বেড়িবাঁধ সংস্কার না করলে কুতুবদিয়া জেটি তলিয়ে যাওয়া শঙ্কা দ্বীপবাসীর

ছৈয়দ আলম, কক্সবাজার
 | প্রকাশিত : ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১৫:০৩

পর্যটন জেলায় ৯শ খ্রিস্টাব্দে সাগর বক্ষে জেগে উঠা দ্বীপ কুতুবদিয়া এখন চরম অস্তিত্ব সংকটে। ইতোমধ্যে সাগরে বিলীন হয়েছে এক-তৃতীয়াংশ এলাকা। চারপাশে অব্যাহত ভাঙ্গনে কুতুবদিয়ায় চলছে মানুষের সূখ-দুংখের জোয়ারভাটা। বিশেষ করে এই সময়ে বেড়িবাঁধ সংস্কার না করলে কুতুবদিয়ার ঘরবাড়ি-ফসল-মাঠ অচিরেই সাগরে বিলীন হয়ে যাবে।

এদিকে দ্বীপের মানুষের একমাত্র চলাচলের পথ জেটিঘাট ও পারাপারে চরম ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে প্রতিনিয়ত। অনেক্ষন দাঁড়িয়ে থাকার পরেও কোন মানুষ জরুরী কাজ সরাতে পারছেনা। যার ফলে মানুষের ভোগান্তি আরো দ্বিগুন বৃদ্ধি পেয়েছে। আবার সংশ্লিষ্ট ইজারাদারের বিরুদ্ধে অতিরিক্ত টোল আদায়ের অহরহ অভিযোগ উঠেছে। ইচ্ছা মাফিক ও বিভিন্ন পণ্য আনা-গোনায় যেমন ইচ্ছে তেমন করে আদায় করছে টাকা।

জানা গেছে, প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় ১৯৯১ এর পরে বিধ্বস্ত পুরো কুতুবদিয়া তৎকালীন সরকারের আমলে ব্যাপক পুনর্বাসন, বাঁধ নির্মাণ ও সাইক্লোন শেল্টার প্রতিষ্ঠার করার দীর্ঘ কয়েকযুগ অতিবাহিত হলেও অবহেলিত দ্বীপাঞ্চল কুতুবদিয়ার প্রয়োজনীয় সংস্কার ও বেড়িবাঁধ নির্মাণ কাজ না হওয়ায় প্রতিবছর দ্বীপ ক্ষয় হয়ে আসছে। তারই ধারাবাহিকতায় এ মুহূর্তে বিলীন হওয়ার পথে দ্বীপাঞ্চল কুতুবদিয়া। তারই বাস্তবচিত্র দেখা গেছে-আলী আকবর ডেইল ইউনিয়নে। সরেজমিনে ৩নং ওয়ার্ডের বেড়িবাঁধ ভেঙ্গে একাকার হয়ে গেছে। আগামী বর্ষা মৌসুম আসার আগেই এখন পূর্ণিমার জোয়ারে পানি প্রবেশ করে লবণ মাঠ, ফসলি জমি ও মানুষের ঘরবাড়ি তলিয়ে যায়। সেই সাথে একমাত্র বায়ুবিদ্যুৎ কেন্দ্রও অকেজো হয়ে গেছে।

একসময়ের বাতিঘরের জন্য বিখ্যাত কুতুবদিয়া দ্বীপ, পূর্বদিকে আঁকাবাঁকা নদী সারি সারি প্যারাবন। উত্তরে একমাত্র খর¯্রােতা নদী-কর্ণফুলী, পশ্চিমে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি সমুদ্র সৈকত, শামুক, ঝিনুক এবং ঝাঁকে ঝাঁকে লাল কাঁকড়া। দক্ষিণে সীমানাহীন লবণের মাঠ, উত্তর-পশ্চিম, পূর্ব দক্ষিণ যে দিকেই তাকাই মাঝি-মাল্লার দেখা মিলে, চারদিকে বঙ্গোপসাগরে ঘেরা ২১৫ বর্গ কিলোমিটারের এই দ্বীপটি প্রাকৃতিক খনিজ সম্পদে ভরপুর।

হযরত শাহ আব্দুল মালেক কুতুব আউলিয়ার পুণ্যভূমি, পর্যটক সম্ভাব্য এলাকা, বাংলার চিরচেনা সব ঐতিহ্য বিরাজমান ছিল। কুতুবদিয়াবাসীর ছিল গোলাভরা ধান, পুকুর ভরা মাছ, গোয়াল ভরা গরু, মহিষ, ছাগল, মাঠে-ঘাটে সোনালী ফসল, নদী খালে সোনালী রুপালী নানা প্রজাতির মাছ। কিন্তু এসব আজ হারিয়ে যাচ্ছে আগ্রাসনী সমুদ্রের কবলে। শিক্ষা, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য কোন অংশে পিছিয়ে নেই এই এলাকা। শিক্ষার হার বিবেচনায় কক্সবাজার জেলায় শীর্ষে অবস্থানে রয়েছে। এই ছোট্ট জনপদের লোকজন মানব সম্পদে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশ সরকারের সচিবালয় থেকে শুরু করে নানা পদে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে আসছে এই এলাকার কৃতি সন্তানেরা।

সরেজমিনে দেখা গেছে, এই অঞ্চলের লোকজন পেশায় সামুদ্রিক মাছ আহরণ ও লবণ চাষাবাদে জড়িত। কিন্তু প্রাকৃতিক প্রতিকূলতা, মানবসৃষ্ট ধূ¤্রজালে তালবেতাল হয়ে পড়েছে। এই এলাকার জনজীবন, হারিয়ে ফেলেছে জীবন যাত্রার ছন্দ। তীব্র রোদে লবণ চাষীরা ব্যস্ত সময় পার করছে। অপরদিকে মাছ আহরনে সমুদ্রের পাড়ে আর সাগরে দম ফুরানোর সময় পাচ্ছেনা। স্থানীয়রা জানিয়েছেন, কুতুবদিয়ায় বলতে গেলে কোন মানুষ বেকার নেই। এলাকায় যার যার মত কাজে ব্যস্ত থাকে সবসময় মানুষ।

আলী আকবর ডেইল ইউনিয়নের ৩নং ওয়ার্ডের বাসিন্দা আবদুল মজিদ জানান, আমাদের মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর আগেই প্রকৃতি জীবন যাত্রার অগ্রগতিকে থামিয়ে দেয়। দ্বীপের সকল মানুষ হাজারো স্বপ্ন নিয়ে প্রতিকুলতার মাঝে সমুদ্র উপকণ্ঠে বসবাস করে আসছে লাখো মানুষ। শিক্ষা, সংস্কৃতি ঐতিহ্য নিয়ে অগ্রসর হতে চাইলেও বাধার সম্মুখীন হতে হচ্ছে প্রতিনিয়ত। বর্ষা এলেই আতঙ্ক বিরাজ করে দ্বীপবাসীর মাঝে। বারবার প্রাকৃতিক দুর্যোগ, নদীভাঙন, জলোচ্ছ¡াস লÐভÐ করে দেয় স্বাভাবিক জীবনযাত্রা।

তিনি আক্ষেপ করে আরো বলেন, দুর্যোগের কারণে সহায় সম্পত্তি, বসতবাড়ি জমি জমা হারিয়ে নিঃস্ব হতে হচ্ছে আমাদের। দ্বীপবাসীর মাঝে হতাশা চরমভাবে লক্ষণীয়, প্রতিনিয়ত পানির স্বাভাবিক উচ্চতা বাড়ছে। নিম্নাঞ্চল জোয়ারের পানিতে ভাসে সবসময়। যার ফলে উদ্বাস্তু মানুষের সংখ্যা বাড়ছে, ভাসমান পরিবার বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ এক বিভীষিকাময় জীবন, নিয়তির কাছে হার মানতে হচ্ছে দ্বীপবাসীর।

স্থানীয় সমাজসেবক আতিকুর রহমান জানান, দ্বীপের মানুষের দুঃখ কেউ বুঝে না। ভাঙন আর জোয়ারে বিলীন হচ্ছে এলাকা। নেই স্থায়ী বেড়িবাঁধ নির্মাণ ও সংস্কার। বর্ষা এলেই জোড়াতালি দিতে দেখা যায় শুধু।

জানা গেছে, ১৯৯১ সালের তাণ্ডবে উপকূলীয় এলাকায় প্রায় ১ লাখ ৩৮ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়। এর সিংহভাগ ছিল কুতুবদিয়া এবং তার আশপাশের এলাকার। বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্টের তথ্য অনুযায়ী ৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়ে কুতুবদিয়ার ৬টি ইউনিয়নে প্রাণহানি ঘটে ৯ হাজার ১৫ জনের। সরকারি তথ্য অনুযায়ী ১৫ হাজার ও বেসরকারী তথ্য অনুযায়ী ৪০ হাজার মানুষের প্রাণহানি ঘটে। আজ এতো বছর পেরিয়ে গেলেও মানুষের জানমালের ক্ষয়ক্ষতি পুষিয়ে উঠতে পারেনি। বর্তমানে কুতুবদিয়ার চার পাশের প্যারাবন, ঝাউবন এখন উজাড় প্রায়।

সচেতন শাফায়েত হোসেন, আবদুল কুদ্দুস ও ওয়াসিম আকরাম জানান, স্থানীয় প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতারা ক্ষমতার অপব্যবহার করে, সরকারের ছত্রছায়ায় লবণমাঠ, চিংড়ি ঘের ইত্যাদি নির্মাণের জন্য উপকূলীয় প্যারাবনের শত শত গাছ যেমন-বাইন, কেউড়া, ঝাউবন ইত্যাদি রাতারাতি উজাড় করে দিয়েছে। অনেক স্থানীয় প্রতিনিধি রক্ষক সেজে ভক্ষক হয়েছে। এভাবে হলে আমরা কোথায় যাব। তাদের কারনে দ্বীপে উন্নয়ন হচ্ছে না।

কুতুবদিয়া হাই স্কুলের ছাত্র আনিসুর রহমান বলেন, দ্বীপ থেকে পারাপারে ও জেটিতে শিক্ষার্থীদের কোন সুযোগ-সুবিধা নেই। পর্যাপ্ত স্পীড বোট ও নৌযান নেই। ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থেকেও জরুরী কাজে যাওয়া যায়না। বিদ্যুতের অভাবে ঠিকমত পড়ালেখা করতে পারছিনা। আবার টেনশন থাকে কখন বাড়িতে জোয়ারের পানি ডুকে।

কুতুবদিয়ার সন্তান সাংবাদিক হুমায়ুন কবির সিকদার জানান, কুতুবদিয়া এখনো অবহেলিত থেকে গেছে। কুতুবদিয়াকে রক্ষা করতে চাইলে অবশ্যই কার্যকরী উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। এব্যাপারে আমরা প্রতিনিয়ত আন্দোলন সংগ্রাম করে আসছি। তবুও দ্বীপের মানুষের কাছে সংশ্লিষ্ঠরা এগিয়ে আসে না।

তিনি আরো বলেন, প্রবল সামুদ্রিক জোয়ারের কারণে পানিতে তলিয়ে যাচ্ছে, ঘর বাড়ি, ক্ষেত-খামার, এখানে রয়েছে দেশের একমাত্র বায়ুবিদ্যুৎ প্রকল্প। বর্তমানে প্রকল্পটি ধ্বংসাবশেষে পরিণত হয়েছে। শুধুই লোক দেখানো প্রকল্প চালিয়ে যাচ্ছে একটি মহল।

সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান আ.স.ম শাহরিয়ার চৌধুরী জানান, আমার ইউনিয়নটি উপজেলার একমাত্র জনবহুল ইউনিয়ন। বর্তমানে ইউনিয়নের আওতাভুক্ত অনেক এলাকা আজ বিলীন হয়ে গেছে। এভাবে বারবার বিলীন হচ্ছে আলী আকবর ডেইল। এছাড়াও ধুরুং, আকবর বলীরপাড়া, চর ধুরুং, কৈয়ারবিল, কাইছারপাড়া, জালিয়াপাড়াসহ বিভিন্ন গ্রামে জোয়ার-ভাটার পানি আনাগোনা অব্যাহত আছে। তিনি দ্রæত দ্বীপের উন্নয়নসহ মানুষের জানমাল নিরাপত্তায় সরকারকে এগিয়ে আসার আহবান জানান।

উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা: গোলাম মোস্তফা নাদিম বলেন, স্বাস্থ্যক্ষেত্রে দ্বীপ উপজেলা এখন অনেক উন্নত হয়েছে। সরকারী সুযোগ সুবিধায় এলাকার সব মানুষ সেবা পাচ্ছে। বর্তমান নরমাল ডেলিভারীও হচ্ছে নিয়মিত। পুরো উপজেলায় স্বাস্থ্যসেবা দিতে বদ্ধ পরিবার স্বাস্থ্য বিভাগ।

কুতুবদিয়া থানার ওসি মিজানুর রহমান জানান, কুতুবদিয়ার আইন-শৃংখলা পরিবেশ অনেক ভালো রয়েছে। বলতে গেলে কোন দস্যু, ডাকাত, চোর এলাকা ছেড়ে পালিয়েছে আবার অনেককে গ্রেপ্তার করে জেলহাজতে প্রেরণ করা হয়েছে। আগামিতেও শান্তি-শৃংখলা বজায় রাখার সর্বাত্মক চেষ্টা অব্যাহত থাকবে।

(ঢাকাটাইমস/২৩ফেব্রুয়ারি/এআর)

সংবাদটি শেয়ার করুন

বাংলাদেশ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :