সীমান্তে বাংলাদেশ-ভারতের নাগরিকদের অনন্য মেলবন্ধন

মো. হোসেন আলী, সাতক্ষীরা
 | প্রকাশিত : ০৬ ডিসেম্বর ২০২৩, ২১:০২

সাতক্ষীরা সদরের ভোমরা স্থলবন্দর থেকে ১০ কিলোমিটার দূরে বাংলাদেশ সীমান্তে ইছামতি নদীর তীরে অবস্থিত হাড়দ্দাহ গ্রাম। গ্রামটিতে বসবাস করে বাংলাদেশি ২০টি পরিবার।

অপরদিকে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের উত্তর ২৪ পরগনা সীমান্তে পানিতর গ্রামে ভারতীয় ২০ পরিবার বসবাস করেন। মূলত বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তের আন্তর্জাতিক মেইন সীমানা পিলার-১ এর পাশে এর অবস্থান। গ্রামের মধ্য রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন বাংলাদেশ ও ভারতের সীমানা রেখা। ভারতের পানিতর গ্রাম ও সাতক্ষীরার ভোমরা স্থলবন্দর সংলগ্ন হাড়দ্দাহ গ্রামের বাসিন্দারা প্রায় ১৮ বিঘা জায়গা জুড়ে বসবাস করছেন দুই দেশের সীমান্তবর্তী এই জায়গাটিতে। সব কিছুর ঊর্ধ্বে সেখানে সম্প্রীতি-সৌহার্দ্য। মানচিত্রে সীমারেখা ভিন্ন হলেও এই জনপদের দুই দেশের নাগরিকদের মধ্যে নেই কোন ভেদাভেদ।

সরেজমিনে দেখা গেছে, যেদিকে বাংলাদেশি নাগরিকের বসতবাড়ি ঠিক তার উঠানে রয়েছে ভারতীয়দের বসতঘর। বিকাল গড়ালে বাংলাদেশি ও ভারতীয় শিশুরা খেলছেন একই মাঠে, শৈশবে মেতে উঠছেন সীমান্ত নদী ইছামতিতে, গাইছেন যে যার ভাষাতে। নিজেদের অভিব্যক্তি প্রকাশ করছেন নিজ দেশের অঙ্গভঙ্গি দিয়ে। ভাষার ভিন্নতা থাকলেও তারা উভয়ে উভয়ের মনোভাব বুঝতে অভ্যস্ত হয়ে গেছেন।

স্থানীয় সূত্র জানায়, শুরুর দিকে বাংলাদেশি ১৫টি পরিবার ও ভারতীয় ১৫টি পরিবার এখানে বসবাস শুরু করলেও বর্তমান দুই দেশের প্রায় ৪০টি পরিবার এক সঙ্গে বসবাস করছেন। দেশ বিভক্তির পর থেকে বসতিদের মধ্যে সীমানার বিভক্তিকরণের সূচনা হয়। বাংলাদেশের জাতীয় পরিচয়পত্র পদ্ধতি চালু হওয়ার আগে এই জনপদে ভারতীয় ও বাংলাদেশিদের মধ্যে বিবাহবন্ধনের মধ্য দিয়ে সর্ম্পক্য স্থাপন হলেও বর্তমানে সেটি আর হয় না। দেশের আইনসহ নানা প্রতিবন্ধকতার কারণে এখন নিজেদের মধ্যে আত্মীয়তার বন্ধন তৈরির সুযোগ কমেছে। বাংলাদেশি নাগরিকের ঘর থেকে ভারতীয়দের ঘরে যেতে সময় লাগে কয়েক সেকেন্ড। দূরত্বটা কয়েক সেকেন্ডের হলেও তাদের মধ্যে গড়ে উঠেছে দুই বাংলার এক অনন্যা মেলবন্ধন।

স্থানীয় বাংলাদেশ ও ভারতের বাসিন্দাদের যৌথ উদ্যোগে তৈরিকৃত পানিতর জামে মসজিদের ঈমাম আলহাজ্ব মাওলানা আব্দুল আজিজ। তিনি ভারতের বশিরহাট উত্তর ২৪ পরগনার বাসিন্দা। তিন বছর মসজিদটির ঈমামের দায়িত্বে রয়েছেন তিনি। দুই দেশের সকলে মিলে তার বেতন-ভাতা দিয়ে থাকেন।

ঢাকা টাইমসের সঙ্গে আলাপকালে ঈমাম মাওলানা আব্দুল আজিজ বলেন, বশিরহাট থেকে আরও ৩০ কিলোমিটার ভেতরে আমার বাড়ি। তিন বছর যাবত সীমান্তবর্তী এই মসজিদটির দায়িত্বে রয়েছি আমি। মসজিদটি একটি স্পর্শকাতর স্থানে অবস্থিত, এখানে উভয় দেশের সীমান্তবর্তী এলাকা। এই মহল্লায় দু'দেশের মানুষ একসঙ্গে বসবাস করে শান্তিপূর্ণভাবে। নামাজের সময় হলে দু'দেশের মানুষ কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে এক কাতারে দাঁড়িয়ে এখানে নামাজ আদায় করেন।

তিনি আরও বলেন, আমার তিন বেলার খাবার ও বেতন দু'দেশের বাসিন্দারা মিলেমিশে বহন করে। দুই বাংলার মানুষের মধ্যে সম্প্রীতি-সৌহার্দ্যে বোঝার উপায় নেই তাদের মানচিত্র ভিন্ন। তাছাড়া দুই দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিবি ও বিএসএফ সব সময় সার্বিক বিষয়ে সহযোগিতা করে থাকেন।

বাংলাদেশের হাড়দ্দহা গ্রামের কিশোর আরিফ হোসেন ঢাকা টাইমসকে বলেন, বিকাল গড়ালে ইছামতি নদীর তীরবর্তী মাঠে ভারতীয় ও বাংলাদেশিরা একত্রে খেলাধুলা করি। তখন দেশ ও সংস্কৃতি ভুলে আমরা একে অন্যের সাথে সৌহার্দপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলি। যখন ভারতীয়দের উৎসব হয় তখন আমরা সেটাতে অংশগ্রহণ করি আবার বাংলাদেশিদের আনন্দ উৎসবে ভারতীয়রা স্বতস্ফুর্তভাবে অংশগ্রণ করে। একসাথে বসবাস করতে কোন প্রকার বিপত্তির সম্মুখন হতে হয় না কখনো।

ভারতের বশিরহাট থানার পানিরতর গ্রামের বাসিন্দা হাসান গাজী বলেন, বাংলাদেশিদের সাথে বসবাস করতে গিয়ে একে অপরের বন্ধুতে রুপান্তর হয়েছে। এক সাথে পুকুরে গোসল করি, এক সাথে দোকানে গিয়ে চা খায়। কখনো বুঝতে পারি না আমরা দুই দেশের লোক এখানে বসবাস করছি। কখনো বাংলাদেশি কারও বিপদ বা অসুস্থ হলে তাৎক্ষণিকভাবে আমরা গিয়ে তাদের পাশে দাঁড়ায়। যদিও কখনো একে অপরের সাথে মনোমালিন্য বা ঝগড়া হয় না তারপরেও সামান্যতম কিছু হলে সেটা বিজিবি ও বিএসএফ এসে সমঝোতা করে দেয়। এই যাবতকালে কখনো কোন বড় সমস্যার তৈরি হয়নি। এখানে বসবাস করতে করতে একে অপরের আত্মীয় হয়ে গেছে। বাংলাদেশিরা ভারতীয়দের সাথে বিয়ের মাধ্যমে আত্মীয়তা করেছেন। উভয়ের মধ্য একটি সুন্দর বন্ধন তৈরি হয়েছে। মানচিত্রের সীমানা ভিন্ন হলেও আমাদের সবার আত্মর টান অভিন্ন।

পানিতর গ্রামের বাসিন্দা মোহতাব বলেন, দুই দেশের লোকের সমন্বয়ে এখানে একটি মসজিদ তৈরি করেছি। যে মসজিদটির নাম পানিতর জিরো পয়েন্ট জামে মসজিদ। এখানে বসবাস করা দুই দেশের ৪০ পরিবার একত্রে নামাজ পড়া হয়। এক সাথে বসবাস করা হলেও ধর্ম, বর্ণ কিংবা বৈষম্যের সৃষ্টি হয় না কখনো। আমাদের কোন কিছু ধার লাগলে বাংলাদেশিদের থেকে সেটা নিতে পারি বা বাংলাদেশিদের কিছু লাগলে আমরা ধার দিয়ে থাকি। একত্রে এক সাথে শ্রম দিয়ে অর্থ উপার্জন করে সুন্দরভাবে বেঁচে আছি এখানে।

দেশের হাড়দ্দহা গ্রামের আবু জাফর বলেন, দুই বাংলার ৪০ পরিবার এক সঙ্গে বসবাস করলেও আজ পর্যন্ত কোন আপত্তিকর ঘটনার সৃষ্টি হয়নি। দুই দেশের মানুষ এক সাথে এক উঠানে বসবাস করার যে অনুভূতি সেটা প্রকাশ করার ভাষা নেই। ভারতীয়রা ভারতের ইটনা বাজার বা বশিরহাটে গিয়ে দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় কেনাকাটা করে থাকেন। আবার পাশ্ববর্তী বাংলাদেশের সীমানায় থাকা দোকানেও আসার কিছুটা সুযোগ আছে ভারতীয়দের। সেখানে এক সাথে চা খাওয়ার, আড্ডা দেওয়ার সুযোগ তৈরি হয় রোজ।

ভোমরা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. ইসরাফিল গাজী বলেন, সীমান্তবর্তী হাড়দ্দহা গ্রামে বাংলাদেশিদের সঙ্গে ভারতীয়রা শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করে আসছে। সেখানকার বাঙালিরা সরকারি সকল সুযোগ সুবিধা পেয়ে থাকেন। তাদের যোগাযোগ ব্যবস্থা ভাল করার লক্ষ্যে রাস্তা পাকা করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। দুই দেশের মানুষ মিলেমিশে বসবাস করতে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। তাদের বিষয়টা অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে দেখা হয়।

সাতক্ষীরা-৩৩ বিজিবি ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল মো. আশরাফুল হক বলেন, বিজিবি সার্বক্ষণিক তাদের নিরাপত্তা দিচ্ছেন। সেক্ষেত্রে কোনো সমস্যার সম্মুখীন হতে হয় না। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে ভারতীয়রা বাংলাদেশের সীমানায় প্রবেশ করার চেষ্টা করে। তাদের বৈধ কাজ কাগজপত্র না থাকায় প্রবেশে বাধা দেওয়া হয়। সেখানকার বাসিন্দাদের মধ্যে কোন সমস্যা তৈরি হলে তাৎক্ষণিকভাবে বিজিবির হস্তক্ষেপে সেটা সমাধান করা হয়ে থাকে। সবকিছু মিলিয়ে তারা উভয় দেশের নাগরিক শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করছেন।

তিনি আরও বলেন, যেহেতু এলাকাটি দু’দেশের সীমানায় অবস্থিত তাই সেখানে নিরাপত্তা ব্যবস্থা সর্বদা জোরদার থাকে। তাছাড়া কোন ধরনের অপরাধ কর্মকাণ্ড যাতে না ঘটে সে বিষয়ে নজরদারি করা হয়ে থাকে।

(ঢাকা টাইমস/০৬ডিসেম্বর/এসএ)

সংবাদটি শেয়ার করুন

বাংলাদেশ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :