রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায় খনিজ লবণ
দেহের গঠন ও সুস্থতা রক্ষায় প্রয়োজনীয় উপাদান খনিজ লবণ। প্রতিদিন খাবারের সঙ্গে আমরা লবণ খাই। এ লবণকে খাদ্যলবণ বলে। খাদ্যলবণ ছাড়া আরও অনেক লবণ আছে,যা আমাদের দেহের জন্য প্রয়োজনীয়। দেহকোষ ও দেহ তরলের জন্য খনিজ লবণ একটি অত্যাবশ্যকীয় উপাদান।
ক্যালসিয়াম, সোডিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, ফসফরাস, ক্লোরিন, আয়োডিন, লৌহ, সালফার ইত্যাদি লবণ জাতীয় দ্রব্য খাদ্যের সাথে দেহে প্রবেশ করে ও দেহ গঠনে সাহায্য করে। প্রধানত দুই ভাবে খনিজ লবণ দেহে কাজ করে। যথা- দেহ গঠন উপাদান রূপে ও দেহ অভ্যন্তরীণ কাজ নিয়ন্ত্রণ করে।
বেশিরভাগ খনিজ লবণ উদ্ভিজ্জ খাদ্যেও মাধ্যমে গৃহীত হলেও কিছু কিছু খনিজ লবণ সরাসরি টেবিল সল্ট রূপে গৃহীত হয়। এই লবণ বা ধাতব যৌগগুলো বেশির ভাগই মাটির তলা থেকে বা খনি থেকে সংগৃহীত হয় বলেই এদর খনিজ লবণ বলা হয়। অবশ্য খনি অর্থে উদ্ভিদ দ্বারা মাটির গভীর থেকে সংগৃহীত উপাদানও বোঝায়।
খনিজ লবণকে পুষ্টি ক্রিয়ায় গুরুত্ব অনুযায়ী দুইভাগে ভাগ করা হয়। যেমন ম্যাক্রো মৌল বা মেগা মৌল (যেগুলো দেহে বেশি পরিমাণে প্রয়োজন হয়) এবং মাইক্রো মৌল বা ট্রেস মৌল ( যেগুলো দেহে অপেক্ষাকৃত কম পরিমাণে প্রয়োজন হয়)।
বিজ্ঞানীদের মতে সালফার, ফসফরাস, ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, পটাসিয়াম, লৌহ প্রভূতি ম্যাক্রো মৌলের অন্তর্ভুক্ত। তেমন মলিবডেনাম, বোরন, জিঙ্ক, অ্যালুমিনিয়াম, কপার প্রভৃতি মাইক্রোমৌল রূপে গণ্য হয়।
অনেক সময় আমরা না বুঝে, না জেনে ছেলেমেয়েদের লবণ খেতে বারণ করি। কিন্তু এই লবণের কতটা উপযোগিতা তা উপলদ্ধি করা খুবই প্রয়োজন। যদিও বয়স্কদের বা হার্টের রোগীদের কিংবা রক্তঘটিত রোগাক্রান্ত ব্যক্তিদের কথা আলাদা। তাদের ক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী চলতে হয়।
সাধারণভাবে খনিজ লবণের অভাবে মানুষের দেহে নানা রোগ দেখা দিতে পারে। তাই রোগ প্রতিরোধ হিসাবে খাদ্যের সঙ্গে কোন কোন খনিজ মৌল গ্রহণ করা দরকার তা নিয়ে একটু সতর্ক হলেই ভালো। বিশেষভাবে বাড়ন্ত শিশুদের ও পড়ুয়াদের ক্ষেত্রে খনিজ লবণ সম্বন্ধে সচেতনতা খুবই দরকার। তাদের সামগ্রিক পুষ্টি ও বৃদ্ধি, মেধা ও বিকাশ অনেকাংশে খনিজ লবণের ওপর নির্ভর করে।
মানুষের দেহে অন্যান্য খাদ্যের সঙ্গে এই খনিজ লবণগুলো সার্বিক পুষ্টিতে অতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এদের কয়েকটি নিয়ে আলোচনা করলে খনিজ লবণ সম্বন্ধে মোটামুটি একটা ধারণা তৈরি হতে পারে।
সালফার
মানুষের নখ, চুল, তরুণাস্থি, অস্থি, স্নায়ুকলা, রক্ত এবং কতকগুলো হরমোন যেমন ইনসুলিন, বিভিন্ন রাসায়নিক যৌগ যেমন হেপারিন, মেলানিন প্রভূতিতে থাকে। তাই প্রত্যহ খাদ্যের সঙ্গে গড়ে দুই-তিন মিলিগ্রাম পরিমাণে গ্রহণ করতে হয়। দেহের নখ, চুল, অস্থি ও তরুণাস্থি প্রভৃতির স্বাভাবিক কাজকর্মে, রক্তের কার্যকারিতায়, রক্তে সঞ্চালনে, জৈব বস্তুর জারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তাই যদি কোনো কারণে দেহে পরিমাণ মতো সালফার দ্রব্যের ঘাটতি হয় তাহলে দেহের বৃদ্ধি ব্যবহত হয়, অনাক্রম্যতা কমে, রক্তজনিত রোগ সৃষ্টি হয় এবং শর্করা বিপাক ব্যবহত হয়।
ফসফরাস
ফসফরাস মানবদেহের বিশেষত অস্থির অতি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান।যকৃৎ ও রক্ত রসে থাকে। তাই বাড়ন্ত শিশুর দেহে প্রত্যহ দেড় গ্রাম এবং বড়দের এক গ্রাম ফসফরাস খাদ্যের সঙ্গে গ্রহণ করা প্রয়োজন। সাধারণত উদ্ভিজ্জ খাদ্যবস্তু–দানাশস্য, শিম, মটরশুটি ইত্যাদিতে বেশি থাকে। অনুরুপভাবে প্রাণীজ খাদ্য–দুধ, ডিম, মাছ, মাংসের প্রচুর পরিমাণে থাকে। এই ফসফরাস অস্থি, দন্ত গঠনে অংশগ্রহণ করলেও স্নেহবিপাকে, নিউক্লিওপ্রোটিন গঠনে, কোষ বিভাজনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে। তাই কোনো কারণে দেহে ফসফরাসের অভাব হলে অস্থিক্ষয়, দন্তক্ষয়, রিকেট রোগ, হাত-পা-কোমরের গাঁটে ব্যথা প্রভৃতি উপসর্গ দেখা দেয়।
ক্যালসিয়াম
ক্যালসিয়াম মৌলটি মানুষের অস্থি ও দন্তের এবং রক্তের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। মানবদেহের মোট ওজনের প্রায় শতকরা দুইভাগ ক্যালসিয়াম থাকে। তাই প্রত্যহ বাড়ন্ত শিশুদের দেড় গ্রাম থেকে দুইগ্রাম এবং বড়দের এক থেকে দুইগ্রাম পরিমাণ ক্যালসিয়াম খাদ্যের সঙ্গে গ্রহণ করতে হয়। সাধারণত উদ্ভিজ্জ খাদ্যের মধ্যে ফুলকপি, লেবু, গাজর, পালংশাক, বাঁধাকপি, লেটুস শাক, সবুজ শাক-সবজিতে থাকে। অণ্যভাবে প্রাণীজ খাদ্যের মধ্যে মাছ, মাংস, ডিম, চুনো মাছ, দুধের মধ্যে প্রচুর পরিমাণে থাকে। কোনো কারণে দেহে এই খনিজ মৌলটির ঘাটতি হলে টিটেনি রোগ, রিকেট, অস্টিওম্যালেসিয়া রোগ, হৃদপিন্ড ঘটিত রোগ দেখা দেয়। রক্ত ও পেশির স্বভাবিক কার্যকারিতা বিঘ্নিত হয়।
ম্যাগনেসিয়াম
মানুষের দেহে পেশিকোষে, অস্থিকোষে, স্নায়ুকোষে গুরুত্বপূর্ণ ভূসিকা পালন করে। তাই দৈনিক গড়ে প্রায় এক গ্রাম ম্যাগনেসিয়াম খাদ্যের সঙ্গে লবণ রূপে কিংবা অন্য যৌগরূপে গ্রহণ করতে হয়। উদ্ভিজ্জ খাদ্যের মধ্যে বিশেষত সবুজ শাক-সবজি ও ফলমূলে বেশি থাকে। প্রাণীজ খাদ্যের মধ্যে মাছ, মাংস, ডিম ও দুধে এই খনিট মৌলটি থাকে। কোনো কারণে দেহে এর ঘাটতি হলে হৃদস্পন্দনের হার বাড়ে, অস্থি ভঙ্গুর হয়, স্নায়ু দুর্বল হয়ে পড়ে ও মেধা হ্রাস পায়। দাঁতের রোগ দেখা দেয়। ফলে দেহের স্বাভাবিক পুষ্টি ও বৃদ্ধি বিঘ্নিত হয়।
পটাসিয়াম
মানবদেহের স্নায়ুকোষের একটা গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হল এই পটাসিয়াম। তাই একজন সুস্থ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের দৈনিক এই খনিজ মৌলটির দরকার হয় প্রায় চার-পাঁচগ্রাম। দেহের চাহিদা পূরণের জন্য সবুজ শাকসবজিতে, ফলে ও বীজে প্রচুর পরিমাণে থাকে। মাছ, মাংস, দুধ ও ডিমও কম-বেশি পরিমাণে থাকে। যদি কোনো কারণে এই মৌলটির ঘাটতি হয় তবে দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়, রক্তের স্বাভাবিক কার্যকারিতা বিঘ্নিত হয়, পেশির দুর্বলতা, হার্টের রোগ দেখা দেয়।
লৌহ বা আয়রন
মানুষের দেহে আয়রন একটি প্রধান উপাদান। দেহের ওক্ত, অস্থি, তরুণাস্থি, যকৃত প্রভূতি সক্রিয় রাখতে প্রতিনিয়ত প্রচরি পরিমাণে লৌহ দরকার। একজন প্রাপ্তবয়স্ক সুস্থ মানুষের দৈনিক দশ থেকে পনেরো মিলিগ্রাম আয়রন না হলে কোনো না কোনো রোগ সৃষ্টি হতে পারে। লৌহঘটিত লবণ যেমন ফেরাস সালউেঁ, ফেরিক সালফেট প্রভূতি বেশি থাকে ফুলকপি, নিমপাতা, নটেশাক, ডুমুর, কাঁচকলা, এঁচোড়, থোড়, মোচা প্রভূতি উদ্ভিজ্জ খাদ্যে। প্রাণীজ খাদ্যের মধ্যে ডিম, দুধ, মাছ, মাংসেও লৌহ থাকে। যদি কোনো কারণে দেহে লৌহের অভাব হয় তবে অ্যানিমিয়া, শ্বাসনজনিত রোগ, পরিপাক জনিত গন্ডগোল দেখা দিতে পারে এবং সার্বিকভাবে বিশেষত বাড়ন্ত শিশুদের দেহের পুষ্টি ও বৃদ্ধি ব্যাহত হয়। অস্থি ভঙ্গুর হয়ে পড়ে।
আয়োডিন
এই খনিজ লবণটি দেহের পুষ্টিতে যেমন অংশগ্রহণ করে তেমনি থাইরক্সিন নামক এক প্রকার হরমোন তৈরিতে ও তার কার্যকারিতায় খবই সহায়ক। মানুষের দৈনিক আয়োডিনের চাহিদা প্রায় ০.০৫ থেকে ১ মিলিগ্রাম। সবুজ শাকসবজি কম-বেশি থাকলেও বেশি থাকে সামুদ্রিক মাছে আর টেবিল সল্টের সঙ্গে। কোনো কারণে মানুষের দেহে এই খনিজ মৌলটির ঘাটতি হলে গলগন্ডের মতো মারাত্মক রোগ দেখা দেয়। তাছাড়া সার্বিক বৃদ্ধি ও পুষ্টির সহায়ক হরমোন থাইরক্সিন ঠিকমতো তৈরি না হওয়ার কারণে নানা সমস্যা হয়।
(ঢাকাটাইমস/৬সেপ্টেম্বর/আরজেড/এজেড)
মন্তব্য করুন