ভূমিখেকোদের দখলে বেলাই বিল, আদালতের সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে চলছে বালু ভরাট

কালীগঞ্জ (গাজীপুর) প্রতিনিধি, ঢাকাটাইমস
| আপডেট : ৩০ আগস্ট ২০২৩, ১৮:৩৩ | প্রকাশিত : ৩০ আগস্ট ২০২৩, ১৭:৪০

গাজীপুর জেলার সদর, কালীগঞ্জ, কাপাসিয়া ও শ্রীপুর উপজেলা বিভিন্ন এলাকা জুড়ে বয়ে গেছে প্রায় ৪০ বর্গকিলোমিটার আয়তনের বেলাই বিল। বিশাল আয়তনের এ বিল থেকে জেলার এক তৃতীংশ মানুষের মাছের চাহিদা মিটে। বেলাই বিলকে ঘিরে চার উপজেলার শত শত মানুষ জীবিকা নির্বাহ করে। সেই বেলাই বিল আজ ভালো নেই। ভূমি খেকো কোম্পানী ও এলাকার কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তিদের লোলুপ দৃষ্টিতে হুমকির মুখে পড়েছে বিলটি। আদালতের সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে চলছে বালু ভরাট। চটকদার বিজ্ঞাপন দিয়ে চলছে আবাসন ব্যবসা। এতে বিল পারের শিল্প কারখানাগুলোর বর্জ্য ও দূষিত পানিতে ধংস হচ্ছে প্রাকৃতিক পরিবেশ, হুমকিতে পড়েছে বেলাইয়ের জীববৈচিত্র্য। এতে এই বিলের হাজারো উপকারভোগী মানুষের মধ্যে চলছে নীরব কান্না। প্রভাবশালীদের অর্থ ও ক্ষমতার দাপটের মুখে অসহায় হয়ে পড়েছেন তারা।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, টঙ্গী-কালীগঞ্জ-ঘোড়াশাল মহাসড়কের পিপুলিয়া থেকে নলছাটা সংলগ্ন বেলাই বিলের বিশাল এলাকাজুড়ে তেপান্তর, নর্থ-সাউথ গ্রুপ ও কে এম ইউসুফ আলী অ্যান্ড গংয়ের সাইনবোর্ড লাগানো। সড়কের পাশে রয়েছে তেপান্তর গ্রুপের সাইড অফিস এবং ওই সাইড অফিস সংলগ্ন মহাসড়কের পাশে বিল বেলাইয়ের কিছু অংশ ভরাট করে দুটিস্থানে তেপান্তরের পাকা স্থাপনা করে তাতে বড় সাইনবোর্ড বসানো হয়েছে। পাশেই নর্থ-সাউথ গ্রুপ বিলের মধ্যে রাস্তা করে পানির ওপরে তৈরি হচ্ছে পাকা স্থাপনা। একই জায়গায় ‘কে এম ইউসুফ আলী অ্যান্ড গং’ লেখা নতুন সাইনবোর্ড বসানো হয়েছে অতি সম্প্রতি। পূবাইল ব্রিজের নিচ থেকে বালু নদীর ওপর ড্রেজার বসিয়ে সড়কের পাশ দিয়ে বালু উত্তোলনের পাইপ টানা হয়েছে প্রায় এক কিলোমিটার এলাকা জুড়ে। ইতোমধ্যে বিলের মাঝখানে বেশখানিকটা জায়গা ভরাট করা হয়েছে। আর ওই ভরাট অংশে বেড়ে উঠেছে কাশবন।

স্থানীয়রা জানান, কাশবন গজিয়ে ওঠা জায়গা কয়েক বছর আগেই ভরাট করা হয়েছে। এরপর উচ্চ আদালতের নির্দেশে প্রশাসনের লোকজন এসে ড্রেজার বন্ধ করে দেয় এবং কিছু সাইনবোর্ড উঠিয়ে ফেলা হয়। প্রশাসনের লোক চলে গেলে আবার উঠিয়ে ফেলা সেই সাইনবোর্ড পুনরায় বসানো হয়। দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার পর আবারও ওই চক্রটি রাতের আঁধারে করছে বালু ভরাট।

স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, কোম্পানিগুলো এলাকার প্রভাবশালী ও গুন্ডা প্রকৃতির লোকজনকে জমির দালাল নিয়োগ করেছে। তারা ভয়ভীতি দেখিয়ে নামমাত্র মূল্যে কৃষককে জমি বিক্রিতে বাধ্য করছে। বাড়িতে বসেই কমিশনে হচ্ছে জমি রেজিস্ট্রি। নর্থ-সাউথ গ্রুপের সাইনবোর্ডের পাশে কে এম ইউসুফ আলী অ্যান্ড গং লেখা সাইনবোর্ড কার? জানতে চাইলে স্থানীয় বাসিন্দা রওশন বলেন, কোম্পানির নামে জলাভূমি ভরাটে নিষেধাজ্ঞা আছে। তাই ব্যক্তিমালিকানা সাইনবোর্ড লাগিয়ে ভরাট করছে। ইউসুফ আলী নর্থ-সাউথ গ্রুপেরই ব্যবস্থাপনা পরিচালক।

এদিকে, আবাসন প্রকল্পের চটকধারী বিজ্ঞাপন অনুযায়ী শুধু নর্থ-সাউথ গ্রুপেরই দখলে আছে বিল বেলাইয়ের ৩ হাজার বিঘারও বেশি জমি। অন্যদিকে, চটকধারী বিজ্ঞাপন অনুযায়ী বিল বেলাইয়ে তেপান্তর গ্রুপেরও দখলে রয়েছে প্রায় একই পরিমাণ জমি।

স্থানীয় একটি সূত্র জানায়, বেলাই বিলে সাইনবোর্ড বসানো অধিকাংশ জায়গা এখনো ব্যক্তিমালিকানাধীন। প্রতি সাইনবোর্ড বসানের জন্য মাসে জমির মালিককে দেওয়া হয় ১ হাজার টাকা। শুধু ম্যাপ বানিয়ে চার বছরের বেশি সময় ধরে প্লট বিক্রি করছে বেলাই বিল দখল করা কোম্পানিগুলো।

তেপান্তর হাউজিং লিমিটেডের প্রজেক্ট ম্যানেজার মামুন আহমেদ বলেন, আমরা বর্তমানে কোনো বালু ভরাটের কাজ করছি না। জেলা পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে অনুমতি পেলে তারপর আমরা বেলাই বিলে পুনরায় হাউজিং প্রকল্পের কাজ শুরু করবো।

নর্থ সাউথ গ্রুপের এজিএম হুমায়ুন কবিরের ব্যবহৃত মুঠোফোনে ফোন করলে তিনি প্রতিবেদকের পরিচয় পেয়ে বলেন, আমি মিটিং এ আছি। এ বিষয়ে কিছু জানতে চাইলে আমাদের বনানী অফিসে আসেন, বলেই তিনি ফোনের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করেন।

বাংলাদেশ রিভার ফাউন্ডেশন চেয়ারম্যান মুহাম্মদ মনির হোসেন বলেন, নর্থ সাউথ হাউজিং ও তেপান্তর হাউজিং লিমিটেড আইন ভঙ্গ করে বিলের জমিতে বালি ভরাট করছে। কখনই উন্মুক্ত জলাধারের জমি কোনো আবাসন প্রতিষ্ঠানের নামে জারি হওয়ার সুযোগ নেই। এটা হয়ে থাকলে তা হবে আইনের বড় ধরনের লঙ্ঘন। এ বিষয়ে অবশ্যই সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া উচিত।

বেলাই বিলে আবাসনের অনুমতির ব্যাপারে জানতে চাইলে পরিবেশ অধিদফতরের গাজীপুর জেলা অফিসের উপ-পরিচালক মো. নয়ন মিয়া বলেন, কখনই কোনো প্রতিষ্ঠান উন্মুক্ত জলাশয় ভরাট করতে পারে না। আইন ভঙ্গ করে তেপান্তর হাউজিং লিমিটেড ও নর্থ সাউথ গ্রুপ বেলাই বিলে বালু ভরাট করছে বলে আমরাও অভিযোগ পেয়েছি। তদন্ত সাপেক্ষে তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হবে।

গাজীপুর সদরের সহকারী কমিশনার (ভূমি) রাফে মোহাম্মদ ছড়া বলেন, ২০১০ সালের জলাশয় আইন অনুযায়ী বিভাগীয়, জেলা ও পৌর শহরের জলাশয় ভরাট করা যাবে না। খালের পাশে বিলের জায়গাগুলো ব্যক্তিগত হলেও ভরাট করা যাবে না। এ ছাড়া হাই কোর্টের নির্দেশনা মোতাবেক বেলাই বিল ও আশপাশের জলাশয়গুলোয় বালু ভরাট, অবৈধ দখল ও সাইনবোর্ড টানানো যাবে না। এরই মধ্যে আমরা খবর পেয়ে নোটিশ করে দিয়েছি। নোটিশের পরও যদি তারা এ বালু ভরাটের কাজ করে তাহলে তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

কালীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আজিজুর রহমান বলেন, যেখানে হাই কোর্টের নিষেধাজ্ঞা রয়েছে এবং জেলা প্রশাসনের নির্দেশনা রয়েছে সেখানে কারো সঙ্গে সমঝোতার কোনো সুযোগ নেই। তা সে যত বড় শক্তিশালীই হোক। যেহেতু জেলা সদর ও কালীগঞ্জ উপজেলায় এ বিলের অবস্থান তাই ডিসি স্যারের নির্দেশনায় দুই উপজেলা প্রশাসন যৌথভাবে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

(ঢাকাটাইমস/৩০আগস্ট/এআর)

সংবাদটি শেয়ার করুন

বাংলাদেশ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :