প্রেমের বিয়েতে ক্ষুব্ধ বাবা মেয়েকে হত্যা করেন: পিবিআই

টাঙ্গাইলের কালিহাতির কিশোরী পারুল আক্তার ভালোবেসে বিয়ে করেছিলেন প্রতিবেশী এক তরুণকে। এটি মেনে নিতে পারেননি তার বাবা। বিয়ের তিন বছর পর কৌশলে মেয়েকে নিজের কাছে নিয়ে যান তিনি। পরে জয়পুরহাটের পাঁচবিবিতে নিয়ে হাত-পা বেঁধে শ্বাসরোধ করে হত্যা করেন মেয়েকে।

২০১৫ সালের এ ঘটনায় জড়িত পারুল আক্তারের বাবা আবদুল কুদ্দুছ খাঁ ও তার সহযোগী মোকাদ্দেছ ওরফে মোকা মন্ডলকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। গ্রেপ্তার দুজন আদালতে এ বিষয়ে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিও দিয়েছেন।

রবিবার দুপুরে রাজধানীর ধানমন্ডিতে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) সদর দপ্তরে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান পিবিআই প্রধান অতিরিক্ত আইজিপি বনজ কুমার মজুমদার।

সংবাদ সম্মেলনে বনজ কুমার মজুমদার বলেন, আব্দুল কুদ্দুছ খার তিন মেয়ের মধ্যে পারুল আক্তার ছিল মেধাবী। তাই বাবা আব্দুল কুদ্দুছ খার স্বপ্ন ছিল মেয়েকে উচ্চশিক্ষিত করে ভালো জায়গায় বিয়ে দেবেন। কিন্তু পারুল দশম শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় একই এলাকার মো. নাছির উদ্দিন ওরফে বাবুর সঙ্গে প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন। বিয়ে দেওয়ার জন্য দুই পরিবারকে জানানো হলেও পারুলের বাবা রাজি হননি।

একপর্যায় নাসির উদ্দিন ও পারুল পালিয়ে বিয়ে করেন। এতে আব্দুল কুদ্দুছ খার সম্মানহানি হলে ক্ষুব্ধ হন মেয়ে ও তার জামাতার প্রতি। ক্ষোভ থেকে নিজের মেয়েকেই হত্যা করেন বাবা। ঘটনার সাত বছরেও থানা পুলিশ, ডিবি, সিআইডি, পিবিআই (টাঙ্গাইল) তদন্ত করে কোনো রহস্য উদঘাটন করতে না পারলেও অবশেষে খুনের ঘটনা উন্মোচন করে ঢাকা জেলা পিবিআই।

সংবাদ সম্মেলনে পিবিআই প্রধান বলেন, ঘটনার শুরু ২০১২ সালে। ওই বছর টাঙ্গাইলের কালিহাতির গড়িয়া গ্রামের আব্দুল কুদ্দুছ খার মেয়ে পারুল আক্তার পার্শ্ববর্তী এলাকার মো. নাছির উদ্দিন ওরফে বাবুকে ভালোবেসে ঢাকায় পালিয়ে বিয়ে করেন। এই ঘটনায় কুদ্দুছ খা ২০১২ সালে কালিহাতি থানায় জিডি করেছিলেন। উভয়ের পরিবার বিয়ে মেনে না নেওয়ায় তারা ঢাকার আশুলিয়ার জামগড়ায় বসবাস শুরু করেন।

নাসির উদ্দিন চাকরি নেন পোশাক কারখানায়। নানা কারণে তাদের পারিবারিক অশান্তি চলতে থাকে। পারুল তার বাবাকে ফোন করে অশান্তির কথা জানায়। বাবা মেয়ের ভবিষ্যত নিয়ে বেশ চিন্তিত ছিলেন। অপমান বোধ ও প্রচন্ড রাগও ছিল। একপর্যায় ভালো ছেলে দেখে অন্য জায়গায় বিয়ে দিয়ে উন্নত জীবন যাপনের লোভ দেখান বাবা।

বনজ কুমার মজুমদার বলেন, ২০১৫ সালের ১৮ জুলাই পারুলের স্বামী নাসির তার নানিকে দেখতে যান। সেই সুযোগে বাবার দেওয়া আশ্বাসে পারুল পরদিন তার বাবাকে ফোন করে টাঙ্গাইলে চলে যায়। একই দিন পারুল আক্তারের স্বামী মো. নাছির উদ্দিন আব্দুল কুদ্দুছ খার বিরুদ্ধে মেয়েকে বাবার বাড়ি পালিয়ে যেতে প্ররোচনা দেওয়ার অভিযোগে আশুলিয়া থানায় জিডি করেন।

কিন্তু ওই দিন বাবা তার মেয়েকে নিজ বাড়িতে না নিয়ে বন্ধু মোকাদ্দেছ ওরফে মোকা মন্ডলের বাড়ি ভূঞাপুরে নিয়ে যান। সেখান থেকে মোকাদ্দেছ ওরফে মোকা মণ্ডল ভবিষ্যতে পারুলকে প্রতিষ্ঠিত করবে এবং কিছুদিন নাসির উদ্দিনের কাছ থেকে লুকিয়ে থাকতে হবে এই আশ্বাস দিয়ে জয়পুরহাটের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেন।

কুদ্দুছ খা এর আগে দীর্ঘ ১২ বছর জয়পুরহাটের পাঁচবিবি এলাকায় থাকায় ওই এলাকার সবকিছু চিনতেন। পরে মেয়েকে নিয়ে তুলসী গঙ্গা নদীর পাশে নির্জন জায়গায় নিয়ে যান।

হত্যার ঘটনার বিষয়ে পিবিআই প্রধান বলেন, তারা তিনজন রাতের অন্ধকারে নদীর পাড় দিয়ে হাঁটতে থাকেন। মেয়ের আগের কার্যকলাপের অপমান সইতে না পেরে রাগে বাবা মেয়েকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেন। তারপর মেয়ের ওড়না দুই টুকরো করে বাবা মেয়ের হাত এবং মোকাদ্দেছ ওরফে মোকা মন্ডল পা বাঁধে। বাবার নিজের গামছা দিয়ে মেয়ের গলায় পেঁচিয়ে শ্বাসরোধ করে হত্যা করে। পারুলের মরদেহ নদীতে ফেলে দিয়ে তারা টাঙ্গাইলে চলে যান।

ঘটনার তদন্তের বিষয়ে তিনি বলেন, ২০১৫ সালের ৪ আগস্ট মো. নাছির উদ্দিনের পরিবারের বিরুদ্ধে টাঙ্গাইলের আদালতে পেনাল কোডে মামলা করেন পারুলের বাবা কুদ্দুস খা। কালিহাতি থানা পুলিশ তদন্ত করে প্রেম করে বিয়ে করার সংশ্লিষ্টতা পায়। কিন্তু অভিযুক্তকে না পওয়ায় ঘটনাস্থল তাদের এখতিয়ার বহির্ভূত এলাকা (ঢাকায়) মর্মে প্রতিবেদন দাখিল করে।

ডিবি পুলিশ, পিবিআই (টাঙ্গাইল), সিআইডি (টাঙ্গাইল) তদন্ত করে একই প্রতিবেদন দাখিল করে। পরে আদালত জুডিশিয়াল তদন্ত করে প্রতিবেদন দেয়, বাদী ঢাকার আদালতে মামলা করলে প্রতিকার পেতে পারে। ২০২২ সালের ২৭ নভেম্বর আব্দুল কুদ্দুছ খা বিজ্ঞ নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন আদালতে তদন্ত প্রতিবেদনসহ নারী নির্যাতন দমন আইন ২০০০ এ যৌতুকের জন্য মারপিট করে হত্যা মামলার আবেদন করেন।

বনজ কুমার মজুমদার বলেন, গত ৩০ নভেম্বর আদালত আশুলিয়া থানাকে মামলা রুজু এবং পিবিআই ঢাকা জেলাকে তদন্তের নির্দেশ দিলে আশুলিয়া থানায় ১১ ডিসেম্বর মামলা দায়ের করা হলে পিবিআই ঢাকা ভোলা তদন্ত শুরু করে। পিবিআই মো. নাসির উদ্দিনকে গ্রেপ্তার করে আদালতে পাঠায়। বাদী আ. কুদ্দুছ খাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলে অসামঞ্জস্য তথ্য দেন। পরে তার ব্যবহৃত মুঠোফোন নম্বরের সূত্র ধরেই এক পর্যায়ে তিনি নিজেই তার মেয়েকে হত্যার কথা স্বীকার করেন। তার দেওয়া তথ্য যাচাই করার জন্য পিবিআই ঢাকা জেলা জয়পুরহাটের পাঁচবিবি থানা থেকে ২০১৫ সালের তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে।

পাঁচবিবি থানায় করা মামলার আলামত, সুরতহালের বর্ণনা এবং পোস্টমর্টেম প্রতিবেদনের সঙ্গে কুদ্দুস খার বর্ণনার মিল পাওয়া যায়। এই ঘটনায় আসামি মোকাদ্দেছ ওরফে মোকা মন্ডলকেও গ্রেপ্তার করা হয়।

(ঢাকাটাইমস/২২ জানুয়ারি/এএ/এসএম)