বন্ড সুবিধা নিয়ে শত কোটি টাকার কাপড়-সুতা ‘হাওয়া’

রুদ্র রাসেল, ঢাকাটাইমস
| আপডেট : ০৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১১:৫১ | প্রকাশিত : ০৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১১:৪৭

এক যুগের বেশি সময় ধরে বন্ড সুবিধা ব্যবহার করে পোশাক তৈরির শুল্কমুক্ত কাঁচামাল আমদানি করে খোলাবাজারে বিক্রি করেছে গাজীপুর সদরের সোয়ান নিট ম্যানুফ্যাকচারিং লিমিটেড। এছাড়া এফওসি (ফ্রি অব কস্ট) সুবিধার আওতায় নিজেদের পরিশোধিত মূল্যে বিদেশি ক্রেতারা করে যেসব কাঁচামাল বা কাপড় পাঠাতেন, তাও বিক্রি করে তাদের সঙ্গে প্রতারণা, অর্থপাচারসহ বিভিন্ন দুর্নীতি-অনিয়ম করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।

২০১০ সাল থেকে সোয়ান নিট ম্যানুফ্যাকচারিং লিমিটেড এমন জালিয়াতির মাধ্যমে শত কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। বিষয়টি শুল্ক গোয়েন্দাদের তদন্তে ধরা পড়লে সম্প্রতি স্থগিত করা হয় প্রতিষ্ঠানটির বন্ড লাইসেন্সের কার্যক্রম।

কাস্টমসের একটি সূত্র জানায়, প্রতিষ্ঠানটির ব্যাংক হিসাব ফ্রিজ করাসহ শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের প্রক্রিয়া এগিয়ে চলছে। প্রতিষ্ঠানটির বন্ড লাইসেন্স বতিল হওয়াসহ বাজেয়াপ্ত করা হতে পারে বন্ডের বিপরীতে জামানত থাকা ৩০ লাখ টাকা। গ্রেপ্তার ছাড়াও অর্থদণ্ড-কারাদণ্ডের মতো শাস্তির মখোমুখিও হতে পারেন প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান, ব্যবস্থাপনা পরিচালক, নির্বাহী পরিচালক ও প্রতিষ্ঠানের জড়িত কর্মকর্তারা।

এ বিষয়ে প্রতিষ্ঠানের এসব শীর্ষ কর্মকর্তারা ঢাকা টাইমসের কাছে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। বন্ডের সুবিধায় এ পর্যন্ত আনা কয়েকশ কোটি টাকার শুল্কমুক্ত রপ্তানিকৃত পোশাক তৈরির কাঁচামাল দেশে এনে নির্দিষ্ট সিন্ডিকেটের সহায়তায় খালাসের পর হাওয়া করে দেওয়ার বিষয়ে কথা বলতে অনিহা প্রকাশ করেন তারা।

তবে কাস্টমস কর্মকর্তারা বলছেন, পোশাক রপ্তানিকারক ‘সোয়ান নিট’ এ পর্যন্ত কত পরিমাণ কাঁচামাল ও কাপড় বিদেশ থেকে এনেছেন, আর কি পরিমাণ তৈরি পোশাক রপ্তানি করেছেন—তা জানতে সংশ্লিষ্ট সরকারি দপ্তরগুলো থেকে তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে।

আইনের বাত দিয়ে কর্মকর্তারা জানান, বন্ড সবিধায় যে কাঁচামাল বিদেশ থেকে আমদানি করা হয়, এর সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ওই পরিমাণ তৈরি পোশাক সংশ্লিষ্ট দেশে রপ্তানির নিয়ম রয়েছে। এছাড়া প্রতিষ্ঠানটিকে বিদেশি বায়াররা এফওসি (ফ্রি অব কস্ট) সুবিধার আওতায় নিজেরা মূল্য পরিশোধ করে যেসব কাপড় পাঠিয়েছেন, তার বিপরীতে কি পরিমাণ পোশাক ওইসব কোম্পানিকে পাঠিয়েছে- তা তদন্ত করে দেখা হচ্ছে।

সোয়ান নিটের অনিয়ম অডিটসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা ঢাকা টাইমসকে বলেন, প্রতিষ্ঠানটির আমাদানি ও রপ্তানিকৃত পোশাকের যে অসাঞ্জস্যতা ধরা পড়েছে, এসব বেআইনি কর্মকাণ্ড থেকে পার পাওয়ার সুযোগ নেই। এর বাইরেও এই অবৈধ কর্মকাণ্ডে আরও কারা জড়িত, কে কে এর মাস্টারমাইন্ড- তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। প্রতিষ্ঠানটির লেনদেনসহ সব কার্যক্রম নজরদারি করা হচ্ছে বলেও জানায় কাস্টমস সূত্র।

আর ঢাকার কাস্টমস বন্ড কমিশনারেটের প্রধান, কমিশনার মোহাম্মদ আহসানুল হক পুঙ্খানুরূপে তদন্তের মাধ্যমে সোয়ান নিট ও এর কর্ণধারদের শাস্তির আওতায় আনার কথা জানান। এ বিষয়ে জিরো টলারেন্স নীতির কথাও ঢাকা টাইমসকে বলেন কমিশনার আহসানুল।

গেল ডিসেম্বর মাসের শেষ দিকে প্রতিষ্ঠানটির ওয়্যার হাউজে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা অভিযান চালালে বেরিয়ে আসে থলের বিড়াল। ধরা পড়ে বন্ড সুবিধায় রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে আনা কাঁচামালের হেরফের। তদন্তে ফাঁস হয় সরকারের কোটি টাকার বেশি রাজস্ব ফাঁকি দেওয়াসহ কোটি কোটি টাকার কাঁচামাল আমদানির গোমর।

পরে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের প্রধানের নির্দেশে প্রতিষ্ঠানটির গত ৩ বছরের আমদানি করা কাঁচামাল ও রপ্তানিকৃত পোশাকের হিসেবে ব্যাপক গড়মিল পান অডিটকারী কর্মকর্তারা। এছাড়া আমদানির আড়ালে অর্থপাচার ও বন্ডসুবিধার শর্ত ভাঙার বিষয়টি উল্লেখ করে অডিট প্রতিবেদন দাখিল করেন রাজস্ব কর্মকর্তা ও শুল্ক গোয়েন্দাদের সমন্বিত ৫ সদস্যের একটি টিম।

ওই প্রতিবেদনে পোশাক রপ্তানির জন্য বন্ড সুবিধার আড়ালে শত কোটি টাকা হেরফেরের বিষয়টি উঠে এলে গত ১৯ জানুয়ারি প্রতিষ্ঠানটির বন্ড লাইসেন্স সাসপেন্ড (স্থগিত) করা হয়। কাগজে-কলমে অডিট কর্মকর্তারা যে পরিমাণ আর্থিক দুর্নীতি ও অনিয়ম পেয়েছেন, তার কয়েকগুন টাকা প্রতিষ্ঠানটি লোপাট করেছে বলে ধারণা করছেন সংশ্লিষ্ট অডিট কর্মকর্তারা। অডিটে সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা ঢাকা টাইমসকে বলেন, খুব সুক্ষ্মভাবে জালিয়াতি করেছে প্রতিষ্ঠানটি। একদিকে সরকার রাজস্ব হারিয়েছে, অন্যদিকে অর্থপাচারসহ বিদেশের বায়ারদের কাছে দেশের পোশাক খাতের সুনাম ক্ষুণ্ণ হয়েছে, বলেন সংশ্লিষ্ট একাধিক কর্মকর্তা।

অন্যদিকে সোয়ান নিটের জালিয়াতি কর্মকান্ডের তদন্ত করতে গিয়ে প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. হামিদুর রহমানের সার্ক ডিজাইন লিমিটেড নামে আরেক প্রতিষ্ঠানের জালিয়াতিও উঠে আসে। সেটিরও ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) তিনি। ওই প্রতিষ্ঠানটির নামে শুল্কমুক্ত সুবিধায় আনা রপ্তানিকৃত পোশাক তৈরির কাঁচামাল খোলা বাজারে বিক্রি করে তা ধামাচাপা দিতে সোয়ানের নামে আমদানি করা কাঁচমাল দিয়ে সার্ক ডিজাইনেও উৎপাদন চালিয়ে যাচ্ছিলেন নামমাত্র। ২০১৫-১৬ অর্থবছর থেকে এ কৌশলে দুর্নীতির মাধ্যমে অর্থলোপাট করা হচ্ছিল বলে তদন্ত চালিয়ে ২০১৯ সালে নিশ্চত হন শুল্ক গোয়েন্দা কর্মকর্তারা। ব্যবস্থাগ্রহণ করা হয় সার্ক ডিজএনর বিরুদ্ধে। বন্ধ করে দেওয়া হয় বন্ড সুবিধায় আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম। ওই বছরের ১৯ ডিসেম্বর তৎকালীন সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা মা. সাজিবুল ইসলাম বাদী হয়ে অর্থপচারের অভিযোগ এনে একটি মামলা করেন। এতে এমডি হামিদুর রহমান এবং সার্ক ডিজাইনের পরিচালক মো. গোলাম কিবরিয়াকে আসামি করা হয়। মামলাটি বিচারাধীন রয়েছে।

সোয়ান নিট কম্পোজিটরের বন্ড লাইসেন্স স্থগিত করার তথ্য নিশ্চিত করে ঢাকার কাস্টমস বন্ড কমিশনারেটের কমিশনার মোহাম্মদ আহসানুল হক ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘প্রতিষ্ঠানটির বিষয়ে পরবর্তী আইনি পক্রিয়া চলমান। বন্ড সুবিধার নামে জালিয়াতি বা যে কোনো ধরনের অনিয়মের বিষয়ে আমরা কঠোর অবস্থানে রয়েছি।’ আইনানুযায়ী প্রতিষ্ঠানটি ও কর্তৃপক্ষের বিরদ্ধে ধাপে ধাপে ব্যবস্থা গ্রহণের প্রক্রিয়া অব্যাহত রয়েছে বলেও জানান এই কাস্টমস কমিশনার।

এদিকে এ বিষয়ে প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান একেএম মুজতাবা, ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. হামিদুর রহমান, নির্বাহী পরিচালক সাইদুর রহমানকে একাধিকবার ফোনকল ও খুদে বার্তা এবং হোয়াটস বার্তা পাঠিয়ে এ বিষয়ে বক্তব্য চাওয়া হলে তারা এড়িয়ে যান। হোয়াটস বার্তা সিন করলেও উত্তর দেননি। ফোনে পাওয়া যায় প্রতিষ্ঠানটির ওয়েবসাইটে জেনারেল ম্যানেজার হিসেবে উল্লেখ থাকা আবেদ আলী মামুনকে। তবে তিনি ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘কয়েক মাস ধরে প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে তার সম্পর্ক নেই।’

একপর্যায়ে এই জালিয়াতির বিষয়ে কর্তৃপক্ষ গণমাধ্যমে মন্তব্য করবেন না বলে ইঙ্গিত দেন তিনি। তবে বুধবার সন্ধ্যা ৭টা ১৮ মিনিটে এ রিপোর্ট লেখার সময়েও আবেদ আলী মামুনের নাম সোয়ান নিটের ওয়েবসাইটে দেখা গেছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কানাডা, ফ্রান্স, বেলজিয়াম, ইউকে, পোল্যান্ড, ইতালি ও সবচেয়ে বেশি ইউএসএর ক্রেতা (বায়ার) ক্রয়াদেশ দিত প্রতিষ্ঠানটিতে।

তবে শতভাগ তৈরি পোশাক শিল্পের উদ্যোক্তারা আগের বছরের রপ্তানির এক তৃতীয়াংশ কাপড় ফ্রি অব কস্ট (এফওসি) সুবিধায় পতেন। অর্থাৎ বিদেশি বায়াররা ওই পরিমান কাপড় কিনে সংশ্লিষ্ট বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠানকে পাঠাতেন- ওই কাপড় দিয়ে পোশাক তৈরি করে ফের ওই বায়ারদের কাছে পাঠানোর জন্য। ২০০২ সালে এফওসি সুবিধা চালু হয়। এ সুবিধা ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে এফওসি জাল করে প্রাপ্যতার চেয়ে অতিরিক্ত কাঁচামাল আনা হচ্ছিল সার্ক ডিজাইন লিমিডেট ও সোয়ান নিট কম্পোজিটর লিমিটেড নামে প্রতিষ্ঠঅন দুটিতে, যার এমডি হামিদুর রহমান। তিনিই মূলহোতা, বলছেন তদন্তকারী কাস্টমস কর্মকর্তারা।

এছাড়া সদ্য বন্ড লাইসেন্স স্থগিত হওয়া সোয়ান নিটের একটি লিয়েন ব্যাংক হিসাব রয়েছে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশের গাজীপুর চৌরাস্তা শাখায়। বন্ডের সুবিধার নামে এসব অনিয়ম করে লোপাট করা অর্থ ওই ব্যাংক হিসাবে রয়েছে বলে সেটি ফ্রিজ করার কথা ভাবছেন কাস্টমস কর্মকর্তারা।

(ঢাকাটাইমস/০৯ফেব্রুয়ারি/আরকেএইচ/ডিএম)

সংবাদটি শেয়ার করুন

বিশেষ প্রতিবেদন বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন এর সর্বশেষ

দুই জঙ্গি ছিনতাইয়ে গ্রেপ্তার হন সাবেক রেলমন্ত্রীর এপিএস, যেভাবে উত্থান তার

‘মেড ইন জিনজিরা’: অবহেলিত সম্ভাবনার স্বপ্ন দুয়ার 

ইবনে সিনা হাসপাতালে রুশ কিশোরীকে যৌন হয়রানি: অভিযোগের সত্যতা পেয়েছে পুলিশ

ভারতের রপ্তানির খবরে ১০ টাকা কমলো পেঁয়াজের দাম

অবন্তিকার আত্মহত্যা: এখনো মেলেনি তদন্ত প্রতিবেদন, থমকে গেছে আন্দোলন 

সড়কে এআইয়ের ছোঁয়া, বদলে যাচ্ছে ট্রাফিক ব্যবস্থা 

এখন তিন হাসপাতালে রোগী দেখছেন সেই ডা. সংযুক্তা সাহা

কোরবানির ঈদ সামনে, মশলার বাজারে উত্তাপ

প্রতিমন্ত্রীর শ্যালকের অপহরণকাণ্ড: ১৬ দিনেও গ্রেপ্তার হননি আলোচিত লুৎফুল হাবীব

মে দিবস বোঝে না শ্রমিকরা, জানে ‘একদিন কাজ না করলে না খেয়ে থাকতে হবে’

এই বিভাগের সব খবর

শিরোনাম :