কাপড়ের ব্যবসায় বিরাট ঠকবাজি
আমি বরাবর ঈদের শেষ মূহূর্তে কেনাকাটা করি। কারণ কাজের চাপে সময় পাওয়া য়ায় না।
গতকাল শনিবার অফিস করে রাত আটটায় গেলাম গাউসিয়া, নিউমার্কেট ও হকার্স মার্কেটে। হকার্স মার্কেটে ঢুকলাম মায়ের জন্য একটা জামদানি শাড়ি কিনব বলে। ছোট ভাইয়ের অনেকদিনের ইচ্ছা, নিজের আয়ের টাকা দিয়ে মায়ের জন্য একটা জামদানি শাড়ি কিনবে। আমারও ইচ্ছা একটা কেনার।
গত পাঁচ বছর ধরে যতবারই মায়ের জন্য শাড়ি কিনতে গেছি, ততবারই জামদানির দোকানে ঢু মেরেছি। কিন্তু আমার পছন্দের শাড়িটির দাম শুনে মনে হতো মুখ লুকিয়ে মার্কেট থেকে বের হয়ে যাই। দাম হতো তার ১৫ হাজার, ২০ হাজার, ২৫ হাজার টাকা বা তারও বেশি। কোন রকমে দামটা ১০ হাজারের নীচে বললেও বিক্রেতা এমনভাবে অপমান করে কথা বলতেন যেন মনে হতো লজ্জায় মুখ লুকাই, অথবা সব কিছু বিক্রি করে দিয়ে ওই টাকাতেই কিনে নিয়ে নিজের সম্মান বাঁচাই।
কিন্তু এবার ভিন্ন চিত্র। গতকালও একটু ভয়ে দোকানে গেলাম, আবার অপমান হতে হয় কি না তাই। আমি কয়েকটা দোকানে ঘুরলাম, কম দামি, বেশি দামি অনেক শাড়ি দেখছি। মাঝে মাঝে হাত দিয়ে একটু ছুঁয়ে পরীক্ষা করছি কাপড়ের কাজ ও সুতা।
বিক্রেতারা সুন্দর ব্যবহার করে বসতে বললেন। আবার কেউ কেউ একটার পর একটা শাড়ি নামাতে থাকলেন, তাদের ভালো ব্যবহার দেখে মনে একটু সাহস পেলাম। গত কয়েক বছর ধরে যে শাড়িগুলো দেখে কিনতে চেয়েছিলাম সেগুলোর কয়েকটা দেখে দাম জিজ্ঞেস করলাম। কোনটা ১৫ হাজার, কোনটা ১০ হাজার চাইলেন বিক্রেতা।
আগে থেকে একটু কম দেখে একটু জোড় পেলাম মনে। তাছাড়া গত দুই বছর অনলাইনে ব্যবসা করে শাড়ি ও পোশাকের দাম সম্পর্কে আমারও কিছুটা ধারণা হয়েছে। তাই আমি যে কয়টা শাড়ি গত কয়েক বছর ধরে দেখছিলাম সেগুলোর দাম বললাম মাত্র দুই হাজার টাকা।
কোথায় ১০/১৫ হাজার কোথায় দুই হাজার! ভাবলাম, হয়ত এখন বিক্রেতা অপমান করবে। কিন্তু না, কোন বিক্রেতাই খারাপ ব্যবহার করলেন না।
একজন এক দাম সাড়ে সাত হাজার টাকা বলে দিলেন। আমি ২৫০০ বলে চলে আসার পর তিনি তিন হাজারের একটু বেশি হলে দিয়ে দেবেন বললেন।
পরে আরও কয়েকটা দোকান ঘুরলাম। তার চেয়ে একটু ভালো শাড়ি ১৪ হাজার টাকা দাম চাইলেন অনেকে। শেষে দরদাম করে তিন হাজার টাকায় কিনলাম আমার সেই পছন্দের শাড়িটি!
বিষয়টি অবাক করা হলেও গতকাল তাই ঘটেছে। ক্রেতা না পেয়ে লোকসানের অংক না গুণে কোনোরকম লাভ করেই বিক্রি করে দিচ্ছিলেন বিক্রেতারা।
এক ক্রেতাকে দেখলাম ৫৫০০ টাকায় কিনলেন আমার পছন্দের শাড়ির চেয়ে কিছুটা নিম্নমানের। আবার আরেক দম্পতি ৭০০ টাকায় কিনলেন যে শাড়ি, যার দাম হাঁকা হয়েছিল তিন হাজার টাকা। এবার আসি থ্রি পিস নিয়ে।
ছয় মাস আগে একটি একটি সুতি হালকা কাজের থ্রিপিস কিনলাম ১২০০ টাকা দিয়ে, কিন্তু দোকানে ট্যাগ লাগানো ছিল ২২০০ টাকা।
একই দোকানে ভিন্ন রঙ এর একই থ্রি পিস ২২০০ টাকা ফিক্সড প্রাইস লেখা দেখলাম। আমি ১২০০ টাকায় কিনেছি জানালেও লাভ হলো না। ১৫০০ টাকা বললেও এক চুল পরিমাণ কম নেই বলে জানালেন।
অথচ এই ২২০০ টাকায় আমি ভারতীয় একটি জমকালো নকশার পোশাক কিনতে পারি। কারণ, আমার অনলাইনের জন্য ভারী কাজ করা থ্রি পিস আমি পাইকারি ২২০০ টাকায় কিনেছি, তা বিক্রেতারা খুচরা বিক্রি করেন ৫০০০ টাকায়! আর ভারতে তা বিক্রি হয় ৯০০-১০০০ রুপিতে।
আবার সেখানেও আছে প্রতারণা। ভরতীয় পোশাকগুলো তো রেপ্লিকা হয়ে যাচ্ছে। রেপ্লিকা হচ্ছে অবিকল ভারতীয় ডিজাইনের নকল। তবে সফট জর্জেট, মার্বেল জর্জেট বা মোলায়েম সুতি কাপড়ের বদলে ব্যবহার করা হয় কমদামি শক্ত কাপড়, সুতি মিক্সড, লিলেন কাপড়, যার রঙ উঠে যায় ও ফেঁসে যায়। কারিগররা এসব পোশাকের ছবি দেখে বা একনজর দেখেই তা বানিয়ে ফেলতে পারেন।
রেপ্লিকা যেমন মার্কেটগুলোতে বিক্রি হচ্ছে তেমনি অনলাইনেও বিক্রি হচ্ছে দেদারসে। এগুলো তৈরি করতে খরচ যায় ২০০\৩০০ টাকা, কিন্তু অরিজিনাল বলে বিক্রি করা হয় ২০০০ থেকে ৪০০০ টাকা পর্যন্ত।
গাউসিয়া মার্কেটের উপরের তলাগুলোতেই এগুলো বেশি তৈরি হয়।
মার্কেটে কেনার সময় অনেকেই কাপড় আর ডিজাইন নিজ হাতে ধরে চেক করে দেখেন, কেউ যদি কখনো তার পছন্দের পোশাকটির অরিজিনাল কপি ধরে দেখার সুযোগ পান তাহলে তাৎক্ষণিক বুঝতে পারেন ওই পোশাকটি অরিজিনাল নাকি নকল। তা না হলে অধিকাংশ মানুষই নকলটাকেই মনে করেন অরিজিনাল।
গত তিনবছর ধরে অনলাইনে ওইসব ভারতীয় পোশাকের রেপ্লিকা অরিজিনাল ভারতীয় পোশাকের নামে বিক্রি করা হয়েছে।
আমার অনলাইন ব্যবসার সুত্র ধরে এক পরিচিত অনলাইন ব্যবসয়ীকে বললাম, ‘আপনার সবগুলো প্রোডাক্টই তো রেপ্লিকা, কিন্তু কাস্টমারদের কেন রেপ্লিকা না বলে অরিজিনাল বলছেন? রেপ্লিকা বলে দিলেই তো হয়?’
ওই ব্যবসায়ী বললেন, ‘যদি রেপ্লিকা বলি তাহলে তো কেউ কিনবেন না।’
বললাম, ‘এটা তো মিথ্যা হয়ে গেল। এটা ঠিক না।’
বললেন, ‘ব্যবসা করতে গেলে এত কিছু ভাবলে চলে না। তাছাড়া বুঝতে পারে না অনেকে, কেউ কেউ বুঝলেও রিটার্ন করার তো সুযোগ নাই, বুঝাই দেই একটা।’
তার কথা শুনে রীতিমত ‘থ’। কিন্তু আমি রেপ্লিকা পোশাক নেইনি। নিজের অনলাইন ব্যবসা থাকবে রেপ্লিকামুক্ত। কিন্তু যখনই মার্কেট ঘুরলাম এবং ভারতীয় কিছু কোম্পানির সঙ্গে যোগাযোগ করলাম। তাদের তৈরি করা পোশাকগুলো দেশীয় মার্কেটে খোঁজ নিতে গিয়ে দেখলাম, যেসব ভারতীয় পোশাকগুলোর ডিজাইন ও কাজ খুব সুন্দর সেসবের একটারও অরিজিনাল নাই! এমনকি বাংলাদেশে অরিজিনালগুলো আসার আগেই সেগুলো নকল করে বিক্রি করা শুরু।
অনেক পাইকারি বিক্রেতার কাছে এর অরিজিনাল কপি চাইলাম, কিন্তু তাদের ভাবটা এমন ছিল যেন আমি এটা চেয়ে বড় অন্যায় করে ফেলেছি। ব্যবসায়ী হয়েও অনভিজ্ঞ, অপরিপক্ক। আমি জানিই না যে এখানে অরিজিনাল কপি না, রেপ্লিকাই অরিজিনাল। অরিজিনাল পাওয়া গেলেও তা কয়েক মাস পর।
পাইকারি ব্যবসায়ীরা বললেন, ভারতে তৈরি করার পরপরই তা বাংলাদেশে নকল হয়ে যায়। তাছাড়া ভারত থেকে ভ্যাট ট্যাক্স দিয়ে না এনে যদি ছবি দেখে বা পোশাক দেখে একদিনেই অবিকল বানাতে পারে আর তা বিক্রি করে যদি মালিকপক্ষ বেশি লাভবান হয়, তাহলে কেন তারা ভারতের অরিজিনাল পোশাক আনবেন।
তাছাড়া এগুলো কম দামে পেয়ে মানুষ বেশি কেনে। অরিজিনাল আসতে আরও দুই মাস লাগবে। তাছাড়া ক্রেতারা তো বুঝে না কোনটা আসল, কোনটা নকল।
বিক্রেতারা বলছেন দামি কাপড়ের ক্রেতা নাই। কিন্তু দামি কাপড় কোনটা? ১৪ হাজার টাকা দামেরটা নিশ্চয় সস্তা নয়। কিন্তু আসলে কি তার দাম ১৪ হাজার টাকা ছিল নাকি তিন হাজার টাকা দামের কাপড়টাই ১৪ হাজার টাকা দাম রেখে দামি বলা হচ্ছে? ৭০০ টাকার কাপড় তিন হাজার টাকায় বিক্রি করে বলা হচ্ছে দামি?
অর্থাৎ দামি কাপড় বলে বিক্রেতারা যা বুঝান, অধিকাংশ ক্ষেত্রে কমদামি সস্তা পোশাকের ১০ গুণ বেশি দাম রেখে বলা হয় দামি কাপড়।
গতকাল অফিস যেতে বাসের জন্য দাঁড়িয়ে থাকার সময় এক নারীকে লাইনে দাঁড়িয়ে উচ্চস্বরে রাগারাগি করতে শুনলাম। তার দিকে তাকিয়ে ভালো করে শুনলাম, তিনি এক অনলাইন হাউজের কর্মকর্তার সাথে রাগারাগি করছিলেন।
তিনি অনলাইন থেকে যে পোশাকটি অর্ডার করেছেন, বাস্তবে তা ছবির পোশাকের মত অবিকল দেখতে ডিজাইনের হলেও কাপড়ের সাথে কোন মিল নেই। তিনি এটা ফেরত দিতে চাইলেও তারা নিতে অপারগতা প্রকাশ করছেন।
হয়ত অনেকে বলবেন, দেশি পোশাক কেনা দেশের প্রতি প্রেম বা ভালোবাসা, কেন বিদেশি পন্যের দিকে ঝুঁকবে? কিন্তু দেশি পোশাক বেশি লাভের আশায় বিদেশি নামে বিক্রি করা কি দেশপ্রেম? সস্তা কাপড় দামি বলে চালানো কি দেশ প্রেম? তিন হাজার টাকার পণ্য ১৪ হাজারে বিক্রি করা কি দেশপ্রেম?
ব্রান্ডের নাম দিয়ে ক্রেতাদের গলাকাটা প্রতারণার কথা আগে থেকেই জানতাম। নিজের হাতে কাপড় ধরে দেখেছি কতটা নিম্নমানের কাপড় বেশিরভাগ। তাই কখনো আড়ং বা এই ধরনের ব্র্যান্ডের পোশাক কিনিনি। ইতিমধ্যে অনেকেই তাদের প্রতারণার কথা জানিয়েছেন, সেটায় আর না গেলাম।
সুন্দর আরামদায়ক ও কম দামে ভালো পোশাক কেনার অধিকার সবারই আছে। ভারতীয় পোশাকগুলোর কাপড়ের মান ও ডিজাইন যেমন ভালো তেমনি দামও সে তুলনায় কম।
কিন্তু এভাবে বারবার প্রতারিত হয়ে, দেশের মানুষ এখন যাচ্ছে ভারতে। ক্রেতাদের ঠকিয়ে অতিরিক্ত যে টাকা বিক্রেতারা নিয়ে নিতেন সেই টাকা দিয়ে অনায়াসে পরিবারসুদ্ধ ভারতে কেনাকাটা করতে পারেন। দেশ ঘুরা, হলো কেনাকাটাও হলো।
আর তাই ব্যবসায়ীরা এখন বসে বসে মাছি মারছেন আর ভবিষ্যতেও মারতে থাকবেন।
তবে বিক্রি যে একেবারে হচ্ছে না, তা নয়। তবে বিক্রেতারা রোজার মাস এলেই যে লাখ টাকা লাভের আশায় থাকেন, সেটা না করে কিছুটা কম লাভ করছেন এবার ক্রেতা কম হওয়ায়।
সামনে কী অবস্থা হবে বিক্রেতা ব্যবসায়ীদের? ভাববার সময় কি এখনো হয়নি?
লেখক: সাংবাদিক