রাঙ্গাবালী ছাত্রলীগে কী হচ্ছে? কেন এত সমালোচনা?
পটুয়াখালী জেলা ছাত্রলীগের নতুন কমিটির প্রথম পদক্ষেপই সমালোচনার জন্ম দিয়েছে। গত ১৫ মার্চ রাঙ্গাবালী উপজেলা ছাত্রলীগ ও রাঙ্গাবালী কলেজ ছাত্রলীগের কর্মিসভা করে নতুন কমিটি গঠনের লক্ষ্যে জীবন বৃত্তান্ত সংগ্রহ করে পটুয়াখালী জেলা ছাত্রলীগ।
পরবর্তীতে কেন্দ্রীয় নির্দেশনা ভঙ্গ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে প্রেস বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে দেওয়া হয় রাঙ্গাবালী উপজেলা ও কলেজ ছাত্রলীগের কমিটি।
কর্মিসভার এক সপ্তাহ পর গত ২২ মার্চ পটুয়াখালী জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি সাইফুল ইসলাম ও সাধারণ সম্পাদক তানভীর হাসান আরিফ স্বাক্ষরিত এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে এই দুই কমিটি ঘোষণা করা হয়। সেই বিজ্ঞপ্তি প্রচার করা হয় তাদের ফেসবুক আইডি থেকে।
তবে এর আগে এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের উদ্দেশে ১০টি নির্দেশনা প্রদান করে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ। যার মধ্যে রয়েছে-জেলা, মহানগর, বিশ্ববিদ্যালয় শাখা সম্মেলন ব্যতীত তাদের অধীনস্থ কোনো ইউনিটের কমিটি গঠন করা যাবে না।
কেন্দ্রীয় নির্দেশনা অমান্য করে প্রেস বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে কমিটি দেওয়ায় নানা মহলে সমালোচনার ঝড় ওঠে। সমালোচনা চলার মধ্যে প্রকাশ্যে আসে আর এক চাঞ্চল্যকর ঘটনা।
গুঞ্জন ওঠে, রাঙ্গাবালী উপজেলা ছাত্রলীগের কমিটিতে স্থান পাওয়া একাধিক নেতার সঙ্গে রয়েছে বিএনপির রাজনীতির সংশ্লিষ্টতা। কারো পরিবার বিএনপির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে সংশ্লিষ্ট কেউ আবার পূর্বে নিজেই সরাসরি জড়িত ছিল।
সমালোচনা পিছু ছাড়ছে না সাইফুল-আরিফের। জেলা ছাত্রলীগের বর্তমান কমিটি গঠনের দিনই সমালোচনার বোঝা কাঁধে চেপে বসে জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক তানভীর হাসান আরিফের।
গত বছরের ৯ নভেম্বর কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের এক প্রেস বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে সাইফুল ইসলামকে সভাপতি এবং তানভীর হাসান আরিফকে সাধারণ সম্পাদক করে পটুয়াখালী জেলা ছাত্রলীগের ৫৭ সদস্য বিশিষ্ট নতুন কমিটি ঘোষণা করার পর নবগঠিত কমিটির সাধারণ সম্পাদক আরিফকে শুভেচ্ছা জানিয়ে আনন্দ মিছিল করে তার সমর্থকরা।
ওই আনন্দ মিছিলে বিএনপি ও শহীদ জিয়ার স্লোগান দেওয়ার একটি ভিডিও ফেজবুকে ভাইরাল হয়। যা নিয়ে তাৎক্ষণিক বিভিন্ন গণমাধ্যমে সংবাদ প্রচার হয়েছে। এমন ন্যক্কারজনক ঘটনায় তেলে-বেগুনে জ্বলে ওঠে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। বিষয়টি নিয়ে জেলা আওয়ামী লীগের বহু নেতাকর্মী সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিভিন্ন মন্তব্যে হতাশা প্রকাশ করেন।
শুরু থেকেই জেনো বিএনপির গন্ধ লেগে আছে জেলা ছাত্রলীগের গায়। নেতা-কর্মীদের মাঝে তৈরি হয় হতাশা। এ ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই সামনে আসে নতুন ঘটনা।
রাঙ্গাবালী উপজেলা ছাত্রলীগের নব গঠিত কমিটির সভাপতি আরিফ হোসেন। যাকে দেখা যায় জেলা বিএনপির ফ্রন্ট লাইনের নেতাদের সঙ্গে একই ছবির ফ্রেমে। এ ছবি ঢাকা টাইমস প্রতিনিধির কাছে সংগৃহীত আছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, একসময় ছাত্রদলের সক্রিয় কর্মী ছিল এই আরিফ। যা নিয়ে ফেসবুকে বিভিন্ন লেখালেখি চলছে।
রাঙ্গাবালী বার্তা নামের একটি ফেসবুক পেজ থেকে জেলা ছাত্রলীগের নেতৃবৃন্দকে উদ্দেশ করে লেখা হয়েছে, ‘ছাত্রদলের ছেলেগুলোকে রাঙ্গাবালী উপজেলা ছাত্রলীগে জায়গা দেওয়ায় ধন্যবাদ সাইফুল-আরিফ।’
রাঙ্গাবালী উপজেলা ছাত্রলীগের ১নং সহ-সভাপতি মাহমুদ হোসেন টিটু। যার আপন চাচা মো. শাহিন ফরাজী ঢাকা কলেজ ছাত্রদলের যুগ্ম-সম্পাদকের দায়িত্বে ছিলেন। খোঁজ নিয়ে জানা যায় তিনি এখনো সরাসরি যুক্ত আছেন বিএনপির রাজনীতিতে।
কমিটির ২ নং সহ-সভাপতি মো. ইমরান মাহমুদ। যার আপন চাচা মো. আব্বাস উদ্দীন হাওলাদার বর্তমান উপজেলা বিএনপির যুগ্ম- সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন।
কমিটির ৬ নং যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক মো. শিমুল। যার মা মোসা. সাহিদা গাজী ১৫ নং চরমোন্তাজ ইউনিয়ন বিএনপির কার্যনির্বাহী সদস্য।
প্রথমে প্রেস বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে উপজেলা ছাত্রলীগের ২৪ সদস্য বিশিষ্ট কমিটি প্রকাশের কিছুক্ষণের মধ্যেই আরেকজন যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক মো. রায়হান এর নাম দিয়ে ২৫ বিশিষ্ট কমিটি গঠন করে ফেসবুকে প্রকাশ করে সভাপতি-সম্পাদক।
অলৌকিক ক্ষমতায় শেষে যুক্ত হওয়া এই যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক মো. রায়হান সরাসরি জড়িত বিএনপির রাজনীতিতে। রায়হানের নিজের তোলা একটি সেলফিতে রায়হানকে দেখা যায় বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা এ বি এম মোশাররফ হোসেনের সঙ্গে। এই ছবি নিজের ফেসবুক আইডিতে পোস্ট করেন রায়হান। এই পোস্টের স্ক্রিনশট ও বিএনপি নেতার সঙ্গে রায়হানের সেলফি দৈনিক ঢাকা টাইমসের কাছে রয়েছে।
এছাড়া খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২৫ সদস্য বিশিষ্ট কমিটির প্রায় ১৫ জনই রাজনীতির সঙ্গে খুব একটা জড়িত নন। আর কমিটির বাকি প্রায় ১০ জনের সঙ্গেই রয়েছে বিএনপির সংশ্লিষ্টতা।
এছাড়া জেলা ছাত্রলীগের একাধিক নেতাকর্মী জানান, জেলা কমিটির নেতাদের সঙ্গে কোনোভাবে সমন্বয় না করে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক একক ক্ষমতা বলে কমিটি করেছে। জেলা ছাত্রলীগের সুপার কমিটির অন্যান্য নেতৃবৃন্দের সঙ্গে সমন্বয় না করে একক ক্ষমতা বলে কিভাবে কমিটি গঠন করা হয়? এমনটাই প্রশ্ন জেলা ছাত্রলীগের একাধীক নেতৃবৃন্দের।
রাঙ্গাবালী উপজেলা ছাত্রলীগ নেতা মো. নেছার খান বলেন, আমি চ্যালেঞ্জ নিয়ে বলতে পারি কমিটিতে যাদের রাখা হয়েছে তারা ননপলিটিক্যাল। কখনো তেমনভাবে রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলো না। আর বাকি যারা আছে তাদের বিএনপির সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা রয়েছে।
আমি উপজেলার সাধারণ সম্পাদক পদপ্রার্থী ছিলাম। ছাত্রলীগের জন্য বহুবার হামলা-মামলার স্বীকার হয়েছি। অনেক শ্রম দিয়েছি। আমাকে কমিটিতেই রাখলো না। যাদের রাখলো তাদের এই অবস্থা। আমি নেই ঠিকাছে, তাও মেনে নিলাম। কিন্তু যাদের কমিটিতে রাখছে তারা যদি যোগ্য হতো তবে আমার কোন বক্তব্য থাকতো না।
পটুয়াখালী জেলা ছাত্রলীগের নতুন কমিটির প্রথম পদক্ষেপে এত বড় ভুল কিভাবে হলো? নাকি জেনে শুনেই বিএনপি-জামায়াত সংশ্লিষ্ট ছেলেদের কমিটিতে এনেছে। এমন প্রশ্ন ঘুরে বেড়াচ্ছে নানা মহলে।
আরও অবাক করা বিষয়, জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক তানভীর হাসার আরিফকে নিয়েও রয়েছে বিএনপি সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ। তার পরিবার বিএনপির রাজনীতিতে ওতোপ্রোতভাবে জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে। আরিফের বাবা জামান গাজী পটুয়াখালী পৌর বিএনপির ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প সম্পাদক। এ নিয়ে জেলা কমিটি গঠনের পূর্বে একাধিক গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশ হয়েছে। আরিফের এই বিএনপি সংশ্লিষ্টতার খবর জানতো তৎকালীন কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সভাপতি-সম্পাদক স্বয়ং। তবুও অলৌকিক ক্ষমতা বলে জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদকের চেয়ারে অধিষ্ঠিত হয় তানভীর হাসান আরিফ।
বাবার ও পরিবারের বিএনপির রাজনীতিতে জড়িত থাকার ব্যাপারে আরিফকে মুঠোফোনে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি ও আমার পরিবার যদি বিএনপির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থাকতাম তবে আজকে তো আমি জেলা ছাত্রলীগের সেক্রেটারি, এই পর্যায়ে আসতে পারতাম না। আপনি আমার বিষয়ে খোঁজ নিয়ে দেখেন।
আপনার বিরুদ্ধে অভিযোগ মিথ্যা হলে আপনি প্রতিবাদ করলেন না কেন? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ একেবারেই ভিত্তিহীন। এগুলো মিথ্যা।
রাঙ্গাবালী উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতিসহ অভিযুক্ত ৫ জন সদস্য কীভাবে কমিটিতে আসলো এমন প্রশ্নের জবাবে আরিফ বলেন, আপনি প্রথমে কী বললেন সভাপতি বিএনপির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট? কিন্তু আমরা জানি এই ছেলে এর আগে উপজেলার সাংগঠনিক সম্পাদক ছিল। সে স্কুলজীবন থেকেই ছাত্রলীগ করে৷ তাছাড়া আমরা উপজেলা আওয়ামী লীগ, স্থানীয় সংসদ সদস্যসহ সিনিয়র নেতৃবৃন্দের সঙ্গে আলোচনা করেই কমিটি দিয়েছি। এরপরেও যদি এমন অভিযোগ থেকে থাকে আর তা যদি সত্যি হয় তবে আমরা অবশ্যই সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেবে।
জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি সাইফুল ইসলামকে রাঙ্গাবালী উপজেলা ছাত্রলীগের নব-গঠিত কমিটির এই আলোচনা-সমালোচনা নিয়ে মুঠোফোনে প্রশ্ন করতে চাইলে তিনি ব্যস্ত থাকার অজুহাত দেখিয়ে, পরে যোগাযোগ করতে বলে ফোন কেটে দেয়। তার পরবর্তীতে তাকে একাধিকবার ফোন করলেও রিসিভ করেননি।
এদিকে, উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি অধ্যক্ষ দেলোয়ার হোসেন কমিটিতে স্থান পাওয়া নেতাদের বিরুদ্ধে বিএনপির সংশ্লিষ্টতার কথা স্বীকার করে মুঠোফোনে জানায়, যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তাদের পরিবার বিএনপির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থাকতে পারে। কিন্তু তারা এখন ছাত্রলীগের কর্মী। এ বিষয়ে আমাদের আসলে কোনো বক্তব্য নাই।
এ বিষয়ে উপজেলা আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক সাইদুজ্জামান মামুন খান মুঠোফোনে জানান, বিএনপির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এমন কাউকে কমিটিতে রাখার কথা না। তারপর আমি দেখছি। যদি অভিযোগ সত্য হয় তবে আমরা জেলা ছাত্রলীগকে এ ব্যাপারে লিখিতভাবে অবহিত করবো এবং উপযুক্ত ব্যবস্থা নেব।
এ বিষয়ে পটুয়াখালী-৪ আসনের সংসদ সদস্য অধ্যক্ষ মহিব্বুর রহমান মহিবের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তার সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।
এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে একাধিকবার ফোন করা হলেও তারা তা রিসিভ করেনি৷
এ বিষয়ে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা কাজী আলমগীর বলেন, এ বিষয়ে আমরা কিছু জানি না। যদি বিএনপি ঘরানার কেউ থেকে থাকে আর তার প্রমাণ যদি থাকে তবে আপনারা পত্রিকায় প্রকাশ করুন। এ বিষয়টায় আমাদের প্রতিবাদ আছে। প্রানের এই সংগঠনকে কেউ কলুষিত করতে চাইলে তার বিরুদ্ধে অবশ্যই ব্যবস্থা নেয়া হবে৷ প্রমাণ হাতে পেলে আমরা কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে জানাবো। এ বিষয়ে দ্রুত ব্যবস্থা যাতে নেয়া হয় সে বিষয়ে কথা বলবো৷
জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বীর মুক্তিযোদ্ধা ভিপি আবদুল মান্নান বলেন, যদি সত্যিই এমনটা হয়ে থাকে আপনারা পত্রিকায় দিয়ে দিন। আমাদের কোনো আপত্তি নাই। অভিযোগ সত্য হলে আমরা আপনাদের সহযোগিতা করবো৷ কথা দিলাম অবশ্যই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেব। এই বিষয়ে আপনারা নিশ্চিত থাকেন।
(ঢাকাটাইমস/৬এপ্রিল/এআর)