জাতির এই ক্ষতি হওয়ার আগে কি কোটা-সংস্কার সম্ভব ছিল না?

মোহাম্মদ সাজ্জাদ হোসেন
  প্রকাশিত : ৩১ জুলাই ২০২৪, ১১:১১| আপডেট : ৩১ জুলাই ২০২৪, ১১:২২
অ- অ+

বাংলাদেশ পৃথিবীর অন্যতম ঘনবসতিপূর্ণ এবং জনবহুল দেশ। স্বাভাবিকভাবে এখানে বেকারত্বের হারও বেশি। মানুষের চাহিদা এবং প্রয়োজনের তুলনায় কাজের সুযোগ কম। ফলে অনেক মানুষকে দেশের মায়া ত্যাগ করে বিদেশে কাজ করতে যেতে হয়। তারপরও শিক্ষিত বেকারদের একটি বড়ো অংশ সরকারি চাকরিতে যোগদানের চেষ্টা করে। কিন্তু চাকরির তুলনায় বেকারদের সংখ্যা বেশি হওয়ায় সরকারি চাকরির জন্য তীব্র প্রতিযোগিতা সৃষ্টি হয়। এরই মাঝে সরকারের কোটা ব্যবস্থা প্রতিযোগিতাকে আরো তীব্রতর করে তোলে। বর্তমানে কোটা-সংস্কারের আগে সাধারণত ১০০টি শূন্য পদের মধ্যে ৫৬টি পদ নির্দিষ্ট কিছু কোটাধারীদের জন্য সংরক্ষিত থাকতো। বাকি ৪৪টি পদ মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ দেওয়া হতো। কিন্তু বছরের পর বছর ধরে চলতে থাকা কোটা ব্যবস্থা সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভের সৃষ্টি করে। ২০১৮ সালে তারা কোটা ব্যবস্থা সংস্কারের জন্য তীব্র অথচ শান্তিপূর্ণ আন্দোলন গড়ে তোলে। আন্দোলনের ফলে সরকার কোটা ব্যবস্থা বাতিল করে এবং প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির সরকারি চাকরিতে ১০০% মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ দেওয়ার প্রথা চালু করে।

উল্লেখ করা যেতে পারে যে ২০১৮ সালের আন্দোলন অনেকটাই শান্তিপূর্ণ এবং জনসাধারণের জন্য অতটা ভোগান্তিপূর্ণ ছিল না কারণ সে সময়কার আন্দোলনের নেতৃত্ব ছিল সুচারুরূপে পরিচালিত। অনেকেই সে সময় কোটা সংস্কার আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়ে ডাকসু নির্বাচনে গুরুত্বপূর্ণ পদে জয়লাভও করেছিলেন।

সরকারি নিয়োগে সমতার বিষয়ে বাংলাদেশের সংবিধান বলে: ২৯। (১) প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগ বা পদ লাভের ক্ষেত্রে সকল নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা থাকিবে। বাংলাদেশে সরকারি চাকরিতে কোটা ব্যবস্থা একটি বহুল আলোচিত বিষয়। দেশটি জনবহুল এবং এখানে কাজের সুযোগও সীমিত। ফলে অনেকে দেশে কাজ না পেয়ে বিদেশে প্রবাস জীবন বেছে নেয়। কিন্তু প্রবাসেও নানান বঞ্চনা রয়েছে। তাই অনেকের স্বপ্ন থাকে দেশে একটি সরকারি চাকরি পাবার। কিন্তু বৈষম্যমূলক কোটা ব্যবস্থার কারণে প্রায় ৫৬% পদ নির্দিষ্ট কিছু কোটাধারীদের জন্য সংরক্ষিত থাকায় সব মানুষ সমানভাবে চাকরি পাবার সুযোগ পায় না। যদিও সরকারি চাকরির সুযোগ-সুবিধা তুলনামূলকভাবে কম, তবুও পেনশনসহ কিছু সুবিধার কারণে এটি অনেক তরুণ-তরুণীর স্বপ্ন।

আন্দোলনের আগে প্রশ্ন ওঠেছিল ৫৬% সরকারি চাকরিই যদি কোটা দ্বারা পূরণ করা হয় তাহলে দেশের অগণিত মেধাবীর অবস্থান কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়। তারা সারাজীবন কষ্ট স্বীকার করে বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রি অর্জন করে যদি অপেক্ষাকৃত কম মেধাবীর নিকট এসে শেষ পর্যন্ত হেরে যায় তাহলে তাদের মধ্যে এই ক্ষোভ তৈরি হওয়াই কি স্বাভাবিক নয়! বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে প্রথম শ্রেণির একটি সরকারি চাকরিকে ধরা হয় সর্বোচ্চ প্রাপ্তি হিসেবে। সরকারি এই মহার্ঘ্যরে বিপরীতে একজন শিক্ষার্থী জীবনভর কঠোর পরিশ্রম করে সেই যোগ্যতাও হয়তো অর্জন করলো কিন্তু বাধা হয়ে দাঁড়ায় কোটা পদ্ধতি। এই সবকিছু মিলে দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষার্থীদের মধ্যে যে চাপা ক্ষোভ বিরাজ করছিল তারই বিস্ফোরণ এই কোটা-সংস্কার আন্দোলন। কিন্তু অতীব দুঃখের বিষয় যে- সরকার পরোক্ষভাবে যেমন করে এই আন্দোলন ব্যর্থ করে দেবার চেষ্টা করছে তাতে সরকারের এই কাজের ফল হয়েছে আরো বিপরীত। পুলিশ ও ছাত্রলীগ কর্মীদের দ্বারা সরকার আন্দোলনকারীদের ওপর যে প্রক্রিয়ায় নির্যাতন চালিয়ে আন্দোলনকে ভণ্ডুল করার চেষ্টা করছে তাতে সরকার-পক্ষীয় বুদ্ধিজীবী এবং খাস আওয়ামী লীগের লোকরাও বিষয়টিকে অত্যন্ত ন্যক্কারজনক বিষয় হিসেবে প্রতিপন্ন করেছে।

সন্দেহ নেই দীর্ঘদিন ধরে ধারাবাহিকভাবে বঞ্চিত বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থীর এটা ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ। গত ১৫ই জুলাই আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বলেছেন- ‘কোটাবিরোধী কতিপয় নেতা যেসব বক্তব্য দিয়েছেন, এর জবাব দেওয়ার জন্য ছাত্রলীগ প্রস্তুত।’ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের কোটা-সংস্কার আন্দোলনের ওপর ভিত্তি করে দেওয়া এই বক্তব্যের সঙ্গে আন্দোলনকারীদের নৈতিক অধিকার আদায়ের সংগ্রামের কোনো সামঞ্জস্য নেই।

বলা বাহুল্য যে- বহু প্রতিভাবান চাকরিপ্রার্থী নিয়োগ প্রক্রিয়ায় দীর্ঘদিন ধরে বঞ্চিত হচ্ছিলেন বলে অভিযোগ উঠেছিল। স্বাধীনতার পর থেকেই বিভিন্ন শ্রেণির চাকরিতে কোটা ব্যবস্থা চালু ছিল। কিন্তু ২০১৮ সালের অক্টোবরে শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রার্থীদের আন্দোলনের মুখে নবম থেকে ১৩তম গ্রেডের (প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণি) সরকারি চাকরিতে কোটা বাতিল করে পরিপত্র জারি করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়।

২০১৮ সালের আন্দোলনের সময় সরকার কমিটি করলেও সেই কমিটি জনমত যাচাই করেনি কিংবা জনগণের কাছ থেকে মতামত আহ্বান করেনি। ফলে সিদ্ধান্ত একতরফা ছিল এবং তাতে জনমতের প্রতিফলন ঘটেনি। ২০১৮ সালের আন্দোলনে যোগ্য ও বিচক্ষণ নেতৃত্ব ছিল যা এবারকার আন্দোলনে ছিল না। এবার তাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণে কোনো সমন্বয় ছিল না। তাছাড়া, ক্যাম্পাসের বাইরে আন্দোলনকে নিয়ে আসা এবার একটি বড়ো ভুল ছিল তাদের। এতে আন্দোলনের সুযোগে তৃতীয় পক্ষ ঢুকে পড়ে এবং আন্দোলন ছাত্রদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। কোটা সংস্কার আন্দোলনের নেতারা এই দায়িত্ব এড়াতে পারেন না।

সরকার পক্ষেরও দুর্বলতা ছিল। ২০১৮ সালের কোটা বাতিল করার সময় জনগণের মতামত সংগ্রহ করলে এবং বৈষম্য বিলোপ করে সুন্দর ও ভারসাম্যমূলক একটি পরিপত্র জারি করলে এটা হাইকোর্টে চ্যালেঞ্জ করার সুযোগ থাকতো না। সব ধরনের কোটা বাতিল করায় মুক্তিযোদ্ধার সন্তানেরা হাইকোর্টে রিট করার সুযোগ পেয়েছে।

বলার অপেক্ষা রাখে না- সম্প্রতি দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা কোটা-সংস্কার সংকট ও আন্দোলন শেষ পর্যন্ত একটি সন্তোষজনক সমাধানে পৌঁছাতে সমর্থ হয়েছে বটে কিন্তু এর জন্য জাতির যে সীমাহীন সীমাহীন মূল্য দিতে হলো- এর কি কোনো প্রতিকার আছে? ৯৩% মেধাকোটা রেখে হাইকোর্টের আপিল বিভাগের রায় ঘোষণা করা হয়েছে গত ২১শে জুলাই রবিবার। ৫% মুক্তিযোদ্ধা কোটা, ১% আদিবাসী কোটা এবং ১% প্রতিবন্ধী ও তৃতীয় লিঙ্গ কোটা রাখা হয়েছে আপিল বিভাগের এই রায়ে। রায়ে কোটা-সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরাও ইতোমধ্যে সর্বোচ্চ সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছে। তবে তাদের অন্য দাবিগুলো থেকে তারা সরে যায়নি। প্রথম অবস্থায় তাদের অন্য দাবিগুলো ছিল- কোটা-সংস্কার আন্দোলনে নিহত শিক্ষার্থীদের সঠিক তদন্ত-উত্তর বিচার, কোটা-সংস্কার আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে কোনো আইনানুগ ব্যবস্থা না নেওয়া, কোটা সংস্কার আন্দোলনকে নস্যাত করতে যে সমস্ত বিশ^বিদ্যালয়ের ভিসি ও প্রক্টর অপচেষ্টা চালিয়েছে তাদের পদত্যাগ, ছাত্রলীগ-যুবলীগসহ সরকার সমর্থিত ছাত্র সংগঠনগুলোর কোটা-সংস্কার আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের ওপর নগ্ন হামলার বিচারসহ ৮ দফা দাবি। এসব দাবি কমিয়ে এখন শিক্ষার্থীরা আন্দোলনে নিহতদের বিচারের দাবিকেই প্রধান করেছে। এছাড়া অবিলম্বে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার দাবি করেছে তারা। হাইকোর্টের রায় ঘোষণার পর প্রধান বিচারপতি কোটা-সংস্কার আন্দোলনের শিক্ষার্থীদের ক্লাসে ফিরে যেতে আহ্বান জানিয়েছেন। কিন্তু সমস্যা হলো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান যদি খুলেই না দেওয়া হয় তাহলে শিক্ষার্থীরা ক্লাসে ফিরে যাবে কীভাবে!

ইতোমধ্যেই দেশে জারি করা কারফিউ আংশিক তুলে নিয়েছে সরকার; যেটুকু কারফিউ থাকছে সেটুকুতেও বলা যায় অনেকটাই শিথিল আকারেই চলছে। কেশ কিছুদিন ধরেই রাস্তাঘাটে যানবাহন চলাচল স্বাভাবিক হয়েছে বলা যায়। জনজীবনে যে অস্থিরতা ও নানামুখী সংকট সৃষ্টি হয়েছিল এর আগে সেসবও অনেকটাই স্বাভাবিকতার পথ ধরে হাঁটতে শুরু করেছে। আসলে সবকিছুই স্বাভাবিক হবে এবং হচ্ছে- কিন্তু এই সবকিছুর জন্য দুইশতাধিক তাজা প্রাণ ঝরে যাওয়া ও ব্যাপক ধ্বংসের ক্ষতি স্বীকারের যে সীমাহীন মূল্য চুকাতে হলো পুরো দেশকে তার সমান্তরালে আর কিছু নেই।

শিক্ষার্থীদের কোটা-সংস্কার আন্দোলনে দুই সপ্তাহেরও বেশি সময়ে সারা দেশে গুলিবিদ্ধ হয়ে দুইশতাধিক মানুষের নিহত হওয়ার ঘটনা প্রমাণ করে এই আন্দোলনটি দমাতে সরকার কোনমাত্রার দমনপীড়নের কৌশল গ্রহণ করেছিল। গত ১৮ই জুলাই বৃহস্পতিবার রাজধানীর যাত্রাবাড়ীতে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হয়েছেন ঢাকা টাইমস-এর সিনিয়র রিপোর্টার হাসান মেহেদী। রাজধানীর যাত্রাবাড়ীতে কোটা-সংস্কার আন্দোলনের খবর সংগ্রহ করার কাজে তিনি নিয়োজিত ছিলেন। হাসান মেহেদীর মতো একজন সৎ, মেধাবী, আত্মপ্রত্যয়ী ও কাজের প্রতি দৃঢ় আস্থাশীল সংবাদকর্মীকে হারিয়ে ঢাকা টাইমস পরিবার যারপরনাই শোকাহত, স্তব্ধ ও বাক্রুদ্ধ। কোটা-সংস্কার আন্দোলনে পুলিশের সঙ্গে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ধাওয়া-পালটা ধাওয়া ও সংঘাত-সংঘর্ষের ভিতর থেকে সংবাদ সংগ্রহ অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ জেনেও নির্ভীক সংবাদকর্মী হাসান মেহেদী সেখান থেকে তাৎক্ষণিক ঘটমান বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ সংগ্রহ করছিলেন। কিন্তু অকুতভয় সেই সংবাদকর্মীও গুলিবিদ্ধ হয়ে প্রাণ হারালেন- এটা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না।

সর্বশেষ বলতে চাই- ২০২৪ সালের আন্দোলনের শুরুতেই যদি সরকার পক্ষ ছাত্রদের সাথে আলোচনায় বসতো তাহলে ব্যাপারটা এতদূর এগোতে পারতো না। সরকার পক্ষের উচিত ছিল না ছাত্রদের আন্দোলনকে ক্যাম্পাসের বাইরে আনার সুযোগ দেওয়া। একটি রিটের চূড়ান্ত শুনানি শেষে গত ৫ই জুন হাইকোর্ট নবম থেকে ১৩তম গ্রেডের পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিলের পরিপত্র অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেয়। আমি মনে করি, যদি উভয় পক্ষ যথাসময়ে দায়িত্বশীল ভূমিকা নিয়ে এগিয়ে আসতো তাহলে দেশজুড়ে এমন নারকীয় ও অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনাগুলোকে সহজেই এড়ানো যেত। এড়ানো যেত অসংখ্য প্রাণহানি ও ধ্বংসযজ্ঞও।

মোহাম্মদ সাজ্জাদ হোসেন: কলাম লেখক ও সাবেক কলেজ শিক্ষক

google news ঢাকা টাইমস অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি ফলো করুন

মন্তব্য করুন

শীর্ষ খবর সর্বশেষ জনপ্রিয়
সব খবর
শেখ পরিবারের ৫ সদস্যের জমি-বাড়ি ক্রোক, রিসিভার নিয়োগের আদেশ
ধাওয়া খেয়ে পিছু হটল ভারতের চার যুদ্ধবিমান
নিজের ওপর চলা নির্যাতনের বর্ণনা দিয়ে বিচার চাইলেন রাশেদ খান
এসপি পদমর্যাদার ১৪ কর্মকর্তার বদলি
বিশেষ প্রতিবেদন তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা