পর্যটনের টেকসই উন্নয়নে ট্যুরিস্ট পুলিশের দায়

ড. মোহাম্মাদ আনিস রহমান
 | প্রকাশিত : ১৪ মার্চ ২০২৩, ১৫:৪৯

দৃষ্টিনন্দন, বৈচিত্র্যপূর্ণ, বহুমাত্রিক এবং নয়নাভিরাম আকর্ষণসমৃদ্ধ পর্যটনের লীলাভূমি বাংলাদেশ। কাশফুল কিংবা ঘাসফুলের মোহনীয় আকর্ষণও মানুষের মনকে এখন আন্দোলিত করে বলে প্রায় প্রতিটি পরিবার বছরের কোনো একটা সময় গ্রাম থেকে শহর কিংবা শহর থেকে গ্রাম, ঝর্ণা থেকে পাহাড়, নদী থেকে সাগর ভ্রমণে বের হয়। লক্ষ লক্ষ মানুষ পর্যটন শিল্পে পেশাজীবী হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেছে। ১২০ কিমি দীর্ঘতম অবিচ্ছিন্ন সমুদ্র সৈকত পর্যটন নগরী কক্সবাজার, সমুদ্রকন্যা কুয়াকাটা, সিলেট কিংবা পঞ্চগড়ের চা বাগানের নয়নাভিরাম আকর্ষণ বাঙালির কাছে এখন নাড়ির টানের মতো মনে হয়। অথচ বিশাল সম্ভাবনাময় পর্যটন শিল্পে পর্যটক আকর্ষণ, পর্যটনের বিকাশ এবং পর্যটকের নিরাপত্তার জন্য সময়োপযোগি ও সমন্বিত পরিকল্পনার অভাব আমাদেরকে পিছিয়ে রেখেছে বিশ্ব পর্যটন শিল্প থেকে অনেক দূরে। যদিও ২০২৫ সালের মধ্যে পর্যটন শিল্পের সর্বোচ্চ বিকাশে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিয়েছে সরকার। সমগ্র দেশে প্রায় ১৪০০টির অধিক পর্যটন আকর্ষণ চিহ্নিত করেছে বাংলাদেশ পর্যটন করপেরেশন। কক্সবাজার থেকে টেকনাফ পর্যন্ত সাগরের পাড়ে ৮০ কিলোমিটার দীর্ঘ মেরিন ড্রাইভ নির্মাণ, ৬ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে চাঁদপুরের মেঘনার চরে আন্তর্জাতিক মানের পর্যটন কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা প্রকল্প এবং ২০০ কোটি মার্কিন ডলারের অর্থনৈতিক কার্যক্রমের অংশ হিসেবে সাবরাং ট্যুরিজম পার্ক, নাফ ট্যুরিজম পার্ক এবং সোনাদিয়া ইকো ট্যুরিজম পার্ক তৈরির পরিকল্পনা বাংলাদেশে পর্যটন শিল্পে নতুন মাত্রা দেবে বলে মনে করা যায়। ২০০৯ সালে বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পর্যটক ও পর্যটন শিল্পের সামগ্রিক নিরাপত্তার বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে বাংলাদেশ পুলিশের বিশেষ শাখা হিসাবে ট্যুরিস্ট পুলিশ ইউনিট প্রতিষ্ঠা করেন এবং ২০১৩ সালের নভেম্বর মাসে দেশে ট্যুরিস্ট পুলিশ তার কার্যক্রম শুরু করে। নিঃসন্দেহে বিষয়টি সময়োপযোগি। তবে গত এক যুগ ধরে ট্যুরিস্ট পুলিশের পরিধিকে আমরা পর্যটন শিল্পের নিরাপত্তা ও বিকাশে কতটুকু সমৃদ্ধ করতে পেরেছি সেই চিন্তা কি কখনো করে দেখেছি?

দুই. বাংলাদেশের পর্যটন শিল্পে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে প্রায় ২৩ লাখ লোক জড়িত। প্রতি বছর আবার লক্ষ লক্ষ ভ্রমণপ্রেমী মানুষ বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকার পর্যটন স্থানে ভ্রমণ করে থাকে। ভ্রমণপিপাসু দেশি-বিদেশি পর্যটকের জান-মাল ও সম্মানের নিরাপত্তা এবং পর্যটকদের বিরুদ্ধে অপরাধের তদন্তের বিষয়টিকে কেন্দ্র করেই বাংলাদেশ পুলিশের একটি বিশেষ শাখা হিসেবে ট্যুরিস্ট পুলিশ বা পর্যটন পুলিশের অগ্রযাত্রা নিঃসন্দেহে বিজ্ঞানসম্মত ও যৌক্তিক সিদ্ধান্ত। কিন্তু শুধু শুধু সৃষ্টিতেই সন্তুষ্টি থাকলে হবে না বরং ট্যুরিস্ট পুলিশের পরিধিকে বিস্তৃত করতে হবে অনেক দূরে। সাম্প্রতিক কক্সবাজারে পর্যটক নারীকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনা অনেক না বলা অভিযোগকে সামনে এনেছে। এমন অনেক ঘটনা অতীতে ঘটে থাকতে পারে যা সামনে আসেনি। লোকলজ্জা বা সম্মানের ভয়ে অনেক নির্যাতনকারী মুখ খোলেনি। এছাড়াও জোরপূর্বক লুণ্ঠন, ছিনতাই, কিংবা স্থানীয়দের মধ্যে ‘দাদাগিরি’ ভাব দেখানোর প্রবণতা প্রায় সব এলাকার পর্যটন স্থানগুলোতে কম-বেশি দেখা যায়। কিশোর গ্যাং-এর সৃষ্টি পর্যটন স্থানগুলোতে নতুন সংযোজন। কাজেই এসব বিষয়গুলো প্রতিরোধ ও প্রতিকারের বিবেচনায় একটি সুসজ্জিত ইউনিট হিসাবে ট্যুরিস্ট পুলিশের সৃষ্টি ও উন্নয়ন নিঃসন্দেহে আশার আলো দেখাবে।

তিন. পর্যটকদের নিরাপত্তা ও নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত করা, ভ্রমণ অনুকুল পরিবেশ নিশ্চিত করা, পর্যটকদের আইনগত সহায়তা প্রদান, জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ এবং সর্বোচ্চ পেশাদারত্ব বজায় রাখা-এমন পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ কাজের মাধ্যমে ট্যুরিস্ট পুলিশ দেশ ও জাতির সেবায় পর্যটন শিল্পের উন্নয়নে ভূমিকা রাখছে। এ কথা সত্যি যে, পর্যটন মৌসুমে ট্যুরিস্ট পুলিশের প্রয়োজনীয়তা সমধিক। মৌসুম ব্যতিত ট্যুরিস্ট পুলিশের কার্যাবলী অর্ধেক কমে যাওয়া স্বাভাবিক। পুলিশের বিভিন্ন ইউনিটের মধ্যে বদলীর ব্যবস্থা প্রচলন থাকায় পর্যটন মৌসুমে পরিধি বিস্তৃতির বিবেচনায় ট্যুরিস্ট পুলিশে অভিজ্ঞ, দক্ষ ও মানবসেবায় ব্রত আছে এমন সদস্যকে বদলী করে ইউনিটের কলেবর বৃদ্ধি করা জরুরি। ২০১৭ সালে মোবাইল অ্যাপ 'হ্যালো ট্যুরিস্ট ' চালু করেছে যার মাধ্যমে ট্যুরিস্ট পুলিশ পর্যটন খাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ও উন্নয়নমূলক কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। প্রেক্ষাপট বিবেচনায় ট্যুরিস্ট পুলিশে হেলিকপ্টার ব্যবস্থা থাকা উচিত। দিনের মত রাতের পর্যটন স্থানও নিরাপদ রাখা জরুরি। অপ্রয়োজনেও ট্যুরিস্ট পুলিশের টহল গাড়িতে হুইসেল বাজানোর ব্যবস্থা রাখা ভালো এবং জরুরি। এসব করা গেলে দেশী-বিদেশী পর্যটক যেমন বাড়বে, তেমনি বাড়বে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি। পর্যটকের দৃষ্টিসীমায় ট্যুরিস্ট পুলিশের টহল বৃদ্ধি; পর্যটন স্থানগুলোতে একাধিক ট্যুরিস্ট পুলিশের ফাঁড়ি কিংবা নিরাপত্তা চৌকি এবং সিসি ক্যামেরা স্থাপন করা; অবকাঠামো নির্মাণ, লজিস্টিক সাপোর্ট ও স্থাপনা নির্মাণসহ সাইনবোর্ড ও বিলবোর্ডসহ বিভিন্ন প্রচারণার মাধ্যম স্থাপন করা; পরিবহন সেবা ও আবাসিক ব্যবস্থাকে ট্যুরিস্ট পুলিশের সেবার আওতাভুক্ত করা; যানবাহনের টিকিটে ট্যুরিস্ট পুলিশের জরুরি সেবা নাম্বার বা হটলাইন নাম্বার (+8801320222222, +8801887878787) আবশ্যকভাবে থাকা; পর্যটকদের ভ্রমণকালীন সময়ের যাবতীয় তথ্য যেমন আসা-যাওয়া, যেখানে থাকবেন সেখানকার তথ্য সবকিছু লিপিবদ্ধ থাকার জন্য ট্যুরিস্ট পুলিশের অনলাইন নিবন্ধন ব্যবস্থা থাকা এবং সে অনুযায়ি কর্মপরিধি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের ব্যবস্থা থাকলে বাংলাদেশের পর্যটন শিল্প ট্যুরিস্ট পুলিশের হাত ধরেই বদলে যাবে।

চার. ট্যুরিস্ট পুলিশ শুধু পর্যটকদের যে কোনো সমস্যা সমাধান, হয়রানি রোধ, বখাটে ও সন্ত্রাসীদের তৎপরতা প্রতিহত করেন না বরং দেশি-বিদেশি পর্যটকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, প্রত্নসম্পদ চুরি ঠেকানো এবং পর্যটন সম্পদ ধ্বংস প্রতিরোধে ২৪ ঘণ্টা নিয়োজিত থেকে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রাখছে বা আরও উন্নয়নমূলক ভূমিকা রাখতে পারে। এজন্য উপযুক্ত সমাজনীতি (স্যোশাল পলিসি) নির্ধারণ, উপযোগী পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়নের ব্যবস্থা থাকা খুবই জরুরি। আর তাই ট্যুরিস্ট পুলিশে জনবল, প্রশিক্ষণ এবং সরঞ্জামের কোনো ঘাটতি আর কাম্য নয়। ট্যুরিস্ট পুলিশের সক্ষমতা প্রচার-প্রচারণার অভাবে যেমন প্রকাশ্যে আসেনি, তেমনি পরিচিতি এখনো অনেকটা সীমিত পর্যায়ে রয়েছে বলে মনে হয়। ৯৯৯-এর সেবা যেমন গ্রামের ঘরে ঘরে পৌছে গেছে, তেমনি পর্যটন মৌসুমে প্রশিক্ষণের বিষয়বস্তু এবং কর্মসূচিতে পরিবর্তন এনে ট্যুরিস্ট পুলিশের পরিচিতি প্রত্যেক পর্যটক যেন জানতে পারেন সে ব্যবস্থা থাকা অত্যন্ত জরুরি। বর্তমান উন্নয়নবান্ধব সরকার পদ্মাসেতু, মেট্রোরেল, কর্ণফুলি টানেল বাস্তবায়ন করে দেখিয়েছে উপযুক্ত পদক্ষেপ নিলে জনবান্ধব প্রকল্প বাস্তবায়ন সম্ভব। ঠিক একইভাবে বাংলাদেশের পর্যটন শিল্পের সামগ্রিক উন্নয়নে উপযুক্ত পদক্ষেপ নেয়ার এখনই সময়। এজন্য টেকসই পর্যটন শিল্পের বিকাশ ও উন্নয়নে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশন এবং ট্যুরিস্ট পুলিশকে সমন্বিত পদক্ষেপ নিতে হবে, এককভাবে নয়। টেকসই পর্যটন শিল্প বাংলাদেশের অর্থনৈতিকভিত্তি আরও মজবুত করতে পারে।

পাঁচ. ট্যুরিস্ট পুলিশ কিভাবে পর্যটনশিল্পে অবদান রাখছে-এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে দেখা যায়, ট্যুরিস্ট পুলিশের প্রথম এবং প্রধান কাজ হলো পর্যটকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, পর্যটকদের সুবিধা ও অসুবিধার বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে দ্রুত সময়ের মধ্যে সমাধানের চেষ্টা করা, কোনও ধরনের দুর্ঘটনা ঘটলে উদ্ধারকাজে অংশ নেয়া, কোনও পর্যটক অসুস্থ হলে চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করা, প্রাকৃতিক দুর্যোগের বিষয়ে বা কোনও ধরনের সতর্কবার্তা থাকলে সেটি তাৎক্ষণিক পর্যটকদের অবহিত করা, অভিযোগ পেলে সঙ্গে সঙ্গে ঘটনাস্থলে যাওয়া, দুর্ঘটনা ঘটলে উদ্ধারকাজে অংশ নেয়ার মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো ট্যুরিস্ট পুলিশ গুরুত্বের সাথে করে থাকেন। টেকসই পর্যটশিল্পের জন্য ট্যুরিস্ট পুলিশের মাধ্যমে কঠোর অথচ প্রয়োজনীয় মনিটরিং খুব বেশি দরকার এখন। রেসকিউ টিম ও বোট; তথ্যকেন্দ্র, সহায়তা ও হেল্থ ডেস্ক স্থাপন; পর্যবেক্ষণ টাওয়ার স্থাপন; যে পর্যটন স্থানগুলোতে ট্যুরিস্ট পুলিশিং কার্যক্রম নেই সেখানে জরুরি ভিত্তিতে ট্যুরিস্ট পুলিশ থানা স্থাপন জরুরি। আমরা প্রায় প্রতি বছর দেখে থাকি, পর্যটন মৌসুমে খাবার হোটেল ও আবাসিক হোটেলগুলো কারনে-অকারনে মূল্য বৃদ্ধি করে থাকে। অনেক পর্যটকের সমাগমে খাবারের গুনগতমান রক্ষা করে না। তাই ট্যুরিস্ট পুলিশেও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সংযুক্ত করা জরুরি যেন প্রয়োজনের সময় ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে ট্যুরিস্ট পুলিশ অভিযান চালাতে পারে। প্রচার-প্রচারণায় বাংলাদেশের সকল ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ার যথাযথ পদক্ষেপ নিয়ে ট্যুরিস্ট পুলিশের পাশে থাকা উচিত। ট্যুরিস্ট পুলিশেরও উচিত তাদের নিজস্ব সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের তথ্যসমৃদ্ধভাবে সর্বোচ্চ ব্যবহার করা যেন ফেসবুক ও ইউটিউব ব্যবহারকারী পর্যটক সব সময় অনুভব করে তাদের নিরাপদ ভ্রমণে ট্যুরিস্ট পুলিশ তাদের ছায়াসঙ্গি।

লেখক: সমাজনীতি ও কমিউনিটি স্বাস্থ্যনীতি বিষয়ক গবেষক এবং শিক্ষক, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, গোপালগঞ্জ।

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :