প্রকৃতিপ্রেমীতে মুখরিত শেরপুরের পর্যটন কেন্দ্র
ঈদের ছুটি উপভোগে শেরপুরের পর্যটন কেন্দ্রগুলোতে ভিড় করছেন প্রকৃতিপ্রেমী দর্শনার্থীরা। তাদের পদচারণায় মুখরিত হয়ে উঠেছে বিভিন্ন পর্যটন স্পট।
ঈদের আমেজ উপভোগ করতে জেলার ঝিনাইগাতী, শ্রীবরদী ও নালিতাবাড়ীর উপজেলার বনাঞ্চলের বিভিন্ন পর্যটন কেন্দ্রে ভিড় করছেন তারা।
স্থানীয়রা জানান, ওইসব পর্যটন কেন্দ্রে পরিবার-পরিজন নিয়ে নৈসর্গিক দৃশ্য দেখতে ছুটে আসছেন বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার হাজার হাজার মানুষ।
এদিকে বিনোদন কেন্দ্রগুলোতে আসা দর্শনার্থীদের নিরাপত্তায় বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছে জেলা পুলিশ। শেরপুর শহরে কর্মরত একটি বেসরকারি কলেজের প্রভাষক সজীব আনসারী বলেন, পর্যটকদের খুব সহজেই আকৃষ্ট করে ঝিনাইগাতীর গজনী অবকাশ পর্যটন কেন্দ্র, নালিতাবাড়ীর মধুটিলা ইকোপার্ক, পানিহাতা তাড়ানি ও শ্রীবরদীর রাজার পাহাড়ের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। এখানে প্রতিনিয়ত হাতছানি দিয়ে ডাকে অপরূপ রূপের পাহাড়। ছোট-বড় ও মাঝারি টিলা, সমতলভূমির সেগুনবাগান আর লতাপাতার সবুজের সমারোহ মনে দোলা দেয় প্রকৃতিপ্রেমীদের।
এছাড়া জেলা সদরের শ্যামলী শিশু পার্ক, দারোগ আলী পৌর শিশুপার্ক, গোল্ডেন ভ্যালি পার্ক এবং অর্কিড দর্শনার্থীদের কোলাহলে পরিপূর্ণ থাকে।
কবি ও ছড়াকার সজল আশরাফ বলেন, গারো পাহাড় প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপূর্ব লীলাভূমি। ঝিনাইগাতীর ঐতিহ্যবাহী গারো পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত গজনী অবকাশ পর্যটন কেন্দ্র। এখানে রয়েছে সারি সারি শাল, গজারি, সেগুন গাছ। ছোট-বড় মাঝারি টিলা, লতাপাতার বিন্যাসও প্রকৃতি প্রেমীদের ভীষণভাবে আকৃষ্ট করে। তিনি আরও বলেন, ভারতের মেঘালয় রাজ্যের কোল ঘেঁষে ও বাংলাদেশের উত্তর সীমান্তে অরণ্যরাজি আর গারো পাহাড় এলাকার পাহাড়ি নদী ভোগাই, চেল্লাখালি, মৃগী, সোমেশ্বরী, মালিঝি, মহারশীর ঐশ্বরিক প্রাচুর্য স্নাত জনপদ শেরপুর। এই জেলার বিশাল অংশজুড়ে গারো পাহাড়ের বিস্তৃতি। লাল মাটির উঁচু পাহাড়। গহিন জঙ্গল, টিলা, মাঝে সমতল। দুই পাহাড়ের মাঝখান দিয়ে ছন্দ তুলে পাহাড়ি ঝর্ণার এগিয়ে চলা। পাহাড়, বনানী, ঝর্ণা, হ্রদসহ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অনেক সংযোজনই রয়েছে গজনী অবকাশ কেন্দ্রে।
জানা যায়, জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে বেশ কিছু স্থাপনা ও ভাস্কর্য তৈরি হয়েছে গজনী অবকাশ পর্যটন কেন্দ্রে। এর প্রবেশমুখে রয়েছে জলপরী, ডাইনোসরের প্রতিকৃতি, ড্রাগন টানেল, দণ্ডায়মান জিরাফ, পদ্ম সিঁড়ি, লেক ভিউ পেন্টাগন, হাতির প্রতিকৃতি, স্মৃতিসৌধ, গারো মা ভিলেজ, ওয়াচ টাওয়ার অন্যতম। পূর্বে ছোট পরিসরে একটি চিড়িয়াখানায় নতুন করে সংযুক্ত করা হয়েছে মেছো বাঘ, অজগর সাপ, হরিণ, ভাল্লুকসহ প্রায় ৪০ প্রজাতির প্রাণী।
এছাড়া গারো পাহাড়ের বুক জুড়ে তৈরি করা হয়েছে সুদীর্ঘ ওয়াকওয়ে। পায়ে হেঁটে পাহাড়ের স্পর্শ নিয়ে লেকের পাড় ধরে হেঁটে যাওয়া যাবে এক পাহাড় থেকে অন্য পাহাড়ে। উঁচু পাহাড় থেকে জলপ্রপাত তৈরি হয়েছে। আগত শিশু দর্শনার্থীদের জন্য চুকুলুপি চিলড্রেনস পার্কের পাশাপাশি নতুন যুক্ত হয়েছে শিশু কর্নার। থাকছে শেরপুর জেলা ব্র্যান্ডিং কর্নার। ‘পর্যটনের আনন্দে, তুলসীমালার সুগন্ধে শেরপুর’ এ স্লোগানে শেরপুর জেলা ব্র্যান্ডিংয়ের জন্য নির্মিত ব্র্যান্ডিং কর্নারে জেলার বিভিন্ন ইতিহাস-ঐতিহ্য সম্বলিত ছবি, পুস্তক, ভিডিওচিত্র থাকবে। জেলার ব্র্যান্ডিং পণ্য তুলসীমালা চালের জন্যও থাকছে নির্দিষ্ট স্থান। এক পাহাড় থেকে অন্য পাহাড়ে যাওয়ার জন্য তৈরি করা হয়েছে ক্যাবল কার। যা গজনী অবকাশে আগত ভ্রমণ পিপাসুদের জন্য আলাদা মাত্রা যোগ করেছে।
পাশাপাশি ভ্রমণপিপাসুদের জন্য গজনী অবকাশ কেন্দ্রে রয়েছে ক্রিন্সেন্ট লেক, লেকের ওপর রংধনু ব্রিজ, কৃত্রিম জলপ্রপাত। রয়েছে শিশু পার্ক, কাজী নজরুল ইসলাম ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতিফলক, মাটির নিচে এক পাহাড় থেকে অন্য পাহাড়ে যাতায়াতের জন্য ড্রাগন টানেল মুখের ভিতর দিয়ে পাতালপুরী, লাভলেন, কবিতাবাগ। অবকাশকেন্দ্রের অন্যতম আকর্ষণ সাইট ভিউ টাওয়ার। ৮০ বর্গফুট উচ্চতা সম্পন্ন এ টাওয়ারে উঠলে দেখা যাবে পাহাড়ি টিলার অপরূপ বৈচিত্র্যময় দৃশ্য। জামালপুরের ইসলামপুর থেকে আসা শিক্ষার্থী মীর আসাদের বক্তব্য, অবকাশ কেন্দ্রে ‘চুকুলুপি চিলড্রেনস পার্ক’ আর ‘শিশু কর্নার’ তাকে অনেক আনন্দ দিয়েছে।
দর্শনার্থী দম্পতি শাহেদ আলম ও লিপি আক্তার জানান, তারা ঢাকায় থাকেন। ঈদের ছুটিতে শহরের কোলাহল ছেড়ে গজনী অবকাশে ঘুরতে এসেছেন। পর্যটনকেন্দ্রে তৈরি করা নতুন নতুন ভাস্কর্য তাদের মনে এক অন্য রকম অনুভূতি তৈরি করেছে। মধুটিলা ইকোর্পাক এলাকার ব্যবসায়ী রমজান আলী বলেন, নালিতাবাড়ী সদর থেকে প্রায় ১৪ কিলোমিটার উত্তরে পোড়াগাঁও ইউনিয়নে ২০০০ সালে সরকারিভাবে নির্মিত হয় ‘মধুটিলা ইকোর্পাক’। এই পার্কটির প্রধান ফটক পেরিয়ে ভেতরে ঢুকতেই প্রথমে চোখে পড়বে সারি সারি গাছ। রাস্তার ডানপাশে খোলা প্রান্তর আর দুই পাশে রকমারি পণ্যের দোকান। সামনের ক্যান্টিন পার হলেই পাহাড়ি ঢালু রাস্তা। এরপরই হাতি, হরিণ, রয়েল বেঙ্গল টাইগার, সিংহ, বানর, কুমির, ক্যাঙারু, মৎস্য কন্যা, মাছ ও পাখির ভাস্কর্য।
সাইফুল ইসলাম নামে একজন বলেন, ইকোর্পাকের আঁকাবাঁকা পথে ঘন গাছের সারি লেকের দিকে চলে গেছে। স্টার ব্রিজ পেরিয়ে পাহাড়ের চূড়ায় পর্যবেক্ষণ টাওয়ারে আরোহণ করলেই নজর কেড়ে নেয় ভারতের উঁচুনীচু পাহাড় আর সবুজের সমারোহ। প্রকৃতির এই নয়নাভিরাম দৃশ্য দেখে মুগ্ধ হন হাজার হাজার ভ্রমণ পিয়াসী।
স্থানীয় একটি স্কুলের সহকারী শিক্ষক আব্দুল বাতেন বলেন, যারা সবুজের কাছাকাছি যেতে পছন্দ করেন, তাদের জন্য অপেক্ষা করছে রামচন্দ্রকুড়া ইউনিয়নের পানিহাতা। এখানে প্রকৃতি প্রেমীদের ভিড় চোখ পড়ার মতো। গারো পাহাড়ে অবস্থিত পানিহাতায় গেলে সহজে ভারতের মেঘালয় রাজ্যের কিছু অংশ দেখা যায়। এ স্থানটিতে এখনও পর্যটকদের জন্য কোনো পার্ক গড়ে না উঠলেও প্রকৃতি সবার মন কেড়ে নিচ্ছে।
এসব বিনোদন কেন্দ্র ঘুরে দেখা গেছে, পর্যটকদের মধ্যে কেউ তুলছেন সেলফি, কেউবা নিজ ও প্রিয়জনের ছবি ক্যামেরাবন্দি করতে ব্যস্ত। আর এসব ছবি তারা ছড়িয়ে দিচ্ছেন ফেসবুকসহ নানা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে।
মধুটিলা ইকোপার্কে ঘুরতে আসা পর্যটক রতন আহমেদ বলেন, সব সময় কাজের জন্য ব্যস্ত থাকি। তাই সময় পেলে প্রকৃতির কাছে চলে আসি। কাছাকাছি হওয়ায় এখানকার সব পর্যটন কেন্দ্রে একসঙ্গে ঘোরা যায়।
পর্যটন কেন্দ্রের ব্যবসায়ী ইসমাইল হোসেন বলেন, গত ঈদগুলোর চেয়ে এবার প্রচুর দর্শনার্থীর সমাগম হয়েছে। এ কারণে বিক্রিও অনেক ভালো হচ্ছে। ঈদ সামনে রেখে পর্যটন কেন্দ্রের রাইডসগুলো নতুন রূপে সাজানো হয়েছে বলে জানিয়েছেন গজনীর রাইডস ইজারাদার ছানোয়ার হোসেন।
অর্কিডের মালিক আবু সাঈদ বলেন, ঈদের কয়েকদিন আগে থেকেই আমরা ভালো প্রস্তুতি নিয়েছি। এবার পর্যটক ভালো আসছে। বিনোদন প্রেমীরা ভালো সাড়া ফেলেছে। আর এমনভাবে আসলে আমাদের এবছরও ভালো ব্যাবসা হবে। সুন্দর পরিবেশে বিনোদন কেন্দ্র ঘুরে দেখতে দর্শনার্থীদের জন্য বাড়তি নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন ঝিনাইগাতী থানার ওসি বসির আহমেদ বাদল।
(ঢাকাটাইমস/১১এপ্রিল/প্রতিনিধি/পিএস)