ক্ষমতার পালাবদলে ভাস্কর্য ভাঙা হয় বিশ্বের যেসব আলোচিত নেতার

ঢাকা টাইমস ডেস্ক
  প্রকাশিত : ২৩ আগস্ট ২০২৪, ১৪:৪১| আপডেট : ২৩ আগস্ট ২০২৪, ১৫:০৬
অ- অ+
আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় নিউইয়র্কে ব্রিটেনের রাজা তৃতীয় জর্জের একটা লোহার ভাস্কর্য ভেঙে ফেলা হয়

বাংলাদেশে ছাত্র-জনতার প্রবল আন্দোলনের মুখে গত ৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রীর পদ ছেড়ে দেশত্যাগ করেন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। এরপর আনন্দ উদযাপন করতে গিয়ে গণভবনে ঢুকে পড়ে মানুষ। এসময় লুটপাট চালানো হয়। ওইদিন ভেঙে ফেলা হয় রাজধানীর বিজয় সরণিতে নির্মিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্য।

৫ আগস্ট সরকারের পতনের পর রাজধানীর অন্যান্য জায়গার মতো বিজয় সরণিতেও উল্লাস করতে দেখা গেছে অনেককে। এ সময় মোড়ে অবস্থিত বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভাঙচুর করতে শুরু করে কিছু মানুষ। ভাস্কর্যের চশমার কিছু অংশ ভেঙে ফেলতে দেখা যায়। পরে ভাস্কর্যের মুখের অংশ ভেঙে নিয়ে যেতে দেখা যায়।

বঙ্গবন্ধুর এই ভাস্কর্যটি ঘিরে বিজয় সরণির ওই স্থানটির নাম দেওয়া হয় ‘মৃত্যুঞ্জয়ী প্রাঙ্গণ’। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের প্রায় এক বছর আগে ২০২৩ সালে ১০ নভেম্বর উদ্বোধন করা হয়েছিল। এমন আলোচিত-স্মরণীয় নেতাদের ভাস্কর্য ভাঙচুর বিশ্বে বিরল নয়। ক্ষমতার পালাবদলে ভাঙা হয়েছে ইরাকি প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেন, লিবিয়ার গাদ্দাফি, ইতালির স্বৈরশাসক মুসোলিনি, রাশিয়ার ইউক্রেনে লেনিনের ভাস্কর্যও ভেঙে ফেলা হয়।

এ বিষয়ে বিবিসি বাংলা শুক্রবার একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে।

আরও যেসব বিশ্বনেতার মূর্তি ভাঙা হয়েছে

সাদ্দাম হোসেন

২০০৩ সালে ইরাকি প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনকে উৎখাতের পর চারদিকে আনন্দের পরিবেশ দেখা গিয়েছিল। এরপর ফিরদৌস স্কোয়ারে সাদ্দাম হোসেনের ভাস্কর্যটি ভেঙে ফেলার চেষ্টা করেন ইরাকিরা। কিন্তু তারা সফল হননি। পরে সেখানে উপস্থিত মার্কিন সেনারা সাদ্দাম হোসেনের ভাস্কর্যের গলায় লোহার শিকল জড়িয়ে এম৮৮ সাঁজোয়া যানের সঙ্গে বেঁধে টেনে নিয়ে যায়। এরপর ভাস্কর্যটি ভেঙে পড়লে সঙ্গে সঙ্গে সেখানে জড়ো হওয়া জনতা এর টুকরো সংগ্রহ করতে থাকেন। টুকরোতে জুতো দিয়ে আঘাত করতে করতে বাগদাদের রাস্তায় প্যারেড করতে দেখা যায় জনতাকে।

সাদ্দাম হোসেনের ১২ মিটার উঁচু এই ভাস্কর্য ২০০২ সালের এপ্রিল মাসে নির্মাণ করা হয়েছিল।

গাদ্দাফি

২০১১ সালে লিবিয়ার শাসক মুয়াম্মার গাদ্দাফির বিরুদ্ধে গণঅভ্যুত্থানের সময় ত্রিপোলির বাব আল-আজিজিয়া প্রাঙ্গণে ঢুকে তার ভাস্কর্যের মাথা ভেঙে ফেলার পর সেটা পদদলিত করা হয়। ওই বছর ২৩ আগস্ট ওই প্রাঙ্গণে মোতায়েন রক্ষীরা বিদ্রোহীদের কাছে আত্মসমর্পণ করে।

গাদ্দাফির মৃত্যুর পর এই প্রাঙ্গণকে পর্যটন কেন্দ্রে রূপান্তর করা হয়। হাজার হাজার মানুষের সমাবেশ হতে থাকে এই স্থান দেখার জন্য।

ইউক্রেনে লেনিনের ভাস্কর্য ভাঙার দৃশ্য।

লেনিন

২০১৪ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর ইউক্রেনের খারকিভে প্রায় পাঁচ হাজার বিক্ষোভকারী ভ্লাদিমির লেনিনের একটা ভাস্কর্য হাতুড়ি দিয়ে ভেঙে মাটিতে ফেলে দেয়। এই পুরো কাজটা করতে তাদের সময় লেগেছিল প্রায় চার ঘণ্টা। ভাস্কর্যটি ভেঙে দেওয়ার পর সেখানে জড়ো হওয়া জনতা এর টুকরোগুলো স্মারক হিসেবে সংগ্রহ করতে শুরু করে। সেখানে ইউক্রেনের পতাকা উত্তোলন করা হয়। এরপরই দেশজুড়ে লেনিনের ভাস্কর্য ভাঙার প্রক্রিয়া শুরু হয়।

ইথিওপিয়ার রাজধানী আদিস আবাবার পৌরসভার একটা গ্যারেজেও রুশ নেতা লেনিনের একটা ভাস্কর্য ভাঙা হয়। লেনিনের এই ভাস্কর্য শুধু বড়ই নয়, ভারীও। সেটা টেনে নামাতে গিয়ে অনেক পরিশ্রম করতে হয়েছিল। দড়ি বেঁধে সরানো সম্ভব না হওয়ায় যন্ত্রের সাহায্য নেওয়া হয়েছিল।

১৯৮৯ সালের নভেম্বরে বার্লিন প্রাচীর পতনের পর বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে এই একই দৃশ্য দেখা গিয়েছে। বারেবারে ভেঙে ফেলা হয়েছে লেনিনের ভাস্কর্য।

এনভার হোক্সা

ঠিক একই চিত্র দেখা গিয়েছিল আলবেনিয়ায়। সেখানে ৪০ বছর ধরে ওই দেশ শাসন করা এনভার হোক্সার বেশ কয়েকটা ভাস্কর্য ভেঙে ফেলা হয়।

ফেলিক্স জেরনস্কির ভাস্কর্য সরিয়ে ফেলা হচ্ছে

ফেলিক্স জেরনস্কি

১৯৯১ সালে রাশিয়ায় প্রেসিডেন্ট মিখাইল গর্বাচেভকে উৎখাতের চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পর মস্কোর লুবিয়াঙ্কা স্কয়ারে সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রথম গুপ্ত পুলিশ সংস্থা চেকা'র প্রতিষ্ঠাতা ফেলিক্স জেরনস্কির ভাস্কর্য সরিয়ে ফেলা হয়।

কমিটি অফ স্টেট সিকিউরিটি যার রুশ ভাষায় সংক্ষিপ্তকরণ ‘কেজিবি', সেই সংস্থার বিরুদ্ধে হাজার হাজার মানুষকে অপহরণ, নির্যাতন ও হত্যার অভিযোগ আনা হয়।

১৯৯১ সালের ২২ আগস্টের সন্ধ্যায় হাজার হাজার মানুষ লুবিয়াঙ্কা স্কোয়ারে অবস্থিত কেজিবি ভবনের সামনে জড়ো হয়। তারা জেরনস্কির মূর্তির গায়ে লিখে দেন ‘খুনি'। সেখানে উপস্থিত বিক্ষোভকারীরা ভাস্কর্যের উপরে উঠে দড়ি দিয়ে বেঁধে ফেলে। তাদের উদ্দেশ্য ছিল ট্রাকের সঙ্গে বেঁধে টান দিয়ে উপড়ে ফেলা। কিন্তু পার্শ্ববর্তী লুবিয়ানকা মেট্রো স্টেশনের ইমারতের পক্ষে তা ঝুঁকির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। সেই সময় মস্কো সিটি কাউন্সিলের ডেপুটি চেয়ারম্যান সের্গেই স্টানকেভিচ উপস্থিত জনতাকে জানান তিনি নিজেই ভাস্কর্যটি অপসারণে নেতৃত্ব দেবেন। এরপর ক্রেনের সাহায্যে সেখান থেকে সেটি সরিয়ে ‘ফলেন মনুমেন্ট পার্কে’ স্থাপন করা হয়।

তৃতীয় জর্জ

আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় নিউইয়র্কে ব্রিটেনের রাজা তৃতীয় জর্জের একটা লোহার ভাস্কর্যও ভেঙে ফেলা হয়েছিল।

স্বাধীনতার জন্য লড়াইয়ে সামিল আমেরিকানরা এটি ব্রিটিশ অত্যাচারের প্রতীক হিসেবে বিবেচনা করতেন। এই ভাস্কর্য গলিয়ে ৪২০০০ বুলেট বানানো হয়েছিল। সেই বুলেটই ব্যবহার করা হয়েছিল ব্রিটিশ সৈন্যদের বিরুদ্ধে।

ব্রিটেনের অনুগত কিছু ব্যক্তি অবশ্য ভেঙে ফেলা সেই ভাস্কর্যের কিছু অংশ বাঁচানোর চেষ্টা করেন। ভাঙা অংশ মাটিতে পুঁতে ফেলেন।

মুসোলিনির ভাস্কর্যের পরিণতি

মুসোলিনি

১৯৪৫ সালে ইতালির স্বৈরশাসক মুসোলিনির পতন হয়। সেই সময় তার ভাস্কর্যেরও একই পরিণতি দেখা গিয়েছিল।

তার ক্ষমতাচ্যুতির পর তার কিছু সমর্থক এবং তার বান্ধবী ক্লারা পিটাচিকে গুলি করে হত্যা করা হয়। একটা ভ্যানে করে তাদের মৃতদেহ মিলানে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে একটা খুঁটি থেকে উল্টো করে ঝুলিয়ে রাখা হয় তাদের দেহগুলো।

এরপর শুরু হয় মুসোলিনির ভাস্কর্য ভাঙার প্রক্রিয়া। তার স্বৈরাচারের প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হওয়া সমস্ত স্মারক, ভবন এবং ভাস্কর্য ভেঙে দেওয়া হয়। বেশ কয়েক মাস ধরে চলেছিল এই একই প্রক্রিয়া।

পঞ্চম জর্জ

১৯৪৭ সালে ভারত যখন স্বাধীন হয়, তখন দিল্লির অনেক জায়গায় ব্রিটিশ শাসনের সঙ্গে সম্পর্কিত কর্তা ব্যক্তিদের ভাস্কর্য ছিল। এর মধ্যে বেশ কয়েকটা যুক্তরাজ্যে ফেরত পাঠানো হয়েছিল এবং কিছু স্থানান্তরিত করা হয় দিল্লিতে। উত্তর দিল্লির করোনেশন পার্কে স্থানান্তরিত করা হয়েছিল সেই ভাস্কর্যগুলো।

যে কয়টা ভাস্কর্য সরিয়ে ফেলা হয়েছিল, তার মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ছিল দিল্লির ইন্ডিয়া গেটে পঞ্চম জর্জের মূর্তি। ৭০ ফুট উঁচু ছিল সেটি।

প্রসঙ্গত, ১৯৬৮ সাল পর্যন্ত কিন্তু ব্রিটিশ রাজা পঞ্চম জর্জের ভাস্কর্য তার পুরানো জায়গাতেই ছিল। কিন্তু পরে বিবেচনা করে স্থির করা হয়, দিল্লির এমন এক বিশিষ্ট স্থানে এই মূর্তি থাকার কোনো যুক্তি নেই। তাই তা সরিয়ে ফেলার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

পঞ্চম জর্জের ভাস্কর্য ধ্বংস করা হয়নি বরং রাখা হয়েছিল ঠিক সেই স্থানে যেখানে ১৯১১ সালে তিনি দিল্লি দরবারে গিয়েছিলেন।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ইন্ডিয়া গেটের কাছে যেখানে পঞ্চম জর্জের ভাস্কর্য ছিল, সেখানেই ২০২২ সালে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর ভাস্কর্য বসানো হয়।

(ঢাকাটাইমস/২৩আগস্ট/এফএ)

google news ঢাকা টাইমস অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি ফলো করুন

মন্তব্য করুন

শীর্ষ খবর সর্বশেষ জনপ্রিয়
সব খবর
ওষুধ ছাড়াই ঘরোয়া উপায়ে দূর করুন হজমের সমস্যা
সব দেশের সার্বভৌমত্বকে সম্মান করে বাংলাদেশ: প্রেস সচিব
মে দিবস ২০২৫-এ বয়ে আনুক কর্মজীবীদের আশার আলো
৩২ বছর পর ৩১ জুলাই হতে যাচ্ছে জাকসু নির্বাচন
বিশেষ প্রতিবেদন তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা