ্ট্রপতি।
স্বাধীনতার পর ১৯৭২ থেকে ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত রাষ্ট্রপতির ক্ষমা পায়নি কোনো আসামি। ১৯৮৭ সালে এরশাদের আমলে দেশে প্রথম কোনো ফাঁসির আসামি রাষ্ট্রপতির ক্ষমায় মুক্তি পায়। গাজীপুরের আওয়ামী লীগ দলীয় সাবেক সংসদ সদস্য মেহের আফরোজ চুমকির বাবা ময়েজউদ্দিন খুনের ঘটনায় আজম খানকে ক্ষমা করেন এরশাদ।
বিএনপি-জামায়াতের চারদলীয় জোট সরকারের পাঁচ বছরে রাষ্ট্রপতির ক্ষমা পান দুজন। মহিউদ্দিন ঝিন্টু নামের একজন এবং সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে ফাঁসির এক আসামিকে ক্ষমা করেন রাষ্ট্রপতি।
২০১৪ সালের মার্চে সংসদ অধিবেশনে জাতীয় পার্টির পীর ফজলুর রহমানের এক প্রশ্নের জবাবে তৎকালীন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান জানান, মহাজোট সরকারের পাঁচ বছরে ২৮ জন ফাঁসির দণ্ড পাওয়া আসামির সাজা মওকুফ করেন রাষ্ট্রপতি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাষ্ট্রপতি যদি দণ্ডপ্রাপ্ত কাউকে ক্ষমা করে দেন, সে ক্ষেত্রে মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হতে পারেন বিচারপ্রার্থী মানুষ।
গত বছরের ২৫ আগস্ট ব্যারিস্টার ওমর ফারুক ১৯৯১ থেকে ২০২৪ সালের জুলাই পর্যন্ত কতজনের সাজা মওকুফ, স্থগিত বা হ্রাস করেছেন রাষ্ট্রপতি, তার তালিকা প্রকাশের জন্য লিগ্যাল নোটিশ পাঠান। স্বরাষ্ট্র, আইন, মন্ত্রিপরিষদ ও রাষ্ট্রপতির কার্যালয়ের সচিবকে নোটিশ দেওয়া হলেও কোনো উত্তর মেলেনি।
(ঢাকাটাইমস/২০জানুয়ারি/এসএস/এজে)

মন্তব্য করুন