মাদ্রাসাতেও ছেলেদের পেছনে ফেললো মেয়েরা
শিক্ষায় মেয়েদের জয়জয়কার। প্রাথমিক থেকে শুরু করে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায় পর্যন্ত সব ক্ষেত্রেই এগিয়ে মেয়েরা। সাধারণ শিক্ষা ব্যবস্থার পাশাপাশি মাদ্রাসাও এর বাইরে নয়। এই শিক্ষা ব্যবস্থাতেও ছেলেদের আধিপত্য ভেঙে গিয়েছে মেয়েরা।
সরকারি হিসাবগুলো বলছে, গত ১৫ বছরে মাদ্রাসা শিক্ষায় নারীদের অগ্রগতি ঘটেছে অবিশ্বাস্য রকমের। এই সময়ের মধ্যে ছাত্রী সংখ্যা বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ। অথচ এই সময়ে ছেলে শিক্ষার্থীর সংখ্যা কমে গেছে। একে নারী বিপ্লব বলে মনে করছেন শিক্ষাবিদরা।
৯০ দশকের শুরুর দিকেও মেয়েদের শিক্ষার অধিকার নিশ্চিত করতে অনেক কর্মসূচি হাতে নিতে হয়েছে সরকারকে। এমনকি মেয়েদের স্কুলে যাওয়ার অধিকার আছে-এমন বার্তা সম্বলিক কার্টুনও প্রচার হয়েছে টেলিভিশনে। পাশাপাশি মেয়েদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নিয়ে আসতে উপবৃত্তি, শিক্ষাবৃত্তি, মেয়েদের বেতন মওকুফসহ নানা সুবিধা দিতে হয়েছে। ধীরে ধীরে এর সুফল মিলেছে।
গত এক দশক ধরেই দেখা যাচ্ছে, শিক্ষাখাতে মেয়ের সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। কেবল সংখ্যার দিক দিয়েই নয়, ফলাফলের দিক থেকেও এগিয়ে যাচ্ছে মেয়েরা। পঞ্চম শ্রেণি সমাপনী পিইসি, অষ্টম শ্রেণি সমাপনী জেএসসি, দশম শ্রেণির পর এসএসসি বা দ্বাদশের পর উচ্চমাধ্যমিক-সব ক্ষেত্রেই ফলাফলের দিক থেকে ছেলেদেরকে ছাড়িয়ে গেছে মেয়েরা।
চলতি বছর এইচএসসির ফলাফল ঘোষণা করতে গিয়ে মেয়েদের এই অগ্রগতির প্রশংসা করে খানিকটা রসিকতাও করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, ‘আমি ছেলেদেরকে বলবো, তোমরা পিছিয়ে থাকবে কেন, তোমাদেরকেও ভালো করে পড়াশোনা করতে হবে।’
শিক্ষাবিদরা বলছেন, প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশে নারী জাগরণ ঘটেছে। ব্যাপকহারে নারী নির্যাতন ও বৈষেম্যের মধ্যেও তারা সব ক্ষেত্রেই এগিয়ে যাচ্ছে।
মাদ্রাসা শিক্ষায় অগ্রগতি
বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর (ব্যানবেইস) সর্বশেষ প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ২০০০ সালে ইবতেদায়ী থেকে কামিল শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থী ছিল ৩১ লাখ ১২ হাজার ২০৫ জন। এরমধ্যে মেয়ে শিক্ষার্থী ছিল ১২ লাখ ২৬ হাজার ২০৯ জন। অর্থাৎ ১৬ বছর আগে মেয়েদের দেড়গুণেরও বেশি ছেলে পড়তো মাদ্রাসায়। তখন ছেলের সংখ্যা ছিল ১৮ লাখ ৮৫ হাজার ৯৯৬ জন।
১৫ বছরের ব্যবধানে চিত্রটা পুরোপুরি পাল্টে গেছে। সবশেষ অনুযায়ী মাদ্রাসায় শিক্ষার্থী সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৮ লাখ ৮৩ হাজার ৯৮২ জন। এরমধ্যে মেয়ে শিক্ষার্থী সংখ্যা ২০ লাখ ৪ হাজার ৮৪৪ জন। অর্ধেকেরও বেশি মেয়ে। মোট শিক্ষার্থীর প্রায় ৫২ শতাংশ। অর্থাৎ মাদ্রাসায় মেয়ের সংখ্যা বাড়ার কারণেই শিক্ষার্থী সংখ্যা বেড়েছে।
মাদ্রাসা শিক্ষায় গত ১৫ বছরে মেয়েদের সংখ্যা বেড়েছে সাত লাখ ৭৮ হাজার ৬৩৫ জন। গত বছর মাদ্রাসায় মোট শিক্ষার্থী ছিল ৩৮ লাখ ১৫ হাজার ২৮০ জন। এরমধ্যে মেয়েদের সংখ্যা ছিল ১৯ লাখ ৭৭ হাজার ৯৭৫ জন। গত এক বছরে মেয়েদের সংখ্যা বেড়েছে ২৬ হাজার ৮৬৯ জন। আর গত ১৫ বছরে মাদ্রাসায় ছেলে শিক্ষার্থীর সংখ্যা কমেছে ছয় হাজার ৮৫৮ জন।
ব্যানবেইসের তথ্য মতে, ২০১৫ সালে ইবতেদায়ী থেকে দাখিল শ্রেণি পর্যন্ত মোট শিক্ষার্থী ছিল ২২ লাখ ৫৭ হাজার ৭৫৫ জন। এরমধ্যে ছাত্রী ছিল ১২ লাখ ৬০ হাজার ৬৭৯ জন। অর্থাৎ মাদ্রাসা শিক্ষার প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক পয্যায়ে মেয়েদের সংখ্যা অর্ধেকেরও বেশি, প্রায় ৫২ শতাংশ। ২০০০ সালে এই পর্যায়ে মোট শিক্ষার্থী ছিল ১৮ লাখ ৭৯ হাজার ৭০৭ জন। এরমধ্যে মেয়ে ছিল আট লাখ ৬২ হাজার ৮২০ জন।
২০১৫ সালে আলিমে মোট শিক্ষার্থী ছিল ছয় লাখ ৯৪ হাজার ৮৭৭ জন। এরমধ্যে মেয়েদের সংখ্যা তিন লাখ ৬০ হাজার ২৩২ জন। এখানেও মেয়েদের সংখ্যা প্রায় অর্ধেক। একই বছর ফাজিলে মোট শিক্ষার্থী ছিল ছয় লাখ ৭০ হাজার ৬০৮ জন। এরমধ্যে মেয়েদের সংখ্যা তিন লাখ পাঁচ হাজার ৫২২ জন। এখানেও মেয়েদের সংখ্যা অর্ধেকের কিছু কম। আর কামিলে মোট শিক্ষার্থী ছিল দুই লাখ ৬০ হাজার ৭৪২ জন। এরমধ্যে মেয়েদের সংখ্যা ৭৮ হাজার ৪১১ জন। মাদ্রাসা শিক্ষার সর্বোচ্চ স্থানে মেয়েদের সংখ্যা অর্ধেকেরও বেশি কম। এই পর্যায়ে মেয়েরা এখনও পেছনে রয়েছে।
অনন্য নজির হিসেবে দেখছেন শিক্ষামন্ত্রী
শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ মনে করেন মাদ্রাসায় মেয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছেলেদেরকে ছাড়িয়ে যাওয়া বিশ্বের মধ্যে একটি অনন্য নজির। তিনি বলেন, ‘সব দিকেই এখন মেয়েরা এগিয়ে যাচ্ছে। জ্ঞান-বিজ্ঞানের অভূতপূর্ব উন্নয়ন সাধন করছে মেয়ে শিক্ষার্থীরা। মাদ্রসা শিক্ষায়ও এখন এগিয়ে রয়েছে তারা। এটি বিশ্বের মধ্যে এক অন্যান্য নজির।’
সার্বিক বিষয় নিয়ে জানতে চাইলে ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মাহবুবুর রহমান ঢাকাটাইমসকে জানান, ‘দেশের দারিদ্যের হার কমেছে। মানুষের মধ্যে ধর্মীয় অনুভূতিতে পরিবর্তন এসেছে। এছাড়া ইসলামী শিক্ষার প্রতি মানুষের মধ্যে আগ্রহ বাড়ছে। এসবের প্রভাব মেয়েদের মধ্যে পড়ছে।’
জানতে চাইলে গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরী ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘মাদ্রাসা শিক্ষায়ও বিপ্লব করছে মেয়েরা। এটি মেয়ে শিক্ষার্থীদের সার্বিক উন্নয়নের প্রভাব মাদ্রাসা খাতেও পড়েছে।’
(ঢাকাটমস/৬ডিসেম্বর/এমএম/ডব্লিউবি)