চলচ্চিত্রে সুচন্দার ৫৫ বছর, কী অর্জন এই পাঁচ দশকে?

বাংলাদেশের সিনেমার ইতিহাসে শুরু থেকেই সম্পৃক্ত থাকা একজন নন্দিত নায়িকা কোহিনূর আক্তার সূচন্দা। সম্পৃক্ত তাঁর পরিবারও। সুচন্দার কারণেই পরবর্তীতে দেশীয় সিনেমায় আরো দুজন গুণী নায়িকা ববিতা ও চম্পার আবির্ভাব হয়। ১৯৬৬ সালে ডাগর চোখের সুনয়না নায়িকা সুচন্দার চলচ্চিত্রে অভিষেক হয় কিংবদন্তি নির্মাতা ও অভিনেতা সুভাষ দত্ত পরিচালিত ‘কাগজের নৌকা’ সিনেমায় অভিনয়ের মধ্যদিয়ে।
১৯৬৬ সালটা ছিল পাকিস্তানি সিনেমার বিপরীতে বাংলাদেশি সিনেমার মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর বছর। সে বছরই মুক্তি পেয়েছিল দুই কালজয়ী সিনেমা সালাহ উদ্দিন পরিচালিত ‘রূপবান’ এবং জহির রায়হান পরিচালিত ‘বেহুলা’। ‘বেহুলা’তে সুচন্দার বিপরীতে প্রথম নায়ক হিসেবে অভিষেক হয় প্রয়াত নায়ক রাজ রাজ্জাকের।
পরবর্তীতে কিংবদন্তি এই নায়িকা ‘চাওয়া পাওয়া’, ‘ আয়না ও অবশিষ্ট’, ‘নয়ন তারা’,‘ আনোয়ারা’,‘ দুই ভাই’,‘ মনের মতো বউ’,‘ যে আগুনে পুড়ি’,‘ জীবন থেকে নেয়া’, ‘অশ্রু দিয়ে লেখা’,‘ ধীরে বহে মেঘনা’,‘ কাঁচের স্বর্গ’,‘ গলি থেকে রাজপথ’সহ আরো অসংখ্য কালজয়ী সিনেমায় অভিনয় করেন। অভিনয় জগতে তিনি কাটিয়ে ফেলেছেন দীর্ঘ ৫৫টি বছর। কী অর্জন করলেন এই সুদীর্ঘ ক্যারিয়ারে?
গত পাঁচ দশকে সুচন্দার সবচেয়ে বড় অর্জুন হচ্ছে তিনি দর্শকের মন জয় করেছেন। নজর কেড়েছেন দেশের কিংবদন্তি সব পরিচালক ও প্রযোজকদের। তিনি নিজেও কয়েকটি ছবি পরিচালনা ও প্রযোজনা করেছেন। প্রয়াত স্বামী জহির রায়হান পরিচালিত ‘জীবন থেকে নেয়া’ সিনেমাতে অভিনয়ের জন্য অভিনেত্রী প্রথম আন্তর্জাতিক পুরস্কারে ভূষিত হন শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী হিসেবে।
২০০৫ সালে স্বামী জহির রায়হানের লেখা ‘হাজার বছর ধরে’ উপন্যাস অবলম্বনে একই নামে সিনেমা নির্মাণ ও প্রযোজনা করেন সুচন্দা। সেখানে তিনি অভিনয়ও করেন। ছবিটি ২০০৬ সালে ‘মেরিল প্রথম আলো’র আসরে শ্রেষ্ঠ ছবির পুরস্কার লাভ করে। একই ছবির জন্য ২০০৮ সালে শ্রেষ্ঠ পরিচালক ও প্রযোজক হিসেবে দুটি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান সুচন্দা।
২০১০ সালে সুচন্দাকে দেয়া হয় সিজেএফবি পারফরম্যান্স অ্যাওয়ার্ড অনুষ্ঠানে আজীবন সম্মাননা। ২০১৭ সালে আরও একটি আজীবন সম্মাননা পান ‘দশম স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড-দ্য ডেইলি স্টার জীবনের জয়গান’ অনুষ্ঠানে। চলচ্চিত্রে বিশেষ অবদান রাখায় ২০১৯ সালে তিনি অর্জন করেন ফজলুল হক স্মৃতি পুরস্কার। একই বছর জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারের আসরে তাকে দেয়া হয় আরও একটি আজীবন সম্মাননা।
১৯৭২ সালে মস্কো ফিল্ম ফ্যাস্টিভ্যালে সুচন্দাই প্রথম বাংলাদেশের পতাকা গর্বের সঙ্গে নিজ হাতে উড়িয়েছিলেন এবং পুরস্কৃত হয়েছিলেন ‘জীবন থেকে নেয়া’তে অভিনয়ের জন্য।
অভিনয় জীবনের দীর্ঘ ৫৫ বছরের পথচলা প্রসঙ্গে সুচন্দা ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘ছোট্ট এই জীবনে চলার বাঁকে পেয়েছি দর্শকের অকুণ্ঠ ভালোবাসা, এটাই আসলে জীবনের অনেক বড় প্রাপ্তি। করোনার ক্রান্তিকালে জীবন কোথায় যেন এসে থমকে গেছে। চলচ্চিত্রের সোনালী দিন নিয়ে যখন ভাবি, তখন ভাবনায় চলে আসে বর্তমান চলচ্চিত্রের কথা।’
তিনি জানান, ‘আমাদের সময় অনেক সীমাবদ্ধতার মধ্যে মেধাবী পরিচালকরা, অভিনয়শিল্পীরা তাদের সেরা কাজটুকু উপহার দিয়েছেন। বর্তমানে যে তরুণ পরিচালকরা চলচ্চিত্র নির্মাণ করছে তাদের উপরই নির্ভর করছে আমাদের বাংলা চলচ্চিত্রের ভবিষ্যত। আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের মধ্যদিয়ে তরুণ নির্মাতারা তাদের ভালোবাসা ও প্রচেষ্টা দিয়ে ভালো ভালো সিনেমা উপহার দিক, এটাই প্রত্যাশা।’
প্রসঙ্গত, ১৯৪৭ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর সুচন্দার জন্ম যশোরের সাতক্ষীরায়। তাঁর পিতা এএসএম নিজামউদ্দীন আইয়ূব সরকারি কর্মকর্তা ছিলেন। পাশাপাশি সাহিত্যচর্চাও করতেন। মা বেগম জাহান আরা ছিলেন একজন হোমিও চিকিৎসক। তিন বোন ও তিন ভাইয়ের মধ্যে সুচন্দা সবার বড়। স্কুল-কলেজে পড়াকালীন সময় থেকেই বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে তার অংশগ্রহণ ছিল। তিনি যশোরে কিশোরী নৃত্যশিল্পী হিসাবে জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন। যশোরে থাকাকালীন শকুন্তলা নাটকে অভিনয় করে তিনি খ্যাতি অর্জন করেন।
১৯৬৭ সালে ‘বেহুলায’ ছবিতে অভিনয় করার সময় লেখক ও পরিচালক জহির রায়হানের সঙ্গে সুচন্দার সম্পর্ক তৈরি হয় এবং একই বছর তারা বিয়ে করেন। এই দম্পতির দুই ছেলে ভাব বিনিময় হয় এবং ১৯৬৭ সালে তাকে বিয়ে করেন। আরাফাত রায়হান অপু ও তপু রায়হান। জহির রায়হান ১৯৭২ সালের ৩০ জানুয়ারি বড় ভাই শহীদুল্লাহ কায়সারকে খুঁজতে গিয়ে নিখোঁজ হন। এরপর ১৯৭৬ সালে সুচন্দা ব্যবসায়ী এম রেজাউল মালিককে বিয়ে করেন। তাদের দুই মেয়ে রাফাইয়াৎ মালিক ও রাফাইয়া মালিক।
ঢাকাটাইমস/০৩জুন/এএইচ

মন্তব্য করুন