ক্যাসিনো-কাণ্ডে বন্ধ ক্লাবগুলোর তালায় জং, খুলবে কবে?

আবদুল হামিদ, ঢাকাটাইমস
| আপডেট : ০১ জুন ২০২২, ১১:০৫ | প্রকাশিত : ০১ জুন ২০২২, ০৯:২০

প্রতিদিন সকালে এই ক্লাবগুলো থেকে বেরিয়ে অনুশীলনে যেতেন খেলোয়াড়রা। এই ক্লাবেরই কোনো অংশে কিংবা কক্ষে তাঁবু (ক্যাম্প) পড়ত তাদের। সেখানে হতো তাদের বসবাস। আবার এই ক্লাবগুলোয় বিকালের পর পরিণত হতো অন্য এক জগতে। ভিন্ন খেলোয়াড়দের নিয়ে এই জগৎ।

রঙিন বাতির রোশনাই, ধূপ-ধুনো-আগরবাতির সুবাস আর ধোঁয়ায় রাতভর আচ্ছন্ন থাকত ক্লাবগুলো। বাইরে লোকজনে গমগম। ভেতরে কিছু পরপর হল্লা। জেতা-হারার উল্লাসধ্বনি। গভীর কিংবা ভোররাতে কেউ পকেট ভরে, কেউবা শূন্যপকেটে বিধ্বস্ত চেহারায় বেরিয়ে যেতেন ক্লাব থেকে।

ফকিরাপুলের সেই ক্লাবপাড়ায় এখন সন্ধ্যার পর নেমে আসে ভুতুড়ে পরিবেশ। আবর্জনায় ভরে উঠেছে অনেক ক্লাবের আঙিনা। জং ধরা ফটক ভেঙে পড়ছে কোনো কোনোটির। জং ধরেছে ফটকের তালায়। আড়াই বছরের বেশি সময় ধরে তালাবদ্ধ এসব ক্লাব। কবে তালা খুলবে সে কথা বলতে পারছে না কেউ। ইতিমধ্যে দরজা-জানালা ভেঙে চুরি হয়ে গেছে অনেক মূল্যবান আসবাবপত্র।

অবৈধ ক্যাসিনো ও মদের আসর চালানোর অভিযোগে ২০১৯ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর বিকাল সাড়ে পাঁচটায় ফকিরাপুলের ইয়ংমেনস ক্লাবে প্রথম অভিযান চালায় র‌্যাব। সেখান থেকে ২৫ লাখ টাকাসহ ১৪২ জনকে আটক করা হয়। জব্দ করা হয় বিপুল পরিমাণ মদের বোতল।

এরপর একে একে আরও কয়েকটি ক্লাবে অভিযান চালানো হয়। রাজধানীতে ক্লাবপাড়া বলে পরিচিত ফকিরাপুলের এক গলিতেই অবস্থান ওয়ান্ডারার্স ক্লাব, ভিক্টোরিয়া স্পোর্টিং ক্লাব, আরামবাগ ক্রীড়া সংঘ, ফকিরাপুল ইয়ংমেনস ক্লাব, দিলকুশা স্পোর্টিং ক্লাব, মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবসহ আরও বেশ কয়েকটি সংগঠন। এই ক্লাবগুলো অধিকাংশ গড়ে উঠেছে গত শতকে। এর বাইরে গুলিস্তানে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ক্লাবে চালানো হয় অভিযান। তালা পড়ে সব কটিতেই।

ক্লাবগুলোর বর্তমান অবস্থান জানতে সম্প্রতি সরেজমিনে গিয়েছিলেন এই প্রতিবেদক। মতিঝিলের ৩৮ তলা সিটি সেন্টারের পেছনে আরামবাগের একই গলিতে আরামবাগ ক্রীড়া সংঘ, ফকিরাপুল ইয়ংমেনস ক্লাব, দিলকুশা স্পোর্টিং ক্লাবসহ পরপর চারটি ক্লাব। ফটকের সামনে দেখা গেছে ময়লা আবর্জনাসহ ভাংড়ি গাড়ি। ক্লাবগুলোর প্রধান ফটকে ঝুলছে বিভিন্ন ধরনের রাজনৈতিক পোস্টার, বাসা ভাড়ার টু-লেট। বদ্ধ ফটকে ঝুলছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর লাগানো তালা। মরিচা পড়ে গেছে অনেক তালায়।

ওয়ান্ডারার্স ক্লাবের পক্ষ থেকে ঈদের শুভেচ্ছা জানিয়ে একটি ব্যানার ঝুলতেও দেখা গেছে। আর পাশের দেয়ালে সদস্য সংগ্রহের আবেদন চেয়ে আরেকটা ব্যানার লাগানো।

সরেজমিনে আলাপ করে জানা যায়, যারা এর আগে ক্লাবপাড়ায় পড়ে থাকতেন, এখান থেকেই রুটি-রুজির ব্যবস্থা হতো, কিংবা যারা নিয়মিতই এখানে আসতেন, তাদের কেউ কেউ আজ এড়িয়ে চলছেন জায়গাটি। আবার কেউ কেউ এসে ঘুরে যান। পথের পাশে দোকানে বসে চা খেতে খেতে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন ক্লাবগুলোর দিকে। ক্লাবের পাশে চা-স্টলসহ বিভিন্ন পণ্যের দোকান সন্ধ্যার পর বন্ধ হয়ে গেলে ক্লাবপাড়ায় নেমে আসে ঘুটঘুটে অন্ধকার।

গত রবিবার ভোরে সরেজমিনে ক্লাবপাড়ায় দেখা যায়, দোকানগুলো বন্ধ। তবে উঠতি বয়সের বেশ কয়েকজন কিশোর বসে কী যেন সেবন করছে। করিম নামের এক ব্যবসায়ী ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘প্রতিদিন ভোরে এই পথ দিয়ে যাই, অধিকাংশ দিনই এই কিশোরদের দেখি মাদক সেবন করতে। মাঝেমধ্যে সাধারণ পথচারীদের হেনস্তা করে তারা।’

গত কয়েক দিন ক্লাবগুলো ঘুরে দেখা যায়, ভিক্টোরিয়া, ওয়ান্ডারার্স, ইয়ংমেনস, আরামবাগ ও দিলকুশা ক্লাবের তালা না খুললেও গুলিস্তানে মুক্তিযোদ্ধা ক্লাবের মূল ফটকে এখন আর তালা নেই। ওখানে দায়িত্বে থাকা এক ব্যক্তি ক্লাবের সদস্য দাবি করে জানান, ক্লাব কর্তৃপক্ষ সবকিছু দেখভালের দায়িত্ব দিয়েছে তাকে। ভেতরে ঢুকে দেখা গেল, জুয়া খেলার স্থানগুলো বন্ধ।

দিলকুশা ক্লাবের প্রধান ফটক দিয়ে উঁকি মেরে দেখা গেল, ভেতরে পরিত্যক্ত অবস্থা। ঘুটঘুটে অন্ধকার। এছাড়া এটি যে একটা ক্লাব, তা বোঝারই উপায় নেই এখন।

পাশেই শত বছরের পুরনো ক্লাব ভিক্টোরিয়া স্পোর্টিং। ছোট ফটকের কিছু অংশ ভেঙে গেছে। ভেতরে ময়লা-আবর্জনায় ভরে আছে।

অভিযানের পর থেকেই মোহামেডানে তালা শুধু ক্যাসিনো ও জুয়া খেলার হলঘরে। মূল ভবন খোলা থাকায় সেখানে চলছে স্বাভাবিক কাজকর্ম।

আরামবাগ ক্লাবে ক্যাসিনো খেলার হলঘরে তালা ঝুলছে। তবে কয়েক মাস আগে তারা মতিঝিল থানা পুলিশের বিশেষ অনুমতি নিয়ে অফিস ও খেলোয়াড়দের থাকার জায়গা খুলে দিয়েছে।

এরই মধ্যে কয়েকটি বন্ধ ক্লাবে চুরির অভিযোগ উঠেছে। ভিক্টোরিয়া ক্লাবের দরজা-জানালা ভেঙে এসি, সোফা, চেয়ার টেবিলসহ নানা কিছু চুরি হয়ে গেছে। একই অভিযোগ ইয়ংমেনস, ওয়ান্ডারার্স, দিলকুশা ক্লাবের কর্মকর্তাদেরও।

তারা বলছেন, ক্লাবের ভেতরে এখন আর কিছুই নেই। সবই চুরি হয়ে গেছে। চুরির ব্যাপারে অভিযোগও করা হয় মতিঝিল থানায়। খেলাধুলার স্বাভাবিক কার্যক্রম ফিরিয়ে আনতে বন্ধ ক্লাবগুলো খুলে দেওয়ার জন্য বেশ কয়েকবার মতিঝিল থানায় আবেদন করা হয়েছে বলে জানান ক্লাবের কমিটিতে থাকা কয়েকজন নেতা। ওপর মহলের নির্দেশ এলেই কেবল ক্লাব খোলা হবে বলছে পুলিশ।

মতিঝিল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ইয়াসিন আরাফাত ক্লাব থেকে মালামাল চুরি হওয়ার বিষয়ে সাধারণ ডায়েরি (জিডি) সম্পর্কে কিছু বলতে চাননি। ক্লাব খুলে দেওয়ার বিষয়টা অনেক বড় বিষয় এবং এটা ওপরের লোকজন দেখভাল করছেন বলে জানান তিনি।

মতিঝিল জোনের অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি) এনামুল হক মিঠু ঢাকাটাইমসকে বলেন, ক্লাব কর্তৃপক্ষ পুলিশের কাছে আবেদন করে কোনো কিছুই হবে না। ক্লাব খুলে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে আদালত। আদালত থেকে নির্দেশনা এলে পুলিশ গিয়ে সেটা খুলে দিতে পারবে, তার আগে কিছু করার নেই।

তবে আরামবাগ ক্রীড়া সংঘের সিলগালা করা প্রধান ফটক বন্ধ থাকলেও অন্য পাশ দিয়ে দোতলায় ওঠার ব্যবস্থা করা হয়েছে। সেখানে অফিস করছেন আরামবাগ ক্রীড়া সংঘের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আমিনুল ইসলাম শামীম। এ ছাড়া আরও কয়েকটি রুমে রাখা হচ্ছে খেলোয়াড়দের। তবে এ বিষয়ে কথা বলতে চাইলে তিনি পরে কথা বলবেন বলে আর যোগাযোগ করেননি।

জানা গেছে, বন্ধ হওয়া ক্লাবগুলো অন্য কোথাও জায়গা ভাড়া নিয়ে বিভিন্ন টুর্নামেন্টে খেলা চালিয়ে যাচ্ছে। ওয়ান্ডারার্স ক্লাবের দপ্তর সম্পাদক তারিক আলম ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি ক্লাব খোলার জন্য। কিন্তু উপর মহল থেকে আশ্বাস দিলেও কাজ হচ্ছে না।’

গত মাসে ফুটবলের বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগের (বিপিএল) একটা মিটিংয়ে বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের (বাফুফে) কাছে আবেদন করা হয়েছে ক্লাবগুলো খুলে দেওয়ার জন্য। বাফুফেও মন্ত্রণালয়কে বারবার জানিয়ে আসছে।

এদিকে মাঠে গড়ানো কয়েকটি ফুটবল টুর্নামেন্টের ফিকশ্চারে নাম আছে ফকিরাপুল ইয়ংমেনস ক্লাব, ঢাকা ওয়ান্ডারার্স ক্লাব, আবাহনী, মোহামেডান স্পোর্টিং ও মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ক্রীড়া চক্রের।

বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগে (বিপিএল) খেলছে আবাহনী, মোহামেডান, মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ক্রীড়া চক্র। আর বাংলাদেশ চ্যাম্পিয়নশিপ লিগে খেলছে ফকিরাপুল ইয়ংমেনস ক্লাব, ঢাকা ওয়ান্ডারার্স ক্লাব। বাংলাদেশ কাবাডি ফেডারেশনের ২য় বিভাগে কাবাডি লিগ-২০২১ এর ফিকশ্চারে দেখা য়ায় দিলকুশা স্পোটিং ক্লাবের নাম।

বন্ধ ক্লাবগুলোর কয়েকজন নীতি-নির্ধারক ঢাকাটাইমসকে বলেন, বর্তমানে বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন ক্লাব-মেস ভাড়া নিয়ে যেভাবে চলছি, এভাবে একটা ক্লাবের খেলা চালানো কষ্টকর।

এ বিষয়ে যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী জাহিদ আহসান রাসেল বন্ধ ক্লাবগুলো খুলে দেওয়ার পক্ষে। তার মতে, ক্লাবগুলোর কোনো অপরাধ নেই, যেসব ব্যক্তি অপরাধ করেছে তাদের শাস্তি হোক। ব্যক্তির দায় প্রতিষ্ঠান নেবে না।

ক্লাব খুলে দিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ক্লাব কর্তৃপক্ষ আবেদন করেছে জানিয়ে যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘এখানে আমার কোনো সহযোগিতার প্রয়োজন হলে আমি করব। ব্যক্তিবিশেষের অপরাধের জন্য কোনো প্রতিষ্ঠান ধ্বংস হতে পারে না। ব্যক্তিবিশেষের দায়দায়িত্ব তাদের নিতে হবে, যাতে ক্লাব খুলে দেওয়া যায়। ক্লাবগুলো বন্ধ থাকায় খেলাধুলায় অনেক ক্ষতি হচ্ছে।’

যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘এই ক্লাবগুলো আমাদের আওতাধীন না। তাদের নিবন্ধন দেয় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। তারা তাদের মতো করেই প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করে। ক্লাব নিয়ন্ত্রণ করার দায়িত্ব যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের না। ক্লাবগুলো খুলে দেওয়ার পরে সুষ্ঠু-সুস্থভাবে খেলাধুলার জন্য যাতে ব্যবহার হয়, সেদিকে সার্বক্ষণিক মনিটারিং করে ব্যবস্থা নিতে হবে স্বরাষ্ট্র ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে। যাতে ওই ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি না হয়। তারা যেন সঠিকভাবে খেলাধুলা করে, সেই বিষয়ে মনিটারিং করতে পারে যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণায়লয়। তবে ক্লাব নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না।’

ক্লাবগুলো কবে নাগাদ খুলে দেওয়া হতে পারে এমন এক প্রশ্নের জবাবে প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘ক্লাবগুলো আইনগত প্রক্রিয়ার মাধ্যমে খুলতে হবে। কারণ সেটা আইনগত প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই সিলগালা করা হয়েছে। ক্লাবগুলোসহ ফেডারেশনকে এ ব্যাপারে আরও উদ্যোগ নেয়া দরকার। পাশাপাশি যেখানে যেখানে বলা দরকার সেখানে আমাদের কাজে লাগাতে পারে।’

(ঢাকাটাইমস/০১জুন/মোআ)

সংবাদটি শেয়ার করুন

বিশেষ প্রতিবেদন বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন এর সর্বশেষ

এই বিভাগের সব খবর

শিরোনাম :