বাঙালির ঘরে আগুন জ্বালিয়ে শেষ রক্ষা পাবে কি বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ?

এস এম জাহাঙ্গীর আলম সরকার
 | প্রকাশিত : ৩০ আগস্ট ২০২৩, ১১:২০

সংস্কৃতি ও ভাষা বিকশিত হওয়ার স্বার্থেই সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষা-দীক্ষার উৎকর্ষ সাধনে বিভিন্ন পরম্পরায় বিবিধ মণীষী, লেখক, কবি, সাহিত্যিক ও সংস্কৃতিকর্মীদের প্রগতিশীল ভাবনার সমন্বয়ে এবং বহু ঋদ্ধ বুদ্ধিজীবী ও রাজনীতিবিদদের প্রাজ্ঞতার স্পর্শে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি বর্তমান রূপ লাভ করেছে। খণ্ডিত ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় নিলেও চর্যাপদের সময়কাল বিবেচনা করলে অন্তত হাজার বছরের বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির একটা পটভূমিকা আমরা আমাদের মনস্তত্ত্বে সহজেই অনুভব করতে পারি। বাঙালি চেতনার জাতীয়তাবোধ ঠিক কখন থেকে বর্ণনা করার মতো পর্যায়ে অনুভূত হয়েছে, তা আমার ক্ষুদ্র জ্ঞান দ্বারা সীমায়িত করা অনুচিত হবে। বরং, তা ইতিহাসবিদ, ভাষা ও সাংস্কৃতিক গবেষকদের দ্বারা নির্ধারিত হওয়াই বাঞ্চনীয়। তবে পূর্ণাঙ্গ রূপ ধারণ করে যে সময়ে আত্মপ্রকাশ করেছে এই বাঙালি জাতীয়তাবাদের চেতনাবোধ, তা খোলা চোখে দৃশ্যমান হওয়ার পর সেই ইতিহাসের যাত্রাপথ ঊনবিংশ শতাব্দীর গোড়া থেকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়কাল বিবেচনায় নিলে খুব বেশি অপরিপক্কতার পরিচয় মিলবে না বোধ করি।

পূর্বকাল বিবেচনায় বর্তমান বাংলাদেশ নামক ভূখণ্ডের পাশাপাশি ভারতবর্ষের পশ্চিমবঙ্গ, বিহার, আসাম, ত্রিপুরা ও উড়িষ্যাসহ বেশ কিছু অঞ্চলে বাংলা ভাষাভাষী মানুষের বসবাস থাকলেও ১৯৪৭ সালে সমগ্র ভারতবর্ষ দ্বিজাতি তত্ত্বের ধারায় অনিবার্যভাবে বিভাজিত হলে পাকিস্তানের শাসক শ্রেণির হীনম্যন্যতার চরম শিকারে পরিণত হয় বর্তমান বাংলাদেশের বাংলা ভাষা।

তৎকালীন পাকিস্তানে বাংলা ভাষা রাষ্ট্রীয় ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি না পাওয়ার বিপরীতে সুপরিকল্পিতভাবে বাংলা ভাষাকে বিলুপ্তির দিকে নিয়ে যাওয়ার চক্রান্তের ধারাবাহিকতায় সাম্প্রদায়িক মানসে ধর্মকে ব্যবহার করে এদেশের সাধারণ মানুষের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া তৈরি করার লক্ষ্যে বাংলা ভাষায় সাহিত্যচর্চার অন্যতম পথিকৃৎ কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পাঠ্যচর্চাকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছিল। শুধু তাই নয়, উর্দুকেই একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঘোষণা করা এমনকি বাংলাকে উর্দু অক্ষরে লিখবার ঘোষণা করার মধ্য দিয়ে বাংলা ভাষাকে চিরতরে মুছে ফেলার সুদূরপ্রসারী নীলনকশা বাস্তবায়নে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিল তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীরা। অপরদিকে বলে রাখা প্রয়োজন, স্বাধীন ভারতের অংশভুক্ত বাংলা ভাষাভাষী মানুষকে স্ব-স্ব ক্ষেত্রে নিজেদের ভাষা ব্যবহার এবং শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতি চর্চায় অন্তত ন্যাক্কারজনকভাবে এমনতর অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হয়নি।

হাজার বছর ধরে চলে আসা এ ভূখণ্ডের বাংলা ভাষাভাষী মানুষের ওপর জোর করে উর্দু ভাষা চাপিয়ে দিয়ে চিরতরে বাংলা ভাষাকে বিদায় করার প্রয়াস পেতেই বাঙালি জনগণের ভাষাকেন্দ্রিক আত্মতাগিদ জাগ্রত হয়ে সংগ্রামী ভাষা আন্দোলনে পরিণত হয়। জেল-জুলুম, অত্যাচার-নির্যাতন, বুলেট-বোমার মুখোমুখি হয়ে বেশ কয়েকজন ভাষা সৈনিকের আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে ১৯৫২ সালে এ বাঙালি জনগোষ্ঠী মাতৃভাষাকে রক্ষা করে পৃথিবীর বুকে বিরল ইতিহাস রচনা করেন। ভাষা রক্ষায় এমন পরিসরে রক্তদানের কীর্তি বর্তমান বাংলাদেশ ভূখণ্ডের বাঙালির ইতিহাস ব্যতীত বিশ্ব ইতিহাসে দ্বিতীয়টি আছে বলে আমার জানা নেই।

বাঙালি জাতীয়তাবাদের অন্তর্নিহিত মর্মার্থ অনুধাবনের লক্ষ্যে বিশেষ করে বর্তমান প্রজন্মের পাঠকদের সরল উপলব্ধি জন্মাতে সর্বভারতীয় প্রেক্ষাপটের সামান্য আলোচনা খুবই প্রাসঙ্গিক। সাম্রাজ্যবাদিতার পরম্পরার কষাঘাতে সমগ্র ভারতবর্ষ এক ভারত রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশের সুযোগ পায়নি কখনোই। সর্বশেষ ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের অধীনে থেকে নানা সময়ে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের চেষ্টা করা হলেও আন্দোলনের মুখে ব্রিটিশকে পরাজিত করে ভারত রাষ্ট্র জন্ম দেওয়া সম্ভব হয়নি। সমগ্র ভারতে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নৃ-জাতি গোষ্ঠী, তাদের ভাষা সংস্কৃতির ভিন্নতা, ভূ-সম্পদের পার্থক্য, এমনকি জনসংখ্যার ভিত্তিতে আঞ্চলিক ও অর্থনৈতিক পার্থক্য, জাত-পাত, বর্ণ বিভেদ আর মোটাদাগে ধর্মভিত্তিক জনগোষ্ঠীর ভিন্ন পরিচয় শুরু থেকেই এক ভারত রাষ্ট্র গঠনের উপযোগী ছিল না। শিক্ষা দীক্ষার পার্থক্যসহ আর্য, অনার্য বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গির ভিন্নতা এবং সুপরিকল্পিত কূটনীতির প্রভাব একক ভারতের বিরুদ্ধাচারণ করেছে। ফলে সে সময়ের উচ্চ মার্গীয় নেতৃবর্গ মহাত্মা গান্ধী, নেতাজী সুভাস বসু, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস, শের-ই- বাংলা একে ফজলুল হক সহ অনেকেই এই প্রচেষ্টায় ব্যর্থ হয়েছেন। কখনও উত্তরে আন্দোলন শুরু হলে দক্ষিণে সমর্থন পায়নি, আবার দক্ষিণে শুরু হলে উত্তর চুপচাপ ছিল কিংবা যখন বাংলায় শুরু হয়েছে সেখানে দিল্লি নিস্ক্রিয় থেকেছে, না হয় উল্টো ব্রিটিশকে সহায়তা করেছে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে। এই রকম প্রেক্ষাপটে কার্যত গর্ব করবার মতো জাতীয়তাবাদের ল্যান্ডমার্ক হিসেবে একক জাতীয়তাবাদের কোনো ভিত্তি রচনা করা সম্ভব হয়নি সমগ্র ভারতবর্ষে।

হাজার বছর ধরে বাংলা ভাষাভাষী মানুষ নিজেদের মধ্যে মিথস্ক্রিয়ার ফলে আবেগ অনুভূতির আদান প্রদান করতে করতে আপন মনোভাবসম্পন্ন আন্তরিক বন্ধন গড়ে তোলে। জাতিরাষ্ট্র তৈরি হওয়ার প্রেক্ষাপট পূর্ব পর্যন্ত একই ভাষাভাষির মানুষ ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি ও সামাজিক সম্পর্কে জড়িয়ে একে অপরকে আপন আত্মীয় ভাবার ক্ষেত্রে যে টান বা মায়া অনুভব করতো, মূলত সেই অনুভূতির সচেতন বোধকেই জাতীয়তাবোধ বলা যেতে পারে। আধুনিক রাষ্ট্রগঠন প্রক্রিয়ায় এসে পূর্বপটের জাতীয়তাবাদের বিমূর্ত রূপটি মূর্ত হয়ে আন্দোলনের ভিত্তি হিসেবে কিংবা একটি জাতি রাষ্ট্রের জাতীয় চেতনা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে।

১৯০০ থেকে শুরু থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত সময়টিকে ভাষা-স্কৃতিভিত্তিক জাতীয়তাবাদের চেতনার বিমূর্ততা উতরে মূর্ততার প্রাথমিক ও পরিপক্কতার স্পষ্ট রূপ লাভের সময় হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে। বঙ্গভঙ্গ রোধ, ভাষা আন্দোলন ও নানান রাজনৈতিক এবং সামাজিক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ৬৬’র ছয় দফা ৬৯’র গণঅভ্যুত্থান, ৭০’র নির্বাচন এবং তৎপরবর্তী ৭১’র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত বাংলাদেশের মানুষ বাঙালি জাতি হিসেবে ভাষা ও সংস্কৃতিভিত্তিক জাতীয় চেতনাকেই সর্বাগ্রে গ্রহণ করেছে।

ভারতবর্ষে বহুবিধ ভাষা, নানা ধর্ম-বর্ণ, জাতপাত গোত্র, নানা সংস্কৃতি, খণ্ড খণ্ড আঞ্চলিক ঐতিহ্য, নানান অঞ্চলের মানুষের নানান রাজনৈতিক চিন্তাভাবনা, আর্য-অনার্য ইত্যাদি নানা মতের কারণে শিক্ষাদীক্ষায়, সামাজিক বন্ধনে নানা প্রশাসনিক বৈষম্যের কারণে বিশেষ কোনো একক আদর্শে সবাইকে একমতে এনে স্বাধীন একক ভারত রাষ্ট্র গঠন করা সম্ভব হয়নি বলে ব্রিটিশদের চলে যাওয়ার প্রাক্কালে তদানীন্তন রাজনীতিবিদদের ব্যর্থতা, অযোগ্যতা, নমনীয়তা ও তোষামোদের ফসল হিসেবে ব্রিটিশরা ধর্মভিত্তিক বিভাজন করে পাকিস্তান ও ভারত রাষ্ট্রের জন্ম দিলেন। বিশেষ আন্দোলনের ফসল না হওয়ায় এ কথা খুব পরিষ্কার যে, উভয় দেশই শুরুতে ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদকে গ্রহণ করেই পৃথক হল। মুশকিলটা হল উভয় দেশেই তখনো নানা ধর্মের নানা মতের নানা সংস্কৃতির মানুষ রয়েই গেল। ফলে জন্মের মধ্যেই ভাঙনের যথেষ্ট কারণ বিদ্যমান থেকেই গেল। বিকল্প হিসেবে এক ভারতীয় অস্তিত্ব অনুভবে যার যার ভাষা, সংস্কৃতি, ধর্ম এবং অন্যান্য অনুষঙ্গ বিবেচনায় নিয়ে যুক্ত রাষ্ট্র বা রাষ্ট্রপুঞ্জ আকারে যাত্রা শুরু করতে পারতো। কিন্তু তৎকালীন নেতৃবর্গ সে পথে সফল চিন্তায় হাঁটতে সক্ষম হননি তা বলাই যায়।

বর্তমান বাংলাদেশ আমরা পাকিস্তান রাষ্ট্রের অংশ হলাম। সঙ্গত কারণে আমাদের জাতীয়তাবাদের পরিচয় হলো ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদ। এখানটা মুসলিম প্রধান হলেও উল্লেখযোগ্য সব ধর্মের মানুষই বাস করে আসছিল। তৎকালীন পাকিস্তানের পূর্বাংশের পূর্ব বাংলা তথা আজকের বাংলাদেশের লোকসংখ্যা পশ্চিম পাকিস্তানের লোকসংখ্যার চেয়ে বেশি ছিল। এই অংশের উৎপাদন ব্যবস্থা, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পশ্চিম পাকিস্তানের তুলনায় উন্নত ছিল। কিন্তু কেন্দ্রীয় শাসনব্যবস্থা পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পরিচালিত হত।

ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদের চেতনা থেকে অন্তত ইসলাম ধর্মের ধর্মীয় বিধান আলোচনা সাপেক্ষে সাম্য, সামাজিক ন্যায়বিচার, সম্পদের সুষম বণ্টন, চাকরি-বাকরির সুযোগ সুবিধা, ভ্রাতৃত্ববোধ, শিক্ষাদীক্ষা, কলকারখানার সমতাভিত্তিক বাস্তবায়ন, শোষণমুক্ত অর্থনৈতিক ন্যায়বিচার- এমনটাই রাষ্ট্রীয় কার্যকলাপে মানদণ্ড হিসেবে কার্যকরী হবে সেটা সবাই আশা করেছিল। কিন্তু বিধি বাম ! অধার্মিকের কাছে ধর্ম নিরাপদ নয়। সেটি ৪৭’র পর থেকেই আমরা চরমভাবে অনুভব করতে শুরু করলাম। আমাদের শ্রমঘাম আর কষ্টে অর্জিত সম্পদ কেন্দ্রমুখী হতে শুরু করল। বিনিময়ে সব ক্ষেত্রে ঠকবাজিতা, শোষণ-বঞ্চনা, অত্যাচার-নির্যাতন, শিক্ষাদীক্ষায় অনুন্নতকরণ প্রচেষ্টা, আচার ব্যবহার দৃষ্টিভঙ্গি সব ক্ষেত্রেই চরম বিমাতাসুলভ আচরণে অতিষ্ঠ করে তুলতে শুরু করল। আর, এই কাজে সামরিক শাসন ব্যবস্থা ছিল তাদের অন্যতম প্রধান হাতিয়ার। সামাজিক ন্যায়বিচার তো দূরের কথা, বাংলার এই অংশের মানুষকে দাস কিংবা দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকে পরিণত করার সব ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছিল। বাংলা ভাষাকে চিরতরে বিলুপ্ত করে বাঙালি সত্তার পরিচয়কে মুছে ফেলার জন্য উর্দু ভাষাকে বাধ্যতামূলক করার ঘোষণা দিলেন আর বাংলা ভাষাকে উর্দু অক্ষরে লিখতে বললেন। তাদের ধূর্ততা খুব দ্রুত উপলব্ধি করে বাঙালি জাতি ১৯৫২ সালে মাতৃভাষাকে রক্ষা করলেন। এখানেই শেষ নয়, বরং বাঙালির ভাষাভিত্তিক এ চেতনার জাগ্রত রূপ বাঙালিকে সম্মুখপানে হাঁটতে তাড়িত করল। এক কথায় রাজনৈতিক ভাবধারায় স্বায়ত্তশাসন কিংবা স্বাধীনতার ভাবনাতে গতি সঞ্চার করতে থাকল।

ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদের খোলস থেকে বেরিয়ে এসে সব ধর্ম-বর্ণ জাতপাতকে একই চেতনায় একিভূত করে একই সংস্কৃতির ছায়াতলে সব ধর্মকে সমমর্যাদা দান করে সহাবস্থান করার জন্য ধর্মনিরপেক্ষতাকে সংযোজন করে ৬৬’র ৬ দফা উপস্থাপনের মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ববাংলার স্বায়ত্তশাসন তথা একান্ত করে ভাবলে স্বাধীনতা আন্দোলনের রূপরেখা তৈরি করে ফেললেন। ৭০ এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় এবং প্রাদেশিক নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে সমগ্র পাকিস্তানের শাসনভারে পরিবর্তন আনতেই ক্ষমতার পালাবদল না করে পাকিস্তানি সামরিক জান্তা এবং হীনমন্য রাজনীতিবিদদের স্বেচ্ছাচারিতা অন্যায় আচরণের শিকার হয়ে জেলজুলুম নির্মম অত্যাচার নির্যাতনের মধ্য দিয়ে বেশ খানিকটা পূর্ব থেকেই প্রস্তুত করা বাঙালি জাতিকে ৭১ সালের ৭ই মার্চ স্বাধীনতার সর্বদিক নির্দেশিত ঐতিহাসিক ভাষণের মধ্যে দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে বাঙালি জাতি নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সব শ্রেণি-পেশার মানুষ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে ৩০ লাখ মুক্তিযোদ্ধার আত্মত্যাগে অর্জিত হলো আমাদের স্বাধীনতা।

রাষ্ট্র হিসেবে ভারত কিংবা পাকিস্তানের খুব সুনির্দিষ্ট করে জাতীয়তাবাদের অহংকার না থাকায় তাদের রাজনৈতিক ব্যর্থতার কারণগুলোকে যথাযথভাবে গবেষণা ও উপলব্ধি করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সাম্য, সামাজিক ন্যায়বিচার ও ধর্মনিরপেক্ষতাকে বেছে নিয়ে রাজনৈতিক আন্দোলনে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সব শ্রেণি পেশার মানুষের চৈতন্য জাগ্রত করে এবং তা একীভূত করে পূর্ববাংলার সমগ্র মানুষের আস্থায় একমাত্র নির্ভরযোগ্য স্বাধীনতাকামী জাতীয়তাবাদী নেতা হিসেবে নিজের অবস্থান ও বিশ্বাস দৃঢ়তার সঙ্গে তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিলেন। ফলে রাজনীতিতে অন্যান্য শাখা-প্রশাখা ভিন্ন মতাবলম্বী থাকলেও কেবলমাত্র বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়েই এ বাংলার আপামর মানুষ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে এক সাগর রক্ত ঝরিয়ে স্বাধীনতা অর্জনের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুকে উপহার দিয়েছে তাঁর স্বপ্নের বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধু বিশ্বদরবারে বাঙালিকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সম্মানীত করে আমাদেরকে বাঙালি জাতি হিসেবে বিশ্ব মানচিত্রে পরিচয় করিয়ে দিলেন। সংক্ষেপে বাঙালি জাতীয়তাবাদের অন্তর্নিহিত মর্মার্থ পরবর্তীতে সংবিধানের চারটি মুলনীতিতে একীভূত হয়েছে।

সমালোচনার ঊর্ধ্বে না হলেও এ কথা খুব স্পষ্ট করে বলতে কোনো দ্বিধা নাই যে, ভারতীয় উপমহাদেশের একমাত্র রাষ্ট্র বাংলাদেশ, যা একটি সফল নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জন করেছে। বর্তমান ভারত এবং পাকিস্তান রাষ্ট্রের কোনো নেতা তার দেশের নাগরিকদেরকে মুক্তিযোদ্ধার সম্মান এনে দিতে পারেননি। এ বিবেচনায় সফলতার মাপকাঠিতে সমগ্র ভারতবর্ষে বঙ্গবন্ধুর সমতুল্য কোনো নেতা আসেননি। বাঙালি জাতীয়তাবাদ, বাংলাদেশ ও বঙ্গবন্ধু সমার্থক।

স্বাধীনতা উত্তর যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের দায়িত্বভার গ্রহণ করে রাষ্ট্রগঠন প্রক্রিয়ায় মাত্র সাড়ে তিন বছর সময় পেয়েছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। স্বল্প সময়ের মধ্যে সংবিধান প্রণয়নসহ নাগরিক জীবনে মৌলিক প্রয়োজনসমূহের চাহিদা পূরণে প্রয়োজনীয় গৃহীত পদক্ষেপ, দারিদ্রতা দূরীকরণে আন্তরিক প্রচেষ্টা, অর্থনীতির গতি সঞ্চালনে গৃহীত পদক্ষেপ, রাষ্ট্র পরিচালনায় অভ্যন্তরীণ সঞ্চালন ব্যবস্থায় নীতি প্রণয়ন, পররাষ্ট্রনীতির সুস্পষ্টিকরণ, বহির্বিশ্বের স্বীকৃতি আদায়ে আন্তর্জাতিক নেতৃত্বে জ্যোতি ছড়ানোসহ ভবিষ্যৎ সাক্ষাৎ সোনার বাংলা গড়ে তোলার লক্ষ্যে যে সব দিকনির্দেশনা, নীতি কৌশল, বিধি-বিধান প্রয়োজন, তার বেশিরভাগটাই তিনি প্রণয়ন করেছিলেন। সময় স্বল্পতার বিচারে গৃহীত বাস্তবায়ন প্রক্রিয়াতেও তাঁর ঈর্ষণীয় সাফল্য রয়েছে। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীনতা ও বাঙালি জাতীয়তাবাদের অন্তর্নিহিত মর্মার্থের সৌন্দর্য্য এত স্বল্পতম সময়ের মধ্যে কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় বিকশিত করা সম্ভব হয়নি। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমানসহ তাঁর পরিবারের সদস্যদেরকে নৃশংসভাবে হত্যা করা এবং ৩রা নভেম্বরে চার জাতীয় নেতাকে জেলখানায় হত্যার মধ্য দিয়ে ধর্ম নিরপেক্ষ সংস্কৃতির সৌন্দর্যের নির্যাস বাঙালি জাতীয়তাবাদ এবং মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে ৩০ লাখ মুক্তিযোদ্ধা নরনারীর রক্তমূল্যে অর্জিত কাঙ্খিত স্বাধীনতার মূল চেতনাকেই কার্যত হত্যা করা হয়েছিল।

এ কথা বললে অতিরঞ্জন হবে না যে বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতির পেশা এবং সাধারণ মানুষের মুক্তি কামনায় যেমন ঐক্য সৃষ্টি হয়েছিল, তেমনি করে বঙ্গবন্ধু পরিণতি হিসেবে ধরেই নিয়েছিলেন যে কোনো সময়ে তাঁর মৃত্যু কিংবা কারাভোগ অনিবার্য হতে পারে। ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণই মূলত স্বাধীনতা ঘোষণার ঐতিহাসিক দলিল। সে আশঙ্কাই সত্যি হল। ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চের কালোরাত্রিতে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করে পাকিস্তানি কারাগারে আটক করল সামরিক শাসকগোষ্ঠী। মৃত্যুদণ্ডের পরোয়ানা নিয়ে পুরো মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়টা বঙ্গবন্ধুকে কাটাতে হয়েছিল পাকিস্তানের কারাগারে। তাঁর উপস্থিত থাকা এবং না থাকাকে কেন্দ্র করে দুটি প্রাসঙ্গিক গবেষণাধর্মী মন্তব্য করা যেতেই পারে। একটি বড় ভালো দিক উল্লেখ করার মতো, তা হল ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ডাকে সাড়া দিয়ে দেশের সাধারণ মানুষ এই মহান নেতার প্রতি আস্থা রেখে শেষ অবধি দেশপ্রেম নিয়ে যুদ্ধ করে বাংলাদেশের জন্ম দিতে সক্ষম হয়েছেন। বিপরীতে আরেকটি আশঙ্কার বিষয় এভাবে দেখা যেতে পারে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে বিভিন্ন ব্লকের রাজনীতিবিদ কিছু কিছু সংস্থা সরকারি চাকরিজীবী এবং পাকিস্তানি জান্তাদের সহযোগিতাকারী তথা মুক্তিযুদ্ধবিরোধী পাকিস্তানপন্থি রাজাকারদের মননে যে মরীচিকা সে সময় মানুষ প্রত্যক্ষ করেছিল, তার অনিবার্য পরিণতি হতে পারতো ৩০ লাখ আত্মত্যাগী মুক্তিযোদ্ধার পরিণতির সঙ্গে তুলনীয় এবং পরবর্তীতে পরিকল্পিতভাবে বুদ্ধিজীবীদেরকে যেভাবে হত্যা করা হয়েছে সেই আশঙ্কাটা বঙ্গবন্ধুর ক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম নাও হতে পারতো। বিশেষ করে ক্ষমতালিপ্সু কিছু কিছু রাজনৈতিক দলের অসহিষ্ণু নেতাকর্মীরা স্বাধীনতাকে কেন্দ্র করে পরবর্তীতে ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে যাওয়ার লক্ষ্যে ইতোমধ্যেই যে মনস্তত্ত্ব ধারণ করেছিলেন, তা ছিল পক্ষান্তরে মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধচারণ। অর্থাৎ সাধারণ মানুষের মুক্তিযুদ্ধের আকাঙ্ক্ষাকে এসব তথাকথিত নেতাকর্মীরা পরিবর্তন করতে সক্ষম হননি বলেই না পেরে একান্ত বাধ্য হয়ে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কৌশলে আত্মপ্রকাশ করেছেন।

বঙ্গবন্ধুর প্রতি সাধারণ মানুষের অবিচল আস্থার কারণে তাঁর অনুপস্থিতি সত্ত্বেও ৭ মার্চের ছড়িয়ে দেওয়া মুক্তিতরঙ্গ থেকে এ সব তথাকথিত উশৃঙ্খল বাম ডান রাজনৈতিক নেতারা সাধারণ মানুষকে তাদের পক্ষে টানতে সক্ষম হননি। জীবিত বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা উত্তর সময়ে ফিরে আসবেন কেউ কেউ বিশ্বাস করতেন না বলেই স্বাধীনতা অর্জনের আগেই রাষ্ট্রক্ষমতার প্রতি তাদের লোভ লালসা আকাঙ্ক্ষা ও ষড়যন্ত্রের বুদ্ধিমত্তাকে শান দিতে শুরু করেন। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি, কারাগারে বসে এসবের প্রকৃত ধারণা বঙ্গবন্ধুর লাভ করা সম্ভব হয়নি। ফলে ১০ই জানুয়ারি ১৯৭২ সালে দেশে ফিরে এসে ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চের বিশ্বাসের ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধু তাঁর রাষ্ট্র পরিচালনা কার্যক্রম শুরু করেন। শুরুতেই ক্ষমতার ভাগীদার হতে না পারায় অনেকেই শুরু করে দিলেন তাদের ষড়যন্ত্রতত্ত্বের চর্চা। সেই সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন, পার্শ্ববর্তী বন্ধুরাষ্ট্র ভারত আর বন্ধুমনোভাবাপন্ন দু-একটি দেশ ছাড়া খোদ আমেরিকা থেকে শুরু করে বিশ্বের বেশিরভাগ দেশই যারা আমাদের মুক্তিযুদ্ধে শত্রুপক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন তাদের প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ সহযোগিতা নিয়ে বঙ্গবন্ধুর রাষ্ট্রপরিচালনাকে অকার্যকর করবার জন্য হেন কোনো কাজ নাই যা তারা করেননি। সব প্রতিকূলতাকে ডিঙ্গিয়ে বঙ্গবন্ধু যখন স্বল্পতম সময়ের মধ্যে ১৭৬টি দেশের সমর্থন আদায় করা, জাতিসংঘ থেকে শুরু করে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার সদস্য পদ লাভ করা এমনকি বিশ্ব ব্যবস্থায় জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের সমর্থনে নিজেকে প্রকাশ করার মধ্য দিয়ে আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে জ্যোতি ছড়াতে শুরু করলেন, তখনই চূড়ান্ত ঈর্ষণীয় হয়ে উঠলেন বঙ্গবন্ধু। এ অবস্থায় শত্রুপক্ষ সবাই মিলে পরিকল্পিত সময় থেকে মিশন বাস্তবায়নে সময়কে সীমিত করে নিয়ে এসে মাত্র সাড়ে তিন বছরের চলমান শাসনব্যবস্থার অবসান ঘটালেন বঙ্গবন্ধু সহ পরিবারের সব সদস্যকে নৃশংসভাবে হত্যা করার মধ্য দিয়ে। যদি বঙ্গবন্ধু মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ের সব তথ্য পেয়ে ষড়যন্ত্রকারীদের মোটিভ আমলে নিতে পারতেন, তাহলে তাঁর সরল বিশ্বাসের জায়গায় কিছু পরিবর্তন এনে আরও বেশি সতর্কতা অবলম্বন করতে পারলে হয়তো এত দ্রুত আমরা বঙ্গবন্ধুকে হারাতাম না। স্বাধীনতা অর্জনের চেয়েও স্বাধীনতা রক্ষা করা অনেক কঠিন- এমন বাস্তবতা আমরা স্বাধীনতা অর্জনের মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথায় উপলব্ধি করতে নতুন পরীক্ষায় অবতীর্ণ হলাম। বঙ্গবন্ধুউত্তর বাংলাদেশ পশ্চাদগামী হতে শুরু করল, তা যেন বঙ্গবন্ধু হত্যার পরিকল্পনার মধ্যেই প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিল। এর মাধ্যমেই শুরু হল বাংলাদেশের স্বৈরতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা। বলা যায়, পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান রাষ্ট্র ক্ষমতায় এলেন সেই ঘৃণিত হত্যাযজ্ঞের শেষ অংকের পূর্ণতা দিতে। সংবিধানকে কাটাছেঁড়া করে এমনকি সংবিধানকে ছুঁড়ে ফেলে ইচ্ছামতো দেশ পরিচালনায় মত্ত হলেন। বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বিচার করা যাবে না মর্মে ইনডেমিটি পাস করলেন আর নতুন করে বাঙালি জাতির পরিচয়কে পুরাতন মোড়কে নিয়ে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদকে প্রতিষ্ঠিত করলেন। কী এই বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ? সহজ করে বললে, ১৯৭২ সালের প্রতিবিপ্লবীদের আকাঙ্ক্ষা তথা আওয়ামী রাজনীতির বিরুদ্ধে যারা সোচ্চার হতে শুরু করলেন, তাদের রচিত ক্ষেত্রকে বিবেচনায় নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী শক্তির ধর্মীয় চেতনাকে পুঁজি করে ঘুরেফিরে পাকিস্তানপন্থি জাতীয়তাবাদের মোড়ক উন্মোচন করলেন। আওয়ামী লীগ ও মুক্তিযুদ্ধবিরোধী প্রতিবিপ্লবী ও বুদ্ধিজীবীদের পরামর্শ নিয়ে নিজের চিরাচরিত বিশ্বাসকে প্রতিস্থাপন করে তৎকালীন জিয়াউর রহমান প্রেসিডেন্ট হিসেবে নতুন একটি জাতীয়তাবাদের জন্ম দিলেন। আওয়ামী লীগের বিশ্বাস থেকে বিচ্যুত আর তথাকথিত বাম রাজনীতির সমর্থকেরা ধর্মীয় রাজনীতির সমার্থক হিসেবে প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে ক্ষমতার লোভে বঙ্গবন্ধু ও তাঁর আদর্শের আওয়ামী লীগকে সেই সঙ্গে বাঙালি জাতীয়তাবাদের মূল চেতনাকে চিরতরে মুছে দিয়ে ধর্মীয় ভাবধারার পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদের উত্থান হল জিয়াউর রহমানের হাত ধরে। মৃত্যু হল আবহমান বাঙালি জাতীয়তাবাদের। সেই সঙ্গে বিলুপ্ত হল মুক্তিযুদ্ধ ও আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক দর্শন তথা সদ্যপ্রাপ্ত স্বাধীনতার সৌন্দর্যের বিকাশ। পরবর্তীতে সামরিক শাসনের ধারাবাহিকতায় জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর একই ধারাবাহিকতার অনুসারী জেনারেল এরশাদ রাষ্ট্র ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হলেন। তিনিও সংবিধানের তোয়াক্কা না করে উপর্যুপরি মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় অর্জিত বাংলাদেশের স্বপ্নকে বাস্তবায়িত না করে সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম জুড়ে দিয়ে ধর্মনিরপেক্ষতার বাংলাদেশকে সাম্প্রদায়িক বাংলাদেশে পরিণত করতে জিয়াউর রহমান যে সুযোগটুকু জীবদ্দশায় পাননি তা সম্পূর্ণ করলেন।

বাংলাদেশ স্বাধীনতাবিরুদ্ধ এমন সংস্কৃতিতে প্রায় ২১ বছর পথ হেঁটেছে। ফলে বেশ কয়েকটি প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস, বঙ্গবন্ধু ও বাঙালি জাতীয়তাবাদ কিংবা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সম্পর্কে যে বিপরীত জ্ঞান লব্ধ করেছে, এই শাসন আমলগুলোতে তা আজকের বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নির্মাণে রীতিমতো প্রগতির বিরুদ্ধচারণে এতটাই সক্রিয় যে বাঙালি সংস্কৃতি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, সেই সঙ্গে আওয়ামী লীগ সমর্থিত বাংলাদেশ রাষ্ট্রপরিচালনায় কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। সংস্কৃতির চর্চা শিল্পসাহিত্যের বিকাশ কিংবা বাঙালিয়ানার বিরুদ্ধে ধর্মের দোহাইকে এমন করে শক্ত প্রতিপক্ষ বানিয়ে ফেলেছে যেখানে স্বাধীন বাংলাদেশে জাতির পিতার ভাস্কর্য নির্মাণে তাঁর সুযোগ্য কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার সরকার পরিচালনার সময়েও তারা ইতিহাসের এ শৈল্পিক শিক্ষাকে অপ্রয়োজনীয় মনে করে ধর্মীয় মানসে ভেঙে ফেলতে এতোটুকু পিছুপা হচ্ছে না বরং স্পর্ধার সঙ্গে রাষ্ট্রব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ করে বসে আছে! বলে রাখা প্রয়োজন, জিয়াউর রহমান পরবর্তী যসময়ে তার ঘর থেকে মনোনীত খালেদা জিয়ার শাসনামলে বাংলাদেশে জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতির যে উত্থান হয়েছিল দেশের জাতীয় পতাকা উড়িয়েছিল কুখ্যাত রাজাকার আলবদরদের মন্ত্রী বানিয়ে, সে সময়ে জামায়াতে ইসলামী যে ক্ষেত্র রচনা করেছিল, তার ধারাবাহিকতা আজকের এই চ্যালেঞ্জের হাতিয়ার হিসেবে কাজ করছে। মজার ব্যাপার হল, জিয়াউর রহমানের বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলে সেই সব লোকজনের মহাসমাবেশ ঘটেছিল, যারা বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বকে চ্যালেঞ্জ করেছিল, ক্ষমতার ভাগাভাগিতে আওয়ামী লীগকে অপছন্দ করেছিল। আরও ছিল রাজনৈতিক কপটতায় বিশ্বাসী তথাকথিত বাম দলের নেতৃবর্গের সঙ্গে সরাসরি মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী পাকিস্তানপন্থি মুসলিম লীগের দোসর সাম্প্রদায়িক মানসিকতায় বিশ্বাসী জামায়াতে ইসলামী। রাতারাতি তথাকথিত সুবিধাবঞ্চিত বুদ্ধিজীবী পত্রিকার সম্পাদক এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদেরও মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী শিবিরে সানন্দে যোগদান করতে দেখা গেছে। আর জেনারেল এরশাদ জাতীয় পার্টি করেছেন তাদেরকে নিয়ে, যারা বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ থেকে রাজনৈতিকভাবে বেরিয়ে গিয়েছিলেন এবং জিয়াউর রহমানের মৃত্যুউত্তর জিয়াউর রহমানের দলে থাকা পূর্বের সুবিধাবাদী সেই চিহ্নিত মানুষগুলো। দীর্ঘ ৮-৯ বছর এরশাদের সামরিক শাসনকালে এদেরকে সুবিধা প্রদান করে এবং এদের পরামর্শক্রমে এরশাদ রাষ্ট্র পরিচালনা করেছিলেন বাংলাদেশ জাতীয় পার্টির চেয়ারপার্সন হয়ে।

স্বাধীন বাংলাদেশ তার পথ চলার শুরুতেই মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথায় জাতির পিতাকে হারিয়ে তার স্বাধীনতাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলেছিল। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, এই ঘটনায় পরবর্তী সময়ে দেশের স্বাভাবিক পথচলা নিশ্চিতভাবেই চরম আকারে বিঘ্নিত হয়েছিল। ভাবতে দ্বিধা নেই যে, এ ধারণাটি সম্মোক পূর্ব উপলব্ধি করতঃ পরিকল্পিতভাবেই এই ঘটনা সম্পাদিত হয়েছে। কেন না, মুক্তিযুদ্ধের অংশীদারিত্বের অধিকারের প্রতি শ্রদ্ধা থাকলে রাষ্ট্রক্ষমতায় বসে জিয়াউর রহমান কেন কুখ্যাত অপরাধী রাজাকার গোলাম আযমকে নাগরিকত্ব প্রদান করলেন এবং ধর্মভিত্তিক সাম্প্রদায়িক রাজনীতিকে এক কথায় মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিরোধী শক্তিকে সমীহভরে কেনই বা নতুন করে রাজনীতি করার সম্পূর্ণ স্বাধীনতা দিলেন? এমন কি, মুক্তিযুদ্ধের মহানায়ক সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নৃশংসভাবে যারা হত্যা করেছিল, সেই কুখ্যাত খুনিদের বিচার করা যাবে না মর্মে যে অধ্যাদেশ জারি করা হয়েছিল, তা থেকে স্পষ্টই একথা বলতে কোনো দ্বিধা থাকে না যে, এই হত্যাকাণ্ডে, হত্যা পরবর্তী সরকারের প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষ সমর্থন ও অংশগ্রহণ রয়েছে।

আরেকটি বিষয় যা এই আলোচনার প্রাসঙ্গিকতা ও ভাবনাকে সমর্থন করে, তা হল- বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদী রাজনীতির ভাবধারায় মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে অটুট না রেখে চূড়ান্ত ডানপন্থিদের সঙ্গে এক আত্মায় রাজনীতি করার দর্শন জেনারেল জিয়াউর রহমান গ্রহণ করেছিলেন। যদিও এ কথা সত্য যে, তার অহংকারের মুক্তিযুদ্ধকে লোভ-লালসা ক্ষমতার মোহে বিসর্জিত করে নিজের পরিচয়ের গর্বকে পদদলিত করে সাম্প্রদায়িক ধর্মীয় দর্শনকে গ্রহণ করেছিলেন। মধ্য ডান-বাম সমন্বিত অসাম্প্রদায়িক ও মুক্তিযুদ্ধ সমর্থক চেতনাকে দলীয় চেতনার রূপ দিয়ে একটি রাজনৈতিক দলের যাত্রা শুরু করার সুযোগ ছিল তার কাছে। কিন্তু তা না করে তিনি মূলত তার নিজের মুক্তিযুদ্ধকালীন ভূমিকাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন। অবশ্য এটাই হওয়ার কথা। সৎ নির্লোভ দেশপ্রেমিক মুক্তিযোদ্ধা যেমন মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন আবার বিপরীতে সুবিধাভোগী ক্ষমতালিপ্সু কিছু সুযোগ সন্ধানীরা গোয়েন্দা চরিত্র ধারণ করে উভয়ের হয়েই কাজ করেছেন । আন্দোলন সফল হলেও তারা ক্ষমতার অধিকারী হবেন আর বিফল হলেও তিনি পুরস্কৃত হবেন। প্রসঙ্গক্রমে যুদ্ধে নানান কৌশল অবলম্বন হতে দেখা যায়। যেমন-

পাকিস্তানিরা যদি সত্যি পরাজিত হয়, তবে পরিকল্পনা বাস্তবায়নে যাদেরকে এজেন্ট হিসেবে মুক্তিযুদ্ধের ভেতর থেকে কাজ করানো সম্ভব হয়েছে এমন ভেবে যে, যদি সত্যিই পাকিস্তানের পরাজয় ঘটে আর বাংলাদেশের জন্মকে কোনোভাবেই ঠেকানো না যায়, সেক্ষেত্রে সেই স্বাধীনতা যেন টেকসই হতে না পারে সে লক্ষ্যে ধূরন্দর পাকিস্তান নব্য বাংলাদেশের জন্ম উত্তর স্বাধীনতার সুফল গ্রহণে স্থায়িত্বতা অর্জন করতে যেন না পারে এবং পুনরায় দ্রুত অভ্যন্তরীণ প্রতিপক্ষ দাঁড় করাতে পারে, সেই পরিকল্পনায় বুদ্ধিভিত্তিক বিবেচনাকে গ্রহণ করে এজেন্ট হিসেবে এমন বেশ কিছু সংখ্যক বিভিন্ন শ্রেণিপেশার লোককে বেছে নিয়েছিলেন পাকিস্তান সেনাবাহিনী, তার মধ্যে এরকম জেনারেলদেরও হয়তো কেউ কেউ ছিলেন তা বলাই যায়। সাড়ে তিন বছরেই প্রভুর প্রতি নজিরবিহীন আস্থা ও বিশ্বাসের পরিচয় দিয়ে পশ্চিমা প্রভুদের নতুন করে সন্তুষ্টি অর্জন করলেন অনায়াসে।

মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটকে কেন্দ্র করে বিশ্বের যেসব শত্রুশক্তি রয়েছে তাদের কাছেও অত্যন্ত যোগ্য বিবেচিত হওয়ায়, যে সময়টুকু পর্যন্ত রাষ্ট্রক্ষমতায় ছিলেন, সে সময়টুকুর সদ্ব্যবহার করে বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে এদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার বিরুদ্ধচারী এমন একটি রাজনৈতিক দলকে পরিপূর্ণরূপে ভবিষ্যৎ স্বাধীনতা হরণে অর্থনৈতিক রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠিত করার কাজটি যথাযথভাবে সম্পূর্ণ করলেন অত্যন্ত চতুরতার সঙ্গে। বলে রাখা প্রয়োজন, জিয়াউর রহমান শাহ আজিজকে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বানিয়েছিলেন, যিনি জাতিসংঘে গিয়ে বাংলাদেশের বিরোধিতা করে পাকিস্তানের সাফাই গেয়েছিল। তিনি একজন চিহ্নিত আলবদর রাজাকার। বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে হুমকির মুখে ফেলা, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে অস্বীকার করা এবং দেশের আপামর মানুষকে পাকিস্তানি ভাবধারায় ফিরিয়ে নেয়ার সব প্রচেষ্টা এবং জোর করে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার যে ভয়ঙ্কর সংস্কৃতি স্বাধীনতাউত্তর বাংলাদেশে তিনি দেখিয়েছিলেন, দুর্ভাগ্যবশত সেই একই পরিণতি তিনি ভোগ করলেন তার দেখানো পথেই তারই বিভাগের কিছু জুনিয়র অফিসারদের কৃত খুনের মতো জঘন্য অপরাধের মধ্য দিয়ে। মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অবদান রাখা সহস্রাধিক সেনাকর্মকর্তা ও জুনিয়র সেনাদের হত্যা করা হয়েছে জেনারেল জিয়ার আমলে।

জেনারেল জিয়াউর রহমানের অধ্যায় শেষ হতেই নতুন করে রাষ্ট্রক্ষমতার দায়িত্ব গ্রহণ করলেন জেনারেল এরশাদ। আবারও সামরিক শাসনের যাত্রাপালা শুরু হল। পূর্ববর্তী সামরিক শাসকের অসমাপ্ত কাজকে সমাপ্ত করার লক্ষ্যে তিনিও জাতীয় পার্টি নামে রাজনৈতিক দল গঠন করলেন। জাতীয়তাবাদের ভিত্তিও তিনি পূর্ববর্তী জেনারেলকে সমর্থন করে অবসরপ্রাপ্ত কিছু সামরিক কর্মকর্তা, আওয়ামী লীগ থেকে কিছু নেতা এবং বিএনপি থেকে কিছু নেতাকে দলে ভিড়িয়ে নানান সুযোগ-সুবিধা প্রদানের মধ্য দিয়ে জাতীয় পার্টির জন্ম দিলেন। মুক্তিযুদ্ধকালীন বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনার সৌন্দর্য ধর্মনিরপেক্ষতাকে চিরতরে বিদায় করার লক্ষ্যে জেনারেল এরশাদ সংবিধানকে পরিবর্তন করে রাষ্ট্রধর্ম ইসলামকে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করলেন।

রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম গ্রহণ করে মূল সংবিধানের শুধু অবমাননাই করেননি বরং সাম্প্রদায়িক মনস্তত্ত্বকে রাষ্ট্রের মনস্তত্ত্বে পরিণত করার হীনচেষ্টার মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে চিরতরে বিদায় করার জন্য স্থায়ী বন্দোবস্ত করে বাঙালি জাতীয়তাবাদকে মুছে ফেলার নীলনকশা বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে জেনারেল জিয়ার অসমাপ্ত কাজকে সমাপ্ত করলেন। তখনকার বাংলাদেশে জনসংখ্যার বেশিরভাগ মুসলিম অধ্যুষিত হওয়ায় তিনি খুব চতুরতার সঙ্গে রাষ্ট্রধর্মকে ইসলাম করে মুসলমানদেরকে যেমন বোকা বানিয়ে তাদের নেতা হওয়ার চেষ্টা করেছিলেন, একই সঙ্গে পাকিস্তানের স্বার্থ হাসিলের কাজটিও করেছেন সমভাবে। কেন না জনসংখ্যার আধিক্য অনুযায়ী ইসলাম অনুসারী মানুষের সংখ্যা দিন দিন যতটা বৃদ্ধি পাবে পক্ষান্তরে অন্যান্য ধর্মাবলম্বী জাতিগোষ্ঠীর মানুষের সংখ্যা তুলনামূলকভাবে কমতে থাকবে এটি তিনি খুব পরিষ্কারভাবেই বুঝতে পেরেছিলেন। ফলে তিনি থাকেন বা না থাকেন, তার পরে যারাই রাষ্ট্রক্ষমতায় আসুন না কেন ভোটের গণতন্ত্রকে মাথায় রেখে পরিপূর্ণরূপে পুরনো সংবিধানে আর ফিরে যাওয়া সম্ভব হবে না। আর সেটা তিনি পূর্ণরূপে অনুধাবন করেই রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানে সংযোজন করেছিলেন। যদিও রাষ্ট্রের নিজস্ব কোনো ধর্ম থাকবার অনিবার্যতা আছে বলে জোরালো কোনো অভিমত তুলে ধরা সম্ভব নয়। যখনই বিশেষ কোনো ধর্মকে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে গ্রহণ করা হয়, সঙ্গত কারণেই সে রাষ্ট্রে বসবাসকারী অন্য ধর্মাবলম্বীদের ক্ষেত্রে একটি আঘাত অনুভূত হয়। খুব গভীরভাবে চিন্তা করলে যা অন্য ধর্মের অনুসারীদের অনুভূতিতে চরমভাবে আঘাত করার সমতুল্য। অর্থাৎ রাষ্ট্র নিজেই শুধুমাত্র একটি ধর্মকে তার ধর্ম হিসেবে গ্রহণ করতে গিয়ে অন্য ধর্মের অনুভূতিতে আঘাত করছে, যৌক্তিক বিচারে সেটি বলা ভুল হবে না।

সাম্প্রদায়িক মনন, শোষণ, শাসন, অন্যায় অবিচার অন্যায্যতার বিরুদ্ধে সাম্যতা, সামাজিক সুবিচার, ধর্মনিরপেক্ষতা, ভাষা ও সংস্কৃতি ভিত্তিক জাতীয়তার সমন্বিত নির্যাসকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ধারণ করে বাঙালি জাতি বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে একই বাসনা অনুভব করে যে অভূতপূর্ব সাড়া দিয়েছিল, এরই সুফল হিসেবে বাংলাদেশের জন্ম হয়েছিল। অর্থাৎ বাঙালি জাতীয়তাবাদ মুক্তিযুদ্ধের সমার্থক, পরিপূরক এবং প্রগতিশীল। অপরদিকে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ সম্পূর্ণরূপে বিপরীতমুখী এবং চরিত্রে চরম প্রতিক্রিয়াশীলতা বিদ্যমান।

৭৫ পরবর্তী সময়টা বাংলাদেশের রাষ্ট্র ব্যবস্থায় সামরিক শাসন অব্যাহত থাকায় জনমনে এক অনিশ্চিত আশঙ্কা তৈরি হতে থাকল। স্বৈরশাসন থেকে মুক্ত হওয়ার পথ খুঁজতে শুরু করল মুক্তমনা ছাত্র, শিক্ষক, জনতা থেকে শুরু করে রাজনৈতিক নেতৃবর্গ সবাই। আওয়ামী লীগের কাণ্ডারি হিসেবে ইতোমধ্যে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা নিজের দলের নেতাকর্মীদেরকে বেশ খানিকটা গুছিয়ে ফেলেছিলেন। এমনকি, জিয়াউর রহমান উত্তর বিএনপির রাজনীতিতে বেগম জিয়াও তার দলকে এরশাদ হটাও আন্দোলনে প্রস্তুতির কাজটি বেশ ভালোভাবেই সম্পাদন করেছিলেন। অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলো প্রেক্ষাপটের পরিবর্তনে কেউ কেউ সরাসরি আবার কেউ কেউ মনস্তাত্ত্বিক সমর্থন দিতে থাকলে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে এক ধরনের ঐক্য তৈরি হতে থাকে। রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম করায় ও সামরিক ক্ষমতা জেনারেল এরশাদের হাতে থাকায় স্বৈরশাসনের অবসান ঘটানোর কাজটি মোটেও সহজ ছিল না। বলে রাখা প্রয়োজন, সমন্বিত এই আন্দোলনে প্রধানতম নেতৃত্ব প্রদানকারী দল জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ এবং যুগপথ অবলম্বন করে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপি সেই সঙ্গে অন্যদের সমর্থন। বাঙালির প্রতিটি বড় বড় অর্জনে রক্ত ঝরানোর ইতিহাস যেন খুব স্বাভাবিক চিত্র। আর ৯০’র এ গণআন্দোলনেও তার ব্যতিক্রম হয়নি মোটেও। স্বৈরশাসকের অত্যাচার নির্যাতনের মাত্রা ও তার প্রয়োগে তেমন কোনো বাছবিচার ছিল না। ডা. মিলন এবং মেহনতী বীর নূর হোসেনের রক্তস্রোতের মধ্য দিয়ে গণতন্ত্রকামী গণআন্দোলন সফল হয় স্বৈরাচার জেনারেল এরশাদ সরকারের পতনের মধ্য দিয়ে।

ভাগ্যের পরিহাস ‘খায় দায় কছিমুদ্দিন, মোটা হয় জব্বার’। ৭৫ পরবর্তী জিয়াউর রহমান এবং এরশাদের শাসনের মধ্য দিয়ে বাঙালির নাগরিকচিত্তে যে পচন ধরেছিল তারই বহিঃপ্রকাশ ঘটল ৯১ নির্বাচনে। স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে আওয়ামী লীগ নেত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা জীবন বাজি রেখে যে সাহসী ভূমিকা পালন করেছিলেন, সেই আন্দোলনের ফসল আওয়ামী লীগের ঘরে না এসে চলে যায় বিএনপির ঘরে। রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয় খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপি সরকার। সঙ্গত কারণেই রাষ্ট্র পরিচালনায় বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের নতুন নতুন মাত্রা প্রকাশিত হতে থাকে। বিএনপি-জামায়াতের সখ্যতা বৃদ্ধি পেতে থাকে চোখে পড়ার মতো। যেন কেউ ছাড়া কেউ নয়। কোনো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সংস্কৃতি অবরুদ্ধ হতে থাকলে লোক দেখানো কিছু উন্নয়ন কর্মকাণ্ড সম্পন্ন করা গেলেও গণতন্ত্রের চর্চা করা সম্ভব নয়। কেন না সাম্প্রদায়িক চেতনায় ভর করে কেবলই নতুন মাত্রার স্বৈরশাসন কিংবা সাম্প্রদায়িক শাসন ব্যবস্থা পরিচালনা করা সম্ভব। মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া কুখ্যাত রাজাকার গোলাম আযমকে নাগরিকত্ব প্রদান করে বহালতবিয়তে পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশে এনে জামায়াতি ইসলামের রাজনীতিকেই চাঙ্গা করতে থাকলেন। পরামর্শকদের ভুল পরামর্শ গ্রহণ করে বুঝে কিংবা না বুঝে তিনি খাল কেটে কুমির আনলেন। ক্ষমতার উচ্চাভিলাসের পরিবর্তে রাজনীতিকেই তিনি যদি উত্তম আদর্শ হিসেবে বেছে নিতে পারতেন, তাহলে মধ্য ডানপন্থি অবস্থানকে ক্ষমতা এবং রাজনীতির সংমিশ্রণে জামায়াতকে সাইড লাইনে রেখেই নিজের দলের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ অনেক বেশি সুসংগঠিত করবার সুযোগ ছিল সে সময়ের সার্বিক প্রেক্ষাপটে। মূলত সাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদের কৃষ্ণগহ্বরে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের প্রবেশকে তিনি অবলীলায় উৎসাহিত করতে থাকলেন। জামায়াত বিএনপি হয়ে যাবে এমন ধারণা পরামর্শকরা তাকে দিয়ে থাকলেও কোনো পরামর্শক তাকে এমন কোনো সুপরামর্শ দিয়েছিলেন কিনা যে এ প্রক্রিয়ায় বিএনপি পর্যায়ক্রমে জামায়াতে পরিণত হবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এ বক্তব্যের যথার্থতা স্পষ্ট হবে দ্বিতীয়বার তার ক্ষমতা গ্রহণ উত্তর কার্যকলাপের বিশ্লেষণে।

বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা তাঁর বলিষ্ঠ নেতৃত্বগুনে প্রবল আন্দোলনের মধ্যদিয়ে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন ২০০৮ এ জয়লাভ করে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপরিচালনায় এলে স্বাভাবিকভাবেই প্রথম প্রহর কেটে যায় দেশকে দীর্ঘদিনের স্বৈরাচারী অপশাসনের কলুষতা থেকে মুক্ত করতে। সমাজের সব স্তরে চলমান মানসিক দৈন্যতা, দেশীয় সম্পদের অপব্যবহার, অর্থপাচার, অপশাসন ইত্যাদির বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থানে থেকে একটু একটু করে দেশটাকে পুনরায় গুছিয়ে নিতে যত্নবান হয় আওয়ামী লীগ সরকার। ধীরে ধীরে স্বমহিমায় ফিরতে থাকে বাংলাদেশ। সাধারণ জনতা পুনরায় সেই আস্থা ফিরে পায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পরিচালিত আওয়ামী লীগ সরকারের মাধ্যমে। একের পর এক উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নিয়ে বহির্দেশীয় আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ধারাবাহিক উন্নয়নের দ্বারা বিশ্বদরবারে বাংলাদেশকে একটি শক্ত অবস্থানে দাঁড় করাতে তিনি সক্ষম হয়েছেন। জনগণের আস্থা লাভের ফলস্বরূপ ধারাবাহিকভাবে আওয়ামী লীগ সরকার বর্তমান সময় পর্যন্ত রাষ্ট্রপরিচালনা করে চলেছে। অর্থ বাণিজ্য, উৎপাদন, চিকিৎসা, মানবাধিকার, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ইত্যাদি সব খাতেই একটি দৃশ্যমান উন্নতি পরিলক্ষিত হয়েছে, এই কথা বলাই বাহুল্য। মুক্তিযুদ্ধের মানবতাবিরোধী নরপশুদের বিচার চলমান ধারায় অক্ষুণ্ণ রয়েছে। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীরা রেহাই পায়নি। সগৌরবে স্থাপিত হয়েছে রামপাল পারমানবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও সম্প্রসারিত হয়েছে উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা। কৃষিখাতে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় প্রযুক্তির ব্যবহারে উৎপাদন বেড়েছে। কলকারখানা স্থাপিত হয়েছে। আজ সগর্বে দাঁড়িয়ে আছে পদ্মা সেতু।

উন্নয়নের কথা বলতে গেলে বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের প্রাপ্তির শেষ নেই। কিন্তু, সত্যিকার অর্থে শুধুমাত্র এই অবকাঠামোগত উন্নয়ন একটি সুপ্রাচীন জনপদের জাতীয়তাবোধ সুরক্ষার জন্য যথেষ্ঠ নয়। এই সব উন্নয়নের সমান্তরালে যদি বাংলাদেশের জাতীয়তাবাদের মূল তত্ত্ব বঙ্গবন্ধুর সেই সংস্কৃতিনির্ভর অসাম্প্রদায়িক চেতনার আদর্শকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা যেত, তাহলে আজ এভাবে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব হুমকির মুখে পড়ার আতঙ্ক অনুভব হতো না। আজ স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে দাঁড়িয়ে সেই অপশক্তি বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি ভাঙার স্পর্ধা দেখায়। পৃক্ষাগৃহে বোমা বিস্ফোরণ হয়, রমনার বটমূলে গ্রেনেড হামলা হয়, প্রকাশ্যে বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করা হয়। বাঙালির আবহমানকালের উৎসব নববর্ষবরণকে প্রশ্নবিদ্ধ করার ধৃষ্টতা দেখায় তারা। তাদের এই দুঃসাহসের পিছনে আভ্যন্তরীণ মদতদাতারা যেমন আছে, তেমনি বিদেশি সুযোগসন্ধানী কূটনীতির প্রভাবও অস্বীকার করা যায় না। বলা বাহুল্য, বিগত সময়ে দেশে যে পরিমাণ মসজিদ, মাদ্রাসা নির্মিত হয়েছে, সেই অনুপাতে এক শতাংশও সাংস্কৃতিক কর্মশালার আয়োজন করা হয় নি। এই চরম রাষ্ট্রীয় উদাসীনতা দেশের মূল জাতীয়তাবাদের ধারাকে ক্ষীণকায় করতে করতে আজ প্রায় নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছে।

স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপরিচালনার সামগ্রিক ইতিহাসের সার্বিক বিশ্লেষণের মাধ্যমে যে চিত্রটি ফুঁটে ওঠে, তার কিছু কিছু অংশ যেমন আলোকিত রৌদ্রজ্জ্বল, তেমনি ঈশান কোনে কালো মেঘের ঘনঘটাও ততটাই স্পষ্ট প্রতীয়মান হয়। আশ্চর্যজনকভাবে সেই স্বাধীনতাবিরোধী অশুভ শক্তিগুলো বিগত সময়ে আরও বেশি সংঘবদ্ধ হয়েছে। বিভিন্ন সময়ে রাজনৈতিক প্রয়োজনে বিদেশি কূটনীতির প্রভাবে বাংলাদেশের বিভিন্ন ক্ষমতাসীন সরকারের মদতেই তারা আজ এতটা শক্তিশালী। আমাদের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে বারবার সেই সব বিদেশী প্রভুদের দারস্থ হওয়াটাকে জাতীয় চর্চায় পরিণত করতে দ্বিধা বোধ করেন নি ক্ষমতার প্রলোভনে। অথচ, সুনিপুন ভাবে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় নিজস্ব স্বার্থ ছাড়া কেউই কখনো উদারচিত্তে বাংলাদেশের মতো ছোট কিন্তু উন্নয়নশীল রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতা করেনি। প্রাচ্যের দেশগুলো বরাবরই আমাদের বিষয়ে মাত্রাতিরিক্ত প্রতিক্রিয়াশীল এবং বলতে দ্বিধা নেই, সেই সুযোগ বারবার আমরাই তাদের করে দিয়েছি। ব্রিটিশ ও আমেরিকা গণতন্ত্রের কথা ভেবে কোনো দেশকে সুশাসনের পথে নিয়ে এসেছে এমন উদাহরণ বোধ করি কোনো উন্মাদও দেখাতে পারবে না। অথচ, বারবার নির্বাচনের মতো একটি অন্যতম প্রধান অভ্যন্তরীণ জাতীয়তাবাদ সংশ্লিষ্ট কার্যক্রমে তাদেরকেই আমাদের দন্ডমুন্ডের প্রভু বানিয়ে রাখি, যারা কি না আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধে সরাসরি শত্রপক্ষকে সমর্থন ও সাহায্য করেছিল। এদিকে তাদেরই সামরিক আগ্রাসনে একের পর এক কত দেশ চোখের সামনে ধ্বংস হয়েছে সাম্প্রতিক সময়েও। রাজনীতির নামে এই সার্বভৌমত্ব ধ্বংসের খেলায় মেতে আমাদের মধ্যে অনেকেই বুঝেসুজেই আজ নিজেদের অস্তিত্বকেই বিসর্জন দিতে উদগ্রীব হয়ে আছি।

অবিলম্বে বন্ধ হোক এই আত্মঘাতী প্রহসন। দেশের সবচেয়ে বড় চেতনার জায়গায়, সবচেয়ে বড় গৌরবের স্তম্ভে আঘাত করে ক্ষমতায় গিয়ে কী হবে? দাবানলের দহন থেকে তৃণলতাও কিন্তু রেহাই পায় না। দেশের সুপ্রাচীন ঐতিহ্যের বহমানতাকে অক্ষুণ্ণ রেখে একটি ধর্মনিরপেক্ষ ও সংস্কৃতিপ্রধান জাতীয়তাবাদই বাংলাদেশের স্থায়িত্বের অন্যতম প্রধান ভিত্তি। মৌলবাদী অপশক্তিকে পরিহার করে দেশের অস্তিত্বরক্ষার আন্দোলনে দলমত নির্বিশেষে সব শ্রেণির মানুষকে এখনই একতাবদ্ধ না করতে পারলে অচিরেই হয়তো সেই পশ্চিমা পরাশক্তির কাছে মাথা নত করে তাদের সরাসরি দাসত্ব স্বীকার করেই টিকে থাকতে হবে আমাদের। সেই দিন কিন্তু সরকার বা বিরোধী দল সবাই প্রকৃতপক্ষে ক্ষমতাহীন ক্লীব হয়েই থাকতে হবে। হাজার বছরের বাঙালি সভ্যতার অস্তিত্বরক্ষার এই দায় এককভাবে কোনো সরকারের নয়, বরং সমগ্র বাঙালি জাতির। তাই সেই ৫২’র মতো, ৭১’র মতো আমাদের আবার একটি সুনির্দিষ্ট জাতীয়তাবাদী চেতনায় একতাবদ্ধ হতে হবে। নিঃসন্দেহে সেই চেতনা হতে হবে আবহমান কালের বাঙালি ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সাধারণ মানুষের সমঅধিকার প্রতিষ্ঠা করার আদর্শে অনুপ্রাণিত বঙ্গবন্ধুর সেই আলোকিত পথের চেতনা। তাই এবারের সংগ্রাম হোক প্রকৃত বাঙালি জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম হোক চিরস্থায়ী সার্বভৌমত্ব রক্ষার সংগ্রাম।

লেখক: পুলিশ সুপার ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ।

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :