দায় মেটানোর ডলার: সংকটে ২০ ব্যাংক
ঋণপত্রের দায় ব্যাংকের ঘাড়ে
ডলার সংকটে বিপাকে পড়েছে ক্ষুদ্র, মাঝারি এবং বড় ব্যবসায়ীরা। দেশের অন্তত ২০টি ব্যাংকের কাছে ঋণপত্রের (এলসি) দায় মেটানোর মতো ডলার না থাকায় পণ্য আমদানি করতে পারছেন না ব্যবসায়ীরা। বিশ্ববাজারে পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় আমদানির দায় পরিশোধ করতে গিয়ে এ সংকটে পড়েছে ব্যাংকগুলো। বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশ ব্যাংক রিজার্ভ থেকে যে টাকা দিচ্ছে সেটা যেন সঠিক খাতে ব্যয় হয়, সে বিষয়ে কঠোর নজরদারি রাখতে হবে। এছাড়া ডলারের বাজার উন্মুক্ত করে দেওয়ার কথাও বলছেন তারা।
বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, সার বা খাদ্যের মতো পণ্য আমদানিতে সরকারি ঋণপত্রের মূল্য পরিশোধে বাংলাদেশ ব্যাংক সতর্ক থাকবে এবং প্রয়োজনে সহায়তা করবে।
জানা গেছে, গত জুলাই মাসে ডলার ধরে রাখতে কয়েকটি পণ্য আমদানিতে শতভাগ মার্জিন আরোপ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। এরপরও ব্যাংক ঋণপত্র খুলছিল। কিন্তু অক্টোবরে এসে ব্যাংক একেবারেই ঋণপত্র খোলা বন্ধ করে দেয়। এখন যাদের শুধুমাত্র রপ্তানি আয় আছে ও বড় ব্যবসায়ী, ব্যাংক শুধু তাদের ঋণপত্রই খুলছে। বর্তমানে ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ায় সব ধরনের পণ্যের দাম বেড়ে গেছে। গত এক বছরে প্রতি ডলারে বাংলাদেশি মুদ্রার মান কমেছে ২০ টাকার মতো।
এদিকে বাজারের অস্থিরতা কমাতে রিজার্ভ থেকে বৈদেশিক মুদ্রা বিক্রি করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তবুও ডলার সংকট কমছে না। পাশাপাশি রপ্তানি আয় ও রেমিট্যান্স কমায় দিন দিন রিজার্ভে চাপ বাড়ছে। এদিকে ব্যাংকগুলোর কাছে ডলার না থাকায় এলসি না খুলতে পারার পাশাপাশি অনেক ব্যাংক ঘাটতিতে রয়েছে।
জানা গেছে, রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন অগ্রণী ব্যাংকের অনুমোদিত ডলার সংরক্ষণের ক্ষমতা ৫২ মিলিয়ন বা ৫ কোটি ২০ লাখ ডলার। বিভিন্ন ক্ষেত্রে আমদানি দায় মেটানোর পরও এ পরিমাণ ডলার নিজেদের হিসাবে সংরক্ষণ করতে পারে ব্যাংকটি। কিন্তু বর্তমানে বাণিজ্যিক ব্যাংকটির কাছে দায় মেটানোর মতো কোনো ডলারই নেই। বরং ২৫৬ মিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে ঘাটতি। আর সেটা মেটানো হয়েছে গ্রাহকদের হিসাবে থাকা ডলার ভাঙিয়ে। ডলার সংকটে ঠিক মতো ঋণপত্রের (এলসি) দায়ও পরিশোধ করতে পারছে না ব্যাংকটি। দায় পরিশোধে নিয়মিত ব্যাংকটি বিলম্ব করে যাচ্ছে। বেসরকারি খাতের এক্সিম ব্যাংকের ডলার ধারণ ক্ষমতা ৫৩ মিলিয়ন হলেও এ মুহূর্তে উদ্বৃত্ত কোনো ডলার নেই। বরং ৮৮ মিলিয়ন ডলার ঘাটতিতে পড়েছে।
এই পরিস্থিতি এখন দেশের বেশির ভাগ ব্যাংকের। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য মতে, দেশের অন্তত ২০টি ব্যাংকের কাছে এলসি দায় মেটানোর মতো কোনো ডলার নেই। রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয় থেকে পাওয়া ডলার দিয়েও নিজেদের আমদানি দায় ও গ্রাহকদের বিদেশি ঋণ পরিশোধ করতে পারছে না। ফলে নতুন এলসি খোলা প্রায় বন্ধ করে দিয়েছে ব্যাংকগুলো।
এদিকে ডলার সংকটে দেশের অনেক ব্যাংকই নির্ধারিত তারিখে এলসি দায় পরিশোধ করতে পারছে না। এ অবস্থায় এলসির নিশ্চয়তা দেয়া বিদেশি ব্যাংকগুলোর কাছে বাংলাদেশের ব্যাংক খাতের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে সবচেয়ে বেশি ডলার ঘাটতিতে রয়েছে অগ্রণী ব্যাংক। ব্যাংকটির ঘাটতির পরিমাণ ২৫৬ মিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে। এছাড়া এক্সিম ব্যাংক ৮৮ মিলিয়ন, ঢাকা ব্যাংক ৬৮, শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক ৬৪, ইউসিবিএল ৪৯, দ্য সিটি ব্যাংক ৪৭, পূবালী ব্যাংক ৪৫, প্রাইম ব্যাংক ৪২ ও সাউথইস্ট ব্যাংক ৪১ মিলিয়ন ডলার ঘাটতিতে রয়েছে। ইস্টার্ন ব্যাংকের ঘাটতির পরিমাণ ৩৫ মিলিয়ন ডলার। মার্কেন্টাইল ব্যাংক ৩৪, ওয়ান ব্যাংক ৩২, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক ২৭, ন্যাশনাল ব্যাংক ২৪, ব্যাংক এশিয়া ১৪ ও স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ১১ মিলিয়ন ডলার ঘাটতিতে রয়েছে। এছাড়া ট্রাস্ট ব্যাংকের ৮ মিলিয়ন, ব্র্যাক ব্যাংকের ৮ মিলিয়ন এবং এনসিসি ব্যাংকের ৮ মিলিয়ন ডলার ঘাটতি রয়েছে। বিদেশি খাতের কমার্শিয়াল ব্যাংক অব সিলনেও ৪ মিলিয়ন ডলার ঘাটতি রয়েছে।
গত বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রকাশিত হালনাগাদ প্রতিবেদনে বৈদেশিক লেনদেনের চলতি হিসাবের ভারসাম্য (ব্যালান্স অব পেমেন্ট) এ তথ্যে জানা গেছে, চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে (জুলাই, আগস্টও সেপ্টেম্বর) দেশে বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৭৫৫ কোটি মার্কিন ডলার। একই সময়ে বৈদেশিক লেনদেনের চলতি হিসাবের ভারসাম্যে ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৩৬১ কোটি ডলারে। একই সময়ে ১ হাজার ৯৩৫ কোটি ডলারের পণ্য আমদানি হয়েছে। তার বিপরীতে রপ্তানি হয়েছে ১ হাজার ১৮০ কোটি ডলারের পণ্য। ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশনের (এফবিসিসিআই) সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন বলেন, ‘ব্যবসায়ীরা যখন ডলার–সংকটের কারণে ঋণপত্র খুলতে পারছেন না, তখন কিছু ব্যাংক ডলারের ব্যবসা করে মাসে ২০০ থেকে ৩০০ কোটি টাকা পর্যন্ত মুনাফা করেছে। অবশ্য এই সময়ে মানুষ শেয়ারবাজার ছেড়ে ডলারের ব্যবসায় নেমেছে। কিন্তু সংকটকে পুঁজি করে এমনটা করা ঠিক না।’
তিনি বলেন, ‘আমি চাই না ব্যাংকের বর্তমান সুদ হার উঠিয়ে দেওয়া হোক। তাতে ব্যবসায়ীরা আরও চাপে পড়বেন, শিল্প উৎপাদন আরও কমতে পারে।’ এফবিসিসিআই সভাপতি দেশের ব্যাংক খাতের সুশাসন নিশ্চিত করা, অর্থ পাচার রোধ, রপ্তানি বৈচিত্র্যকরণ ও জ্বালানি সংকটে সংশ্লিষ্ট সবাইকে একযোগে কাজ করার আহ্বান জানান।
বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশ আবাসিক মিশনের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংক আগে যেভাবে সবার কাছে ডলার বিক্রি করত বর্তমানে সে অবস্থাতে নেই। এখন ডলারের বাজার উন্মুক্ত করে দেওয়া দরকার। যে যেখান থেকে পারে ডলার সংগ্রহ করে এলসি খোলার জন্য বলে দেওয়া উচিত।’
তিনি বলেন, ‘এখন কম রেটে ডলারের দাম বাংলাদেশ ব্যাংক বেঁধে দেওয়ায় সবাই এর ওপর নির্ভরশীল। হুন্ডি মার্কেটে বেশি দাম পাওয়ায় প্রতিযোগিতার সুযোগ নেই এখানে।’
‘বাংলাদেশ ব্যাংক রিজার্ভ থেকে যে টাকাটা দিচ্ছে সেটা যেন সঠিক খাতে ব্যয় হয় সে বিষয়ে কঠোর নজরদারি রাখতে হবে।’-যোগ করেন এই অর্থনীতিবিদ। সামগ্রিক বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র জিএম আবুল কালাম আজাদ ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘সম্প্রতি একটি সিদ্ধান্ত হয়েছে যে, বিভিন্ন বাণিজ্যিক ব্যাংক বৈদেশিক মুদ্রার যে আন্তঃপ্রবাহ এবং বহিঃপ্রবাহ করবে, এই বিষয়টা স্ব-স্ব ব্যাংক নিজেদের মধ্যে করবে।’
তিনি আরও জানান, ‘সার বা খাদ্যের মতো পণ্য আমদানিতে সরকারি ঋণপত্রের মূল্য পরিশোধে বাংলাদেশ ব্যাংক সতর্ক থাকবে এবং প্রয়োজনে বাংলাদেশ ব্যাংক সহায়তা করবে।’
গত কয়েক মাসে বাংলাদেশ ব্যাংক যে ৫ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করেছে সেটি কোন ক্ষেত্রে করেছে প্রশ্নে তিনি বলেন, সুনির্দিষ্ট গাইডলাইনেরভিত্তিতে এই ডলার খরচ করা হয়েছে।
(ঢাকাটাইমস/০৭নভেম্বর)