সংবাদকর্মী, আইন ও বৈশ্বিক বাস্তবতা

মো. সাখাওয়াত হোসেন
| আপডেট : ১২ এপ্রিল ২০২৩, ১৫:৫৫ | প্রকাশিত : ০৬ এপ্রিল ২০২৩, ১৪:১৯

যে কোন আলোচিত ইস্যুতে সংবাদমাধ্যমে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষ হতে জিরো টলারেন্স নীতির বিষয় অ্যাকশন গ্রহণে সাধারণ জনতার দিক থেকে তুমুল জনসমর্থন ও জোরালো সহায়তা পাওয়া যায়। অর্থাৎ প্রত্যেকেই মনে প্রাণে জিরো টলারেন্স নীতিকে অনুসরণ ও সমর্থন প্রদানের ক্ষেত্রে ইতিবাচক মানসিকতা বহন করে। জিরো টলারেন্সের মানে হচ্ছে, আইন সবার জন্য সমান, রাষ্ট্রের নিকট আপনার পরিচয় হচ্ছে আপনি রাষ্ট্রের নাগরিক, রাষ্ট্র আপনাকে এবং বাকি সবাইকে একইভাবে মূল্যায়ন করবে এবং সেক্ষেত্রে আপনার বংশগত পদমর্যাদা, পেশা ও অন্যান্য বিষয় ধর্তব্য নয়। মিডিয়া হাউসগুলো জিরো টলারেন্স নীতি অনুসৃতের ব্যাপারে তাদের সম্পাদকীয়তে ইতিবাচক আলোচনা তুলে ধরে।

সমস্যা হয় তখনি যখন মিডিয়া সংশ্লিষ্ট কারোর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয় প্রচলিত রীতি নীতির মাধ্যমে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য রাষ্ট্র উদ্যোগ গ্রহণ করে থাকে। এই সময় কতিপয় মিডিয়া হাউসগুলোর প্রকৃত চরিত্র উঠে আসে, তাদের ভাষ্য অনেকটা এরকম; মিডিয়া সংশ্লিষ্ট কারোর অপরাধ বিবেচনা করলেই কেমন একটা ধোঁয়াশা ইমেজ নিয়ে আসে সংবাদের মাধ্যমে। এই যেমন; দেশে আইনের শাসন নাই; স্বাধীন সাংবাদিকতাতে সরকার ভয় পাচ্ছে। মুক্তচিন্তার সুযোগ নেই এ দেশে; এহেন নানাবিধ শিরোনামে খবর বের হয় প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়াতে। আসলে বিশ্বব্যাপী কি প্রকৃত চিত্র এমন? পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে সাংবাদিক গ্রেফতারের ঘটনা ঘটছে, অথচ যে সব দেশের মিডিয়ায় এ দেশের ন্যায় এত আলোচনা সমালোচনা হয় না। স্ব স্ব দেশের আইনি কাঠামোর মাধ্যমে অভিযোগের ব্যাপারে প্রকৃত ব্যবস্থা গ্রহণের ব্যাপারে মিডিয়া কর্তৃপক্ষ উদ্যোগ গ্রহণ করে। সস্তা জনপ্রিয়তার আশায়, ভাইরাল হওয়ার মনোবাসনায় উদভ্রান্তের মত সংবাদ ঐ সকল দেশে হয় না, নির্লজ্জের মতো এ দেশেই হলুদ সাংবাদিকরা এহেন কর্মকান্ড করে থাকে।

মত প্রকাশের স্বাধীনতার জন্য পরিচিত অনেক পশ্চিমা দেশে সাংবাদিকদের গ্রেফতারের ঘটনা ঘটেছে। প্রেস ফ্রিডম ট্র্যাকারের তথ্য অনুযায়ী, পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে গত তিন বছরে যুক্তরাষ্ট্রে ২১৯ জন সাংবাদিক গ্রেফতার হয়েছেন। তুরস্কের কারাগারে ৩৫ জন সাংবাদিক জীবন কাটাচ্ছেন। রিপোর্টার্স উইথআউট বর্ডারের এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়। ঐ সকল দেশে কিন্তু আমাদের দেশের ন্যায় হই হই রব পড়ে যায় না। কারণ সেখানে আইনের ভিত্তিতে নিয়মানুযায়ী কৃতকর্মের উপর ভিত্তি করেই সাংবাদিকদের গ্রেফতার করা হয়। আমাদের দেশেও কিন্তু আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতেই গ্রেফতার করে থাকে, সেখানে সাংবাদিকদের ব্যাপারে যতটা আলোচনা সমালোচনা হয় অন্য পেশার বা অন্য শ্রেণির কারও ব্যাপারে তেমন দেখা যায় না। এটারও একটা ব্যাপক কারণ রয়েছে যার প্রেক্ষিতে সাংবাদিকরা তাদের মিডিয়া হাউসের বরাতে সাধারণ জনতার মনোযোগ আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়।

প্রতিবেদনে দেখা যায়, বর্তমানে সারা বিশ্বে ৫৫০ জনেরও বেশি সাংবাদিক কারাবন্দী রয়েছেন। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রেও বছরে গড়ে ৫০ জন সাংবাদিককে গ্রেফতার করা হয়। তবে, সংবাদ প্রকাশের জন্য সাংবাদিকদের গ্রেফতারের বেশিরভাগ ঘটনা ঘটে চীন, মিয়ানমার ও ইরানসহ কয়েকটি দেশে। উইকিলিকসের প্রতিষ্ঠাতা জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ যুক্তরাষ্ট্রের লাখ লাখ গোপন নথি প্রকাশ করেছেন। তিনি যুক্তরাজ্যে এক দশক ধরে বন্দী জীবন কাটাচ্ছেন এবং ২০১৯ সাল থেকে কারাগারে রয়েছেন। সুইডেনে তার বিরুদ্ধে ধর্ষণের মামলা রয়েছে।

শুধু অ্যাসাঞ্জই নন, প্রকাশিত সংবাদের কারণে বিশ্বজুড়ে সাংবাদিকদের গ্রেফতার বা কারারুদ্ধ হওয়ার আরও অনেক ঘটনা রয়েছে। বর্তমানে বিভিন্ন দেশে ৫৬৫ জন সাংবাদিক কারাবন্দী, যাদের অধিকাংশই বিনা বিচারে বছরের পর বছর ধরে কারাবন্দী। যেসব সাংবাদিক কারাগারে যান, তাদের দুই-তৃতীয়াংশের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রবিরোধী অপরাধের অভিযোগ আনা হয়। এছাড়া সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে অনেককে গ্রেফতার করা হয়েছে। বেশির ভাগ সাংবাদিকই চীনে বন্দী। বর্তমানে সে দেশে শতাধিক সাংবাদিক কারাগারে রয়েছেন। এছাড়া, মিয়ানমারে ৮০ জনকে আটক করা হয়েছে। বাংলাদেশে সংবাদকর্মীর সংখ্যা অসংখ্য, সে হিসেব তুলনায় বাংলাদেশে কোন কারণ ব্যতিরেকে সাংবাদিককে আটক করার নজির নেই। বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে দেখা যায়, অন্যান্য দেশেও সে দেশের আইন মোতাবেক সাংবাদিকদের গ্রেফতারের নজির রয়েছে কিন্তু সেখানে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা নেই এ মর্মে সংবাদ পরিবেশিত হয় না। আইনগত উপায়ে আটক ও গ্রেফতারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়।

আমাদের দেশে হলুদ সাংবাদিকতার অহরহ ঘটনা রয়েছে। নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য কিংবা সাধারণ জনতার কনসার্ন গ্রহণের আশায় সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে বিভিন্ন ধরনের ভিত্তিহীন সংবাদের উৎপত্তিও আমরা দেখেছি। সম্মানিত পাঠক, আপনি যদি এ দেশের কয়েকটি পত্রিকা পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে বিশ্লেষন করে পাঠ করেন তাহলে দেখবেন, পজিটিভ নিউজগুলো খুব গুরুত্ব দিয়ে প্রচারিত হয় না, বিপরীত দিকে নেগেটিভ নিউজগুলো গুরুত্বসহকারে বড় কলাম করে ছাপানো হয়ে থাকে। এসব খবরাখবর থেকে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম কি ধরনের দীক্ষা নিবে সেটা কিন্তু একটি বড় ভাবনার বিষয়। পদ্মা সেতু হচ্ছে না-এই সংবাদটি দেশের কয়েকটি সংবাদমাধ্যম যে গুরুত্ব দিয়ে তাৎপর্যখচিত ব্যাখ্যা দিয়ে পরিবেশন করেছে, বিপরীতপক্ষে যেদিন পদ্মা সেতুর উদ্বোধন হল সে সংবাদটিতে তেমন গুরুত্ব দেয়া হয়নি। এ ধরনের বিষয়গুলোকে অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে ব্যাখ্যা করা প্রয়োজন রয়েছে। কেননা একটি পক্ষই রয়েছে যারা খুব করে চায় বাংলাদেশ যেন পিছিয়ে যায়, বাংলাদেশ যেন গন্তব্য থেকে হারিয়ে যায়। এ ধরনের মিডিয়া হাউসগুলোর চরিত্র মাঝে মধ্যে দেখা যায়, অর্থাৎ তারা খোলস থেকে বেরিয়ে পড়ে। ষড়যন্ত্রকারীদের সঙ্গে আঁতাত করে এ দেশের বিরুদ্ধে প্রচারণায় নেমে পড়ে, এ ধরনের সাংবাদিকও এ দেশে রয়েছে। তবে সাহসী ও বিচক্ষণ সাংবাদিকও এ দেশে রয়েছেন, যারা এ দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে অনড় অবস্থানে থেকে নানাবিধ ত্যাগ স্বীকার করেছেন।

সাম্প্রতিক সময়ে স্বাধীনতার দিবসের প্রাক্কালে সংবাদ পরিবেশনের সূত্র ধরে যে ধরনের পক্ষ বিপক্ষ অবস্থান চলে এসেছে সেটি কিন্তু কোনভাবেই কাম্য নয়। আপনাকে বুঝতে হবে বিষয়টি কিন্তু মানুষের আবেগের এবং রাষ্ট্রীয় একটি পরিচ্ছন্ন ভাবমূর্তির সঙ্গে সম্পর্কিত। পুরো পৃথিবী যেখানে স্বাধীনতা দিবসের আয়োজনের মর্মার্থে বাংলাদেশের জনগণকে ও সরকারকে অভিনন্দন বার্তা জানাচ্ছে সে মোক্ষম সময়ে জনতার দৃষ্টি ভিন্ন দিকে প্রবাহিত করার বাসনায় এ ধরনের উদ্দেশ্য প্রণোদিত সংবাদ পরিবেশন স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্নের জন্ম দিবে। বিষয়গুলো আইনগতভাবেই সুরাহা হউক কিন্তু সেখানে সাংবাদিকদের অধিকার হরণ করা হচ্ছে, স্বাধীন সাংবাদিকতার পরিবেশ নাই-এ ধরনের বক্তব্য দিয়ে প্রকৃতঅর্থে বক্তারা কি বুঝাতে চাইছেন বিষয়টি বোধগম্য নয়। তবে দীর্ঘদিন ধরে বর্তমান সরকার ক্ষমতায়, প্রকাশ্যে কোন মিডিয়া হাউস সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলেনি এ মর্মে-সরকার তাদের মিডিয়াতে সংবাদ পরিবেশনে বাঁধা সৃষ্টি করছে। কিংবা কোন টিভি মিডিয়ার টকশোর মুক্ত আলোচনায় সরকার হস্তক্ষেপ করেছে-এ ধরনের অভিযোগ এখনো কেউ করেনি। কাজেই এ দেশে সাংবাদিকদের মত প্রকাশে স্বাধীনতা নেই-এ ধরনের অপপ্রচার কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।

সাংবাদিকদের উচিত হবে প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশন করা। সুনির্দিষ্ট বিষয়ে পক্ষ বিপক্ষের মতামত গ্রহণ সাপেক্ষে সংবাদ পরিবেশন করা তাহলে উভয় পক্ষের যুক্তি উপস্থাপিত হবে। সাংবাদিকতার নীতি অন্তত সে বিষয়েই সাক্ষ্য প্রদান করে থাকে। সাদাকে সাদা হিসেবে পরিবেশন করা এবং কালোকে কালো বলেই চিহ্নিত করা উচিত। হলুদ সাংবাদিকদের বয়কট করা জরুরী হয়ে পড়েছে। কেননা এরা দেশ ও জাতির শত্রু, ১/১১ এর সময়ে হলুদ সাংবাদিকতার চরিত্র উন্মোচিত হয়েছে। তাছাড়া হলুদ সাংবাদিকদের একটি গোষ্ঠী রয়েছে যারা সর্বত্রই বাংলাদেশ বিরোধী প্রচারনায় লিপ্ত। এমনো দেখা যায়, বাংলাদেশ যেখানে পরাজিত হয় সেসব সংবাদ কতিপয় সাংবাদিক উন্মুক্ত উল্লাসে প্রচারিত করে প্রকারান্তরে তাদের বাংলাদেশ বিরোধী অবস্থানকে নিশ্চিত করে।

লেখক: চেয়ারম্যান, ক্রিমিনোলজি এন্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :