রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনেই জোর বাংলাদেশের

নজরুল ইসলাম, ঢাকাটাইমস
  প্রকাশিত : ১৪ অক্টোবর ২০২০, ১২:০৮
অ- অ+

মিয়ানমারের রাখাইন থেকে নিপীড়নের শিকার হয়ে বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের সেদেশে ফেরানো আরও জটিল হয়ে পড়েছে। এই বিপুল শরণার্থীর প্রত্যাবাসনে নানামুখি তৎপরতা আর বন্ধুপ্রতিম দু’টি দেশের ওপর ভরসা করেও এই সংকট নিরসনে গতি আসেনি। তার ওপর রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে স্থানান্তরের বিষয়ে এনজিওদের নেতিবাচক প্রচারণা এই সংকটকে আরও ঘনীভূত করে তুলেছে।

রোহিঙ্গা শরণার্থীদের প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু করতে মরিয়া বাংলাদেশ। এ নিয়ে গত তিন বছর ধরে অব্যাহত প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে ঢাকা। কিন্তু কিছুতেই কাক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছানো যাচ্ছে না। রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান নিয়ে শুরু থেকে বলা হচ্ছে- মিয়ানমারের বন্ধু দেশ চীন ও ভারতের হস্তক্ষেপ ছাড়া এ সমস্যার সমাধান মিলবে না।

সেই উপলব্ধি থেকে বেইজিং ও নয়াদিল্লির দরজায় অনবরত কড়া নেড়ে যাচ্ছে ঢাকা। কিন্তু ওপরে ওপরে ঢাকাকে ‘পাশে আছি’ মর্মে আশ্বস্ত করা হলেও বেইজিং ও নয়া দিল্লির রোহিঙ্গা ইস্যুতে আন্তরিকতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে বারংবার।

এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও’র আয়োজনে আগামী ২২ অক্টোবর আন্তর্জাতিকভাবে রোহিঙ্গা বিষয়ক একটি ভার্চুয়াল সম্মেলন হতে যাচ্ছে। যুক্তরাজ্য, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ও জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থার পাশাপাশি এ অনুষ্ঠানে বাংলাদেশকেও আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। তবে আলোচনার বিষয়বস্তু সম্পর্কে জানা না গেলেও রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য একসঙ্গে ১০ বছরের মানবিক সাহায্য দেওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হবে বলে বিভিন্ন সূত্রে বাংলাদেশ জানতে পেরেছে।

তবে ঢাকা এই প্রস্তাবে রাজি হবে না বলে আভাস দিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেন। তিনি বলেছেন, ‘আমরা শুনতে পেলাম, তারা ১০ বছরের মানবিক সাহায্য নিয়ে আলাপ করবে। তারা মাল্টি-ইয়ার প্ল্যানিংয়ের কথা বলছেন। কিন্তু আমরা মাল্টি-ইয়ার প্ল্যানিংয়ে যেতে রাজি নই। মাল্টি ইয়ার পরিকল্পনা রোহিঙ্গা পুনর্বাসনের জন্য। কিন্তু আমরা এ বিষয়ে আগ্রহী নই। আমরা এখন এক বছরের জন্য সাহায্য নিচ্ছি। দীর্ঘমেয়াদি বিষয়ে আমাদের কোনও আগ্রহ নেই। আমরা যত দ্রুত সম্ভব রোহিঙ্গাদের বিদায় করতে চাই। আমাদের মূল লক্ষ্য রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন।’

রোহিঙ্গাদের অবশ্যই ফিরে যেতে হবে উল্লেখ করে মোমেন বলেন, ‘আমাদের মূল লক্ষ্য রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন। এটা বিশ্বের দায়িত্ব। রোহিঙ্গাদের অবশ্যই ফিরে যেতে হবে। রোহিঙ্গা চলে গেলে বাংলাদেশ খুশি।’

এদিকে আজ দুই দিনের সফরে ঢাকায় আসছেন মার্কিন উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্টিফেন ই বিগুন। মার্কিন উপ পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ঢাকা সফরে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে আলোচনা হবে বলে জানিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী।

