শিকলে বন্দি হাবিবুর ও আসাদুলের জীবন

কুড়িগ্রাম প্রতিনিধি, ঢাকাটাইমস
| আপডেট : ০৬ আগস্ট ২০২৩, ১১:৩৭ | প্রকাশিত : ০৬ আগস্ট ২০২৩, ১১:২৬

কুড়িগ্রামের উলিপুর উপজেলার ধামশ্রেণি ও তবকপুর ইউনিয়নের বাসিন্দা মো. হাবিবুর রহমান (১৪) ও আসাদুল ইসলাম (৩৬) মিয়া অন্য দশজনের মত স্বাভাবিক জীবন যাপন করলেও এখন তাদের জীবন কাটছে শিকল বন্দি। বেশ কয়েক বছর ধরে শিকল দিয়ে পা বেঁধে রেখেছে তাদের পরিবারের লোকজন। মানসিক ভারসাম্যহীন এই দুইজনের পা জিঞ্জির দিয়ে বাঁধা থাকলেও জীবনের গল্পটা কিন্তু একেবারেই আলাদা।

সরেজমিনে গিয়ে জানা গেছে, কুড়িগ্রামের উলিপুর উপজেলার তবকপুর ইউনিয়নের সাদুল্যা সরকার পাড়া গ্রামের মো. দেলাবর হোসেনের ছেলে আসাদুল ইসলাম। ছোটবেলা থেকে সুস্থ ছিলেন তিনি। চার ভাই বোনের মধ্যে দ্বিতীয় আসাদুল। বাবার অভাবের সংসারে হাল ধরতে দশম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করে ঢাকায় পাড়ি জমান। গার্মেন্টস কর্মী হিসেবে কাজ করেন দীর্ঘদিন। পরে পরিবারের লোকজনের সম্মতিতে বিয়ের পিঁড়িতে বসেন। বিয়ের এক বছরের মাথায় মারপিট ও অত্যাচার করার অভিযোগ তুলে একতরফা তালাক দিয়ে স্ত্রী চলে যায়। সেই শোকে মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন আসাদুল ইসলাম। পরে পরিবার লোকজন একাধিক বিয়ে দিলেও আসাদুলের সংসার টিকেনি। সুস্থ সবল মানুষটি দিনদিন বেকারগস্ত হয়ে পড়েন। বউ নেই, মাকে হারনোর প্রায় ৮ বছর। সংসারে আসাদুলের বাবা ছাড়া কেউ নেই। বৃদ্ধ বয়সে চোখের সামনে ছেলের পা শিকলে বেঁধে রাখার যন্ত্রণা থেকে মুক্তি চান আসাদুলের বাবা দেলাবর হোসেন।

কথা হলে আসাদুলের বাবা দেলাবর হোসেন জানান, ছেলেটা আগে ভালো ছিল। বউ ডিভোর্স দিয়ে চলে যাওয়া সে সইতে পারে নাই। সেই থেকে পাগলের মত আচরণ শুরু করেন আসাদুল। কেউ শাসন করলে তাকে মারতে যেত। আমাকেও একদিন মারতে এসেছিল। উপায় না পেয়ে দুই পায়ে শিকল পড়িয়ে রাখেছি।

তিনি জানান, আমরা গরীব মানুষ চিকিৎসা করার মত সম্বল নাই। সুষ্ঠু চিকিৎসা করতে পারলে ছেলেটা হয়তো স্বাভাবিক জীবন ফিরে আসতে পারে।

অন্যদিকে মো. হাবিবুর রহমান (১৫) একই উপজেলার ধামশ্রেণি ইউনিয়নের পোদ্দার পাড়া গ্রামের দিনমজুর আবুদ্দির ছেলে। সেও শিকল বন্দি হয়ে আছেন প্রায় ৮ বছর। হাবিবুর জন্মের পর থেকে মানসিক প্রতিবন্ধী। জন্মের পর মা ক্যান্সার আক্রান্ত হয়ে মারা যান। ছেলেকে দেখাশোনা করার মত লোক না থাকায় দ্বিতীয় বিয়ে করেন তিনি। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস তার ঘরে আরো একটি প্রতিবন্ধী শিশুর জন্ম হয়। সংসারে অভাব অনটনের কারণে সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করতে না পারায় সরকার ও বিত্তবানদের সহযোগিতা কামনা করছেন হাবিবুর রহমানের বাবা।

হাবিবুর রহমানের বাবা মো. আবদ্দি জানান, ছোট বেলা থেকে হাবিবুর এমন। ওর মা ক্যান্সার আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। ওর সৎ মা হাবিবুরের দেখাশোনা করেন। ৮ বছর ধরে হাবিবুরকে শিকল দিয়ে পা বেঁধে রাখছি। শিকল পড়া না থাকালে বিদ্যুতের খুঁটিতে উঠে। বেশ কয়েকবার সে হারিয়ে গেছে। আমি গরীব মানুষ। দিনমজুরি করে সংসার চলে। শিকল না পড়ে ছেড়ে দিলে সে তো হারিয়ে যাবে তখন ছেলেটাকে কোথায় খুঁজবো।

তিনি জানান, আমার টাকা পয়সা নাই যে ওকে ভালো চিকিৎসা করাবো। আল্লাহ যতদিন এভাবে রাখবে ততদিন এভাবে শিকল পড়িয়ে রাখবো। হাজারো হোক মা মরা ছেলেটাকে আর হারাতে চাই না। সরকার যদি উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা করতো তাহলে হয়তো আমার ছেলেটা ভালো হত।

হাবিবুরের প্রতিবেশি মো. নায়েব আলী বলেন, হাবিবুরের বাবা দিনমজুর। ঠিকমত দুবলো ভাত খেতে পারে না ছেলের চিকিৎসা করাবে কিভাবে। আমার বিশ্বাস হাবিবুরকে ভালো চিকিৎসা করাতে পারলে সে ভালো হয়ে উঠত।

আসাদুলের প্রতিবেশী রুবেল মিয়া বলেন, আমি দেখেছি আসাদুল ইসলাম বউ পাগল ছিল। বউ তাকে ছেড়ে যাওয়ার কারণে সে মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে পড়েন। পরে আরো দুটো বিয়ে দিয়েও সে সংসার টিকে নাই। তার সঠিক চিকিৎসা করা গেলে হয়তো ভালো হয়ে যেত।

এ বিষয়ে উলিপুর উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা লুৎফর রহমান জানান, হাবিবুর ও আসাদুল ইসলামকে প্রতিবন্ধী ভাতার আওতাভুক্ত করা হয়েছে। তবে তাদের চিকিৎসার টাকার বিষয়ে সহযোগিতা করা সময় সাপেক্ষে ব্যাপার।

কুড়িগ্রামের সিভিল সার্জন কর্মকর্তা ডাঃ মো. মঞ্জুর -এ-মুর্শেদ জানান, এসব রোগীদের শিকলে বেঁধে রাখা কোনো সমাধান নয়। তাদেরকে মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। রোগী কোন পর্যায়ে আছে সেটি পর্যবেক্ষণ করে চিকিৎসা করালে অনেক সময় সুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

কুড়িগ্রামের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সাইদুল আরিফ জানান, মানসিক ভারসাম্যহীন ওই ব্যাক্তি দুজনের সম্পর্কে আমার জানা ছিল না। আমি ওই দুই ব্যাক্তির খোঁজ নিতে স্থানীয় প্রতিনিধি ও সমাজসেবা অফিসার পাঠাচ্ছি। এ বিষয়ে দ্রুত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

(ঢাকাটাইমস/০৬ আগস্ট/ইএইচ)

সংবাদটি শেয়ার করুন

সারাদেশ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

সারাদেশ এর সর্বশেষ

এই বিভাগের সব খবর

শিরোনাম :