অনিশ্চিত জীবন নিয়ে ধুঁকছে তাজরীনের আহতরা

সাত বছর আগে আজকের দিনে সাভারে আশুলিয়ার নিশ্চিন্তপুরে তাজরীন ফ্যাশনে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ভবনে আটকে পড়ে প্রাণ হারায় ১১৩ জন শ্রমিক। অগ্নিদগ্ধ ও ভবন থেকে লাফিয়ে পড়ে আহত হন দেড় শতাধিক। তাজরীন ট্র্যাজেডির এতদিন পেরিয়ে গেলেও যন্ত্রণা যেন পিছু ছাড়ছে না আহত শ্রমিকদের। শারীরিক অক্ষমতা আর মানসিক যন্ত্রণা নিয়ে এখনো অনিশ্চিত জীবনযাপন করছেন তারা।
সাবলম্বী হওয়ার চেষ্টায় গত বছর জরিনা, সবিতারা কয়েকজন মিলে ছোট কারখানা গড়লেও পুঁজির অভাবে বন্ধ হয়ে গেছে সে চেষ্টাও। সাময়িক সাহায্য পেলেও পূর্ণাঙ্গ ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসিত হতে না পেরে তাদের অনেকের পরিবারে নেমে এসেছে অমানিশার ঘোর অন্ধকার।
নিশ্চিন্তপুর এলাকায় গত সাত বছর ধরে বিচ্ছিন্নভাবে বসবাসরত তাজরীনের আহত এমন বেশ কয়েক শ্রমিকের সাথে কথা বলে জানা যায় তাদের এমন জীবনযুদ্ধের কাহিনি। শারীরিক, মানসিক, সাথে অর্থনৈতিক সমস্যায় জর্জরিত হয়ে তারা বেছে নিয়েছেন জীবিকা নির্বাহের নানা পথ। কেউ বা দিন হাজিরায় বিলি করছেন লিফলেট, কেউ বিক্রি করছেন পিঠা, আবার কেউ অন্যের দোকানে কাজ করে পার করছেন অনিশ্চিত কর্মজীবন।
তাজরীন অগ্নিকাণ্ডের ভয়াবহতায় তিন তলা থেকে লাফিয়ে বেঁচে ফেরা এমনি এক শ্রমিক সবিতা রানী। তাজরীন গার্মেন্টের পাশেই একটি শ্রমিক কলোনিতে পরিবার নিয়ে থাকেন সবিতা। আহত হওয়ার পর সাময়িক সাহায্য পেলেও যে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কথা ছিল তা পাননি বলে অভিযোগ তার। এমতাবস্থায় গত বছর নিজেদের জমানো পুঁজি দিয়ে তারা কয়েকজন মিলে একটি ছোট কারখানা গড়েছিলেন। কিন্তু পুঁজির অভাবে বন্ধ হয়ে গেছে সেটাও।
সবিতা রানী ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘সবাই তাজরীনের ঘটনা ভুলতে পারলেও আমরা যারা আহত আছি তারা ওই দিনটার কথা ভুলতে পারবো না। এঘটনার পর থেকে শারীরিক ও মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ি। অনেক কারখানায় ঘুরেও কোনো কাজ না পেয়ে নিজে কিছু করার চেষ্টা করি। গত বছর আমরা আহত শ্রমিকদের কয়জন মিলে একটি ছোট্ট কারখানা শুরু করলেও পুঁজির অভাবে সেটা সম্ভব হয়নি। এরপর অনেক কষ্টে একটা সেলাই মেশিন কিনে বাসায় টুকটাক সেলাইয়ের কাজ করছি। পাশাপাশি একটি সংস্থার প্রচারণার জন্য বিভিন্ন জায়গায় লিফলেট বিতরণ করে দিন ৪০০ টাকা মজুরি পাই।’
তিনি আরও বলেন, ‘দুর্ঘটনার পর সরকার তাদের যে সাহায্য করেছে তা চিকিৎসার পেছনেই শেষ হয়ে গেছে। আমরা সাহায্য চাই না, ক্ষতিপূরণ চাই। তাই আমরা ভালোভাবে সুস্থভাবে চলতে পারি সরকার ও বিজিএমইএ যেন তাদের জন্য এধরনের ব্যবস্থা করে।’
এখনো নিশ্চিন্তপুর এলাকায় ভাড়া বাসায় ছোট মেয়ে ও পাগল বোনকে নিয়ে থাকেন তাজরীনের আহত আরেক শ্রমিক পটুয়াখালী জেলার স্বামীহারা শিল্পী বেগম।
তাজরীনের অপারেটর শিল্পী বেগমের অভিযোগ, ঘটনার বীভৎসতায় ওই দিন তিন তলা থেকে লাফিয়ে পড়ে বেঁচেছিলেন। কিন্তু এরপর দেশের বাড়িতে চলে যাওয়ায় সরকারি সাহায্যের তালিকায় তার নাম ওঠেনি। এ কারণে কোনো ধরনের অনুদান পাননি। তবে বিভিন্ন সংস্থার মাধ্যমে তাজরীনের শ্রমিক হিসেবে কিছুটা চিকিৎসা সেবা পেয়েছেন। তারপরও কেন সরকারি তালিকায় তার নাম নেই এটা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন।
শিল্পী আরও বলেন, তাজরীনের ঘটনার পর শত চেষ্টা করেও কোনো কারখানায় চাকরি নিতে পারিনি। অন্য কারখানায় তাজরীনের শ্রমিকের কথা শুনলেই তাড়িয়ে দেয় কর্তৃপক্ষ। কোনো উপায়ন্তু না পেয়ে কখনো পিঠা বিক্রি করি, আবার কখনও টেইলার্সের কাজ করে পরিবার নিয়ে কষ্টে দিন পার করছি। পরিত্যক্ত এই কারখানাটা সরকার খুললে, তাহলে সেখানে চাকরি করতে পারতাম। এজন্য সরকার ও বিজিএমইএর সুদৃষ্টি চান তিনি।
তাজরীনের চার তলার সুইং সুপারভাইজর সোলায়মান ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘চতুর্থ তলা থেকে লাফ দেওয়ার কারণে আমার ডান পায়ের আট জায়গায় ভেঙে যায়। মাজায়ও ব্যথা পাই। পরে পায়ে রড ঢুকানো অবস্থায় অনেকদিন চিকিৎসাধীন ছিলাম। এরপর সুস্থ হলেও পা দুই ইঞ্চি ছোট থাকায় ভারী কাজ করতে পারি না। তাই এখনো কর্মহীন অবস্থায় বড় ভাইয়ের বোঝা হয়ে কষ্টে দিন পার করছি।’
এব্যাপারে গার্মেন্ট শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের সাংগঠনিক সম্পাদক খাইরুল মামুন মিন্টু ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘তাজরীন ট্র্যাজেডির সাত বছর পেরিয়ে গেলেও ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিকরা সামান্য সাহায্য ছাড়া প্রকৃত পুনর্বাসন সুবিধা পায়নি। আর দীর্ঘদিন ধরে কর্মহীন থাকার কারণেই তারা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। ফলে পারিবারিকভাবেও তারা মানসিক অশান্তিতে রয়েছে। এছাড়া মানসিক সমস্যার আরেকটি বড় কারণ হচ্ছে দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত না হওয়া। তাই তাজরীনের ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিকদের প্রকৃত পুনর্বাসন নিশ্চিত করা গেলে তাদের এই মানসিক ও অর্থনৈতিক সমস্যা থাকতো না।’ এজন্য সরকার ও বিজিএমইএকে উদ্যোগ নেওয়ার আহ্বান জানান তিনি।
(ঢাকাটাইমস/২৪নভেম্বর/জেবি)

মন্তব্য করুন