কিবরিয়া হত্যা: বিচার না পাওয়ার হতাশায় এক যুগ

পাবেল খান চৌধুরী, হবিগঞ্জ
| আপডেট : ২৭ জানুয়ারি ২০১৭, ১১:০১ | প্রকাশিত : ২৭ জানুয়ারি ২০১৭, ০৮:৩০

রাজনীতিতে সজ্জন ব্যক্তি হিসেবে পরিচিতি ছিল তার। অসাধারণ প্রতিভাবান হিসেবে তাকে অগ্রাহ্য করতে পারেনি কেউ। পাঁচ বছর অর্থমন্ত্রী থাকাকালে এতটুকু কালিমা লাগেনি গায়ে। এই মানুষটিকেই জনসভায় গ্রেনেড ছুড়ে হত্যা করা হয়েছে। প্রকাশ্যে ঘটা এই হত্যার বিচার করা যায়নি এক যুগেও। এ নিয়ে তার স্বজন, শুভানুধ্যায়ী, রাজনৈতিক সহকর্মী আর এলাকাবাসীর ক্ষোভ চরমে।

তিনি শাহ এ এম এস কিবরিয়া। অর্থনীতির ছাত্র হিসেবে সমাদৃত ছিলেন সারা বিশ্বেই। বাড়ি দেশের উত্তর পশ্চিমের ছোট্ট জেলা হবিগঞ্জে। রাজনীতিতে যোগ দিয়ে ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের অর্থমন্ত্রী হিসেবে সুনাম কুড়ান। পাঁচ বছর পর নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দলের ভরাডুবি হলেও কিবরিয়া এবং তার জেলায় নৌকার তিন প্রার্থী ভোটে জিতেন অবলীলায়।

এলাকায় কিবরিয়া ছিলেন ভীষণ জনপ্রিয়। বিরোধী দলে থাকার সময়ও তিনি নিজ এলাকার জনগণের জন্য কাজ করেছেন, ছুটে এসেছেন বারবার। সব শেষ গিয়েছিলেন ২০০৫ সালের ২৭ জানুয়ারি। শীতের বিকালে তিনি জনসভা করেছিলেন বৈদ্যেরবাজারে। এই শেষবার তাকে দেখতে পেয়েছে এলাকার মানুষ। জনসভা থেকে ফেরার পথে গ্রেনেড হামলায় ক্ষতবিক্ষত হন তিনি।

কিবরিয়াসহ আহতদের নিয়ে যাওয়া হয় হবিগঞ্জ সদর হাসপাতালে। আওয়ামী লীগ নেতারা ঢাকায় নিয়ে যেতে হন্যে হয়ে খোঁজ করেন একটি হেলিকপ্টারের। কিন্তু সে সময়ের জোট সরকার সেই ব্যবস্থা করেনি। পওে অ্যাম্বুলেন্সে করে কিবরিয়া ও আবু জাহিরকে ঢাকায় পাঠানো হয়। কিন্তু রাজধানীর হাসপাতালে আসার পর চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

ওই হামলায় কিবরিয়া, তার ভাতিজা শাহ মনজুরুল হুদা, আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুর রহিম, আবুল হোসেন ও সিদ্দিক আলী প্রাণ হারান। আহত হন কমপক্ষে ৭০ নেতাকর্মী।

কিবরিয়ার ছেলে রেজা কিবরিয়া বর্তমানে বিদেশে আছেন। তবে তার আমেরিকা প্রবাসী মেয়ে নাজলী কিবরিয়া দেশে এসেছেন। তিনিও এই মামলার বিচার দ্রুত শেষ করার দাবি জানিয়েছেন।

কিবরিয়ার ওপর গ্রেনেড হামলায় স্বামী আব্দুর রহিমকে হারিয়েছেন স্ত্রী আফিয়া খাতুন। এই পৃথিবী তার কাছে বিস্বাদ হয়ে গেছে। তিনি বলেন, ‘সরকারের কাছে কিছুই চাই না। মৃত্যুর আগে তার স্বামী হত্যার বিচার দেখতে চাই।’

নিহত ছিদ্দিক আলীর ছেলে কুদ্দুছ মিয়া বলেন, ‘বিচার তো শেষই হয় না। কবে খুনিদের শাস্তি হবে, আমি শান্তি পাবো।’

বিচার চলছে ১২ বছর ধরে

হামলার পরদিন আওয়ামী লীগ নেতা আবদুল মজিদ খান হত্যা ও বিস্ফোরক আইনে দুটি মামলা করেন। চারদলীয় জোট সরকার সেই মামলা ভিন্ন খাতে নেয়ার চেষ্টা করে বলে পরের তদন্তে উঠে আসে। এরপর একাধিকবার তদন্ত, পুনঃতদন্তের ‘ধকল’ নিতে পারছে না মামলাটি। দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে পাঠিয়েও মামলাটি শেষ করা যাচ্ছে না নানা জটিলতায়। মোট তিনবার তদন্ত হয়েছে মামলাটির। এরপর হবিগঞ্জ থেকে মামলাটি দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য পাঠানো হয় সিলেটের দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে। কিন্তু সেখানেও দীর্ঘসূত্রতায় পড়েছে শুনানি।

আদালত সংশ্লিষ্টরা বলেন, আসামি হাজির করতে না পারা, সাক্ষী আনতে না পারাসহ নানা কারণে শুনানি আগাচ্ছে না। এই মামলায় সাক্ষী করা হয় মোট ১৭১ জনকে। কিন্তু হবিগঞ্জ থেকে তাদেরকে সিলেটে আনা প্রায়ই সম্ভব হয় না।

আবার কিন্তু প্রায় সময়ই আসামি হাজির করা যাচ্ছে না। বিশেষ করে অন্য মামলায় লুৎফুজ্জামান বাবর ও মুফতি হান্নানের ফাঁসির রায় হয়ে গেছে। নিরাপত্তার জন্য তাদেরকে ঢাকা থেকে সিলেট আনা যাচ্ছে না। এ জন্য মামলাটি ঝুলে যাচ্ছে।

সিলেটের দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী কিশোর কুমার কর ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘মামলাটি সাক্ষ্য পর্যায়ে রয়েছে। ১৭১ জন সাক্ষীর মধ্যে ৪৩ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ হয়েছে। বেশ কয়েকদিন ধরে সাক্ষ্যগ্রহণ পিছিয়ে যাচ্ছে। কারণ আসামিদের উপস্থিত করা যাচ্ছে না। এ কারণেই মামলাটি এই আদালতেও দ্রুত নিষ্পত্তি করা যাচ্ছে না।’

তদন্তেই নয় বছর

জোট সরকারের আমল পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ- সিআইডির সহকারী পুলিশ সুপার মুন্সি আতিকুর রহমান ওই বছরের ২০ মার্চ অভিযোগপত্র জমা দেন। এতে তিনি জেলা বিএনপির সে সময়ের সহ-সভাপতি আবদুল কাইয়ুম, বিএনপির কর্মী ও ব্যাংক কর্মকর্তা আয়াত আলী, কাজল মিয়া, জেলা ছাত্রদলের সহ-দপ্তর সম্পাদক সেলিম আহমেদ, জিয়া স্মৃতি গবেষণা পরিষদ জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক সাহেদ আলী, বিএনপি নেতা জমির আলী, জয়নাল আবেদীন মোমিন বিএনপি কর্মী তাজুল ইসলাম, জয়নাল আবেদীন জালাল ও ছাত্রদল কর্মী মহিবুর রহমানকে অভিযুক্ত করা হয়।

বাদী আবদুল মজিদ খান ২০০৬ সালের ৩ মে সিলেট দ্রুত বিচার আদালতে নারাজি দেন। আদালত তার আবেদন খারিজ করলে ১৪ মে তিনি হাইকোর্টে আপিল করেন।

ফখরুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর এ মামলার অধিকতর তদন্ত হয়। দায়িত্ব দেয়া হয় সিআইডির সহকারী পুলিশ সুপার রফিকুল ইসলামকে। তিনি ২০১১ সালের ২০ জুন আরও ১৪ জনকে আসামি করে অভিযোগপত্র দেন।

সম্পুরক অভিযোগপত্রে নতুন যে ১৪ জনকে আসামি করা হয় তারা হলেন, জোট সরকারের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, হরকাতুল জিহাদ নেতা মুফতি আব্দুল হান্নান, লস্কর ই তৈয়বা সদস্য আব্দুল মজিদ কাশ্মীরি, জোট সরকারের উপমন্ত্রী আব্দুস সালাম পিন্টুর ভাই মাওলানা তাজউদ্দিন, মহিউদ্দিন অভি, শাহেদুল আলম দিলু, সৈয়দ নাঈম আহমেদ আরিফ, ফজলুল আলম মিজান, মিজানুর রহমান মিঠু, মোহাম্মদ আব্দুল হাই, মোহাম্মদ আলী, মুফতি সফিকুর রহমান, বদরুল এনায়েত মো. বদরুল ও বদরুল আলম মিজান।

২০১১ সালের ২৮ জুন কিবরিয়ার স্ত্রী আসমা কিবরিয়া এই অভিযোগপত্রের ওপরও নারাজি আবেদন করেন। তিনি বলেন, তদন্ত কর্মকর্তার দাখিলকৃত অভিযোগপত্রে উল্লেখ করা হয়, সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, চারদলীয় জোট সরকারের অন্যান্য মন্ত্রী ও নেতা কর্মীদের যোগসাজসে হরকাতুল জিহাদ সদস্যদের সহায়তায় ২১ আগস্ট আওয়ামী লীগের জনসভায় গ্রেনেড হামলা ছাড়াও, সিলেটের মেয়র বদর উদ্দিন কামরান, আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য জেবুন্নেছা হকের বাসা, বৃটিশ হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরী, আওয়ামী লীগ নেতা সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত এবং কিবরিয়ার উপর গ্রেনেড হামলা হয়েছে। কিন্তু বাবর ছাড়া জোট সরকারের অন্য কারো নাম অভিযোগপত্রে নেই।

২০১৪ সালের ১৩ নভেম্বর হবিগঞ্জের জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম রোকেয়া আক্তারের আদালতে কিবরিয়া হত্যা মামলার তৃতীয়বারের মতো সম্পূরক অভিযোগপত্র দাখিল করেন সিআইডি সিলেট অঞ্চলের তৎকালীন সিনিয়র এএসপি মেহেরুন নেছা পারুল। অভিযোগপত্রে নতুন ১১ জনকে অন্তর্ভূক্ত করা হয়।

এনে নতুন করে আসামি হন সিলেট সিটি করপোরেশনের বর্তমান মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী, হবিগঞ্জ পৌরসভার মেয়র জি কে গউছ, বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার সাবেক রাজনৈতিক উপদেষ্টা হারিছ চৌধুরী, মুফতি আব্দুল হাই, মুফতি তাজ উদ্দিন, মুফতি সফিকুর রহমান, মোহাম্মদ আলী, বদরুল, মহিবুর রহমান, কাজল আহমেদ, হাফেজ ইয়াহিয়া।

একই সঙ্গে আগের অভিযোগপত্রে আসামি করা ইউসুফ বিন শরীফ, আবু বক্কর আব্দুল করিম ও আহছান উল্লাহকে মামলা থেকে অব্যাহতির আবেদন করা হয়। ২০১৪ সালের ২১ ডিসেম্বর এই অভিযোগপত্র গ্রহণ করে আদালত। হত্যা মামলাটি সিলেটের দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে ঝুলে আছে গত দুই বছরেরও বেশি সময় ধরে।

জীবনের রঙ মুছে গেছে তাদের

বৈদ্যেরবাজার ট্র্যাজেডিতে অনেকই এখনও পঙ্গু অবস্থায় জীবন যাপন করছেন। সেই ভয়াল স্মৃতি এখনও তাদেরকে তাড়িয়ে বেড়ায়। জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আবু জাহির ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘আমি বেঁচে থাকার আশা ছেড়েই দিয়েছিলাম। ভারতে গিয়ে চিকিৎসা করে সুস্থ হলেও এখনও আমার গায়ে গ্রেনেডের শত শত স্পিøন্টার, পায়ে স্টিল লাগানো।’

স্ক্র্যাচে বড় দিয়ে চলাফেরা করেন আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুল্লাহ সরদার। তিনি বলেন, সেদিন বিকট শব্দের পর আমি অজ্ঞান হয়ে পড়ি। কিছুই মনে ছিল না আর। দীর্ঘ চিকিৎসায় সুস্থ হলেও কোনভাবে চলাফেরা করেন তিনি।

আহত আব্দুল আহাদ ফারুক বলেন, ‘আমি অল্পের জন্য প্রাণে রক্ষা পেয়েছি। তবে শরীরের যে বেদনা বইতে হয়েছিল তা ছিল কঠিন।’

আহত কুদ্দুছ মিয়া বলেন, ‘আমরা অনেক কষ্টে আছি। এখন আর কেউ আমাদের খোঁজ নেয় না। ২৭ জানুয়ারি আসলে এখনও আঁৎকে উঠি।’

মৃত্যুবার্ষিকী কর্মসূচি

কিবরিয়া হত্যার ১২ বছর পূর্তিতে ঢাকা ও হবিগঞ্জে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। এর মধ্যে আছে হবিগঞ্জের বৈদ্যের বাজারে স্মৃতিস্তম্ভে পুস্পস্তবক অর্পণ, চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা, শোক শোভাযাত্রা, দোয়া মাহফিল ও আলোচনা সভা।

কর্মসূচিগুলো পালন করবে আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ সংগঠন এবং কিবরিয়া স্মৃতি সংসদ। এছাড়া ঢাকায় কিবরিয়ার কবরস্থানে সকাল নয়টায় শ্রদ্ধাঞ্জলী অর্পণ করবে কিবরিয়া পরিবার।

ঢাকাটাইমস/২৭জানুয়ারি/প্রতিনিধি/ডব্লিউবি

সংবাদটি শেয়ার করুন

বিশেষ প্রতিবেদন বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন এর সর্বশেষ

গামছা বিক্রেতা থেকে হাজার কোটি টাকার মালিক, মনে আছে সেই গোল্ডেন মনিরকে?

সোনার ধানের মায়ায় হাওরে নারী শ্রমে কৃষকের স্বস্তি

উপজেলা নির্বাচন নিয়ে কঠোর বার্তা দেবে আ. লীগ 

গরমে অতিষ্ঠ জনজীবন: চাহিদা বেড়েছে তরমুজের, ক্রেতা কম ডাবের

গাছ কাটার অপরাধে মামলা নেই 

কথায় কথায় মানুষ পেটানো এডিসি হারুন কোথায়? থানায় ছাত্রলীগ নেতাদের মারধরের তদন্ত কোথায় আটকে গেল?

মজুত ফুরালেই বাড়তি দামে বিক্রি হবে সয়াবিন তেল

কোন দিকে মোড় নিচ্ছে ইরান-ইসরায়েল সংকট

ছাদ থেকে পড়ে ডিবি কর্মকর্তার গৃহকর্মীর মৃত্যু: প্রতিবেদনে আদালতকে যা জানাল পুলিশ

উইমেন্স ওয়ার্ল্ড: স্পর্শকাতর ভিডিও পর্নোগ্রাফিতে গেছে কি না খুঁজছে পুলিশ

এই বিভাগের সব খবর

শিরোনাম :