সংকট নিরসনে সরকারকে একগুচ্ছ পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের

সৈয়দ ঋয়াদ ও বীর সাহাবী, ঢাকাটাইমস
  প্রকাশিত : ২১ জুলাই ২০২২, ০৭:৪৬| আপডেট : ২১ জুলাই ২০২২, ১১:২২
অ- অ+

দেশের চলমান অর্থনৈতিক সংকটে চাপে রয়েছে সরকার। মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধি, রিজার্ভ কমে যাওয়া, বিশ^বাজারে পণ্যের চড়া মূল্য, রেমিট্যান্স কমে যাওয়াসহ নানামুখী সমস্যা থেকে উত্তরণের জন্য সরকারকে একগুচ্ছ পরামর্শ দিয়েছেন সাবেক অর্থমন্ত্রী, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ও বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদরা।

গত নয় বছরের মধ্যে খাদ্যপণ্যে সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতি হয়েছে, যা এক মাসের ব্যবধানে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮ দশমিক ৩৭ শতাংশ। একই সঙ্গে বেড়েছে সাধারণ মূল্যস্ফীতির হারও। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে অবাধ সুষ্ঠু পণ্য সরবরাহে জোর দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা মনে করছেন মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে পণ্য সরবরাহে অসাধু ব্যবসায়ী ও সিন্ডিকেট দূর করতে হবে। এছাড়া সরকারকে এই মুহূর্তেই ব্যয় সংকোচন নীতি অবলম্বন করতে হবে।

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে জ্বালানি সংকটসহ নিত্যপণ্যের বাজারেও পড়েছে এর প্রভাব। ফলে বিদ্যুৎ উৎপাদনের তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসের (এলএনজি) মূল্য বেড়েছে কয়েক গুণ। যে কারণে বাংলাদেশের মতো ছোট অর্থনীতির দেশ সেই সংকট মোকাবেলা করতে হিমশিম খাচ্ছে। এরই মধ্যে অর্থনৈতিকভাবে বিপর্যস্ত শ্রীলঙ্কার বাংলাদেশের সামনে উদাহরণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সংকট উত্তরণে ব্যয় সংকোচনসহ নানা পরামর্শ এসেছে বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে। এই অবস্থায় সাবধান না হলে বড় বিপদের আশঙ্কা করছেন তারা।

এরই মধ্যে সংকট মোকাবেলা আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ), বিশ্বব্যাংকসহ উন্নয়ন সহযোগীদের কাছে ঋণ সহায়তার প্রস্তাব করেছে বাংলাদেশ। এই মুহূর্তে বৈদেশিক ঋণ নিয়ে সংকট মোকাবেলার বিষয়ে ঢাকাটাইমসের সঙ্গে কথা বলেন অর্থনীতিবিদ ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা মিজ্জা আজিজুল ইসলাম।

তিনি বলেন, উন্নয়ন সহযোগী আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকের কাছে সংকট নিরসনে সরকারে চাওয়া ঋণ প্রস্তাবে সংকট মোকাবেলার বিষয়ে এই অর্থনীতিবিদ বলেন, ঋণ নেওয়ার ক্ষেত্রে এটা নেগোশিয়েট করতে হবে। অযৌক্তিক কোনো শর্ত দিলে ঋণের ব্যাপারে রাজি হওয়া যাবে না। আবার এদিকে আমাদের বর্তমান রিজার্ভের অবস্থা সুবিধাজনক নয়। এটা অলরেডি ৪০ বিলিয়ন ডলারের নিচে চলে এসেছে। আমাদের এক্সপোর্ট গ্রোথ যদিও ভাল ছিল, ইমপোর্ট গ্রোথ অত্যন্ত বেশি। ফলে এক্সচেঞ্জ রেটের ওপর প্রভাব ফেলেছে। এসব কারণে কিছু বিদেশি ঋণ প্রয়োজন আছে। তবে কি শর্ত, সেগুলো বিবেচনা করতে হবে। শর্ত বিবেচনা করে ঋণ নিলে সংকট মোকাবেলা সহজ হবে।’

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমান ঢাকাটাইমসকে বলেন, বাংলাদেশের চলমান অর্থনৈতিক টানাপোড়েন কোভিড-উত্তর ভেঙ্গে পড়া সরবরাহ চেইন মেরামতের আগেই ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে বিশ্ব অর্থনৈতিক সংকটের ফসল। মূলত জ্বালানি তেল, এলএনজি ও গম, সারের সরবরাহ ঘাটতি ও উচ্চ আমদানি মূল্যের প্রভাবে মূল্যস্ফীতি দেখা দিয়েছে। তবে আমাদের কৃষির সাফল্য এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থায়নের জোরে অন্যান্য দেশের চেয়ে আমরা এই সংকট অনেকটাই সফলতার সাথে কাটিয়ে উঠতে পারব বলে আমার বিশ্বাস।

তবে সাবধানের মার নেই উল্লেখ করে তিনি বলেন, সব অংশীজনের সাথে গভীর সংলাপ করেই আমাদের মুদ্রা ও রাজস্ব নীতি পরিচালনা করে দেশের আলো-হাওয়ায় প্রযোজ্য নীতিকাঠামোতেই বাঁচার পথ নিহিত। আমার মনে হয় বাংলাদেশ সেই স্বকীয় পথেই হাঁটছে। কৃষি এক্ষেত্রে বিরাট সহায়ক ভূমিকা রাখছে। প্যানিক না ছড়িয়ে সবাই মিলে অর্থনৈতিক এই টানাপোড়ন থেকে বের হবার সঠিক পথ নিশ্চয় আমরা খুঁজে পাব।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক আরেক গভর্নর সালেহ উদ্দিন আহমেদ ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘অর্থ প্রবাহ যে খুুব বেড়েছে তা না, ব্রড মানি কিন্তু খুব বেশি বাড়েনি। তবে সরকারের ঋণ কিছুটা বেড়েছে, ফলে মূল্যস্ফীতি কিছুটা হচ্ছে। কারণ সরকারের বড় প্রকল্পগুলোতে ব্যয় হয়েছে, এই অর্থটা আসতে সময় লাগবে। এসব প্রকল্পে বিশাল যে অর্থ ব্যয় হয়েছে সেটা গিয়ে মূল্যস্ফীতিতে প্রভাব ফেলছে। সেদিক থেকে চিন্তা করলে অর্থপ্রবাহ কিছুটা বেড়েছে।’

বাংলাদেশের এখন যে মূল্যস্ফীতি সেটা সরবরাহজনিত কারণে বলে মনে করছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক এই গভর্নর ও অর্থনীতিবিদ। সালেহ আহমেদ বলেন, প্রথমত আমরা চাহিদা অনুুযায়ী পর্যাপ্ত পরিমাণ পণ্য উৎপাদন করতে পারছি না। দ্বিতীয়ত, আমাদের আমদানী নির্ভর যেসব পণ্য বিদেশ থেকে আনতে হয় সেগুলোর মূল্য বেড়ে যাওয়ায় তা দেশের বাজারে আসতে সময় লাগছে। বাজারে পণ্য সরবরাহের বড় বাধা সিন্ডিকেট। অসাধু সিন্ডিকেট যারা বাজার নিয়ন্ত্রণ করে, চাঁদাবাজি করে, মূলত এসব কারণে মূল্যস্ফীতি আরও উস্কে দিচ্ছে।

পণ্য সরবাহটা যদি নিশ্চিত কার যেত তাহলে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হতো। দেখা যা সয়াবিন তেল বাজারে একেবারেই নেই তা কিন্ত না, তেল আছে গুদামে। অসাধু ব্যবসায়ীরা ও সিন্ডিকেট করে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে রেখেছে। যে কারণে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখা যাচ্ছে না।

অর্থনৈতিক সংকট থেকে উত্তরণের পথ বাতলে দিয়ে অর্থনীতিবিদ আবু আহমেদ ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘কোনোভাবেই বৈদেশিক ঋণ নেওয়া যাবে না। নীতি নির্ধারণে বাংলাদেশে ব্যাংককে আরো কঠোর হতে হবে। যে বিশাল অঙ্কের খেলাপি রয়েছে তা অতি দ্রুত আদায় করে দেশের অর্থনীতিকে নির্ভরশীল একটি জায়গায় নিয়ে যেতে হবে।’

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান কাজের বিষয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের মূলত তিনটি কাজ, টাকা ছাপানো, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখা, সেই এক্সচেঞ্জ রেট ঠিক রাখা ও ব্যাংকিং সুপারভিশন।

বাংলাদেশ শ্রীলঙ্কার পথে হাঁটছে কি না এমন প্রশ্নের উত্তরে আবু আহমেদ বলেন, ‘নাহ। আপাতত শ্রীলঙ্কার মতো হওয়ার সম্ভাবনা নেই, তবে কঠিন শর্তে বিদেশি ঋণ নিলেই বিপদে পড়বে। ঋণ পরিহার করলেই ভালো। শ্রীলঙ্কা বিপদে পড়ার পর কেউ এগিয়ে আসেনি, আমরা বিপদে পড়লেও কেউ এগিয়ে আসবে না।’ তাই সময় থাকতে সাবধান হওয়ার পরামর্শ এই অর্থনীতিবিদের।

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান ঢাকাটাইমসকে বলেন, প্রকল্প আমরা যেগুলো করছি এগুলো বাংলাদেশের উন্নয়নের জন্য প্রয়োজন। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে সেটার তো একটা গুরুত্ব আছে। যেমন পদ্মা সেতুকে একটা ব্রিজ হিসেবে দেখলেই হবে না, এটাকে ট্রানস্পট ও ইকোনমিক্স করিডোর্স হিসেবে দেখতে হবে। সেগুলো যদি করা হয় তাহলে এটার ইকোনমিক রেট অব রিটার্ন ভালো হবে। আমাদের অন্যান্য উদ্যোগগুলো নিতে হবে।

তিনি আরও বলেন, অবকাঠামো আমাদের অবশ্যই দরকার আছে। কিন্তু আমাদের প্যারালাল ইনিসিটিভসগুলো লাগবে রিটার্নগুলোকে ম্যাক্সিমাস করার জন্য। আর চলমান যেসব প্রকল্প আছে সুশাসনের সাথে গুড গভর্নেন্স-এর সাথে এগুলো যাতে সাশ্রয়ীভাবে বাস্তবায়ন হয়, সময়মতো যাতে শেষ হয় সেটার উপর গুরুত্ব দিতে হবে। যাতে করে আমাদের ইন্টার্নাল রেট অব রিটার্ন এবং ইকোনমিক রেট অব রিটার্ন এনশিওর হয়। তাহলে সেটা অর্থনীতির জন্য বোঝা হবে না।

আমাদের খেয়াল রাখতে হবে এগুলো যাতে আমাদের ওভার কস্টিং না হয়, এসব প্রকল্পের সাথে অন্য যেসব প্যারালাল ইনিশেটিভস প্রয়োজন এগুলোর ম্যাক্সিমাস করার জন্য সেগুলোও যাতে আমরা করি। সেগুলো করলে রিটার্নটা আমরা এনসিওর করতে পারব।

আর দ্বিতীয়ত, এখন বৈশ্বিক পরিস্থিতির চাপও আমাদের অর্থনীতির উপরে পড়েছে। এর সঙ্গে আমাদের টাকার অবমূল্যায়ন যুক্ত হয়েছে। সব সময় আমাদের চেষ্টা করতে হবে রেমিট্যান্স যাতে ফরমাল চ্যানেলে বেশি আসে। আমাদের রপ্তানি যাতে আন্ডার ইনভয়েস না হয়। আমদানি যাতে ওভার ইনভয়েস না হয়। এগুলো নজরদারি খবরদারিও বাংলাদেশ ব্যাংক ও এনবিআরকে বাড়াতে হবে।

এখন যে রিজার্ভ চাপের মধ্যে আছে, আগামীতে যে আমাদের ব্যালেন্স অব পেমেন্টের সমস্যা হতে পারে, সেটার একটা স্বীকৃতি এটার মধ্যে দিয়া আছে। ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের কাছে বাজেটারি সাপোর্ট চাওয়া হচ্ছে। তবে এখানে খেয়াল রাখতে হবে যাতে কঠিন শর্ত না নেয়া হয়।

অর্থনীতির চলমান সংকট মোকাবেলায় সরকারের নানা উদ্যোগের বিষয়ে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান ঢাকাটাইমসকে বলেন, চলমান সংকট উত্তরণের জন্য সরকার নানা কৌশল অবলম্বন করছেন। বিশেষ করে দেশের নানা ক্ষেত্রে ব্যয় সংকোচন করার উদ্যোগ নিয়েছেন। বিদ্যুতের ব্যয় কমানো, সরকারি কর্মকর্তাদের সব ধরনের বিদেশ ভ্রমণের নিষেধাজ্ঞা, অফিস আদালতে এসির ব্যবহার বন্ধ করাসহ নানা উদ্যোগ হাতে নিয়েছে। এছাড়া অফিস আদালতে কর্মঘণ্টা কমানোর পরিকল্পনা চলছে।

বর্তমান যে অর্থনৈতিক সংকট চলছে সেটা বাংলাদেশের একার না, এটা বৈশি^ক সমস্যা। জনগণ একটু সহায়তা করলে এই সংকট থেকে উত্তরণ সহজ হবে। তবে যারা আগুন নিয়ে খেলতে চায়, যদি সেই আগুন চলেই আসে তারাও আগুনে পুড়বে, এটা মনে রাখা উচিত। তবে এখনই এই সংকট থেকে উত্তরণের শিউর শট কোনে পথ আমার জানা নেই, তবে অন্য কেউ জানলে তা বলতে পারে।

তবে সংকটে টিকে থাকার উপায় বলে দিলেন পরিকল্পনামন্ত্রী। বললেন, আমরা যেহেতু এত পাওয়ারফুল অর্থনীতি নই, আমাদের ঘা-টা একটু বেশিই লাগবে। এজন্য আমাদের সরকার প্রধান সবার কাছে আবেদন রেখেছেন। ব্যয় সংকোচনের ব্যাপারে আরও নতুন কিছু উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন। যা সংকট মোকাবেলায় কার্যকর হবে।

(ঢাকাটাইমস/২১জুলাই/মোআ)

google news ঢাকা টাইমস অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি ফলো করুন

মন্তব্য করুন

শীর্ষ খবর সর্বশেষ জনপ্রিয়
সব খবর
নিষিদ্ধ সংগঠন ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় প্রচার সম্পাদক তরিকুল ইসলামকে গ্রেপ্তার করেছে ডিবি
পঞ্চগড়ে রাস্তার কাজে অনিয়ম, অস্বীকার করায় এলজিইডি কর্মচারীকে গণপিটুনি
সাতক্ষীরায় জমি দখলকে কেন্দ্র করে পাঁচজন গুলিবিদ্ধ, আটক ৪
শার্শায় সরকারি চালের বস্তা ছিনতাই, বিএনপির ২ কর্মী গ্রেপ্তার
বিশেষ প্রতিবেদন তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা