‘কেভিন কার্টারের পুলিৎজার পুরস্কার ও রুবেল রশিদের হৃদয় জয়’

প্রতিদিন সকালেই নিয়ম করে প্রায় ১৭-২০টি পত্রিকার ‘ই-পেপার’ দেখা আমার নেশায় পরিণত হয়েছে। সাংবাদিকতা করার কারণেই বেশি করে পত্রিকাগুলোতে চোখ বুলাই। প্রথমত খুঁজি আমার বিটে কে কী নিউজ লিখলো? আমি কী মিস করলাম? অন্যদিকে কোথায় কী ঘটছে, আমরা কী মিস করলাম বা কোন কোন পত্রিকায় দিনের সবচেয়ে আলোচিত নিউজ হয়েছে, সেগুলো পড়া ও জানার চেষ্টা করি। এই তালিকায় দেশ রূপান্তরও আছে।
পত্রিকায় দেখতে গিয়ে চোখ আটকে গেল একটি ছবির দিকে। ‘বড় বোনের সঙ্গে নিয়ে মুগদা জেনারেল হাসপাতালে করোনাভাইরাসের নমুনা পরীক্ষা করতে আসেন বাবুবাজারের চা বিক্রেতা আল আমীন। বোন তাকে রেখে চলে যায়। এরপর আল আমিন সংজ্ঞা হারিয়ে বাইরে পড়ে থাকে।’ সেই ছবিটি তুলেন ফটো সাংবাদিক রুবেল রশিদ। (অবশ্য ছবিটি নিয়ে গতরাত ১২ টায় চ্যানেল আইয়ের সংবাদপত্র পর্যালোচনা অনুষ্ঠানেও আলোচনা করেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত চিকিৎসক অধ্যাপক এবিএম আবদুল্লাহ স্যার।)
এক ছবি হাজার শব্দের চেয়ে বেশি শক্তিশালী। রুবেল রশিদ ভাইয়ের তোলা ছবিই সেই প্রমাণ। ছবিটিতে ফুটেছে মানবতা ও অব্যবস্থাপনা। আপন বোন ভাইকে রেখে চলে গেছেন। আর সেবা পেতে যে কী পরিমাণ ভোগান্তিতে সাধারণ মানুষ সেই চিত্র ফুটে উঠেছে। ছবিটি নিজের ফেসবুকে শেয়ার করবো বলে ই-পেপার থেকে নিয়ে মোবাইলে রাখলাম। সকাল থেকেই ফেসবুকে ছবিটি শেয়ার দেব দেব করেও দেওয়া হয়নি। এরমধ্যে এই ছবিটি ফেসবুকে ভাইরাল হয়েছে।
দুপুরের পর থেকে দুটো ফেসবুকের ওয়ালে ওয়ালে ভাসছে। একটি আল আমীনের পড়ে থাকা, আরেকটি রুবেল রশিদ ভাইয়ের অসুস্থ আল আমীনকে পানি পান করানো। আল আমীনের আপন বোন যখন ছেড়ে চলে গেছেন, হাসপাতালের বাইরে অজ্ঞান পড়ে থাকলেও করোনা আক্রান্ত হতে পারে-এমন অজানা আতঙ্ক কেউ যখন এগিয়ে আসেনি, তখন রুবেশ রশিদ ভাই পেশাগত দায়িত্ব পালনের জন্য ছবিটি তুলেই জীবনের ঝুঁকি জেনেও এগিয়ে গেলেন ছেলেটির দিকে। দেখলেন ছেলেটি জীবিত। তখন এক বোতল পানি কিনে পান করালেন এবং মাথায় ঢেলে সুস্থ করলেন।
ছবিটি দেখে মনে হলো সেই বিশ্বনন্দিত চিত্র সাংবাদিক দক্ষিণ আফ্রিকার কেভিন কার্টারের কথা। দুর্ভিক্ষকবলিত দক্ষিণ সুদানে মৃতুপ্রায় এক শিশুর ছবি তুলে জগত বিখ্যাত হয়েছিলেন। জিতেছিলেন পুলিৎজার পুরস্কার। ছবিটির সারমর্ম ছিল- ১৯৯৩ সালে সুদানে দুর্ভিক্ষপীড়িত এক খুদে মৃত্যুপ্রায় শিশু এক কিলোমিটার দূরে জাতিসংঘের খাদ্য বিতরণ কেন্দ্রের দিকে হামাগুড়ি দিয়ে এগোতে চেষ্টা করছে; কিন্তু পারছে না। সামান্য এগিয়েই মাটিতে মাথা রেখে আবার দম নেওয়ার জন্য থেমে যাচ্ছে। পেছনে সামান্য দূরত্বে একটি শকুন তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে শিশুটির দিকে। শকুনটির অপেক্ষা শিশুটি মারা গেলে তাকে সে খাবে। দৃশ্যটি সহ্য করতে না পেরে কেভিন কার্টার ছবিটি তুলে স্থান ত্যাগ করে চলে যান। পরে শিশুটির ভাগ্যে কী ঘটেছিল, তা জানা যায়নি।
ছবিটি ১৯৯৩ সালের ২৬ মার্চ নিউইর্য়ক টাইমস প্রকাশ করে। এরপর অসংখ্য মুদ্রণ হয়েছে ছবিটি। দুর্ভিক্ষের এই ছবিটি ধারণের মাত্র ১৪ মাস পর ১৯৯৪ সালের ২৩ মে কের্ভিন কার্টার কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে লো মেমোরিয়ালের সুসজ্জিত লাইব্রেরির মঞ্চ থেকে অসংখ্য ভক্ত ও সুধীর সামনে থেকে পুজিৎজার পুরস্কার গ্রহণ করেন। তবে এটি জানা যায়, এরপর তিন মাস পর প্রচণ্ড মানসিক বিষন্নতার কারণে কেভিন কার্টার আত্মহত্যা করেন।
অদৃশ্য মহামারি করোনার কারণে সন্তান যখন বাবার মরদেহ ধরে না, গর্ভধারণী মাকে বনে ভেতরে রেখে যান সন্তানেরা, করোনার লক্ষণ থাকায় স্বামীকে ঘরে ঢুকতে দেন না প্রিয়তমা স্ত্রী, সেখানে চিত্র সাংবাদিক রুবেল রশিদের মানবিকতা আবারও প্রমাণ করলো, না-আমাদের মানবতা এখনো হারিয়ে যায়নি।
তিনিও পারতেন পেশাগত দায়িত্ব পালন শেষে অফিসমুখি হতে। কিন্তু তা করেননি। যেখানে আপন বোন ছেড়ে চলে গেছেন, সেখানে চিত্র সাংবাদিক রুবেশ রশিদ প্রমাণ করলেন আসলেই মানুষ মানুষের জন্য, জীবন জীবনের জন্য।
দক্ষিণ আফ্রিকার কেভিন কার্টার পুলিৎজার পুরস্কার পেলেও বাংলাদেশি ফটো সাংবাদিক রুবেল রশিদ ভাইদের ভাগ্যে এমন পুরস্কার জুটবে কিনা জানা নেই। তবে তিনি ‘মানবিকতার’ প্রমাণ দিয়ে দেশের মানুষের হৃদয় জয় করেছেন।
শুধু রুবেল রশিদ ভাই নয়, এমন আরও অসংখ্য মানবতার সাক্ষর রেখেছেন এদেশের সাংবাদিকরা। রাজনীতিবিদকে যেমন পুলিশের হাত থেকে সাংবাদিকরা রক্ষা করেছেন, নিজের গাড়িতে করে পৌঁছে দিয়েছেন নিরাপদ স্থানে। তেমনি পিকেটারদের হাত থেকে পুলিশকে রক্ষায় এগিয়ে গেছেন অনেক সাংবাদিক। আমরা সুযোগ পেলেই সাংবাদিকদের চৌদ্দগোষ্ঠি উদ্ধার করি। আবার যখন বিপদে পড়ি তখন সাংবাদিকদের দ্বারস্থ হই। আবার একথাও স্বীকার করছি, সাংবাদিক যে সবাই মানবিক, সবাই ভালো তাও নয়। তবে এটাও ঠিক ভালো মন্দ সব পেশাতেই আছে। ধন্যবাদ রুবেল রশিদ ভাই। জয় হোক মানবতার।
লেখক: সাংবাদিক

মন্তব্য করুন