শশীকাহন: পৌরাণিক উপাখ্যান:ফ্যান্টাসি থ্রিলার সিরিজ, পর্ব- দশ

ড. রাজুব ভৌমিক
| আপডেট : ১৬ নভেম্বর ২০১৯, ২২:৫৩ | প্রকাশিত : ১৬ নভেম্বর ২০১৯, ২২:৫২

চলদাজ রাজ্যে এখন খুশির বন্যা বইছে। মহারাজা রাসঙ্ক তার প্রিয় নাতি তৃষকে নিয়ে এখন অধিকাংশ সময় কাটায়। মহারাজ রাসঙ্ক তৃষকে তার প্রাণের চেয়েও বেশি আদর করে। প্রিয় তৃষকে মহারাজ রাসঙ্ক এতই আদর করে যে তিনি লাগগিন্তা রাজ্যের মহারাজ মঞ্জটের দ্বারা রাজকন্যা তিস্রা, এগারজন যুবরাজ ও আশি-হাজার চলদাজ সেনাবধের প্রতিশোধের কথা একদম ভুলে যায়-যেন তৃষ মহারাজার অন্তর পরিপূর্ণ করল। একদিন মহারাজা রাসঙ্ক শিশু তৃষকে কোলে নিয়ে রাজপ্রাসাদের সামনে পায়চারি করছে। মহারাণী যোদি এবং যুবরাজ শিহিলের স্ত্রী পিয়া তার সামনে আসে। মহারাজকে ধীরে ধীরে সুস্থ হতে দেখে মহারানী যোদি খুশি হয়। পিয়া তখন বলে, ‘পিতাশ্রী, আমার চেয়ে তৃষ আপনার কোলে থাকতে বেশি পছন্দ করে।’ মহারাজ রাসঙ্ক বলল, ‘তুমি ঠিকই বলেছ পিয়া। মনে হচ্ছে তৃষের সাথে আমার সেই যুগ ও যুগের সম্পর্ক। আমি তৃষকে দেখলে যেন সব চিন্তা, কামনা-বাসনা, ও সব-ব্যথা ভুলে যাই।’ মহারাজ রাসঙ্ক ছিল পিয়ার মত দেবতা কিতমু ভক্ত। সারা চন্দ্রগ্রহে যখন কেউ পাপের দেবতা কিতমুকে ভয় পেয়ে তার নামও নিত না তখন মহারাজা রাসঙ্ক চলদাজ রাজ্যে দেবতা কিতমুর জন্য প্রথম মন্দির তৈরি করে এবং সেখানে দেবতা কিতমুর পূজা প্রচলন করে।

এখন চলদাজ রাজ্যে সব দেবতাদের পূজা হয়। সব দেবতাদের মন্দির আছে। কিন্তু একসময় চলদাজ রাজ্যে সবদেবতাদের পূজা হত না। তখন চলদাজ রাজ্যে ছিল-আলোর দেবতা দেবরাজ কৃতনুর মন্দির, জ্ঞানের দেবী মহাদেবী উষার মন্দির, সূর্যগ্রহের শান্তিকুঞ্জের রাজা দেবতা আদির মন্দির, আগুনের দেবতা বানহির মন্দির, অস্ত্রের দেবতা আম্ভুর মন্দির, সমুদ্রও বৃষ্টির দেবতা জিনরুর মন্দির, মৃত্যুর দেবতা হিংকার মন্দির, ধন-সম্পদের দেবতা শিশক্রুর মন্দির, পর্বতের দেবতা কুন্ত্রার মন্দির, পাপনাশের দেবতা কৃহনুর মন্দির, ভালবাসা ও কামনার দেবী মুকির মন্দির, যুদ্ধ ও বিচারের দেবী আজ্রিয়ার মন্দির, এবং জীবন দানের দেবী লিনিয়ার মন্দির। চলদাজ রাজ্যে প্রায় সব দেবতাদের মন্দির থাকা স্বত্তেও কেউ কখনো পাপের দেবতা কিতমুর জন্য মন্দির করেনি। দেবতা কিতমুকে শশীরা প্রচন্ড ভয় পেত। মহারাজা রাসঙ্ক তার রাজ্য অভিষেকের পর সব দেব-দেবীদের মন্দির গিয়ে পূজা ও যজ্ঞ করতে যায়। সব মন্দিরে পূজা ও যজ্ঞ শেষ করার পর মহারাজ রাসঙ্ক লক্ষ্য করে তার রাজ্যে পাপের দেবতা কিতমুর কোন মন্দির নাই। ‘দেবতা কিতমুর মন্দির নাই কেন?’ জিজ্ঞেস করলে প্রজারা তখন মহারাজাকে দেবতা কিতমুকে নিয়ে তাদের ভয় ও ভীতির কথা জানায়। মহারাজা তখন প্রজাদের আশ্বস্ত করে এবং তার সেনাপতিকে অবিলম্বে দেবতা কিতমুর জন্য মন্দির তৈরি করতে নির্দেশ দেয়। পাপের দেবতা কিতমুর মন্দির নির্মাণ কাজ সমাপ্ত হলে মহারাজ রাসঙ্ক প্রথম দেবতা কিতমুর পূজা ও যজ্ঞ করে দেবতা কিতমুর পূজা প্রচলিত করে। এতে দেবতা কিতমু মহারাজ রাসঙ্কের উপর খুব সন্তুষ্ট হয়।

কিছুদিন পর যুবক মহারাজ রাসঙ্ক পাশের এক রাজ্য জয় করে রাত্রি বেলায় চলদাজ রাজ্যের রাজপ্রাসাদে ফিরছে।

তখন একজন বৃদ্ধ বেশে দেবতা কিতমু মহারাজ রাসঙ্কের দেবতা-ভক্তির পরীক্ষা নিবে বলে ঠিক করে। মহারাজ রাসঙ্ক সেদিন পথে একজন বৃদ্ধকে মৃত্যু যন্ত্রণায় কাতরাতে দেখতে পায়। মহারাজ রাসঙ্ক তার সারথিকে তার বাহন থামাতে নির্দেশ দেয়। ‘এ কি হলো আপনার? আপনি এত রাতে এখানে একা কেন?’ মহারাজ রাসঙ্ক তার বাহন থেক নেমে বৃদ্ধকে বলল। বৃদ্ধ মৃত্যু যন্ত্রণায় কাতরাতে কাতরাতে বলল, ‘হে দয়ালু, আমার মরণব্যধি কুষ্ঠরোগ হয়েছে। আমার মৃত্যু অনিবার্য। আমার স্পর্শে যেন কেউ এ মরণব্যধিতে আক্রান্ত না হয় তাই আমার সন্তানেরা আমাকে আমাদের গ্রাম থেকে বের করে দিয়েছে। আপনি যদি দয়া করে আমার একটি উপকার করতেন তাহলে আপনার কাছে আমি চির-ঋণী থাকব।’ বৃদ্ধ শশীর কথা শুনে মহারাজ রাসঙ্কের মন খারাপ হয়ে যায়। ‘আচ্ছা বলুন, আপনার জন্য কি করতে পারি?’ মহারাজা রাসঙ্ক তখন বলল। বৃদ্ধ শশী বলল, ‘হে দয়ালু, আপনি আপনার হাতের তলোয়ারটি দিয়ে দয়া করে আমাকে হত্যা করুন। মৃত্যু যন্ত্রণা যে আমার আর সহ্য হচ্ছে না। দয়া করে এই যন্ত্রণা থেকে আমায় মুক্তি দিন।’ মহারাজা রাসঙ্ক অবাক হয় এবং বৃদ্ধ শশীটি পাশে মাটির উপরে বসে তার কথা শুনতে থাকে। মহারাজা বলল, ‘দেখুন জন্ম-মৃত্যু সব দেবরাজ কৃতনুর ঈশারায় হয়। আপনি একটি কাজ করুন। আপনি আমার সাথে আমার বাহনে করে চলুন। আপনাকে আমি জীবন দানের দেবী লিনিয়ার মন্দিরে নিয়ে যাব। আমিও আপনার সাথে দেবী লিনিয়ার কাছে আপনার রোগমুক্তি ও জীবন দানের জন্য প্রার্থনা করব। দেবীর আশির্বাদে আপনি ভাল হয়ে যাবেন।’ মহারাজ রাসঙ্কের কথায় বৃদ্ধ বেশে দেবতা কৃতমু রাজি হয় এবং মহারাজের বাহনে উঠে বসে। মহারাজ রাসঙ্ক সারথিকে তার রথ চালাতে নির্দেশ দেয়। এ সময় কুষ্ঠরোগী বৃদ্ধ বেশে থাকা দেবতা কিতমু তার আসল রূপে ফিরে আসে। রথে দাঁড়ানো অবস্থায় মহারাজ দেবতা কিতমুকে প্রণাম করল। ‘মহারাজ রাসঙ্ক, আমি তোমার কৃতকর্মে অনেক সন্তুষ্ট। বল তুমি কোন বর চাও?’ দেবতা কিতমু রাসঙ্ককে বলল। মহারাজ রাসঙ্ক দেবতা কিতমুর কাছে কিছু না চেয়ে বলল, ‘প্রভু আপনার দর্শনে আমি ধন্য। আমার আর কিছু চাওয়া নেই।’ দেবতা কিতমু মহারাজা রাসঙ্কের উপর আরো সন্তুষ্ট হয় এবং তিনি বলেন, ‘ যা আমি তোকে আশীর্বাদ করছি যতদিন তোর রাজ্যে সব দেবতাদের মন্দির ও পূজা হবে ততদিন তোর রাজ্যে আক্রমণ করে কেউ সফল হবে না। আর তোর দর্শনের ইচ্ছা পূরণ করার জন্য একদিন আমি তোর কোলেই বেড়ে উঠব।’ এই বলে দেবতা কিতমু অদৃশ্য হয়ে যায়।

তৃষকে কোলে নিয়ে রাজপ্রাসাদের সামনে পায়চারি করার সময় হঠাৎ মহারাজ রাসঙ্কের সেই ঘটনার কথা মনে পড়ে যায়। মহারাজ তখন বুঝতে পারে এই শিশু তৃষ নিশ্চয়ই দেবতা কিতমুর অবতার। মহারাজ রাসঙ্ক তখন পিয়াকে বলল, ‘ধন্য তুমি পিয়া, তৃষ একদিন চলদাজ রাজ্যের মুখ উজ্জ্বল করবে।’ মহারাজ তার অনুমাণের কথা পিয়াকে বলে নি। পিয়া যে দেবতা কিতমুর ভক্ত সেটা তার মনে পড়ল। এতে মহারাজার অনুমান আরো গভীর হয়।

এদিকে গুপ্তচর সুনেন্দ মহারাজ মঞ্জটের পুত্র তৃষকে চোখে চোখে রাখার জন্য চলদাজ রাজ্যের রাজপ্রাসদে সাধারণ কর্মী হিসেবে যোগদান করে। রাজপ্রাসাদের বিভিন্ন কক্ষ পরিষ্কার করা এবং রাজপ্রাসাদের আশেপাশে গাছের পরিচর্যা করাই তার প্রধান কাজ। গুপ্তচর সুনেন্দ তার কাজের ফাঁকে তৃষের সব বিষয়ে খোঁজ-খবর রাখে এবং রাজপ্রাসাদের ভিতর সবকর্মকান্ড লক্ষ্য করে লাগগিন্তা রাজ্যে সে সংবাদ পাঠায়। মহারাজ রাসঙ্ক প্রতিদিন তৃষকে কোলে নিয়ে রাজপ্রসাদের সামনে পায়চারি করে। একদিন সুনেন্দ রাজপ্রাসাদের সামনে গাছের পরিচর্যা করছিল তখন সে দেখতে পায় চলদাজ রাজ্যের এক দূত মহারাজা রাসঙ্কের দিকে দ্রুত হেঁটে যাচ্ছে। সুনেন্দ বুঝতে পারে নিশ্চয় চলদাজ রাজ্যের দূত কোন গুরুত্ব-পূর্ণ খবর নিয়ে মহারাজ রাসঙ্কের কাছে যাচ্ছে। সুনেন্দ তাই বুদ্ধি করে রাজপ্রাসাদের সামনের গাছগুলোতে জল দিতে দিতে একটু এগিয়ে যায়। সুনেন্দের উদ্দেশ্য চলদাজ রাজ্যের রাজদূত ও মহারাজ রাসঙ্কের মধ্য-কার আলাপচারিতা শোনা এবং পরে সেটা লাগগিন্তা রাজ্য পৌঁছানো। রাজদূত মহারাজ রাসঙ্ককে বলল, ‘মহারাজ আমি যুবরাজ শিহিলের কাছ থেকে কিছু সংবাদ নিয়ে আপনার নিকট আসছি। আপনি আদেশ দিলে সেই সংবাদ পেশ করতে পারি।’ মহারাজা রাসঙ্ক অভয় দিয়ে রাজদূতকে সে সংবাদ বলার জন্য অনুমতি দেয়। ‘ মহারাজ, যুবরাজ শিহিল বলেছেন তিনি লাগগিন্তা রাজ্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত এবং প্রায় এক-লক্ষ সেনা ইতিমধ্যে চলদাজ রাজ্যের সেনাবাহিনী তে যোগদান করেছে। তারা শুধু আপনার নির্দেশ এর জন্য অপেক্ষা করছে।’ রাজদূত বলল। মহারাজা রাসঙ্ক জানে যুবরাজ শিহিল লাগগিন্তা রাজ্যে আক্রমণ করার জন্য মুখিয়ে আছে। একসময় রাজা রাসঙ্ক নিজেও তাই চেয়েছিল। রাজকন্যা তিস্রা, এগারজন যুবরাজ ও আশি-হাজার চলদাজ সেনাবধের প্রতিশোধের আগুনে তিনিও জ্বলতেন। কিন্তু তৃষ জন্ম নেবার পর থেকে মহারাজ রাসঙ্ক ওসব একদম ভুলে যান। তাই মহারাজ এখন চায় না কোন যুদ্ধ করতে-তাছাড়া তিনি জানেন প্রতিশোধ শুধু ক্ষতির সূচনা করে। মহারাজা রাজদূত থেকে শিহিলের সংবাদ শোনার পর তিনি ভাবলেন যে যুবরাজ শিহিলের সাথে এ বিষয়ে তার জরুরী কথা কথা বলতে হবে। তখন মহারাজা রাসঙ্ক রাজদূত কে বলেন, ‘তুমি যুবরাজ শিহিলকে সেনাক্যাম্প থেকে রাজপ্রাসাদে আসার জন্য বলিবে-এ বিষয়ে যুবরাজ শিহিলের সাথে আমার জরুরী কথা আছে।’ এরপর রাজদূত চলে যায়। লাগগিন্তা রাজ্যের গুপ্তচর সুনেন্দ মহারাজা রাসঙ্ক ও তার রাজ্যের দূতের সাথে কথোপকথন শুনতে পায়। সুনেন্দ ভাবল তার প্রিয় লাগগিন্তা রাজ্যে খুব শীঘ্রই চলদাজ রাজ্যের সেনারা আক্রমণ করতে যাচ্ছে। সেটা ভেবে সুনেন্দ সেখান থেকে চলে যায়। এরপর লাগগিন্তা রাজ্যে খুব শীঘ্রই চলদাজ রাজ্যের সেনারা আক্রমণের খবরটি সে লাগগিন্তা রাজ্যের মহারাজ মঞ্জটের নিকট পৌঁছায়।

আসন্ন আক্রমনের খবর শুনতে পেয়ে মহারাজ মঞ্জট তার দুই লক্ষ সেনা নিয়ে লাগগিন্তা-চলদাজ সীমান্তের দিকে রওনা হয়। পথে তারা লাগগিন্তা রাজ্যের অধীনে একটি ছোট রাজ্য কিতলাতে পৌঁছে। একটানা বহুদিন যাত্রা করতে গিয়ে লাগগিন্তা রাজ্যের সেনারা বেশ ক্লান্ত হয়ে পড়ল। মহারাজা মঞ্জট সিদ্ধান্ত নেয় কিতলা রাজ্যে তারা কিছুদিন বিশ্রাম করবে কারণ কিতলা রাজ্য থেকে চলদাজ রাজ্যের দূরত্ব খুব বেশি নয়-বড় জোর একদিনের পায়ে হাটার দূরত্ব। আর আকাশে উড়ে গেলে অর্ধেক দিনের দূরত্ব। শশীরা স্বভাবতঃ আকাশে উড়তে পারে। চন্দগ্রহের সব শশীদের আকাশে উড়ানোর জন্য ডানা আছে। কিন্তু যুদ্ধে যাবার সময় সেনাদের আকাশপথ ভ্রমণ করতে মহারাজ মঞ্জটের নিষেধ আছে কারণ আকাশপথে ভ্রমণ করার সময় বহুদূর থেকে সেনাদের দেখা যায় যেমনটি স্থলপথে ভ্রমণ করলে হয় না। এতে সেনাদের বিপদ বা তাদের উপর অতর্কিত হামলা হবার সম্ভাবনা বেশি থাকে। তাছাড়া সেনাদের বহু অস্ত্র-সস্ত্র নিয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে রওনা করতে হয়। আর অত অস্ত্র নিয়ে আকাশ পথে ভ্রমণ করতে গেলে সেনারা সহজেই দুর্বল হয়ে যেতে পারে তাই মহারাজ মঞ্জট আগেই সেনাদের আকাশপথে ভ্রমণ করতে নিষেধ করেছে। এ জন্য সেনাদের বহুদিন স্থলপথে ভ্রমণ করে কিতলা রাজ্যে পৌঁছতে হয়। এতে সেনারা ক্লান্ত হয়ে পড়ে।

কিতলা রাজ্যে লাগগিন্তা রাজ্যের মহারাজ সহ সেনাদের আগমনের খবর পৌছলে কিতলা রাজ্যের রাজা চিগু মহারাজ মঞ্জটের সাথে দেখা করতে আসে। কিতলা রাজ্য লাগগিন্তা রাজ্যের অধীনে হলেও রাজা চিগুর সাথে চলদাজ রাজ্যের মহারাজা রাসঙ্কের সাথে বেশ খাতির। সেটা মহারাজা মঞ্জট জানত না। কারণ বহুদিন পূর্বে মহারাজা মঞ্জট চিতলা রাজ্যের রাজা হিমনকে হত্যা করে চিতলা রাজ্য দখল করে এবং লাগগিন্তা রাজ্যে অন্তর্ভুক্ত করে। রাজা হিমন ছিল বর্তমান রাজা চিগুর পিতা। সে রাজা হবার পর মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে যদি কোনদিন সে সুযোগ পায় তাহলে একদিন সে তার পিতৃ হত্যার প্রতিশোধ নিবেই। আজ তার রাজ্যে দুই-লক্ষ সেনা সহ মহারাজা মঞ্জট এসে হাজির। তার পিতৃ-হত্যার প্রতিশোধ নিবার জন্য সুবর্ণ সুযোগ। কিতলা রাজ্যের মোট সেনা সংখ্যা বিশ হাজার। এই বিশ হাজার সেনা দিয়ে যুদ্ধ করে কখনো লাগগিন্তা রাজ্যের সেনার সাথে যুদ্ধে জয়ী হতে পারবে না সেটা রাজা চিগু ঠিকই জানত। তাই সে ঠিক করে একমাত্র কৌশল অবলম্বন করে মহারাজা মঞ্জট ও তার বিশাল সেনাবাহিনীকে পরাজিত করতে হবে। কিন্তু কিভাবে তার পিতৃ হত্যার প্রতিশোধ নিবে সেটা রাজা চিগু ভেবে পাচ্ছিল না।

চিতলা রাজ্যের রাজা হিমন ছিল মৃত্যুর দেবতা হিংকা -এর ভক্ত। রাজা হিমন ছিলেন অনেক জ্ঞাণী এক রাজা-সে সবসময় চন্দ্রগ্রহের কল্যাণ নিয়ে ভাবত। চন্দ্রগ্রহের শশীদের মধ্যে হিংস্রতা, মারামারি, এবং লোভ দেখে রাজা হিমন খুবই কষ্ট পেত। চন্দ্রগ্রহে অধর্মের রাজত্ব দিন দিন বেড়েই চলেছে তাই তিনি একদিন ভাবল মৃত্যুর দেবতা হিংকা এর তপস্যা করবে কেননা একমাত্র দেবতা হিংকাই পারে চন্দ্র-গ্রহ থেকে অধর্মের অন্ত করতে। বহু-বছর রাজা হিমন মৃত্যুর দেবতা হিংকা-এর তপস্যা করার পর অবশেষে দেবতা হিংকা এর দর্শন পায়। দেবতা হিংকা এর কাছে বর না চেয়ে রাজা হিমন বলল, ‘প্রভু, আপনি আমার মনের সবকিছুই জানেন। চন্দ্রগ্রহে অধর্মের সংখ্যা দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে। এর একটি উপায় আপনি করুন।’ দেবতা হিংকা তখন রাজা হিমনকে আশ্বাস দিল যে তিনি একদিন চিতলা রাজ্যে অধর্মের বিনাশ করে চন্দ্রগ্রহে একটি উদাহরণ সৃষ্টি করবে। আজ সে দিন এল। রাজা চিগু যখন তার পিতৃ-হত্যার প্রতিশোধ নিয়ে ভাবছে তখন দেবতা হিংকা একজন চাষীর বেশ ধরে রাজা চিগুর দরবারে এসে হাজির হয়। চাষী রাজা হিংকাকে বলল, ‘হে করুণাময় রাজা, আমার পরিবারের সবাই কালচনি লতার শাক খেয়ে মারা গেছে। আমি এর বিচার চাই।’ চাষী তখন রাজা চিগুকে সব ঘটনা খুলে বলল। চাষী বলল, সে খুবই গরিব। গত কয়েক সপ্তাহ পর্যন্ত সে তার পরিবারকে কিছু এনে খাওয়াতে পারে নি। হঠাৎ তিনদিন আগে সে রাস্তার পাশে কালচনি নামক লতা দেখতে পায়। সে লতা চাষী তার বাড়িতে নিয়ে যায়। পরে তার স্ত্রী সে লতাকে শাক হিসেবে রান্না ঘরের সবাইকে খেতে দেয়। শাকের পরিমাণ কম থাকার কারণ চাষী সে শাক খেতে পারে নি। কালচনি শাক খেতে অনেক সুস্বাদু বলে সে রাজাকে বলল। কিন্তু পরেরদিন কালচনি শাক খেয়ে তার পুরো পরিবারের মৃত্যু হয়। চাষীর কথা শুনে রাজা চিগু ব্যথিত হয় এবং তাকে রাজকর্মী হিসেবে নিয়োগ দেয়। রাজা চিগু তখন তার রাজ্যের রাজ বৈদ্যকে ডেকে পাঠায়। রাজবৈদ্যকে কালচনি লতার উপরে দ্রুত পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার আদেশ দেয়। রাজবৈদ্য অনেকগুলো কালচনি লতা নিয়ে এসে শাক বানিয়ে দুর্ধর্ষ রাজবন্ধীদের উপরে পরীক্ষা চালায়। দুইদিন পর পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষ করে সে রাজা চিগুর কক্ষে প্রবেশ করে। রাজবৈদ্য বলল, ‘প্রভু, আমি কালচনি লতা পরীক্ষা করে দেখেছি যে এই লতা শাক হিসেবে খেতে অনেক সুস্বাদু কিন্তু এটি এক আত্মহননকারী লতা। এই লতা খেলে সাথে সাথে শশীদের মৃত্যু হয় না-সাধারণত একদিন পরে মৃত্যু হয় আবার কারও কারও মৃত্যু হয় না।’ এই বলে রাজবৈদ্য চলে যায়।

রাজা চিগুর মাথায় একটি বুদ্ধি আসে। এদিকে মহারাজ মঞ্জট তার সেনাদের নিয়ে আগামীকাল ভোরে চলদাজ রাজ্যের উদ্দেশে চল যাবে। তাই সে তৎক্ষণাৎ ঠিক করে আজ রাতে সে লাগগিন্তার মহারাজা মঞ্জটের সম্মানে বিশাল একভোজের আয়োজন করবে আর সেখানে কালচনি লতার শাক লাগগিন্তা রাজ্যের মহারাজা মঞ্জটসহ সব সেনাদের খাওয়াবে। এতে তার পিতৃ-হত্যার প্রতিশোধ নেয়া হবে। রাজা চিগু মহারাজ মঞ্জটকে বলল, ‘হে মহান, আপনারা সবাই আগামীকাল ভোরে আমার রাজ্য ছেড়ে চলে যাচ্ছেন শুনে আমি খুবই ব্যথিত। তাই আমি আজ রাতে আপনার সম্মানে বিশাল এক ভোজনের আয়োজন করতে চাই। যাতে আপনাদের সেবা করে আমার মনটা একটু শান্ত হয়। দয়া করে আপনাদের সেবা করতে একটু সুযোগ দিন।’ রাজা চিগুর অমায়িক ব্যবহারে মহারাজ মঞ্জটের মন গলে যায় এবং তিনি সাথে সাথে রাজা চিগুর প্রস্তাবে রাজী হয়ে যায়।

বিকেল থেকে চিতলা রাজ্যে মহাভোজনের জন্য সব প্রস্তুতি চলতে থাকে। রাজা চিগুর আদেশে চিতলা রাজ্যে যত কালচনি লতা আছে সবগুলো দিয়ে শাক রান্না করা হয়। এছাড়া আরো নানাধরনের সুস্বাদু খাবারের আয়োজন করা হয়। সন্ধ্যা হয়ে রাত হলে খাবারের পরিবেশন করা হয়। মহারাজ মঞ্জট সহ লাগগিন্তার রাজ্যের সব সেনারা সুস্বাদু কালচনি লতার শাক খেয়ে মুগ্ধ। খাওয়া শেষ করে সবাই ঘুমিয়ে পড়ে। পরেরদিন ভোরে ঘুম থেকে উঠে মহারাজ মঞ্জট তার দুই লক্ষ সেনা সদস্য নিয়ে চিতলা রাজ্য ত্যাগ করে। সারাদিন হাটলে তারা সন্ধ্যার মধ্যেই সবাই চলদাজ রাজ্যে পৌঁছে যাবে। কিন্তু বেলা যখন দুপুর হয়ে আসে তখন এক এক করে লাগগিন্তা রাজ্যের সেনার পথে মারা যাচ্ছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই প্রায় এক লক্ষ সেনা মারা যায়। মহারাজ মঞ্জট চিন্তিত হয়ে পড়ে। কোন কারণ ছাড়াই কিভাবে তার সেনাদের মৃত্যু হচ্ছে সেটা সে বুঝতে পারছে না। উপায়ান্তর না দেখে মহারাজ মঞ্জট বাকী এক-লক্ষ সেনা নিয়ে লাগগিন্তা রাজ্যে দিকে ফিরতি যাত্রা শুরু করে। চারদিন পরে তারা লাগগিন্তা রাজ্যে পৌঁছায়। পথে আরো প্রায় এক-লক্ষ সেনা মারা যায়। শেষ পর্যন্ত মহারাজা মঞ্জট মাত্র দুই হাজার সেনা নিয়ে লাগগিন্তা রাজ্যে প্রবেশ করে।

চলবে...

লেখক: কবি ও লেখক, অধ্যাপক: অপরাধবিদ্যা, আইন ও বিচার বিভাগ, জন জে কলেজ, সিটি ইউনিভার্সিটি নিউইর্য়ক, মনস্তাত্তিক বিভাগ, হসটস কলেজ, সিটি ইউনিভার্সিটি, নিউইর্য়ক। কাউন্টার টেরোরিজম কর্মকর্তা, নিউইর্য়ক সিটি পুলিশ ডিপার্টমেন্ট (এনওয়াইপিডি)।

সংবাদটি শেয়ার করুন

ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :