নৈতিক মূল্যবোধই হতে পারে সুরক্ষা

মোহাম্মাদ আবু হুরাইরা
 | প্রকাশিত : ০৯ মার্চ ২০১৮, ১১:২৫

পাঠকদের মূল আলোচনায় নিয়ে যাবার আগে কয়েকটি তাত্ত্বিক (Theoretical) বিষয় নিয়ে কিছুটা পরিষ্কার ধারণা নেয়া যাক। হয়ত অনেকের কাছেই তাত্ত্বিক ধারণাগুলো গুরুত্ববহ হতে পারে, আবার নতুন করেও কিছুটা চিন্তা-চেতনা বা বিচার-বিবেচনায় স্থান করে নিয়ে নিতেও পারে। তাত্ত্বিক বিষয়সমুহ নিম্নরূপ নীতিশাস্ত্র (Ethics): নীতিশাস্ত্র দর্শনের একটি শাখা, যেখানে নৈতিকতা, ন্যায়-অন্যায়, ভালো-মন্দ নিয়ে আলোচনা করা হয়। নীতিশাস্ত্র তাত্ত্বিক দিকগুলোর সাথে সাথে এর ব্যবহারিক ও প্রায়োগিক দিক নিয়ে আলোচনা করে।

মূলত মানুষের ব্যবহারগত সম্পর্কের তাৎপর্যের বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা ও পর্যালোচনার ভিত্তিতে নীতিশাস্ত্র বিকাশ লাভ করেছে। নীতি (Principle) নীতি হলো ন্যায়-অন্যায় ও ভালো-মন্দের ধারণা। নীতি আপেক্ষিক এবং বলা যায় অনেকটাই ব্যক্তিক। নৈতিকতা (Morality) নৈতিকতা বা Morality শব্দটি ল্যাটিন শব্দ "moralis” থেকে আগত, যার বাংলা অর্থ চরিত্র, ভদ্রতা, সঠিক আচরণ। সেই অর্থে নৈতিকতা হল এমন একটি দর্শন যার প্রেক্ষিতে ভালো-মন্দ, ন্যায়-অন্যায়, সঠিক-ভুল প্রভৃতি বিষয়সমূহের মাঝে উদ্দেশ্য, সিদ্ধান্ত ও প্রতিক্রিয়াসমূহের মাধ্যে পার্থক্য ও পৃথকিকরণ যায়। নীতিশাস্ত্র মতে নৈতিকতাকে একটি আদর্শিক মানদণ্ড বলা যেতে পারে যা বিভিন্ন অঞ্চলের সামাজিকতা, ঐতিহ্য, সংষ্কৃতি, ধর্ম প্রভৃতির মানদণ্ডের উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে। আবার অনেক ক্ষেত্রে সামগ্রিকভাবে সমগ্র পৃথিবীর জন্য কল্যাণকর বিষয়সমূহকেও নৈতিকতা হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয়।

নৈতিক মূল্যবোধ (Moral Values) নৈতিক মূল্যবোধ মূলত একজন ব্যক্তির সেই নীতিকে নির্দেশ করে, যা তাকে সঠিক বনাম ভুলের মূল্যায়ন নিরুপণ করতে সাহায্য করে। নৈতিক মূল্যবোধই মানুষ ও পশুর মাঝে পার্থক্যের নির্দেশক। নৈতিক মূল্যবোধ সম্পন্ন কোনো মানুষ যা খুশি তা করতে পারে না। উন্নত জীব হিসাবে মানুষের যে অনন্য চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যসমূহ রয়েছে, যেমন ভালোমন্দ উপলব্ধি করার জন্য বিবেক, মানবিক গুণাবলী তা রক্ষা করাই হচ্ছে নৈতিক মূল্যবোধ চর্চার একমাত্র লক্ষ্য। শিক্ষা (Education) শিক্ষা বা ইংরেজি Education এসেছে ল্যাটিন শব্দ ‘educare’ বা ‘educatum’ থেকে। যার অর্থ ‘to lead out’ অর্থাৎ ভেতরের সম্ভাবনাকে বাইরে বের করে নিয়ে আসা বা বিকশিত করা। সাধারণ অর্থে জ্ঞান বা দক্ষতা অর্জনই শিক্ষা। ব্যাপক অর্থে পদ্ধতিগতভাবে জ্ঞানলাভের প্রক্রিয়াকেই শিক্ষা বলে।

সক্রেটিসের মতে শিক্ষার উদ্দেশ্য হলো মিথ্যার বিনাশ আর সত্যের আবিষ্কার। প্লেটোর মত হলো, শরীর ও আত্মার পরিপূর্ণ বিকাশ ও উন্নতির জন্য যা কিছু প্রয়োজন, তা সবই শিক্ষার উদ্দেশ্য অন্তর্ভুক্ত। শিক্ষা ও নৈতিকতা নৈতিকতার মূল ভিত্তিই হচ্ছে শিক্ষা তথা সুশিক্ষা। আর এই শিক্ষা অর্জিত হয় প্রথমত অনানুষ্ঠানিক মাধ্যম যথা পরিবার পরবর্তীতে সমাজ ও পরিবেশ এবং পর্যায়ক্রমে প্রাথমিক বিদ্যালয়, উচ্চ বিদ্যালয়, মহাবিদ্যালয়, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আনুষ্ঠানিক শিক্ষা গ্রহণ করা হয়।

চীনা দার্শনিক কুনফুশিয়াস বলে, ‘যদি তুমি এক বছরের পরিকল্পনা মতো ফল পেতে চাও তবে শস্য রোপণ করো, যদি দশকের পরিকল্পনার ফল পেতে চাও তবে বৃক্ষরোপণ করো, আর যদি সারা জীবনের জন্য পরিকল্পনা করে ফল পেতে চাও তবে সন্তানের জন্য সুশিক্ষার ব্যবস্থা করো।’ শিক্ষা ও নৈতিকতা একে অপরের পরিপূরক। দার্শনিক জন লক (Jhon Locke) এর মতে শিক্ষার লক্ষ্য হলো আদর্শ মানুষ তৈরি করা এবং এই আদর্শ মানবের চারটি গুণ হলো নৈতিক উৎকর্ষ, বিজ্ঞতা, সামাজিক সদাচার এবং বিদ্যা। লকের মতে এ চারটি গুণের মধ্যে নৈতিক উৎকর্ষ হলো সর্বপ্রধান। মূল আলোচনা আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় পরিবার হলো নৈতিক ও মানবিক গুণাবলি অর্জনের প্রথম ও প্রধান শিক্ষাগার, যেখানে একজন শিশুর নৈতিকতা ও মানবিক গুণাবলী বিকাশে পরিবারের ভূমিকাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। বাবা-মা, ভাই-বোন, পরিবার-পরিজন, আত্মীয়-স্বজন প্রত্যেক সদস্যই এখানে সক্রিয় শিক্ষকের ভূমিকা পালন করে। তাই শিশুদের নৈতিকভাবে বিকশিত করতে হলে পরিবারের সদস্যদেরকেও নৈতিক গুণসম্পন্ন হতে হবে। আমার ক্ষুদ্র অভিজ্ঞতা মতে, আমাদের সবারই নৈতিকতা নিয়ে কিছু না কিছু নিজস্ব প্রায়োগিক ধ্যান ধারণা গড়ে নিয়েছি। যার ব্যবহার আমরা আমাদের সুবিধামত স্থান, কাল, পাত্রভেদে তার প্রয়োগ করে থাকি যা নিজেদেরকে উচ্চাসনে উত্তরণের নিমিত্তে।

আমরা সুবিধামত নীতিশাস্ত্র, নীতিবাক্য, সততা, সহনশীলতা, অধিকার, কর্তব্য, মূল্যবোধ, ন্যায়পরায়ণতা ইত্যাদি বিষয়সমূহকে ধ্বনি মাধুর্যে কতই না আকর্ষণীয় করে তুলি অন্যের কাছে। সবাই নৈতিক অবক্ষয় ও তা থেকে উত্তরণের জন্য কতই না আহাজারি করছি। কিন্তু বাস্তবতা হল আমরা কখনোই নিজেদেরকে এই চারিত্রিক স্খলন থেকে বের করে না নিয়ে এসে, অন্যের উপর তার দায় চাপিয়ে নির্ভার হয়ে ‘করিতকর্মা (Smart) জীবনব্যবস্থা’ বেছে নিয়েছি। আমার ব্যক্তিগত পর্যবেক্ষণ হলো একজন ছাত্র ফাঁস হওয়া প্রশ্নের উপর কখনোই নির্ভরশীল হতো না, যদি না তাঁর অভিভাবক তাকে প্রভাবিত, প্ররোচিত, সম্মতি, অসুস্থ প্রতিযোগিতার চাপ চাপিয়ে না দিত। আমি বিশ্বাস করি এর দায় একান্তই পরিবারের।

নৈতিকতা আর নিজের সাথে নিজের কথোপকথন

প্রশ্ন: আচ্ছা, ঘুষ (দুর্নীতি) বাণিজ্যের সাথে কারা জড়িত?

উত্তর: সাধারণ মানুষ আর কিছু অসাধারণ মানুষ।

প্রশ্ন: তারা কারা?

উত্তর: একদল দেয় আর একদল নেয়।

প্রশ্ন: এই দলে কে কে থাকে?

উত্তর: আমি, আমরা, বাবা, মা, ভাই, বোন, চাচা, খালু, মামা, ফুফা আরও অনেকেই।

প্রশ্ন: উনারা কি করেন?

উত্তর: সরকারি-বেসরকারি চাকরি, ব্যবসা-বাণিজ্য, উকিল, মোক্তার, ডাক্তার, শিক্ষক, রাজনীতিবিদ আরও কত কি...

লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, আইইউবিএটি

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :