বল প্রয়োগ ও খ্যাতির বিড়ম্বনা আইনের শাসনের অন্তরায়

অনুপম মাহমুদ
  প্রকাশিত : ০১ মার্চ ২০১৭, ২০:২৪
অ- অ+

বরেণ্য নির্মাতা তারেক মাসুদ ও চিত্রগ্রাহক মিশুক মুনির সহ পাঁচজন নিহত হয়েছিলেন মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় ২০১১ সালের ১৩ আগস্ট। তাদের আগামী ছবি “কাগজের ফুল” এর লোকেশন দেখে ফিরিছিলেন ঢাকায়। পথে মানিকগঞ্জে চুয়াডাঙ্গা ডিলাক্স পরিবহনের একটি বাস দুমড়ে মুচড়ে দেয় তাদের বহন করা মাইক্রোবাসটিকে।

পাঁচ বছরের বেশি সময় মামলা চলার পর মানিকগঞ্জ অতিরিক্ত দায়রা জজ আদালতে রায় ঘোষণা করা হয় গত ২২ ফেব্রুয়ারি। রায়ে বাস চালক জমির হোসেনকে দোষী সাবোস্ত্য করে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয়। আইন অনুযায়ী রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করা যায়। কিন্তু অভিযুক্ত ড্রাইভারকে অবিলম্বে মুক্তি দিতে হবে এই দাবিতে চুয়াডাঙ্গায় পরিবহন ধর্মঘট আহ্বান করা হয় রায়ের সঙ্গে সঙ্গেই।

এর পর খুলনাসহ আরও ১০ টি জেলায় তা বিস্তৃত হয়। গতকাল সন্ধ্যায় খুলনায় উপ বিভাগীয় কমিশনারের সাথে শ্রমিক নেতাদের বৈঠকে এই ধর্মঘটের অবসান হয়েছে বলা হলেও আজ শোনা যাচ্ছে দেশব্যাপী ধর্মঘট শুরু করেছেন শ্রমিক নেতারা। এই অন্যায্য দাবি সহ ধর্মঘট আদালত অবমাননার শামিল।

আইনের প্রতি অনুগত থাকা প্রতিটি নাগরিকের জন্য অপরিহার্য। বাংলাদেশে একটি আইন আছে, যা অমান্য করে যদি আপনি সফল হয়ে যান তাহলে ঠিক আছে, যদি ব্যর্থ হোন, তবে আপনাকে শাস্তি ভোগ করতে হতে পারে। দণ্ডবিধির ৩০৯ ধারায় উল্লেখ আছে; যদি কোন ব্যক্তি আত্মহত্যা করার চেষ্টা করেন এবং অনুরূপ অপরাধ সংগঠনের উদ্দেশ্যে কোন কাজ করে থাকেন তবে এক বছর পর্যন্ত যে কোন মেয়াদে বিনাশ্রম কারাদণ্ড অথবা অর্থদণ্ড অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। আত্নহত্যা ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকেও উৎসাহ দেয়া হয়নি বরং পাপ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এই প্রকারের প্রতিটি মৃত্যুর জন্য থানায় অপমৃত্যু মামলা দায়ের করতে হয়।

২০১৪ সালের ঘটনাবহুল জাতীয় নির্বাচনের আগে সাবেক রাষ্ট্রপতি এরশাদ সাহেব প্রকাশ্যে আত্মহত্যা করার হুমকি দিয়েছিলেন, যা তখন মিডিয়াতে ব্যাপক ভাবে প্রচারিত হওয়ার পরেও তাকে আনা হয়নি আইনের আওতায়। যদিও গত ২৭ বছর ধরেই তিনি মামলার বেড়াজালে বন্দী।

আবার ২৭ বছর একটানা কারারুদ্ধ থেকে ইতিহাসে অমর হয়ে আছেন নেলসন মান্ডেলা। ক্ষুদিরাম তো ফাঁসির মঞ্চে জীবন দিয়েছেন। মহাত্মা গান্ধী, নেহেরু, বঙ্গবন্ধু জেলখানাকেই ভাবতেন নিজের বাড়ি। শাসকের অত্যাচার আর জেলখানা ছিলো রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গের জন্য নিত্য দিনের ঘটনা। তাই বলে আদালত বা আইনকে অমান্য করেননি কখনো। পালিয়ে বেড়াননি কেউ, বরং বুক ঠুকে লড়াই করেছেন আইনের আওতায়। বারবার ফাঁসির মঞ্চের কাছাকাছি থেকে ফিরে এসে জাতির জনক উপহার দিয়েছেন ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ।

নব্বইয়ের দশকে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে ও এক এগারোর পটভূমিতে জেলে গিয়েছেন দুই নেত্রীসহ অপরাপর জাতীয় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ। আইনি পথ পরিক্রমায় তারা বেশিরভাগ বের হয়ে এসেছেন, আবার কেউ কেই শাস্তি মাথায় নিয়ে তা আইনিভাবেই মোকাবেলা করছেন। কিন্তু ২০১৪ সালের নির্বাচন ঠেকানোর ঘোষণা দিয়ে দেশব্যাপী যে তাণ্ডব আমরা দেখেছিলাম, তারই প্রেক্ষিতে অগুনতি মামলা হয় আন্দোলনকারী নেতা কর্মীদের বিরুদ্ধে। শুরু হয় লুকোচুরি। ডাকসাইটে নেতারা আত্নগোপনে থেকেছেন দিনের পর দিন, যা গণতান্ত্রিক সমাজে বিরল।

মামলায় হেরে গিয়ে ইতিমধ্যে গ্রামীণ ব্যাংকের চেয়ারম্যান পদ হারিয়েছে নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ মোহাম্মদ ইউনুস আর সেনানিবাসের ভেতরের বাড়ি ছেড়েছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া। এই মুহূর্তে দুটি বহুল আলোচিত দুর্নীতি মামলায় ১৫৩ কার্য দিবসের মধ্যে উপস্থিত হয়েছেন মাত্র ১৫ দিন।

মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী জনাব মোজাম্মেল হক ও খাদ্য মন্ত্রী আইন বিভাগের প্রতি অবমাননাসূচক বক্তব্য রাখায় ইতিমধ্যে আদালতে তিরস্কৃত হয়েছেন, সাথে জরিমানা। পরিশোধ করেছেন জরিমানার অর্থ। তবে বিতর্ক উঠেছে তাদের মন্ত্রিত্ব থাকবে কি না? যদিও তার সুরাহা হয়নি এখনো।

ফেনীর আলোচিত সংসদ সদস্য নিজাম হাজারী অস্ত্র মামলায় কম সাজা ভোগ করে বের হয়েছেন কি না এটা নিয়ে মামলা হয়েছে, কিন্তু নিষ্পত্তি হয়নি। যদি তিনি সাজা কম ভোগ করে থাকেন, তবে তা হবে আইনের চরম ব্যত্যয় আর অবধারিত ভাবেই তার সংসদ সদস্য পদ হবে অবৈধ।

আওয়ামী লীগ সরকারের এই দুই মেয়াদে বেশ কয়েককজন সংসদ সদস্য, পটুয়াখালীর গোলাম মওলা রনি, টাঙ্গাইলের আমানুর রহমান রানা ও আব্দুল লতিফ সিদ্দিকী, কক্সবাজারের আব্দুর রহমান বদি তাদের নিজ নিজ কৃতকর্মের জন্য জেলে গিয়েছেন। কেউ মন্ত্রিত্ব ও পরবর্তীতে মনোনয়ন বঞ্চিত হয়েছেন।

বহুল আলোচিত পদ্মাসেতু নিয়ে কথিত দুর্নীতির অভিযোগ মাথায় নিয়ে মন্ত্রিত্ব হারিয়েছেন জনাব আবুল হোসেন আর জেলে গিয়েছেন সচিব মোশারফ হোসেনসহ উচ্চ পর্যায়ের একাধিক আমলা। যদিও সেই মামলার অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি, কিন্তু জনমনে সন্দেহ ছিলো প্রচুর। ইতিমধ্যে কানাডার আদালতে ভিন্ন মামলায় সেই অভিযোগকে কাল্পনিক বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

রাজনীতির সাথে আইন আদালতের অম্ল মধুর সম্পর্ক এতোদিন আমরা দেখে এসেছি, ইদানীং দেখা যাচ্ছে সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে তারকা খ্যাতি পাওয়া ব্যক্তিবর্গও কম যাচ্ছেন না।

হ্যাপি চলচিত্রের একজন নবীন নায়িকা, মামলা করলেন জাতীয় দলের ক্রিকেটার রুবেল হোসেন এর বিরুদ্ধে। জেলে গেলেন, গোটা মিডিয়া থেকে শুরু করে আইনজীবীদের একাংশ পর্যন্ত তাকে রক্ষা করতে এগিয়ে এলেন, তিনি বিপুল বিক্রমে বেড়িয়ে এলেন, বিশ্বকাপে খেললেন ও আমাদের মন জয় করলেন! হ্যাপি আমাদের মনোযোগ হারিয়ে চলচিত্রকে বিদায় জানিয়ে অজ্ঞাতবাসে আছেন। আর আইনের ফাঁক গলিয়ে রুবেল এখন মুক্ত বিহঙ্গ...

জাতীয় দলের পেসার শাহাদাৎ একটি ছোট্ট মেয়ের সাথে তার স্ত্রীসহ এতটাই নির্দয় আচরণ করেছিলেন যে সেই কাজের মেয়েটি সহ্য করতে ব্যর্থ হয়ে বাসা থেকে পালিয়ে আসেন আর একজন সাংবাদিক তাকে উদ্ধার করে থানায় মামলা করেন। মিডিয়ার কল্যাণে সেদিন শিশুটির মুখে তার উপর অত্যাচারের কথা আমরা সবাই শুনেছি। কিন্তু কিছুদিন পর দেখলাম আদালতে নির্যাতিতা শিশুটি একেবারেই ভিন্ন বক্তব্য দিলেন আর মহামান্য আদালত সেই ক্রিকেটারকে সপরিবারে বেকসুর খালাস করে দিলেন। মহাবীর সেদিন মিডিয়াতে বলেছিলেন তিনি ন্যায় বিচার পেয়েছেন!

এখন কারাগারে বন্দী আছেন জাতীয় দলের আরেক চেনা মুখ আরাফাত সানি। একজন নারী মামলা করেছেন নির্যাতনের, যৌতুক দাবি ইত্যাদি জামিন অযোগ্য অভিযোগে। এখন আবার মিডিয়াতে দেখলাম আপস করার জন্য ১৫ লাখ টাকার প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। এই মামলার অভিষৎ কি জানি না। পত্রিকার খবর অনুযায়ী জেলখানায় দুজনে একান্তে কথা বলেছেন, আরেকটা চমকের অপেক্ষায় হয়তো গোটা জাতি...

সঙ্গীত তারকা আরফিন রুমি দুই বিয়ে ও প্রথম স্ত্রীকে নির্যাতন এর মামলায় কারাভোগ করে অবশেষে আপোষ করে মুক্তি পেয়েছেন। সঙ্গীত পরিচালক ইমন তেমনি বিয়ের প্রলোভনে প্রতারণার অভিযোগে একজন নারীর মামলায় জেলে গিয়ে আপসের মাধ্যমেই আবার বের হয়েছেন। ক্লোজআপ তারকা নোলক বাবু বিমানবালার সাথে অশোভন আচরন ও ট্রাফিক সিগন্যাল অমান্য সহ নানা প্রকারের আইন অমান্য করে আজ একেবেরেই হারিয়ে গেছেন...

তারকাদের প্রতি সাধারন মানুষের আগ্রহ ও প্রভাব অপরিসীম। তারকাদের কথায় ও আচরনে উদ্বুদ্ধ হয়ে থাকে সাধারণ মানুষ। প্রতিবেশী দেশ ভারতের তামিলনাড়ুতে মুখ্যমন্ত্রী জয় ললিতার মৃত্যু সংবাদ পেয়ে আত্নহত্যা ও হার্ট অ্যাটাক করে মারা গেছেন প্রায় দুই শতাধিক ভক্ত। বাংলাদেশে সালমানশাহ মারা যাওয়ার পর বেশ কিছু ভক্ত আত্নহননের পথ বেছে নিয়েছিলেন।

রাজনিতিবীদরা আমাদের নেতৃত্ব দেয়ার পাশাপাশি দেশকেও পরিচালনা করে থাকেন। তাই আইনের প্রতি তাদের শ্রদ্ধাবোধ আমাদের উদ্বুদ্ধ করবে। আবার যারা সেবা প্রদান করেন আমাদের যেমন, চিকিৎসা, প্রকৌশল, পরিবহন তাদের উচিৎ হবে আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া।

আবার চলচ্চিত্র থেকে শুরু করে মিডিয়া, ক্রীড়া এমনকি সঙ্গীত সব ক্ষেত্রেই তারকাদের আছে ব্যাপক প্রভাব। তাই তারকাদের, নেতৃবৃন্দের আইনের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ বাঞ্ছনীয়। আইন চলুক তার আপন গতিতে। তারকা খ্যাতি ও প্রভাব আইনের পথকে ব্যাহত করবে না এটাই সচেতন প্রত্যাশা...

লেখক: উন্নয়ন ও অধিকার কর্মী

google news ঢাকা টাইমস অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি ফলো করুন

মন্তব্য করুন

শীর্ষ খবর সর্বশেষ জনপ্রিয়
সব খবর
ফেব্রুয়ারিতেই নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত এনসিপি, যদি...
পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচনের কোন বিকল্প নেই: বিচারপতি আব্দুর রহমান
ইস্টার্ন ইউনিভার্সিটি রিসার্চ সোসাইটির আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু
সাবেক প্রধানমন্ত্রী কাজী জাফরের দশম মৃত্যুবার্ষিকী কাল
বিশেষ প্রতিবেদন তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা