চট্টগ্রামের ‘অভিশাপ’ কাপ্তাই বাঁধ

বর্ষা আসলেই চট্টগ্রামের মানুষের মনে উঁকি দেয় কাপ্তাই বাঁধ। কখন ছাড়া হচ্ছে বাঁধের পানি এ আতঙ্ক জিঁইয়ে বসেছে চট্টগ্রামের মানুষের মনে। কারণ এ বাঁধের পানি ছাড়লেই ডুবে যায় চট্টগ্রাম ও রাঙ্গামাটির বিস্তীর্ণ জনপদ।
বাঁধের ফটক খুলে দিলে বিশেষ করে চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া, রাউজান, বোয়ালখালী. হাটহাজারি, ফটিকছড়ি, পটিয়া, রাঙামাটি জেলার কাপ্তাই, ও রাজস্থলী উপজেলার সড়ক, ঘরবাড়ি, ফসলি জমি ও পুকুর ডুবে ব্যাপক ক্ষতি হয়।
গত দুই দশক ধরে এ বাঁধের পানিতে ডুবে যাওয়ার হার শুধু বেড়েই চলেছে তা নয়, পানি উঠে আসছে চট্টগ্রাম মহানগরীতেও। ফলে এ বাঁধ চট্টগ্রামের মানুষের জন্য এখন অভিশাপ হয়ে দাড়িয়েছে।
সাম্প্রতিক সময়ে চট্টগ্রাম মহানগরে জলাবদ্ধতা সৃষ্টির পেছনে বঙ্গোপসাগরের জোয়ার, অতি বৃষ্টির সাথে কাপ্তাই বাঁধের পানির কথাও উঠে এসেছে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন ও চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষসহ নগর পরিকল্পনাবিদদের মুখে।
গত জুলাই মাসের মাঝামাঝি সময়ে টানা বৃষ্টিতে চার দিনের জলাবদ্ধতার সময় মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দিন বলেছিলেন, অতি বৃষ্টি ও জোয়ারের সাথে কাপ্তাই বাঁধের পানি ছাড়ায় জলাবদ্ধতা ভয়াবহ রুপ নেয়।
ওই সময় কাপ্তাই বাঁধের ১৬টি দরজা খুলে দিলে প্রতি সেকেন্ডে ৯৬ হাজার কিউসেক পানি কর্ণফুলী নদীতে গড়িয়ে পড়ে। যার ফলে বঙ্গোপাসাগরের জোয়ারের পানি উজানে উঠতে পারেনি। আবার বৃষ্টির পানি নামতে পারেনি নদীতে। ফলে কর্ণফুলী ও হালদা নদীসহ শাখা খালগুলোতে পানি উপচে ডুবে যায় চট্টগ্রাম মহানগর।
ডুবে যায় কর্ণফুলী তীরবর্তি রাঙ্গুনিয়া, রাউজান, বোয়ালখালী, পটিয়া, কাপ্তাই, রাজস্থলী এবং হালদা নদী তীরবর্তী হাটহাজারী ও ফটিকছড়ি উপজেলার সড়ক, বিল, পুকুর ও ঘরবাড়ি। ঘটে ফসলহানী। এতে ক্ষতির পরিমাণ ২০ হাজার কোটি টাকারও বেশি বলে তথ্য প্রকাশ করে জেলা প্রশাসন।
একইভাবে অমাবশ্যার প্রভাবে গত বৃহস্পতিবার থেকে মাঝারি-ভারী বৃষ্টিপাত শুরু হয়। তাতে লেকে পানি বেড়ে যাওয়ায় শুক্রবার দুপুর থেকে বাঁধের ১৬টি ফটক খুলে দেওয়া হয়। এতে প্রতি সেকেন্ডে ৮০ হাজার কিউসেক পানি কর্ণফুলীতে গড়িয়ে পড়ছে। আর শুক্রবার বিকেল থেকে বঙ্গোপসাগরের জোয়ারের সময় আবারও ডুবে যায় চট্টগ্রাম মহানগর। একইভাবে ডুবে যায় চট্টগ্রামের আট উপজেলা।
চট্টগ্রাম জেলা কৃষি সম্প্রসারণ দপ্তরের শস্য উৎপাদন বিশেষজ্ঞ আমিনুল হক চৌধুরী জানান, কাপ্তাই বাঁধের ছাড়া পানিতে রাঙ্গুনিয়া, রাউজান, বোয়ালখালীসহ নয়টি উপজেলাজুড়ে আবার বন্যা দেখা দিয়েছে। এতে গুমাইবিলসহ ২৮টি বিলের ৫০-৫৫ হাজার হেক্টর রোপা আমন ও ২০ হাজার হেক্টর জমির তরি-তরকারি ক্ষেত নষ্ট হয়েছে।
এছাড়া বিভিন্ন উপজেলায় গুরুত্বপূর্ণ সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে। পানি ছাড়া অব্যাহত থাকায় এবং জোয়ারের সময় বন্যার পানি দ্রুত বেড়ে যাওয়ায় এসব উপজেলার শত শত গ্রামের মানুষ শঙ্কিত।
রাঙ্গুনিয়ার গুমাই বিলের কৃষক আবদুর রহিম বলেন, কাপ্তাই বাঁধের ছাড়া পানিতে পুরো বিল ডুবে রোপা আমন চারা নষ্ট হয়েছে। এমন কোন সড়ক ও ঘরবাড়ি নেই ডুবেনি। রাউজান পৌর সদরের কৃষক রুবেল হোসেন বলেন, কর্ণফুলী ও হালদার উপচে পড়া পানিতে উপজেলার বিস্তীর্ণ ঘরবাড়ি, তরি-তরকারি ও রোপা আমন ক্ষেত ডুবে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।
বোয়ালখালী উপজেলার গোমদ-ী বিলের কৃষক আবু তাহের জানান, শুক্রবার রাত থেকে পুরো বিল পানিতে ডুবে রয়েছে। একই কথা বলেন ফটিকছড়ি ও পটিয়া উপজেলার কৃষক আবদুস সাত্তার, মো. হোসেন, জমির উদ্দিন এবং ফারুক।
কৃষকরা জানান, প্রতি বছর বর্ষায় কাপ্তাই বাঁধে বৃষ্টির পানি উপচে পড়ে। এ সময় বাঁধের ১৬ স্পিলওয়ে খুলে পানি ছাড়া হয়। এবারও পানি ছাড়ায় চট্টগ্রামের উত্তর ও দক্ষিণ জেলার সবকটি উপজেলার বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়।
কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রের ব্যবস্থাপক শফিউদ্দিন আহমেদ বলেন, রুলকার্ভ (পানির পরিমাপ) অনুযায়ী কাপ্তাই লেকে এখন ৯৩.৫২ পানি থাকার কথা। কিন্তুরয়েছে ১০৭.৭৮ ফুট। এতে বাঁধ ঝুঁকিতে পড়ায় পানি ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে। লেকে পানি আরো বৃদ্ধির আশঙ্কা রয়েছে। পানি বাড়লে আরও বেশি পরিমাণে পানি ছাড়া হবে।
চউকের নগর পরিকল্পণাবিদ স্থপতি শাহিনুল খান এ প্রসঙ্গে বলেন, বৃষ্টিতে লেকের পানি বেড়ে বাঁধের উপরেও হাজার হাজার বসতি ডুবে রয়েছে। ডুবে গেছে রাঙামাটি পর্যটনের ঝুলন্ত সেতুও। গত ৪-৫ বছর ধরে এ বাঁধের পানিতে ডুবছে কর্ণফুলী ও হালদা তীরবতির্ উপজেলাসহ চট্টগ্রাম মহানগর।
শাহিনুল বলেন, এ বাঁধের জলবিদ্যুৎ থেকে বছরে যে পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপন্ন হয় তার চেয়েও ৪-৫ গুণ বেশি ক্ষতি হচ্ছে। ফলে এ বাঁধ এখন বৃহত্তর চট্টগ্রামের জন্য অভিশাপ। লেকের গভীরতা বাড়ানোসহ এ ব্যাপারে এখনই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা না নিলে এ বাঁধ ভয়াবহ বিপর্যয় ডেকে নিয়ে আসবে।
ঢাকাটাইমস/১৪আগস্ট/আইকে/ডব্লিউবি

মন্তব্য করুন