পিত্তথলিতে পাথর? প্রাকৃতিক পদ্ধতিতে মুক্তির উপায়

স্বাস্থ্য ডেস্ক, ঢাকাটাইমস
  প্রকাশিত : ০২ জুলাই ২০২৪, ০৯:০৯| আপডেট : ০২ জুলাই ২০২৪, ১০:১৭
অ- অ+

গলব্লাডার হজম ব্যবস্থার একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ যা পিত্তথলি বা পিত্তকোষ হিসেবে পরিচিত। পরিপাকতন্ত্রের একটি নাশপাতি আকৃতির ফাঁপা অঙ্গ লিভারের ডান দিকে থাকে। এটি পোর্টা-হেপাটিস-এর ডান প্রান্ত থেকে যকৃতের নিম্নকিনারা পর্যন্ত বিস্তৃত। এটির দৈর্ঘ্য প্রায় ৭-১০ সেঃমিঃ এবং প্রস্থ ৩ সেঃমিঃ;খাদ্য পরিপাকে ব্যবহারের জন্য একবারে প্রায় ৩০-৫০ মিলিলিটার পিত্তরস ধারণ করে রাখে। পিত্তের কারণে এটির রং গাঢ় সবুজ দেখায়। এটি পিত্তনালীর মাধ্যমে যকৃৎ ও ডিওডিনাম সাথে যুক্ত। গলব্লাডার যকৃত থেকে নির্গত পিত্ত সঞ্চয় করে, তারপর এটি ছোট অন্ত্রে পাঠায়, যেখানে এটি ফ্যাট এবং খাদ্য ভেঙ্গে শোষণ করতে ব্যবহৃত হয়।

পিত্তথলি থেকে নিঃসৃত পিত্তরস খাবার হজমে সাহায্য করে। রক্তে কোলেস্টেরল বাড়লে বা বিলিরুবিনের মাত্রা বৃদ্ধি পেলে পিত্তরস ক্ষরণে বাধা পরে। তখন সেই পিত্তরস পিত্তথলিতে জমে পাথর তৈরি করে। এমন পরিস্থিতিতে এই অংশে পাথর থাকা আপনার শরীর নানা সমস্যায় পড়তে পারে। অনেক সময় এই সমস্যা ক্যানসারেও রূপ নেয়।

গলব্লাডারের পাথর আসলে ছোট ছোট বালুর দানার মতো থেকে শুরু করে মটরের দানা বা তার চেয়েও বড় শক্ত দানাদার বস্তু, যা বিভিন্ন রঙের ও বিভিন্ন আকৃতির হতে পারে। এটা নির্ভর করে কী পদার্থ দিয়ে পাথরটা তৈরি তার ওপর। কোলেস্টেরল, বিলিরুবিন বা ক্যালসিয়াম ইত্যাদি পদার্থের সংমিশ্রণে তৈরি এই পাথরগুলো পিত্তরসের সঙ্গে মেশানো অবস্থায় থাকে এবং হালকা বাদামি, ময়লাটে সাদা বা কুচকুচে কালো রঙেরও হতে পারে।

অতিরিক্ত ওজনের ব্যক্তিদের গলব্লাডারে পাথর বেশি হতে দেখা যায়। পুরুষদের তুলনায় নারীদের এই প্রবণতা বেশি। এ ছাড়া চল্লিশোর্ধ্ব বয়স, জন্মনিয়ন্ত্রণ বড়ি খাবার অভ্যাস, অতিরিক্ত চর্বিযুক্ত খাদ্য গ্রহণ ইত্যাদি এই ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়।

অনিয়মিত খাদ্যাভ্যাস, হরমোনাল অসুখ, কোলেস্টেরলের বাড়াবাড়ি পুরুষদের ক্ষেত্রেও গলব্লাডারে পাথর তৈরি করতে পারে। দু’টি খাবারের মাঝে অনেকক্ষণ বিরতি থাকলেও এই সমস্যা বাড়ে।

চিকিৎসকের মতে, গলব্লাডারের পাথর কোনও লক্ষণ বা উপসর্গ সৃষ্টি করে না। এই লক্ষণগুলো কয়েক মিনিট বা ঘন্টার জন্য দেখা দিতে পারে গলব্লাডারের পথ আটকানোর কারণে। গলব্লাডারে পাথরের লক্ষণগুলো হলো: উপরের ডানদিকে পেটে তীব্র ব্যথা, স্তনের হাড়ের ঠিক নীচে পেটের মাঝখানে তীব্র ব্যথা, কাঁধের মধ্যে পিঠে ব্যথা, ডান কাঁধে ব্যথা, বমি হওয়া, বমি বমি ভাব।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অতিরিক্ত ওজন বা মোটা হলে পিত্তথলিতে পাথর হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে স্থূলতা আপনাকে পিত্তথলির রোগ হওয়ার সম্ভাবনা তিনগুণ বেশি হয়ে যায়। এর কারণ হিসেবে বলা যেতে পারে অতিরিক্ত ফ্যাট আপনার গলব্লাডার স্টোনকে বড় করে তোলে, এছাড়াও কোলেস্টেরলের মাত্রা বাড়ায় যা পাথরের সৃষ্টি করে। জেনে নিন প্রাকৃতিক উপায়ে গলব্লাডারের পাথর যেভাবে দূর করবেন।

পেটের সমস্যার একটাই যম-- কাঁচা হলুদ। হলুদে আছে অ্যান্টি-অক্সিডেন্টের গুণ। যা পিত্তরসকে ঠিক রাখে। রোজ সকালে খালি পেটে মধু সঙ্গে কাঁচা হলুদ মিশিয়ে খান। এতে শরীর ভালো থাকবে।

পেটের রোগ সারাতে লেবুর বিকল্প কিছুই নেই। লেবুর রসে আছে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন সি। গলব্লাডারে স্টোন আটকাতে লেবুর রস খেতেই হবে। সকালে খালি পেটে লেবুর রস মিশিয়ে এক গ্লাস পানি পান করুন।

নারকেল তেল গলব্লাডারের পাথর দূর করতে কাজে লাগে। তিন চামচ নারকেল তেলের সঙ্গে ১/৪ গ্লাস আপেলের রস, ৫ কোয়া রসুন এবং এক টুকরো আদা থেতো করে খান। আর দেখুন চমৎকার। এই মিশ্রণ খেলে কিন্তু পাথর গলে যায়।

গলব্লাডারে স্টোন থাকলে ক্র্যানবেরির জুস খুবই উপকারে আসে। এই জুসে থাকে প্রচুর পরিমাণে ফাইবার। ফাইবার কোলেস্টেরল কমিয়ে দেয়। কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণে থাকলে পিত্তথলিতে পাথর হয় না।

আপেলে অন্যান্য এসেনশিয়াল নিউট্রিয়েন্টের সাথে প্রচুর পরিমাণ ম্যালিক এসিড থাকে। আপেলে প্রাপ্ত ম্যালিক এসিড পিত্তথলির পাথর গলাতে সহায়তা করে। তাই প্রতিদিন একটি করে আপেল নিয়মিত গ্রহণ করুন।

নাসপাতির রস গলব্লাডারের পাথর দূর করে। কোলেস্টেরল শক্ত হয়ে পিত্তথলির পাথর তৈরি হয় তাই নাসপাতির রসে প্রাপ্ত যথেষ্ট পরিমাণ পেকটিন কোলেস্টেরল সমৃদ্ধ পিত্তথলির পাথর জমতে বাঁধা দেয়, সকল পাথরকে বেঁধে ফেলে সম্পূর্ণরূপে নিষ্কাশন করে দেয়।

গলব্লাডারের পাথর দূর করতে নিয়মিত ৬ টি মধ্যম আকৃতির মূলা খেতে পারি তাহলেও পিত্তথলির পাথর অপসারিত হতে পারে।

মূলা এমনকি পিত্তথলির পাথর তৈরিতেও বাঁধা দেয়।

আপেল সিডার ভিনেগার একটি প্রাকৃতিক উপাদান যা কিনা পিত্তথলির পাথর প্রতিরোধে সহায়তা করে। শরীরের কোলেস্টেরলের আধিক্য পিত্তথলির পাথর তৈরির জন্য বহুলাংশে দায়ী যেটা লিভার থেকে উৎসারিত হয়। আপেল সিডার ভিনেগার লিভার থেকে কোলেস্টেরল নিঃসরণ হতে দেয় না এবং পিত্তথলির পাথর তৈরিতে বাঁধা দেয়। তাই প্রত্যহ নিয়মিত খালি পেটে ২ টেবিল চামচ আপেল সিডার ভিনেগার এক গ্লাস পানিতে মিশিয়ে পান করুন।

খাদ্যতালিকায় গোটা শস্য অন্তর্ভুক্ত করুন। গোটা শস্য ফাইবারের একটি ভালো উৎস, যা আপনার এলডিএল বা 'খারাপ' কোলেস্টেরল কমায়। এর পাশাপাশি, গোটা শস্য সেবন হার্টকে সুস্থ রাখতে এবং পিত্তথলির পাথরকে দূরে রাখতে সাহায্য করে। এছাড়াও ফাইবার আপনার পাচনতন্ত্র মেরামত করার পাশাপাশি আপনার শরীর থেকে পিত্ত দূর করে।

​প্রচুর শাকসবজি এবং ফল খান। তাজা শাকসবজি এবং ফল আপনার স্বাস্থ্য ভালো রাখতে কাজ করে। এর মধ্যে রয়েছে আপনার গলব্লাডার। ভিটামিন সি এবং ই সহ ভিটামিনে ভরপুর ফল এবং সবুজ শাক, পিত্তথলির পাথর থেকে রক্ষা করতে সাহায্য করে।

​ভাজা খাবার অবশ্যই এড়িয়ে চলুন। ফ্যাটযুক্ত খাবার হজম করতে সাহায্য করার জন্য পিত্তথলিকে আরও কঠোর পরিশ্রম করতে হয়। ভাজা খাবারে স্যাচুরেটেড ফ্যাট বেশি থাকে, যা আপনার রক্তের কোলেস্টেরল বাড়ায়। এমন পরিস্থিতিতে বেশি করে ভাজা খাবার খেলে পিত্তথলিতে পাথর হওয়ার আশঙ্কাও বেড়ে যায়।

রক্তে ক্যালসিয়ামের মাত্রা নিয়মিত পরিমাপ করে গলব্লাডারে পাথর সম্পর্কে আগাম আভাস পাওয়া যেতে পারে। রক্তে ক্যালসিয়াম বৃদ্ধিও গলব্লাডারের অন্যতম কারণ বলে দাবি করেছেন বিশেষজ্ঞরা।

চিনির কোনো উপকার নেই, বরং অপকার আছে বিস্তর। কাজেই সব রকম মিষ্টি স্বাদের খাবার খাওয়া বন্ধ করুন। ব্যতিক্রম ফল। তবে ফলের রস চলবে না একেবারেই। প্রতি দিন দু’টো ফল খান চিবিয়ে।

ক্যাফেইনসমৃদ্ধ খাবার বা পানীয় কম করে খান। দিনে বার তিনেক ২৫০ মিলি কফি খেতে পারেন। গর্ভাবস্থায় তা নেমে আসবে দু’কাপে। চকোলেট বা নরম পানীয়র ব্যাপারেও সতর্ক থাকুন। চা একটু বেশি খাওয়া যায়। তবে তাও যেন মাত্রা না ছাড়ায়।

লো ক্যালোরির সুষম খাবার খাওয়ার পাশাপাশি নিয়মিত হালকা ব্যায়াম করুন যাতে ওবেসিটি, ডায়াবেটিস ও হাই কোলেস্টেরলের প্রকোপ কম থাকে।

মধ্যবয়সের মানসিক চাপ ও তার হাত ধরে ভুলভাল খাওয়া ও ওজন বৃদ্ধির সমস্যা এড়াতে দরকার রিল্যাক্সেশন থেরাপি। নিয়মিত ব্যায়াম, যোগা, মেডিটেশন ও কোনও ভাল লাগার কাজের চর্চা সে কাজে সাহায্য করতে পারে। প্রয়োজনে কাউন্সেলিং করে হলেও মানসিক চাপ এড়ানোর চেষ্টা করবেন। পর্যাপ্ত পরিমাণ ভালো ঘুম দরকার।

পিত্তথলি ও পিত্তনালির পাথর নির্ণয় করতে মূলত ইমেজিং বা ছবিনির্ভর পরীক্ষা করা হয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই শুধু পেটের আলট্রাসনোগ্রাম করে পিত্তথলি ও পিত্তনালির পাথর ধরা পড়ে থাকে। তবে পিত্তনালির পাথর অনেক সময় আলট্রাসনোগ্রামে ধরা পড়ে না। সে ক্ষেত্রে কোনো রোগীর পিত্তনালির পাথর সন্দেহ হলে এমআরসিপি নামের এক ধরনের এমআরআই পরীক্ষার মাধ্যমে নিশ্চিত হওয়া যায়।

পিত্তথলির পাথরজনিত রোগের চিকিৎসার জন্য এখনো তেমন কার্যকর ওষুধ আবিষ্কৃত হয়নি। মূলত সার্জারির মাধ্যমে পিত্তথলি ফেলে দিয়ে চিকিৎসা করা হয়। ল্যাপারোস্কোপি হচ্ছে আধুনিকতম চিকিৎসাপদ্ধতি, যাতে আগের মতো পেটে কোনো বড় কাটাছেঁড়া লাগে না। শুধু পেটে ছোট কয়েকটি ছিদ্র করে তাতে বিভিন্ন যন্ত্রপাতি ঢুকিয়ে পিত্তথলি কেটে আনা হয়।

আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের অন্যতম সেরা উদ্ভাবন এন্ডোস্কোপিক সার্জারি। কোনো ধরনের কাটাছেঁড়া ছাড়াই মুখগহ্বর দিয়ে এন্ডোস্কোপ মেশিন দিয়ে পিত্তনালির ভেতর থেকে পাথর বের করে আনা হয়। এই পদ্ধতিকে এন্ডোস্কোপিক রেট্রোগ্রেড কোলাঞ্জিওপ্যাংক্রিয়াটোগ্রাফি (ইআরসিপি) বলে। পাথর অনেক বড় হলে অন্য কোনো জটিলতার কারণে অনেক সময় ইআরসিপির মাধ্যমে পিত্তনালির পাথর বের করা যায় না। তখন অপারেশন করে পিত্তনালি থেকে পাথর বের করতে হয়।

(ঢাকাটাইমস/২ জুলাই/আরজেড)

google news ঢাকা টাইমস অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি ফলো করুন

মন্তব্য করুন

শীর্ষ খবর সর্বশেষ জনপ্রিয়
সব খবর
এক মোটরসাইকেলে যাচ্ছিল ৪ বন্ধু, ট্রাক চাপায় প্রাণ গেল দুজনের
ভারতের সামরিক অভিযানের দ্রুত, দৃঢ় ও কঠোর জবাব দেওয়া হবে: পাকিস্তানের সেনাপ্রধান
সুনামগঞ্জে কোটি টাকা মূল্যের ভারতীয় ৯০টি গরুসহ নৌকা জব্দ 
সাবেক আইজিপি মোদাব্বির হোসেন চৌধুরীর ইন্তেকাল 
বিশেষ প্রতিবেদন তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা