শিক্ষকদের সকল প্রকার বাহ্যিক শক্তির নগ্ন আক্রমণ থেকে রক্ষা করুন
শিক্ষাকে যদি জাতির মেরুদণ্ড হিসেবে মেনে নিই তাহলে এটাও মেনে নিতে হবে যে, জাতির সেই মেরুদণ্ডের নির্মাতা হচ্ছেন শিক্ষক। একটি ঘটনার বর্ণনা দিয়ে নিবন্ধটি শুরু করতে চাই-
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে আবাসিক ছাত্র হিসেবে ঠিকানা ছিল কবি জসীমউদদীন হল। মাঝেমধ্যেই কাকরাইল মসজিদ থেকে তাবলিগ জামাতের বিভিন্ন দল আসতো হলগুলোতে। তাদের উদ্দেশ্য ছিল আমরা যেন দ্বীন থেকে বিচ্যুত না হই সে বিষয়ে দাওয়াত দেওয়া। বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে বেশিরভাগ সময়ে ইংল্যান্ড, মালয়েশিয়া, পাকিস্তান, অস্ট্রেলিয়া, ইন্দোনেশিয়া, চীনসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে আগত মেহমানদের সমন্বয়ে গঠিত তাবলিগের দলগুলোকে পাঠানো হতো। আর হলগুলোতে পাঠানো এই দলগুলো সমাজের উঁচু স্তরের, এককথায় এলিট শ্রেণির মানুষদের (চিকিৎসক, শিক্ষক, প্রকৌশলী, সাবেক সেনা কর্মকর্তা, আমলা ইত্যাদি) নিয়ে প্রায়ই গঠিত হতো। একবার হলে এমন একটি দল পাঠানো হলো যাতে কাজাকিস্তানের একজন সাবেক সরকারি আমলা ছিলেন। তিনদিন অবস্থানকালে বিভিন্ন সময়ে ঐ সাবেক আমলার সরব উপস্থিতি দেখেছি কিন্তু তিনি একেবারে চুপসে যেতেন যখন আমাদের হলের হাউজ টিউটর মসজিদে প্রবেশ করতেন। এতটাই চুপসে যেতেন আর সমীহ করতেন যে, সেটা সকলের দৃষ্টিগোচর হতো। সে কারণে আমাদের মধ্য থেকে এ বিষয়ে তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলো। উত্তরে তিনি যা জানালেন তা আমাদের বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বিস্ময়কর, অকল্পনীয় এবং চমকপ্রদ। তিনি জানালেন তাদের সমাজে সকল স্তরের শিক্ষককে সবচেয়ে বেশি সম্মান ও মর্যাদা দেওয়া হয়। এটি শুধু গালভরা বুলি নয়, চর্চিত বাস্তবতা। তো কেমন সেই মর্যাদার নমুনা? তিনি জানালেন- মনে করুন রাস্তায় ট্রাফিক জ্যাম বা কোনো কারণে পুলিশ গাড়িতে তল্লাশি করছে। এমতাবস্থায় একজন শিক্ষকের গাড়ি উপস্থিত। তখন শিক্ষকের গাড়িতে তল্লাশির প্রশ্ন তো অবান্তর, ভয়াবহ জ্যাম থেকে সবার আগে শিক্ষকের গাড়িটিকে মুক্ত করে তাঁকে তাঁর গন্তব্যের পথটি সহজ করে দেওয়া হয়। এটি শুধু পুলিশ করেন তা নয়, অন্য সকলেও এই কাজে পুলিশকে সহযোগিতা করেন স্বতঃস্ফূর্তভাবেই। কেন এই আয়োজন শিক্ষকের জন্য? উত্তরে তিনি বললেন- শিক্ষকমণ্ডলী হচ্ছেন আমাদের মাথার তাজ। আর যেকোনো কারণে ঐ শিক্ষক যদি রাস্তায় এক মিনিট আটকে থাকেন তাহলে গবেষণা, জ্ঞানচর্চা, জাতীয় অগ্রগতিতে পুরো জাতি এক মিনিট পিছিয়ে পড়বে। দেশটির প্রাথমিক শিক্ষা থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা পর্যন্ত ট্রাফিক সিগনাল থেকে রাষ্ট্রীয় যেকোনো সেবা বা রাষ্ট্রীয় মর্যাদার ক্ষেত্রে শিক্ষকদের আসন এভাবেই নিশ্চিত করা হয় বলে তিনি জানালেন। মূলত একটি দেশের সত্যিকারের টেকসই উন্নয়নের জন্য শিক্ষা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, শিক্ষকের যথার্থ মর্যাদা নিশ্চিত করাটা শুধু প্রয়োজন নয়, অপরিহার্য। সেই অপরিহার্য বিষয়টিকে আমাদের দেশে কীভাবে চর্চা করা হয় তা কারো অজানা নয়, তবুও আলোচনাটিকে এগিয়ে নেওয়ার স্বার্থে দুই-একটি সাধারণ চিত্র তুলে ধরতে প্রয়াস পাচ্ছি।
সাম্প্রতিক সময়ে দেশের অন্যতম ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ভিকারুননিসা নূন স্কুল এন্ড কলেজের অধ্যক্ষ মহোদয়কে নিয়ে কয়েকটি ঘটনা যেন বাংলাদেশের প্রত্যেকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের এবং তার শিক্ষকদের অসহায়ত্বকে আর একবার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। বিদ্যালয়টিকে ঘিরে বিভিন্ন ব্যবসায়ী শ্রেণির মানুষের আর্থিক লালসার কথা বিভিন্ন গণমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। এখানে দেখা গেছে, অধ্যক্ষ মহোদয়কে সেই ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে কতটা চাপে রাখার আয়োজন করা হয়েছে। আজ ভিকারুননিসার ঘটনাটি যেকোনোভাবে সামনে এসেছে বলেই আমরা জানতে পারছি। আর অধ্যক্ষ মহোদয়ের নৈতিক শক্তি এবং ব্যক্তিত্বের প্রভাবের বদৌলতে তিনি অন্যায়ের কাছে নিজেকে বিকিয়ে দেওয়ার হাত থেকে রেহাই পেয়েছেন। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রে শিক্ষকদের এ সমস্ত অশুভ শক্তির কাছে হার মানতে বাধ্য করা হয়। খোঁজ নিয়ে দেখা যাবে দেশের প্রায় সকল বিদ্যালয় ও মহাবিদ্যালয়ের প্রধান থেকে শুরু করে সাধারণ শিক্ষক পর্যন্ত ক্ষেত্রবিশেষে মোড়ের বাদাম বিক্রেতা, পান বিক্রেতা এমনকি ক্যান্টিনবয়দের কাছে জিম্মি। দেশের শিক্ষকমণ্ডলীকে আজ আমরা এমন পরিস্থিতিতে আবদ্ধ করেছি যেখানে পরিচ্ছন্ন কর্মী থেকে শুরু করে সরকারের কর্তাব্যক্তি পর্যন্ত সকলেই শাসন করার অধিকার রাখে। শাসনে কাজ না হলে ইচ্ছামতো পিটুনি পর্যন্ত দিতে পারে। পিরোজপুর জেলার ভান্ডারিয়া কলেজের মোন্তাজ স্যারকে একজন ক্ষুদে আমলা বাধ্য করেছিলেন তার পায়ে ধরতে আর সেটি নিজ দায়িত্বে সেই পেটি সরকারি কর্মচারী ভিডিও করে ভাইরাল করেছিলেন নিজের বড়ত্ব প্রকাশ করতে। সমাজের প্রতিটি শ্রেণি-পেশার মানুষের শিক্ষকদের পদদলিত করে নিজেদের শ্রেষ্ঠ প্রমাণ করার প্রতিযোগিতা উপভোগ করতে আমরা যখন ব্যস্ত তারই মধ্যে পুরো জাতির অধঃপতন যে নিশ্চিত হয়ে গেছে তা আমরা উপলব্ধি করার সুযোগ পাইনি।
ফাঁসকৃত টেলিসংলাপগুলোতে শুনেছি জনৈক নির্বাচিত অভিভাবক প্রতিনিধি অধ্যক্ষ মহোদয়কে শিক্ষা দিচ্ছেন কীভাবে দুর্নীতি করতে হবে, কীভাবে ভর্তি-বাণিজ্য করতে হবে, দেশের সিস্টেম কেমন, আরো কত কী! এই প্রেক্ষিতে যদি দেশের সমস্ত প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে শুরু করে মাধ্যমিক বিদ্যালয় এবং মহাবিদ্যালয়গুলোর দিকে দৃষ্টিপাত করি তাহলে আমরা দেখতে পাবো অন্যায়, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতির দীক্ষা দিতে দিনমজুর পরিষদ, ছাত্র পরিষদ, ওলামা পরিষদ, টোকাই পরিষদ, পরিচ্ছন্নকর্মী পরিষদ (কল্পিত নাম)সহ বিভিন্ন সংগঠনের নেতৃবৃন্দ প্রতিষ্ঠানপ্রধানের চেম্বারে নিয়মিত তালিম দিতে আসেন। অবশ্য এই তালিমের জন্য উপযুক্ত সম্মানীও তারা আদায় করে থাকেন! শুধু এই সমস্ত সংগঠনের কথা বলি কেন, বিভিন্ন বৈধ সংস্থা থেকেও তাদের ভাগের অংশ বুঝে নেওয়ার জন্য নিয়মিত তাগিদ দিতে দেখা যায়। আর এই তালিমের পরেও যদি কেউ ভালোভাবে শিখতে না পারেন তাহলে তাদের ভাগ্যে জোটে চ্যাংদোলা হয়ে নর্দমার পানিতে পতিত হওয়া, রাস্তাঘাটে হেনস্তা হওয়া, ছুরিকাহত হওয়া, ময়লা পানিতে সিক্ত হওয়াসহ প্রাণের ঝুঁকিতে দিনাতিপাত করা। আর দিনশেষে আমরা বুক চাপড়াই শিক্ষকদের মধ্যে লিডারশিপের ঘাটতি কেন দেখা দিচ্ছে সেই চিন্তায়। আসলে সমাজের সকলেই যখন শিক্ষকদের শিক্ষকে পরিণত হয় (দুর্নীতি শেখানোর জন্য) আর আমরা সেই পথ রুদ্ধ করার কোনো কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে ব্যর্থ হই তখন শিক্ষকদের মধ্যে লিডারশিপ আশা করাটাই একধরনের স্ববিরোধী চিন্তার বহিঃপ্রকাশ।
একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিচালনা পর্ষদে আমরা দেখি নেতৃত্ব দেন সেই লোকগুলো যারা সমাজে কালো টাকা, পেশিশক্তি, রাজনৈতিক প্রভাবে প্রভাবশালী (মূলত শিক্ষা আর ইতিবাচক গুণাবলি ছাড়া সমস্ত প্রকার নেতিবাচক বৈশিষ্ট্যে তারা বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত। আসলে শিক্ষা বা সততার ঘাটতি না থাকলে তাদের এই সমস্ত মধ্যস্বত্বভোগী পদগুলো অধিকার করে থাকার প্রয়োজন হতো না।) আজ সরকারের উচ্চ পর্যায়ে ভেবে দেখার সময় এসেছে যে, এই সমস্ত পরিচালনা পর্ষদ, অভিভাবক পর্ষদ বা অন্যান্য পর্ষদ একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জন্য চাপ সৃষ্টিকারী গোষ্ঠী হিসেবে টিকিয়ে রাখা কতটা যৌক্তিক বা কোন প্রক্রিয়ায় সেগুলো ভালোভাবে কাজ করতে পারে। শিক্ষা বিষয়ে বিভিন্ন মডেল রাষ্ট্রকে আমরা এক্ষেত্রে দৃষ্টান্ত হিসেবে সামনে রাখতে পারি।
একজন শিক্ষকের কাছ থেকে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে একাডেমিক শিক্ষা, নৈতিক শিক্ষা, লিডারশিপের শিক্ষা গ্রহণ করার স্বার্থে শিক্ষককে আর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে সমস্ত প্রকার বাহ্যিক নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত রাখা প্রয়োজন। সাথে সাথে শিক্ষকের মর্যাদা সমুন্নত রাখা একান্ত অপরিহার্য। এক্ষেত্রে দেশের প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষক পর্যন্ত সকলকে বিবেচনায় রাখতে হবে। যে দেশের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকের মান দেশের তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারীদের সমান, যে দেশের মাধ্যমিক এবং কলেজ পর্যায়ের অধিকাংশ শিক্ষকের মাসিক বেতন-ভাতার নিশ্চয়তা নেই তাদের কাছ থেকে জাতির মেরুদণ্ড নির্মাণে কতটা যথার্থ সেবা আমরা পেতে পারি তা গভীরভাবে ভেবে দেখা সময়েরই দাবি। শিক্ষককে যদি বেশিরভাগ সময় তার আত্মমর্যাদা রক্ষার কৌশল, বাহ্যিক নানাবিধ চাপ থেকে মুক্তির কৌশল, কূটকৌশলীদের (দুর্নীতিবাজ, লুটেরা, অবৈধ ক্ষমতালিপ্সু এবং দুর্জন ব্যক্তিবর্গ) কাছ থেকে পালাবার কৌশল রপ্ত করতে সর্বদা ব্যস্ত থাকতে হয় তবে তিনি শিক্ষা আর গবেষণা নিয়ে কখন ও কীভাবে কার্যকরী উদ্যোগ নিবেন এই প্রশ্নের উত্তর সত্যিই আমাদের জানা নেই। শিক্ষা, শিক্ষার মান এবং শিক্ষাকে ভিত্তি ধরে টেকসই উন্নয়ন কীভাবে নিশ্চিত করা যায় সে বিষয়ে সরকারি তত্ত্বাবধানে মানসম্পন্ন গবেষণা এবং সেই গবেষণার ফলাফল বিবেচনা ও সুপারিশ বাস্তবায়নের জন্য সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে নীতিগত সিদ্ধান্ত গ্রহণের সময় ইতিমধ্যে পেরিয়ে গেছে। এ বিষয়ে আমরা আরো যত বেশি বিলম্ব করবো জাতির আগামী দিনগুলো তত বেশি অন্ধকারের অতলে হারিয়ে যেতে থাকবে।
লেখক: বিসিএস (সাধারণ শিক্ষা) ক্যাডারের সদস্য ও
পিএইচডি গবেষক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়