বিষণ্ণতা থেকে আত্মহত্যা যেভাবে ঠেকাবেন

ফিচার ডেস্ক, ঢাকাটাইমস
| আপডেট : ১০ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১১:৩৬ | প্রকাশিত : ১০ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১১:০৯

মৃত্যু একটি অবধারিত সত্য। পৃথিবীর বুকে জন্ম নেওয়া প্রতিটি প্রাণীকেই মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে হবে। তাই বলে আত্মহত্যার মধ্য দিয়ে প্রাণ বিসর্জন কোনো মতেই কাম্য নয়। আজ ১০ সেপ্টেম্বর, রোববার ‘বিশ্ব আত্মহত্যা প্রতিরোধ দিবস’। বিশ্বের অন্যান্য দেশের সঙ্গে বাংলাদেশেও নানা আয়োজনে পালিত হচ্ছে দিবসটি। এবারে দিবসটির প্রতিপাদ্য ‘কর্মের মাধ্যমে আশা তৈরি কর’।

আত্মহত্যা ইচ্ছাকৃতভাবে নিজের জীবন বিসর্জন দেয়া বা স্বেচ্ছায় নিজের প্রাণনাশের প্রক্রিয়াবিশেষ। ল্যাটিন ভাষায় সুই সেইডেয়ার থেকে আত্মহত্যা শব্দটি এসেছে, যার অর্থ হচ্ছে নিজেকে হত্যা করা। আক্ষরিক অর্থে মৃত্যুতে জীবনের মুক্তি নয়। জীবনে মুক্তিলাভ নানা ভাবে সম্ভব। 'আমার দ্বারা কিছু হবে না' বা 'এ জীবনে আমার আর পাওয়ার কিছু নেই', 'এভাবে বেঁচে থেকে লাভ কি'... এসব থেকেই আসে আত্মহত্যার প্রবণতা। চিকিৎসা পরিভাষায় যা মানসিক অবসাদের কারণ হিসেবেই চিহ্নিত হয়। প্রতি বছর বিশ্বে প্রায় দশ লক্ষ মানুষ আত্মহত্যা করেন। হু ( বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা) এর মতে প্রতি বছর যত মানুষের ম়ত্যু হয় তার মধ্যে অন্যতম প্রধান কারণ আত্মহত্যা।

বিষন্নতা, হতাশা ও একাকিত্ব জীবনবোধে আত্মহননের চিন্তা নিয়ে আসে। এদের প্রভাবে জীবন হয়ে উঠতে পারে লক্ষ্যহীন ও অর্থহীন। চিরচেনা চলার পথ হয়ে পড়ে অপাঙ্ক্তেয়। প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির দোলাচলে জীবন ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করে। নিজেকে অপ্রয়োজনীয় ভাবার বোধ কাজ করে। আশাহত, একাগ্রতা, ব্যক্তিগত, সামাজিক, পারিবারিক, অর্থনৈতিক জীবনের বিভিন্ন অংশকে মূল্যহীন করে তোলে। পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য অকল্যাণকর এমন ঘটনা এখন নিত্যনৈমিত্তিক হয়ে দাঁড়িয়েছে। ঘুরে দাঁড়ানোর পৃথিবীতে নিজেকে নিয়ে ভাবার তখন অবশিষ্ট থাকে না। সামাজিক রীতিনীতি, চাপ মানুষের হতাশাকে বহুগুণে বাড়িয়ে দেয়। এ থেকে মুক্তি পেতে মানুষ তখন আত্মহননের পথ বেছে নেয়।

বিষন্নতা আত্মহত্যার জন্য অন্যতম ঝুঁকিপূর্ণ মানসিক রোগ। গবেষকরা বলছেন, গুরুতর বিষণ্ণতা বা মেজর ডিপ্রেসিভ ডিসঅর্ডার—এ আক্রান্ত ব্যক্তিদের ১৫ শতাংশই আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। বিষণ্ণতা রোগে আক্রান্তরা দিনের পর দিন অধিকাংশ সময়ই মন খারাপ করে থাকেন, কোন কাজে উৎসাহ—মনোযোগ পান না, ঘুম-খাওয়ার রুচি-উদ্যম-গতি কমে যায়। পরবর্তীতে তা তীব্র আকার ধারণ করলে আক্রান্তরা নিজেদের জীবনকে নিরর্থক ও বোঝা মনে করতে থাকেন, সমাজ থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখেন, প্রতিনিয়ত আত্মঘাতী চিন্তায় মন আচ্ছন্ন হতে থাকে। সঠিক সময়ে সঠিক চিকিৎসা না করালে এদের অনেকেই নির্মম সিদ্ধান্তের পরিণতি ঘটান।

পারিবারিক নির্যাতন, কলহ, শারীরিক-মানসিক নির্যাতন, পরীক্ষা-প্রেমে ব্যর্থতা, দারিদ্র্য, বেকারত্ব, প্রাত্যহিক জীবনের অস্থিরতা, নৈতিক অবক্ষয় ও মাদক ইত্যাদি কারণে মানুষ আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিবেদন মোতাবেক প্রতি বছর বিশ্বে ৮ লাখেরও বেশি মানুষ আত্মহত্যা করে। প্রতি ৪০ সেকেন্ডে একজন মানুষ আত্মহত্যা করে। এছাড়া এর প্রায় ১৫ থেকে ২০ গুণ মানুষ আত্মহত্যার চেষ্টা চালিয়ে ব্যর্থ হয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিবেদন অনুযায়ী, আত্মহত্যা প্রবণতার ক্ষেত্রে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান দশম। বাংলাদেশে প্রতি বছর কমপক্ষে ১৩ হাজার থেকে ৬৪ হাজার মানুষ আত্মহত্যা করে।

বিভিন্ন দেশের মানুষের মধ্যেই আত্মহত্যার প্রবণতা দেখা যায়। ছেলেদের তুলনায় মেয়েদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা আমাদের দেশে বেশি দেখা যায়। এর মধ্যে আবার গ্রামের মেয়েরা শহরের মেয়েদের তুলনায় এই দিকে বেশি ঝুঁকে পড়ছে।

বিবাহিত মেয়েদের আত্মহত্যার ক্ষেত্রে অনেক সময় খবর রটেছে যে, তাতে পরিবার কিংবা স্বামীর ইন্ধন বা প্রত্যক্ষ ভূমিকা ছিল। সময় পরিবর্তনের সাথে সাথে আত্মহত্যার ধরনেও এসেছে পরিবর্তন। আগে মেয়েদের ক্ষেত্রে অধিকাংশই ইভ টিজিং, যৌতুকের চাপ, অভাব, হতাশা, পারিবারিক কিংবা সামাজিক নির্যাতনের মতো ঘটনায় আত্মহত্যার পথে এগোত। হয়তো তারা ভাবত এটাই মুক্তির একমাত্র পথ। আর ছেলেদের বেলায় প্রেমে ব্যর্থতা, অভিমান, নেশাগ্রস্ততা কিংবা জীবনের দায়ভার নেওয়ার সাহস না থাকাটাই হয়ে দাঁড়াত আত্মহত্যার কারণ।

সামাজিক এবং অবস্থানগত কারনের উপর নির্ভর করে আত্মহত্যার প্রবণতা। একাকিত্ব, আর্থিক সমস্যা এবং সমাজের নানাবিধ চাপে অবসাদে ভোগেন এরকম মানুষের সংখ্যা নেহাত কম নয়। পড়াশোনা করা সত্ত্বেও যোগ্য ব্যক্তি তাঁর উপযুক্ত চাকরি পাচ্ছেন না, ব্যক্তিগত জীবনে অশান্তির জের, কর্মক্ষেত্রে হেনস্থা ইত্যাদি নানা কারণ থেকে মানুষ আত্মহত্যার চেষ্টা করেন। ইদানিং বয়স্কদের মধ্যেও একাকিত্ব থেকে আত্মহত্যার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। এমনও বহু মানুষ আছেন যাঁদের পরিবারে আত্মহত্যার প্রবণতা একধরনের অসুখ। সেখান থেকেও কারণে অকারণে লোকজন আত্মহননের দিকে এগোয়।

জীবনটা আসলে অনেক বড়। অনেক কিছু করার থাকে। অনেক কিছু জানার থাকে। সোশ্যাল নেটওয়ার্কের বাইরেও একটা জগত থাকে। কথা বলুন। অনেক বেশি করে মিশতে হবে সবার সঙ্গে। ভার্চুয়াল বন্ধুদের সঙ্গে আপনি চ্যাট করতে পারবেন। হয়তো মেন্টাল সার্পোটও পাবেন। তবে আপনার পাশেরজন যেভাবে আপনার সঙ্গে থাকবে সেইভাবে নয়।

পছন্দের কাজ করুন। তার মধ্যেই আনন্দ খুঁজে নিন। একপ্রকার জোর করেই তা করতে হবে। নিজেকে বলতে হবে আমি ভালো থাকবো। আপনার চারপাশে এরকম অনেক মানুষ পাবেন যাঁরা সত্যিই সমস্যার মধ্যে রয়েছেন। অনেক বেশি খারাপ রয়েছেন। সেখান থেকে অনুপ্রেরণা নিন।

পছন্দের মানুষজনের সঙ্গে মিশুন। যোগাযোগ রাখুন। পারিবারিক অনুষ্ঠানে থাকার চেষ্টা করুন। নিজের মতো করে মানিয়ে নেওয়া অভ্যেস করুন।

সাফল্য-ব্যর্থতা, ভালো থাকা-মন্দ থাকা এগুলো জীবনের অঙ্গ। ঘুরে ফিরে সবই আসে। সময়ের উপর ধৈর্য রাখুন। আজ না হলে কাল সাফল্য আসবেই। ভালো কিছু হতে কখনও হয়তো সময় লাগে। কারোর ক্ষেত্রে তাড়াতাড়ি, কারো দেরীতে আসে। কিন্তু আসে।

মনের কথা খুলে বলুন। সে বাবা-মা, বন্ধু স্থানীয়, আত্মীয় যে কেউ হতে পারে। একান্ত না পারলে মনোবিদের কাছে যান। তাঁকে আপনার সমস্যার কথা খুলে বললে তিনি আপনাকে সমাধানের পথ দেখাতে পারবেন।

আমি ভালো থাকতে চাই। আমার ভালো থাকা কেউ আটকাতে পারবে না। এই কথাটি মন্ত্রের মতো জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে নিন।

কাউন্সেলিং চিকিৎসার একটা অংশ। আপনাকে কাউন্সেলারের কাছে যাওয়ার পরামর্শ কেউ দিলে তাকে ভুল বুঝবেন না। আমি তো মানসিক রোগী নই.. কেন যাবো.. এ ধরনের প্রশ্ন ভাবনায় আনবেন না।

হয়তো শুনতে খুব বোকা বোকা লাগবে , কিন্তু যদি কখনও মনে হয় একবার সুইসাইড করে দেখি কেমন লাগে তার আগে হোমওয়ার্ক হিসেবে ইউটিউবে 'হেমলক সোসাইটি' দেখে নিতে পারেন।

সফলতার মতো ব্যর্থতাকেও মেনে নেওয়ার মানসিকতা তৈরি করতে হবে। পারিবারিক বন্ধনগুলো আরও সুদৃঢ় করতে হবে এবং পরিবারে প্রত্যেকের সঙ্গে গুণগত সময় কাটাতে হবে। সহানুভূতি আর ভালোবাসাই পারে একজনকে ভালো রাখতে।

মনকে বিষন্ন করে বা মানসিক চাপ বাড়িয়ে তোলে এমন কথা বা কাজ এড়িয়ে চলতে হবে।

বিষণ্ণতার সময়ে বড় কোন সিদ্ধান্ত নেয়া থেকে যথাসম্ভব বিরত থাকতে হবে। নিয়মিত ব্যায়াম বা শরীরচর্চা করুন। সুষম, স্বাস্থ্যসম্মত খাবার গ্রহণ করুন। পর্যাপ্ত সময় ঘুমাতে হবে, তবে বেশী ঘুম নয়।

সুস্থ-স্বাভাবিক সম্পর্কগুলোর চর্চা করতে হবে। মাদকাসক্তি থেকে দূরে থাকুন। রুটিনমাফিক শৃংখলাপূর্ণ জীবনযাপন করুন।

বিষণ্ণতা ব্যক্তির কর্মক্ষমতাকে বাধাগ্রস্ত বা নষ্ট করে দেয় বলে তা সামগ্রিকভাবে সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও উৎপাদনশীলতার উপরও বিরূপ প্রভাব ফেলে।

মাদকাসক্তি, বিষন্নতা, সিজোফ্রেনিয়াসহ সব মানসিক সমস্যা বা রোগের দ্রুত শনাক্ত করা ও সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে।

(ঢাকাটাইমস/১০ সেপ্টেম্বর/আরজেড)

সংবাদটি শেয়ার করুন

ফিচার বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

ফিচার এর সর্বশেষ

এই বিভাগের সব খবর

শিরোনাম :