মক্তবের মৃত্যু, খোদাভীতির সংকট: নৈতিক বাংলাদেশ গড়তে যা করণীয়

বাংলাদেশের ইতিহাস, সংস্কৃতি ও ধর্মীয় চেতনার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে আছে মক্তব। এটি কেবল একটি ধর্মীয় শিক্ষাকেন্দ্র ছিল না, বরং নৈতিকতা, চরিত্রগঠন ও আত্মিক বিকাশের প্রথম পাঠশালা ছিল। দুঃখজনকভাবে, আজ আমরা এমন এক সমাজে বসবাস করছি যেখানে প্রযুক্তিগত অগ্রগতি, তথাকথিত আধুনিকতা ও চাকরিকেন্দ্রিক শিক্ষার চাপে পড়ে সেই মক্তবব্যবস্থা বিলুপ্তির পথে। এই বিলুপ্তির ধারাবাহিকতায় সমাজে খোদাভীতি ও তাকওয়ার ঘাটতি আজ প্রকট। ফলে দেখা দিচ্ছে মূল্যবোধের সংকট, অপরাধ প্রবণতা, এবং নৈতিক অধঃপতন।
এই প্রবন্ধে আমরা আলোচনা করবো মক্তবব্যবস্থার গুরুত্ব, এর বর্তমান অবস্থা, সমাজে খোদাভীতি ও তাকওয়ার অভাবের প্রভাব এবং এসব সমস্যার সমাধানে করণীয়।
মক্তব: প্রাচীন সমাজের নৈতিক কারখানা
ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, উপমহাদেশে মুসলমানদের ধর্মীয় শিক্ষা প্রথম শুরু হতো মক্তব থেকে। শিশুদের কুরআন শিক্ষা, আরবি বর্ণমালা, নামাজ, ওযু, ইসলামি শিষ্টাচার ও জীবনের মূলনীতি শেখানো হতো অত্যন্ত দরদ ও নিষ্ঠার সঙ্গে। এই শিক্ষা ছিল হৃদয়নির্ভর, যেটি শিশুদের ভিতর থেকে আল্লাহর ভয়, দায়িত্ববোধ ও আত্মসমালোচনার অভ্যাস তৈরি করত।
একজন শিশু যখন মক্তবে প্রথমবার ‘বিসমিল্লাহ’ উচ্চারণ করত, তখন থেকে তার মধ্যে একটি আলোকিত জীবনবোধের জন্ম হতো। মক্তব ছিল সেই প্রেরণার কেন্দ্র, যেখানে মানুষের ভিতর আল্লাহর প্রতি শ্রদ্ধা, আত্মসংযম ও সামাজিক দায়বদ্ধতার বীজ বপন হতো।
মক্তব ব্যবস্থার বিলুপ্তি ও বর্তমান বাস্তবতা
বর্তমানে অধিকাংশ অঞ্চলে মক্তব কেবল স্মৃতির পাতায় ঠাঁই নিয়েছে। কয়েকটি গ্রামীণ মসজিদে এখনো হয়তো সকালে কিছু শিশু কুরআন শেখে, কিন্তু সেগুলোর সংখ্যাও দিন দিন কমে যাচ্ছে। বড় শহরগুলোতে তো এই ধারাটির অস্তিত্বই নেই বললেই চলে।
প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যবস্থায় ধর্মীয় শিক্ষাকে এমনভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে, যা শিশুর মনে আনন্দ বা অনুপ্রেরণা জাগায় না। কেবল পরীক্ষার চাপ ও মুখস্থনির্ভরতা—ফলে ধর্মীয় শিক্ষা হয়ে দাঁড়িয়েছে 'অপ্রয়োজনীয়' একটি বিষয়। অন্যদিকে, মক্তব ব্যবস্থা ছিল আত্মিকভাবে গঠনমূলক, যা শিশুর চিন্তাভাবনার গভীরে প্রভাব ফেলত।
খোদাভীতি ও তাকওয়ার সংকট: সমাজের ভিত নড়বড়ে
বর্তমান সমাজে যত নৈতিক বিপর্যয় আমরা দেখছি—জালিয়াতি, দুর্নীতি, আত্মকেন্দ্রিকতা, পরিবারে ভাঙন, মাদকাসক্তি, কিশোর অপরাধ—তার মূল কারণগুলোর অন্যতম হলো খোদাভীতি ও তাকওয়ার অভাব।
খোদাভীতি অর্থ এমন একটি অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণ যা মানুষকে আল্লাহর ভয়ে অন্যায় থেকে বিরত রাখে। তাকওয়া হলো আত্মাকে খারাপ কাজ থেকে রক্ষা করা এবং ভালো কাজের প্রতি মনোযোগী হওয়া।
যখন মানুষের মধ্যে এই গুণগুলো লোপ পায়, তখন আইন-কানুন বা শাস্তির ভয় দিয়ে নৈতিকতা ধরে রাখা সম্ভব হয় না। মক্তব শিক্ষা ছিল এই খোদাভীতি ও তাকওয়ার জাগরণের মূল ভিত্তি।
সমাজে এর প্রভাব: নিঃশব্দ নৈতিক বিপর্যয়
১. পরিবারে অশান্তি: পারিবারিক বন্ধন দুর্বল হয়ে যাচ্ছে। স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক, পিতা-মাতার প্রতি সন্তানের দায়িত্ববোধ ক্রমেই হ্রাস পাচ্ছে।
২. যুব সমাজের বিপথগামিতা: তরুণ প্রজন্মের একাংশ নেশা, অপরাধ ও অনৈতিক বিনোদনে নিমজ্জিত।
৩. ধর্মীয় চেতনার ভ্রষ্টতা: ইসলামের নাম ব্যবহার করে বিভিন্ন উগ্রবাদী কার্যক্রম পরিচালনা হচ্ছে, যা মূলত ধর্মের সঠিক জ্ঞান না থাকার ফল।
৪. সামাজিক অবক্ষয়: সহনশীলতা, দয়া, শ্রদ্ধাবোধের অভাব সমাজকে দিন দিন কলুষিত করছে।
মক্তবব্যবস্থার পুনরুত্থানে করণীয়
১. মসজিদ ভিত্তিক মক্তব পুনরায় চালু করা: প্রতিটি মসজিদের সঙ্গে নিয়মিত মক্তব কার্যক্রম চালু করতে হবে, যেখানে শিশুদের প্রাথমিক ধর্মীয় শিক্ষা দেওয়া হবে আনন্দদায়ক ও হৃদয়গ্রাহী উপায়ে।
২. অভিভাবকদের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন: পিতা-মাতাকে বুঝতে হবে, সন্তানের চাকরি জীবনের আগে তার চরিত্র গঠনের প্রয়োজন বেশি। সন্তানকে ভালো মানুষ বানাতে হলে তাকে ছোটবেলায় মক্তবে পাঠানো উচিত।
৩. আধুনিক ও যুগোপযোগী পাঠ্যক্রম: মক্তব পাঠ্যক্রমে আধুনিক মনোবিজ্ঞান ও শিশু বিকাশের উপযোগী উপাদান যোগ করে একে আরও কার্যকর করা যেতে পারে। গল্প, ইসলামি ইতিহাস, ভিডিও ও ব্যাখ্যাসহ কুরআন শিক্ষা এই পাঠ্যক্রমে থাকা উচিত।
৪. প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষক নিয়োগ: দক্ষ, ধার্মিক ও শিশুবান্ধব শিক্ষক ছাড়া মক্তব কার্যক্রম ফলপ্রসূ হবে না। স্থানীয়ভাবে মক্তব শিক্ষকদের জন্য ওয়ার্কশপ ও প্রশিক্ষণের আয়োজন জরুরি।
৫. সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা: মিডিয়া, সামাজিক সংগঠন ও শিক্ষাবিদদের সমন্বয়ে একটি মক্তব-পুনরুজ্জীবন আন্দোলন শুরু করা যেতে পারে। সমাজের সব শ্রেণির মানুষকে এ ব্যাপারে উদ্বুদ্ধ করতে হবে।
উপসংহার
মক্তবের বিলুপ্তি কেবল একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের হারিয়ে যাওয়া নয়, এটি একটি জাতির আত্মিক জ্ঞানের অবসান। একটি শিশু যদি ছোটবেলা থেকেই আল্লাহর ভয়, দায়িত্ববোধ ও নৈতিকতা শিখে বড় হয়, তাহলে সে জীবনের যে কোনো অবস্থানেই নৈতিকভাবে সৎ ও দৃঢ় থাকতে পারবে।
একটি সুন্দর, সুশৃঙ্খল ও খোদাভীতিময় সমাজ গঠনের জন্য আমাদের মক্তবব্যবস্থার পুনরুজ্জীবনকে একটি জাতীয় কর্মসূচি হিসেবে গ্রহণ করতে হবে। শুধু উন্নত অবকাঠামো নয়, উন্নত মানুষ চাই—যার ভিত্তি গড়ে ওঠে তাকওয়া ও খোদাভীতির ভিত্তিতে।
লেখক: ব্যাংকার ও কলামিস্ট

মন্তব্য করুন