শিক্ষায় হ-য-ব-র-ল

রেজাউল করিম
 | প্রকাশিত : ৩০ মার্চ ২০২৩, ২০:০৮

শিক্ষার মান উন্নয়নে কাজ করছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। নানা সময়ে নানাভাবে পদ্ধতি পরিবর্তন করেও কাটছে না সমালোচনা। ক্লাস পদ্ধতি, পাঠ্যপুস্তক পরিবর্তন, পাঠ্যপুস্তকে অসঙ্গতি ফলাফলে ত্রুটি এমন অভিযোগ লেগেই আছে। প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষা দিয়েই শুরু করা যাক। ২০০৮ সালে শেষবারের মতো পঞ্চম শ্রেণির বৃত্তি পরীক্ষা হয়েছিল। ২০০৯ সালে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা শুরু করে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। করোনার প্রভাবে বিনা নোটিশে উঠে যায় এ পরীক্ষাটি।

২০২২ সালে পূর্বের মতো নিজ বিদ্যালয়ে পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের বার্ষিক পরীক্ষা নেয়ার পর মোট শিক্ষার্থীর ২০ শতাংশ শিক্ষার্থীদের প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করানো হয়। গত ২৮ ফেব্রুয়ারি প্রাথমিক বৃত্তি ফলাফল প্রকাশ হয়। সেখানে বৃত্তি পায় ৮২ হাজার ৩৮৩ শিক্ষার্থী। কয়েক ঘণ্টা যেতে না যেতেই পরীক্ষার ফলাফল স্থগিত করা হয়। পরীক্ষায় অংশগ্রহণ না করেই ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পাওয়ার সংবাদ গণমাধ্যমে প্রকাশ হয়। ‘কারিগরি ত্রুটির’ কারণ দেখিয়ে স্থগিত করা হয় প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষার ফলাফল। এতে কোমলমতি শিশুরা মানসিকভাবে হোঁচট খায়। অভিভাবকরাও ভেঙে পড়েন। পরদিন রাত সাড়ে ১০টায় আবার ফল প্রকাশ করে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর। বৃত্তির সংশোধনী ফলাফলেও পরীক্ষায় অনুপস্থিত শিক্ষার্থীর নাম এসেছে ট্যালেন্টপুল বৃত্তিতে।

এদিকে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনীতে ছিল গ্রেডিং পদ্ধতি। বর্তমানে পঞ্চম শ্রেণির ফলাফল কোন পদ্ধতিতে হবে এর স্পষ্ট কোন নির্দেশনা নেই। একইভাবে ২০১০ সালে দেশে প্রথমবারের মতো সাধারণ স্কুল ও মাদ্রাসার ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষা ও জুনিয়র দাখিল সার্টিফিকেট পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। ফলাফলও গ্রেডিং পদ্ধতিতে। করোনার সময় থেকে প্রাথমিকের মতো বন্ধ হয় জেএসসি ও জেডিসি পরীক্ষা। করোনা কাটলেও শুরু হয়নি সেই জেএসসি-জেডিসি পরীক্ষা। আলাদা করে বৃত্তি পরীক্ষা নিতেও দেখা যায়নি। বরং অনেকটা নিশ্চিত হওয়া গেছে জেএসসি ও জেডিসি উঠে যাচ্ছে। তাহলে গত ১২ বছরের পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণির পরীক্ষা নেওয়া কি ভুল পদ্ধতি ছিল? এমন সমালোচনা করছেন সচেতন ব্যক্তিরা। শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে আরও গভীরভাবে ভাবতে হবে। শিক্ষা বা পরীক্ষা পদ্ধতি ঘনঘন পরিবর্তনে বিপাকে পড়তে হয় শিক্ষক-শিক্ষার্থীসহ অভিভাবকদের। দেশে ১৯৯১ সালে বুয়েটে প্রথমবারের মত গ্রেডিং পদ্ধতি চালু করা হলেও ২০০১ সালে এসএসসি এবং ২০০৩ সালে এইচএসসিতে চালু করা হয়। গ্রেডিং পদ্ধতিতে সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে মোট নম্বরকে মূল্যায়ন করা হয় না। ৮০ থেকে ১০০ যেখানে জিপিএ-৫ ধরা হয় সেখানে ৮০ নম্বর ও ১০০ নম্বর প্রাপ্তির মধ্যে মেধার কোন পার্থক্য দেখানো হয় না। ৮০ এবং ১০০ প্রাপ্ত উভয় শিক্ষার্থীকে একই মানে মূল্যায়ন করা হয়।

আসা যাক- ভর্তি পদ্ধতিতে। ভর্তিতে প্রথম হ-য-ব-র-ল। করোনায় সময় থেকে লটারিরভিত্তিতে সরকারি স্কুলগুলোতে ছাত্রছাত্রী ভর্তি করানো শুরু হয়। করোনার প্রভাব কাটলেও পরিবর্তন হয়নি ভর্তি পদ্ধতি। এতে অনেক মেধাবীদের জায়গা হচ্ছে না ভালো স্কুলগুলোতে। মেধাহীনরা মেধাবীদের আসনে বসে জায়গা দখল করছে। অন্যদিকে মেধাবীদের অনেকে সঠিক পরিচর্যার অভাবে ঝরে পরছে। লটারিতে একই শিক্ষার্থীর নাম একাধিকবার তালিকায় উঠার ঘটনা অহরহ দেখা যাচ্ছে। একই সাথে উচ্চ মাধ্যমিক (কলেজে) অনলাইনে ভর্তি হওয়াটা বিশেষ রকমে বিড়ম্বনা। পছন্দের কলেজ ভর্তি হওয়াটা ভাগ্যের ব্যাপার। এটা আরেক ধরনের লটারি। কলেজ শাখায় ভর্তির ক্ষেত্রে ভর্তি পরীক্ষা নেওয়া হলে মেধাবীরা পছন্দের কলেজে ভর্তি হতে পারতেন। লটারির যুগে কাঙ্ক্ষিত বিষয়ে অনার্স পড়াটাও ভাগ্যের ওপর ছেড়ে দিতে হচ্ছে।

১৯৯২ সালে দেশে এসএসসিতে প্রথম নৈর্ব্যক্তিক প্রশ্ন সংযোগ করা হয়। প্রথম পর্যায়ে ৫০০ নৈর্ব্যক্তিক প্রশ্ন নির্ধারণ করা হয়। পরের বছর ২০০০ নৈর্ব্যক্তিক অন্তর্ভুক্ত করে বিভিন্ন বই বের করে বেসরকারি প্রকাশনী। প্রশ্ন মিলেও যেত ২০০০ থেকে। এরপর থেকে সংখ্যার পরিমাণ অনির্দিষ্ট হয়ে যায়। সম্প্রতি আলোচনায় এসেছে নৈর্ব্যক্তিক প্রশ্ন উঠে যাচ্ছে। চলতি শিক্ষাবর্ষে কোন কোন শ্রেণিতে দেখাও যাচ্ছে নৈর্ব্যক্তিকের পরিবর্তে বিকল্প উত্তর ছাড়া ছোট প্রশ্ন সংযুক্ত করা হচ্ছে। এদিকে আলোচনায় এসেছে এবছর থেকে প্রাথমিকে পরীক্ষা থাকছে না। এদিকে পরীক্ষার ওপর নির্ভরতা কমিয়ে শ্রেণিভিত্তিক মূল্যায়নের ওপর জোর দিতে চলতি বছর থেকে মাধ্যমিক পর্যায়েরও ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের নতুন শিক্ষাক্রম চালু করা হয়েছে। এই শিক্ষাক্রমে ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে পরীক্ষা নেওয়া যাবে না বলে জানিয়েছে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর মাউশি।

সৃজনশীল প্রশ্ন পদ্ধতি শিক্ষায় আরেকটি জটিলতা সৃষ্টি করেছে। ২০০৭ সালের জুনে এ পদ্ধতি বাস্তবায়নে সরকারি আদেশ জারি হয়। ২০০৮ সাল থেকে পদ্ধতিটি নবম শ্রেণিতে চালু হয়। ২০১০ সালের এসএসসি পরীক্ষায় প্রথম প্রবর্তন ঘটে। একযুগ আগে সনাতনী পদ্ধতির পরিবর্তে সৃজনশীল পরীক্ষা পদ্ধতি চালু হলেও অদ্যাবধি তা আয়ত্ত করতে পেরেছেন মাত্র ৫৮ শতাংশ শিক্ষক। তারা এ পদ্ধতিতে প্রশ্ন প্রণয়ন করতে পারেন। বাকি ৪১ দশমিক ৭৩ শতাংশ শিক্ষক সৃজনশীল বিষয়ের প্রশ্ন তৈরি করতে পারেন না। এদের মধ্যে ১৩ দশমিক ১২ শতাংশের অবস্থা খুবই নাজুক। এ ধরনের শিক্ষকরা নতুন পদ্ধতিতে প্রশ্নপত্র তৈরি করতে পারেন না। যেসব শিক্ষক প্রশ্নপত্র তৈরি করতে পারেন না, তাদের দিয়ে কীভাবে শিক্ষার উন্নয়ন ঘটবে?

আগের তুলনায় বর্তমানে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বেশি বন্ধ থাকায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে শিক্ষার্থীরা। এসএসসি পরীক্ষার সময়, রমজান, ঈদসহ বিভিন্ন উৎসবে দফায় দফায় বিদ্যালয় বন্ধ থাকে। এতে সিলেবাস শেষ করা নিয়ে শঙ্কায় থাকে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা। বর্তমানে শুক্রবারের পাশাপাশি শনিবার অর্থাৎ সপ্তাহে দুদিন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় শিক্ষায় আরও ক্ষতি হচ্ছে।

মার্চ পেরুলেও অনেকে হাতে পায়নি পাঠ্যবই। দেশে ১ জানুয়ারি উৎসবের মাধ্যমে বই দিবস উদযাপন হলেও বই হাতে পেতে শিক্ষার্থীদের বিড়ম্বনা পোহাতে হবে কেন? বিশেষ করে নবম শ্রেণির বাংলা, ইংরেজি, গণিত, ইসলাম/হিন্দু ধর্ম, বাংলাদেশের ইতিহাস সভ্যতা, অর্থনীতি, পৌরনীতি, হিসাব বিজ্ঞান, ব্যবসা উদ্যোগ এখনও হাতে পায়নি শিক্ষার্থীরা। বই হাতে না পেলে শিক্ষার্থীরা পড়বেই বা কি?

শিক্ষাব্যবস্থার জটিলতায় অধিকাংশ শিক্ষক পাঠদানে দুর্বল। সেক্ষেত্রে শিক্ষার্থীরা নির্ভরশীল হচ্ছে গাইড বইয়ের ওপর। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে অধিকাংশ বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা নিম্নমানের গাইড কিনতে শিক্ষার্থীদের বাধ্য করছেন। শিক্ষকদের বড় অংকের কমিশন দেয়ায় গাইড বই প্রকাশনা কোম্পানিগুলো গাইড বইয়ের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। এতে বিনামূল্যে শিক্ষার্থীরা পাঠ্যবই হাতে পেলেও গাইড কিনতে হিমশিম খাচ্ছে। যেখানে শিক্ষকরা গাইড কিনতে শিক্ষার্থীদের উৎসাহ দিচ্ছেন সেখানে গাইড না কিনেও পারছে না শিক্ষার্থীরা। অনেকে গাইড বই কিনতে না পেরে পড়ালেখা থেকে ঝরে পড়ছে।

আসলে আমাদের প্রয়োজন কর্মমুখী শিক্ষা। একাডেমিক শিক্ষার সাথে কর্মের কোন মিল নেই। শিক্ষায় যা আছে কর্মে সেটা প্রয়োগ করার সুযোগ নেই। আবার কর্মে যা করতে হচ্ছে, একাডেমিক শিক্ষায় সেটা মিলছে না। এমন কি চাকরির পরীক্ষার সাথেও একাডেমিক পড়ালেখার সাথে ব্যাপক পার্থক্য। একাডেমিক পাঠ্যে কম্পিউটার ছিল না। এখন তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি নামে একটি বিষয় যুক্ত হলেও মিল নেই কর্মের সাথে। পাঠ্যে রয়েছে এইচটিএমএল। অথচ চাকরির পরীক্ষায় নেয়া হয় টাইপিং স্পিড, যা পাঠ্যে কখনও শেখানো হয় না। চাকরির পরীক্ষায় দেয়া হয় সাধারণ জ্ঞান। অথচ একাডেমিক শিক্ষায় সাধারণ জ্ঞানের কোন বই পাঠ্য করা হয়নি। ইংরেজিতে কথা বলতে পারা প্রার্থীকে অনেক কর্মেই দেয়া হয় অগ্রাধিকার। অথচ একাডেমিক শিক্ষায় স্পোকেন ইংলিশ নামে কোন বই পাঠ্য করা হয়নি। গ্রুপভিত্তিক পড়ালেখার কি প্রয়োজন। ব্যবসায় শিক্ষা শাখা বা মানবিক শাখায় পড়ালেখা করেও প্যারাম্যাডিক কোর্স করে চিকিৎসা দিচ্ছেন অনেকে। মানবিক বা বিজ্ঞান বিভাগে পড়ালেখা করে ব্যাংকার হচ্ছেন। তাহলে পড়ালেখার সাথে কর্মের মিল কোথায়? শিক্ষাকে যুগপোযোগী করতে হলে কর্মের সাথে শিক্ষার সংযোগ তৈরি করাটা জরুরি।

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :