৮০০ চাকরিপ্রার্থী তাদের ফাঁদে পড়ে ক্ষতিগ্রস্ত
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে 'এসএসএফ প্রাইভেট কোম্পানি লিমিটেড' নামে চাকরির ভুয়া নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে প্রতারণার মাধ্যমে ৭০০ থেকে ৮০০ চাকরিপ্রার্থীদের টাকা হাতিয়ে নিয়েছে একটি প্রতারক চক্র। এ চক্রের মূলহোতাসহ ছয়জনকে গ্রেপ্তার করেছে র্যাব-৩।
গ্রেপ্তার ব্যক্তিরা হলেন- মূলহোতা মো. মাছুম বিল্লাহ (৩৩), খাইরুল আলম রকি (২০), মো. কামরুজ্জামান ডেনিশ (২২), মো. মাহমুদুল হাসান (৩২), মাসুদ রানা (২৪) ও এসএম রায়হান (২৪)।
এ সময়ে তাদের কাছ থেকে আটটি মোবাইল ফোন, আটটি সিম কার্ড, নগদ পাঁচ হাজার ৫৪০ টাকা, একটি মনিটর, স্ট্যাম্প প্যাড দুইটি, এসএসএফ প্রাইভেট কোম্পানি লিমিটেড ব্যানার দুইটি, শতাধিক ভর্তি ফরম, দুই শতাধিক সিভি, দুইটি চেকবই, পাঁচটি স্ট্যাম্প, দুইটি অঙ্গীকারনামা, ভিজিটিং কার্ড, পণ্য তালিকা, মূল্য তালিকা, অর্ধ শতাধিক ডিপো ও নিয়োগপত্র জব্দ করা হয়।
বৃহস্পতিবার দুপুরে রাজধানীর কারওয়ান বাজার র্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলেন র্যাব-৩ এর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল আরিফ মহিউদ্দিন আহমেদ।
আরিফ মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, কর্মজীবনের শুরুতে তারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নামসর্বস্ব নিয়োগ প্রতিষ্ঠানের চাকরির বিজ্ঞপ্তি দেখে প্রতারণার শিকার হয়। এরপর তারা নিজেরাই প্রতারণাকে পেশা হিসেবে বেছে নেয়। তারা সবাই পেশাদার সংঘবদ্ধ প্রতারক চক্রের সক্রিয় সদস্য। তারা সুপরিকল্পিতভাবে ধাপে ধাপে চাকরিপ্রার্থীদের সঙ্গে প্রতারণা করত।
সংবাদ সম্মেলনে র্যাব জানায়, গ্রেপ্তার মো. মাছুম বিল্লাহ এই প্রতারক চক্রের মূলহোতা। তিনি নিজেকে আইনজীবী হিসেবে পরিচয় দিতেন। তার আইনজীবী পরিচয়ের কারণে ভুক্তভোগীরা তাকে ভয় পেতেন। তিনি ভুক্তভোগীদের মামলার ভয় দেখিয়ে তাদের টাকা আত্মসাৎ করতেন। আইন বিষয়ে পড়াশোনা করার কারণে তিনি সুকৌশলে তার প্রতারণাকে বৈধভাবে উপস্থাপন করার জন্য ভুয়া লাইসেন্স তার অফিসে ঝুলিয়ে রাখতেন এবং তার নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে সরকার অনুমোদিত এবং নিবন্ধন নম্বর উল্লেখ করতেন।
মাছুমের অন্যতম সহযোগী গ্রেপ্তার খাইরুল আলম রকি ও মো. কামরুজ্জামান ডেনিশ আগে সিনথীয়া সিকিউরিটি সার্ভিস লিমিটেড নামে একটি নামসর্বস্ব কোম্পানিতে একইভাবে প্রতারণার কাজ করত। কোম্পানিতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানের পর তারা মাছুম বিল্লাহর সঙ্গে যোগ দেয়। গ্রেপ্তার খায়রুল আলম রকি অফিসে আসা চাকরিপ্রার্থীদের প্রতারণামূলক কথাবার্তা বলে মগজ ধোলাই করে জামানতের টাকা আদায় করতেন।
গ্রেপ্তার কামরুজ্জামান ডেনিশ, এসএম রায়হান ও মাসুদ রানা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিজ্ঞাপন দিয়ে সারাদেশব্যাপী আগ্রহী প্রার্থীদের সঙ্গে যোগাযোগ করে ইন্টারভিউয়ের জন্য অফিসে নিয়ে আসত। গ্রেপ্তার মো. মাহমুদুল হাসান চাকরিপ্রার্থীদের ফরম পূরণ ও প্রয়োজনীয় কাগজপত্রসহ আবেদনপত্র জমা নিতেন।
র্যাব অধিনায়ক বলেন, সরকার অনুমোদিত, এসএসএফ প্রাইভেট কোম্পানি লিমিটেড, সঙ্গে নিবন্ধন নম্বর দিয়ে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করত। এই বিজ্ঞপ্তি দেখে চাকরিপ্রার্থীরা প্রতিষ্ঠানকে সরকারের একটি প্রতিষ্ঠান মনে করত। এছাড়াও এসএসএফ একটি বিশেষ নিরাপত্তা সংস্থার নাম হওয়ায় চাকরিপ্রার্থীরা বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখিত প্রতিষ্ঠানকে তাদের অঙ্গসংগঠন মনে করত।
বিজ্ঞপ্তিতে সিকিউরিটি গার্ড, সহকারী সুপারভাইজার, সুপারভাইজার, সিকিউরিটি ইনচার্জ, মার্কেটিং অফিসার (পুরুষ), মার্কেটিং অফিসার (মহিলা), অফিস সহকারী, লেডি গার্ড, অফিস রিসিপশনস (মহিলা) পদের বিপরীতে উচ্চ বেতন লেখা থাকত। এছাড়াও আকর্ষণীয় সুযোগ হিসেবে থাকা ফ্রি, খাওয়ার সু-ব্যবস্থা, কর্মদক্ষতার উপর পদোন্নতি, অভিজ্ঞতা না হলেও চলবে, কর্মঠ ও সুদর্শন হতে হবে, এসব লোভনীয় প্রস্তাব উল্লেখ করা থাকত। যোগাযোগের জন্য মোবাইল নম্বর দেওয়া থাকত। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এসব বিজ্ঞপ্তি দেখে অসংখ্য বেকার যুবক-যুবতী, স্কুল কলেজ পড়ুয়া শিক্ষার্থীরা তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করত।
প্রতারণার দ্বিতীয় পর্যায়ে তাদের অফিস থেকে চাকরিপ্রার্থীদের মোবাইলে ফোন দিয়ে একটি নির্দিষ্ট তারিখে প্রয়োজনীয় কাগজপত্রসহ অফিসে এসে ইন্টারভিউ দেওয়ার জন্য বলা হত।
র্যাব-৩ এর অধিনায়ক বলেন, প্রতারণার তৃতীয় পর্যায়ে নির্দিষ্ট তারিখে চাকরিপ্রার্থীরা ইন্টারভিউয়ের জন্য অফিসে আসার পর তাদেরকে একটি ফরম পূরণ করতে দেওয়া হত। ফরমে সংযুক্তি হিসেবে ছবি, অঙ্গীকারনামা, প্রার্থীর নিজ এবং পিতা ও মাতার এনআইডির কপি, শিক্ষাগত যোগ্যতার সনদপত্র, নাগরিকতার সনদপত্র দিতে হয়। এরপর প্রার্থীদের বিভিন্ন প্রতারণামূলক কথাবার্তা বলে মগজ ধোলাই করা হত।
এরপর তাদের কাছ থেকে ভর্তি ফরম, ট্রেনিং এবং আইডি কার্ড বাবদ সাড়ে ১২ হাজার টাকা জামানত আদায় করা হতো। তাদের জানানো হতো পদ অনুসারে তাদের মাসিক ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা বেতন দেওয়া হবে। কোনো প্রার্থীর কাছে ওই পরিমাণ টাকা না থাকলে তাদের কাছে যা আছে তাই আদায় করা হত এবং বাসায় গিয়ে বিকাশের মাধ্যমে বাকি টাকা পরিশোধ করার জন্য বলত চক্রটি। কিন্তু জামানত হিসেবে টাকা গ্রহণের কোনো রশিদ দেওয়া হতো না।
একটি নির্দিষ্ট তারিখে প্রার্থীদেরকে কাজে যোগদান করার জন্য বলা হত। পরবর্তীতে সিকিউরিটি অফিসে যোগদান করলে তাদের নিয়োগপত্রে উল্লেখ করা হতো প্রতি মাসে নতুন নতুন চাকরিপ্রার্থী সংগ্রহ করতে হবে এবং নতুন চাকরিপ্রার্থী সংগ্রহের ভিত্তিতে কমিশন হিসেবে তাদের বেতন দেওয়া হবে। কিন্তু কাজে যোগদান করার পর চাকরি প্রার্থীদেরকে কোনো বেতন দেওয়া হয় না। ভুক্তভোগীরা কোম্পানির প্রতারণার বিষয়টি বুঝতে পেরে জামানতের টাকা ফেরত চাইলে তারা বিভিন্ন টালবাহানা করতে থাকে এবং টাকা ফেরত দিতে অস্বীকৃতি জানায়।
লেফটেন্যান্ট কর্নেল আরিফ মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, ভুক্তভোগীদের ভয়ভীতি প্রদর্শন করে কাগজে লিখিয়ে নেওয়া হত, তারা স্বেচ্ছায় চাকরি ছেড়ে দিচ্ছে এবং কোম্পানির সঙ্গে তাদের কোনো আর্থিক লেনদেন নেই। এভাবে অভিযুক্তরা গত ৮ মাসে প্রায় ৭০০ থেকে ৮০০ জন চাকরিপ্রার্থীকে তাদের কোম্পানির নিয়োগ ফরম পূরণ করে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয়। সিকিউরিটি গার্ড নিয়োগের নামে তারা কোম্পানি পরিচালনা করলেও এখন পর্যন্ত কোনো সিকিউরিটি গার্ড নিয়োগ দেয়নি।
(ঢাকাটাইমস/০৪আগস্ট/এএ/কেএম)