আলু রপ্তানিতে পথের কাঁটা ব্যাকটেরিয়া

দেশে উৎপাদিত আলু বিদেশে রপ্তানির ক্ষেত্রে পথের কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে এক ধরনের ব্যাকটেরিয়া। রাইজকটোনিয়া সোলানেসিয়ারাম (Ralstonia Solanacearum) নামক ব্যাকটেরিয়াটি কিভাবে ধংস্ব করা যায় তা নিয়ে কাজ করছে সরকার।

জানা গেছে, গত অর্থবছরে বিদেশে আলু রপ্তানি হয়েছে ৭৮ হাজার মেট্রিক টন। তবে কাঙ্খিত পরিমাণে রপ্তানি না হওয়ায় বৈদেশিক মুদ্রা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে সরকার। নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান আব্দুল কাইউম সরকার জানিয়েছেন, আলুতে ক্ষতিকর জীবাণু থাকায় তা রপ্তানি করা যাচ্ছে। আলু চাষের ক্ষেত্রে মাটিতে কিছু সমস্যা আছে। এ জন্য উন্নত জাতের আলুর বীজ দেশে আনার চেষ্টা চলছে। আমাদের দেশের মানুষ আলু কাঁচা খাচ্ছে না। রান্না করে খাওয়ার পর কোনো ধরনের জীবাণু থাকছে না। তবে রপ্তানির সময় তারা পরীক্ষা করে দেখেছে, আলুতে ক্ষতিকর জীবাণু রয়েছে। এ কারণে কাঙ্খিত পরিমাণে আলু রপ্তানি করা সম্ভব হয়নি।

বিষয়টি নিয়ে ঢাকা টাইমস কথা বলে টোবার ক্রপশ ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্টের পরিচালক কৃষিবিদ মোখলেছুর রহমানের সাথে। তিনি জানান, আলুর বেশ কয়েকটি রোগ আছে। বিভিন্ন কারণে এই রোগগুলো হয়ে থাকে। কোনো কোনো জায়গায় মাটির সমস্যা আছে। এছাড়া ভালো ফলনের প্রধান শর্ত সুস্থ সবল বীজ। আমরা এসব বিষয়ে কৃষকদের সচেতন করার চেষ্টা করছি।

নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান আব্দুল কাইউম সরকার জানিয়েছেন, রাইজকটোনিয়া সোলানেসিয়ারাম (জধষংঃড়হরধ ঝড়ষধহধপবধৎঁস) জাতীয় এক ধরণের ব্যাকটেরিয়ার কারণে রাশিয়ায় আলু রপ্তানি করা যাচ্ছে না। এটি আলুর ভিতরে গোলাকার হয়ে পুজের মতো একটা ক্ষত সৃষ্টি করে।

তবে আলু রপ্তানির ক্ষেত্রে শুধু ব্যাকটেরিয়া ছাড়াও আরও কিছু সমস্যার কথা জানিয়েছেন কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উদ্ভিদ সংগনিরোধ উইংয়ের উপ পরিচালক(রপ্তানি) ড. মো. রেজাউল করিম। তিনি বলেন, গত অর্থবছরে আমরা ৭৮ হাজার মেট্রিকটনের মত আলু রপ্তানি করতে পেরেছি। রাইজকটোনিয়া সোলানেসিয়ারাম ব্যাকটেরিয়ার কারণে রাশিয়া আমাদের কাছ থেকে আলু আমদানি করছে না। যদিও ব্যাকটেরিয়াটি মানুষের জন্য ক্ষতিকর নয়। কিন্তু রাশিয়া সর্তকর্তামূলকভাবে ব্যাকটেরিয়াটি যেন তাদের দেশে না ছড়ায় সেজন্য আলু নিচ্ছে না।

তিনি আরও জানান, সম্প্রতি রাশিয়ার সাথে আমাদের বৈঠক হয়েছে। বৈঠকে আমরা রাশিয়াকে এই ব্যাকটেরিয়ায় আক্রান্ত আলু দিব না বলে জানিয়েছি। আমরা পরীক্ষা নিরীক্ষা করে পাঠাবো বলে জানিয়েছি। এরপরে তারা আলু নিতে রাজি হয়েছে। ইতিমধ্যে আমরা ২৫ কেজি আলু রাশিয়ায় পাঠিয়েছি নমুনাস্বরুপ। তারা এটা পরীক্ষা নিরীক্ষা করে দেখতে দেখবে।

এছাড়া রপ্তানির ক্ষেত্রে আরও একটি বাধার কথা জানিয়েছেন এই উপপরিচালক। তিনি বলেন, বিশ্বের বেশীরভাগ দেশ চায় শুষ্ক আলু। কিন্তু আমাদের দেশের মাটির কারণে বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই আলুতে অধিক পরিমাণে পানি পাওয়া যায়। এটাও একটা সমস্যা। এক্ষেত্রে কৃষকরা জমিতে বেশী পরিমানে সার এবং পানি ব্যবহার করে অথবা সঠিক নিয়ম মেনে চাষাবাদ হয়না। এসব সমস্যা সমাধানে কৃষকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছেন রেজাউল করিম।

‘তবে আলুর উৎপাদন বাড়ানো, সঠিকভাবে চাষ করা এবং রপ্তানি করার জন্য একটি রোডম্যাপ তৈরী করা হয়েছে’-যোগ করেন এই উপপরিচালক। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর থেকে জানা গেছে রাইজকটোনিয়া সোলানেসিয়ারাম নামক ব্যাকটেরিয়াটি আলুর মধ্যে যে রোগের সৃষ্টি করে সেটির কারণে রাশিয়া বাংলাদেশ থেকে আলু নিচ্ছে না।

এ ব্যাকটেরিয়াটি আক্রমণের লক্ষণ হল: গাছ সাধারণত সবুজ অবস্থায়ই ঢলে পড়ে। গাছের একটি শাখা বা এক অংশও ঢলে পড়তে পারে। তবে কান্ডের নিম্নাংশ ও শিকড় অক্ষত থাকে। এছাড়া ব্যাকটেরিয়া আক্রমণ করলে কান্ডের ভিতরে পরিবহন কলায় বাদামী বর্ণের উপস্থিতি ধরা পরে। একটি পদ্ধতিতে সনাক্ত করা যায় সেটি হল, আক্রান্ত গাছের কান্ড কেটে পরিষ্কার পানিতে খাড়া করে রাখলে কিছুক্ষণ পর দুধের মতো সাদা পুজ বের হয়। ব্যাকটেরিয়াটি আক্রমণ করা আলুর চোখে সাদা পুঁজের মতো দেখা যায় এবং আলু অল্প দিনের মধ্যেই পচে যায়।

টোবার ক্রপশ ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্টের পরিচালক কৃষিবিদ মোখলেছুর রহমান এর প্রতিকার করার বিষয়ে বলেন, এই রোগ দমন করা বেশ কষ্টসাধ্য, কেননা এই জীবাণু মাটিতে দীর্ঘদিন বেঁচে থাকতে পারে এবং যার অনেক বিকল্প পোষক আছে। তবে কিছু ব্যবস্থাদি অবলম্বন করলে ব্যাকটেরিয়া জনিত ঢলে পড়া রোগ অনেকাংশে কমানো যায়। প্রথম বিষয়টি হল প্রত্যায়িত অথবা রোগমুক্ত এলাকা থেকে সুস্থ ও রোগমুক্ত বীজ সংগ্রহ করতে হবে। পাশাপাশি বীজ আলু চাষের ক্ষেত্রে কাটা বীজ লাগানো পরিহার করতে হবে। আলু লাগানোর সময় জমিতে সর্বশেষ চাষের পূর্বে প্রতি হেক্টরে ১৫ কেজি হারে স্টেবল বিচিং পাউডার প্রয়োগ করতে হবে।

তিনি আরও বলেন, সোলারাইজেশন পদ্ধতিতে মাটি শোধন করা যায়। বীজতলার মাটি কাদাময় করে তার ওপর স্বচ্ছ ১০ মিমি পলিথিন দিয়ে ৪ সপ্তাহ ঢেকে রাখতে হবে। এতে মাটির তাপমাত্রা বেড়ে গিয়ে ৫০ ডিগ্রী সে. পর্যন্ত পৌছায়। ফলে মাটিসহ রোগজীবাণু, কৃমি, ছত্রাক সহজেই মারা যায়। তবে পলিথিনে যেন কোনো ফুটো না থাকে,নতুবা মাটি পুরোপুরি জীবাণুমুক্ত হবেনা। বছরে দুবার এটি করা যায়। একবার সেপ্টেম্বর-অক্টোবর এবং আরেকবার এপ্রিল-মে মাসে। তবে, এপ্রিল-মে মাসে অধিক কার্যকরী। এছাড়া মাটির ওপর খড় কাঠের গুড়া ৩-৪ ইঞ্চি পুরু করে ছিটিয়ে তারপর পুড়িয়ে মাটি শোধন করা যায়।

মোখলেছুর রহমান জানান, আলু বপনের পর যত শীঘ্র সম্ভব গাছের গোড়ায় মাটি তুলে দিতে হবে। পরিমিত মাত্রায় সেচ প্রয়োগ করতে হবে। ব্যাকটেরিয়াটি প্রতিকারে ১ বিঘা জমির জন্য ৫০ গ্রামের ৪ প্যাকেট ডিকোপ্রাইমা নামক মাইক্রোবিয়াল ছত্রাকনাশক দুই লিটার পানিতে ২৪ ঘন্টা ভিজিয়ে রাখতে হবে। পরে ১০০-১২০ লিটার পানির সাথে মিশিয়ে রোগাক্রান্ত গাছের পাতায়, কান্ডে, গোঁড়ায় ভালো করে স্প্রে করে ভিজিয়ে দিতে হবে এবং গাছের গোড়ায় গোড়ায় ঢেলে দিতে হবে, এইভাবে ৪ দিন পর পর ডিকোপ্রাইমা ব্যবহার করলে ভালো ফল পাওয়া যায়। তাছাড়া চারা রোপণের পূর্বে ১ বিঘা জমির জন্য ৫০ গ্রামের ২ প্যাকেট ডিকোপ্রাইমা নামক মাইক্রোবিয়াল ছত্রাকনাশক এক লিটার পানিতে ২৪ ঘন্টা ভিজিয়ে রাখতে হবে (যে পাত্রে ২৪ ঘন্টা ডিকোপ্রাইমা ভিজানো হবে সেই পাত্রের মুখ উন্মুক্ত রাখতে হবে যাতে বাতাস/ অক্সিজেন আসা যাওয়া করতে পারে, বোতলে ভিজিয়ে মুখ বন্ধ রাখলে অক্সিজেনের অভাবে ডিকোপ্রাইমার গুণাগুণ নষ্ট হয়ে যাবে)। ডিকোপ্রাইমা ভিজানো ১ লিটার পানির সাথে আরো ৫০-৬০ লিটার পানি মিশিয়ে জমিতে স্প্রে করে ৩-৪ দিন পর চারা রোপন করতে হবে। এইভাবে ২০ দিন পর পর আরো দুই বার স্প্রে করে মাটি শোধন করতে হবে।

আরও কিছু ব্যবস্থা নিতে হবে সেগুলো হল, আক্রান্ত গাছ আলুসহ আশেপাশের মাটি দ্রুত অন্যত্র সরিয়ে নষ্ট করে ফেলতে হবে। আক্রান্ত জায়গায় বিচিং পাউডার প্রয়োগ করতে হবে। সেচের প্রয়োজন হলে আক্রান্ত অংশ বাদ দিয়ে সেচ দিতে হবে। আশে পাশের গাছ ও এভাবে বাছাই করতে হবে।

‘বীজ আলুর ক্ষেত্রে একরপ্রতি যদি ১টি গাছ আক্রান্ত হয় তাহলে সেই মাঠ হতে বীজ আলু কখনই সংগ্রহ করা যাবে না।’-বলেন এই কৃষিবিদ।

(ঢাকাটাইমস/১৪সেপ্টেম্বর/এমএস/আরকেএইচ)