অন্যদিকে রোহিঙ্গা ইস্যুতে পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ের ত্রিপক্ষীয় বৈঠক করতে সম্প্রতি চীনের দেয়া প্রস্তাবের বিষয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, চীনের রাষ্ট্রদূত আমার কাছে জানতে চাইলেন আমরা রাজি কিনা। আমি বললাম অবশ্যই, আপনারা মিয়ানমারকে রাজি করান। সেটির তারিখ তারা ঠিক করবে এবং আমরা এ উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছি।’

এছাড়া সম্প্রতি বাংলাদেশ-ভারতের যৌথ কনসাল্টেটিভ কমিশনের (জেসিসি) বৈঠকের পর দুই দেশের যৌথ বিবৃতিতে ঢাকার পক্ষ থেকে রোহিঙ্গা সংকট সমাধানের ক্ষেত্রে মিয়ানমারের ওপর প্রভাব খাটানোর জন্য অনুরোধ জানান পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেন।

সম্প্রতি এক ঝটিকা সফরে মিয়ানমার যান ভারতের পররাষ্ট্র সচিব হর্ষ বর্ধন শ্রিংলা ও সেনাপ্রধান জেনারেল এম এম নারাভানে। সেই সফরে মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সেলর অং সান সু চি এবং সে দেশের সেনাবাহিনীর কমান্ডার-ইন-চিফ অং মিন লেইং-র সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় নানা বিষয়ে তাদের বিস্তারিত আলাপ-আলোচনা হয়।

ভারতের পররাষ্ট্র সচিব ও সেনাপ্রধান তাদের মিয়ানমার সফরে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের রাখাইনে ফিরিয়ে নিতে মিয়ানমারকে আহ্বান জানিয়েছেন। আগামী নভেম্বরে মিয়ানমারে অনুষ্ঠেয় সাধারণ নির্বাচনের আগেই অন্তত কিছু রোহিঙ্গাকে ফিরিয়ে নিতে ভারত মিয়ানমারকে প্রস্তাব দেয় দেশটির গণমাধ্যমে খবর আসে। তবে পুরোমাত্রায় রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে ভারত মিয়ানমারকে কোনো চাপ দেয়নি।

ভারতীয় পররাষ্ট্র সচিব ও সেনাপ্রধানের সফরে রোহিঙ্গা ইস্যুতে কোনো আলোচনার বিষয় উল্লেখ ছিল না মিয়ানমারের প্রেস বিবৃতিতে। সেখানে শুধু ভারতের পররাষ্ট্র সচিব ও সেনাপ্রধানের সফরে দুই দেশের মধ্যে বহুপক্ষীয় সম্পর্ক; বিশেষ করে ব্যবসা-বাণিজ্য, যোগাযোগ ব্যবস্থা (কানেকটিভিটি), পরিবহন ব্যবস্থা (ট্রান্সপোর্ট), জ্বালানি, উন্নয়ন প্রকল্প এবং একটি স্কিল ডেভেলপমেন্ট সেন্টার গড়ে তোলাসহ কর্মসূচির তৃতীয় পর্যায়ে কী কী প্রকল্প হাতে নেওয়া হবে সেবিষয়ে আলোকপাত করা হয়েছে।

রোহিঙ্গা ইস্যুতে ভারত মিয়ানমারকে কখনও চাপ দেবে না বলেই মনে করছেন না বিশ্লেষকরা। তাদের ভাষ্য, ভারত তাদের অর্থনৈতিক স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে বাংলাদেশের পক্ষে বড় ধরণের কোনো ছাড় দিতে রাজি নয়। তাছাড়া ভারত মিয়ানমারকে চাপ দিলেই রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান হবে তেমনটা ভাবারও কোনো অবকাশ নেই।

সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ন কবির ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘ভারতের পররাষ্ট্র সচিব ও সেনাপ্রধান মিয়ানমার সফরের পর দুই দেশ যে বিবৃতি দিয়েছে তাতে চাপের কোনো ইঙ্গিত নেই। মিয়ানমারেরও কোনো প্রতিক্রিয়াও নেই। চাপ হলো কি হলো না সেরকম কিছুতো আসেনি।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক দেলোয়ার হোসেন ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘বাংলাদেশ কি বলল সেটাতো ভারতের কনসার্ন না। মিয়ানমারের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক বিবেচনা করলে দেখা যাচ্ছে, ভারত তাদের অর্থনৈতিক ও ভূরাজনৈতিক স্বার্থ সেটাই তারা মাথায় রাখবে।’

আন্তর্জাতিক সম্পর্কের এই বিশ্লেষক বলেন, ‘রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশের কথায় কিছু কিছু ব্যাপারে ভারতের অবস্থানের পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু সেটা কার্যকরী কোনো পরিবর্তন নয়। রোহিঙ্গা ইস্যুতে ভারত কোনো বড় ধরণের স্যাক্রিফাইস করতে রাজি আছে সেটা আমারা এ পযন্ত দেখিনি আর ভবিষ্যতেও খুব বেশি কিছু করবে সেটাও মনে হয় না। কারণ মিয়ানমারে ভারতের স্বার্থের জায়গাটা অনেক গভীরে।’

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের বিষয়ে বাংলাদেশ একা হয়ে পড়েছে কি-না জানতে চাইলে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের এই অধ্যাপক বলেন, ‘ভারত-চীন ও মিয়ানমারের ভেতরে যদি মোরাল (নৈতিক) জায়গা তৈরি না হয় ততদিন পযন্ত বাংলাদেশ বা অন্য দেশগুলোর চাপ সেভাবে কার্যকর উপলব্দি হবে না। এ সমস্যা সমাধানে আমাদের কূটনৈতিক প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে।’

অন্যদিকে মিয়ানমারের ওপর প্রভাব খাটানো চীন গত বছরের শেষের দিকে প্রত্যাবাসন নিয়ে বেশ তৎপরতা দেখালেও কার্যত তার কোনো ফল আসেনি। এরইমধ্যে চলতি বছরের শুরুর দিকে প্রত্যাবাসনের লক্ষ্যে সরকারের পক্ষ থেকে চীনের সঙ্গে আরও জোরালো কূটনৈতিক তৎপরতার বাড়ানোর সংবাদ পাওয়া যায়। কিন্তু সেই প্রচেষ্টায় হানা দেয় চীনের উহানে শুরু হওয়া নতুন মহামারি করোনাভাইরাস। সম্প্রতি রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু না হওয়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে চীন। ঢাকায় নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত লি জিমিং প্রত্যাবাসন নিয়ে চীনের এই উদ্বেগের কথা জানান।

সাবেক পররাষ্ট্র সচিব তৌহিদ হোসেন বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের সঙ্গে যে অন্যায়টা করা হচ্ছে ভারত সেটার ব্যাপারে সাপোর্ট দিক, ফলাফলটা না হয় আমরা পরে দেখব। ভারত চাপ দিলেই যে রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে তাও কিন্তু না। কিন্তু আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ভারতের একটা প্রভাব তো রয়েছে। এ পর্যন্ত দেখা গেছে ভারত সরাসরি বা পরোক্ষভাবে অনেকটাই মিয়ানমারকেই সাপোর্ট করে গেছে। আমরা চাই সেই অবস্থানটার উন্নতি হোক।’

সাবেক এই পররাষ্ট্র সচিব বলেন, ‘দুঃখজনকভাবে চীনও একই কাজ করছে। তাদের নিজেদের স্বার্থেই তারা হয়তো এটা করেছে। আমরা চাই যে ভারত একটা জোরালো অবস্থান নিক। তারা মিয়ানমারকে বলুক তোমাদের লোকগুলো তোমরা নিয়ে যাও তবেই তাদের অবস্থান পরিস্কার হবে।’

(ঢাকাটাইমস/১৪অক্টোবর/ডিএম)

google news ঢাকা টাইমস অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি ফলো করুন

মন্তব্য করুন

শীর্ষ খবর সর্বশেষ জনপ্রিয়
সব খবর
টয়োটার ব্যবসা হারাচ্ছে নাভানা?
সারজিস বনাম নওশাদ: ভোটে কার পাল্লা ভারি?
মনোহরদীতে চাঁদাবাজি করতে গিয়ে ছাত্রদল নেতা গণধোলাইয়ের শিকার
গণভবন জয় করেছি, এবার জাতীয় সংসদও জয় করব: নাহিদ
বিশেষ প্রতিবেদন তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা