জোনাকি এক্সপ্রেস

মাসুদ আহমেদ
 | প্রকাশিত : ২৩ এপ্রিল ২০২৩, ১৩:২১

মা, আমার মাথায় একটা আইডিয়া এসেছে।

পুত্রবধূ পৃথার কথায় মিনারা বেগম মনোযোগী হয়ে ওঠেন। মেয়েটি সবসময় ইতিবাচক ভাবনার কথা বলে।

-তো তোমার আইডিয়াটা কী?

-আম্মা, বলছিলাম আমার অফিসে সাপ্তাহিক ছুটির সঙ্গে বৃহস্পতিবারও একটা ছুটি পড়েছে। কোথাও যাবেন নাকি? আপনার ছেলেরও তো বন্ধ আছে।

-কথা তো ভালোই বলেছো কিন্তু তোমার নানা শ^শুরের বাড়ি ছাড়া আর যাবো কোথায়? নইলে সবই তো ঢাকা শহরের মধ্যে।

-না মা, আমি দূরে কোথাও যাবার কথা ভাবছি। বাসে চড়ে আর মুন্সীগঞ্জে নয়।

মিনারা বেগমের মনে হয় এতদিন তিনি অপাত্রে স্নেহ ঢালেননি। তাঁর চার পুত্রের তিনজনই বিবাহিত। বড় দুজন বিয়ের পর দুই-তিন মাস তাঁদের সঙ্গে ছিল। তারপর ঝড়ের বেগে আলাদা হয়ে চলে গেছে। এ বাসায় ঝামেলা বা ঝগড়া জাতীয় কিছু নেই। তৃতীয় পুত্র অনিক বিয়ে করলে মিনারা ও তার স্বামী প্রস্তুত ছিলেন এবার তারা আবার নিঃসঙ্গ হবেন। কারণ চতুর্থ পুত্র উপজেলায় কাজ করে। পরিসংখ্যান অফিসে। পাঁচ বছরেও সে ঢাকায় আসতে পারবে কি না সন্দেহ। আর তার বিয়ে হতেও চার-পাঁচ বছর লাগবে বলে দম্পতির ধারণা। কিন্তু বিয়ের এক বছর পরেও অনিক বা পৃথার কাছ থেকে মিনারা বেগম কেন্দ্রাতিগ বা বিচ্ছিন্নতাবাদী মনোভাবের কোনো চিহ্ন পেলেন না। কোনো নারী এই দাবি তুললে তা হয়ে ওঠে ইতিহাস এবং ইতিহাসের গতিকে রুদ্ধ করার মতো ব্যক্তিত্ব অন্তত তাঁর পুত্র মিউজিক কলেজের লেকচারার অনিকের নেই। মিনারা কদিনেই বুঝেছিলেন, তেমন আন্দোলন দানা বাঁধার সম্ভাবনা নেই।

ঝড় ওঠার আগে ঠান্ডা বাতাস, তারপর প্রচণ্ড দমকা হাওয়া, আকাশ কালো হওয়া এবং বজ্র বিদ্যুতের কানফাটা আর্তনাদ শোনা যায়। আসবাবপত্র ও কাচের জিনিস ছোড়াছুড়ির শব্দদূষণও কানে আসে। এ পর্যন্ত তেমন কিছু তাঁরা শোনেননি। তিনি বলেন, কক্সবাজারও তো গিয়েছি। তুমি কোথায় নেবার কথা ভাবছো?

-আম্মা চিটাগাং। কক্সবাজার তো গেছেন প্লেনে। এবার চলেন ট্রেনে যাই। যা একেকটা সার্ভিস এখন বের হয়েছে না। চমৎকার! অফিসের কাজে আমি দু-তিনবার চড়েছি।

মনের প্রবল আনন্দ তাঁর ফর্সা মুখমণ্ডলে চেপে রেখে তিনি বলেন, ব্যবস্থা করে ফেল। তাঁর এ আনন্দ তেইশ বছর পর শুধু রেলগাড়িতে চড়ার জন্য নয়।

কমলাপুর থেকে সুবর্ণা এক্সপ্রেস ছাড়লো বিকেল তিনটে বিয়াল্লিশে। মাত্র চারটি স্টেশন পথে ধরে এ ট্রেন বন্দর নগরীতে পৌঁছবে রাত ৯টার কাছাকাছি সময়ে। জানালার পাশে সিট পড়েছে মিনারার। পৃথা ইচ্ছে করেই তাঁকে ওখানে বসতে দিয়ে নিজে বসেছে তাঁর ডান পাশে। চেষ্টা করে অন্তত পিঠের বদলে মুখের সিট পাওয়া গেছে। মিনারা বেগম সামনের দিকে তাকিয়ে পুরো রাস্তার বাঁ দিক দেখতে পাবেন। বিকেল থেকে সন্ধ্যা হওয়া পর্যন্ত রোদের আলো তাঁর মুখে পড়ছে। তিনি প্রতিটি স্টেশনের নাম পড়ার চেষ্টা করছেন। বনানী, টঙ্গী, ঘোড়াশাল ফ্ল্যাগ...। প্রতিদিন দুপুরে খাবার পর মিনারা বেগম ঘণ্টা দুয়েক ঘুমান। রাতে এই বয়সে এমনিতেই ঘুম কমে যায়। তিনি তখন স্বামীকে বলেন, মরার ঘুম যে কোথায় যায় বুঝি না? স্বামী এ সময় তাঁকে বলেন, এক কেক তুমি কত বার খেতে চাও বল?

শ্রাবণের ধারায় স্নাত সবুজ ঘাস, খেত, ডোবা, গাছ, দড়িতে বাঁধা বাছুর, সঙ্গে তার জননী, সাদা বক্-সভা, ট্রেনের দিকে নির্ণিমেষ কৌতূহল ভরে তাকিয়ে থাকা গ্রাম্য শিশু আর সাদা নিশান উড়িয়ে থাকা রেল কর্মীদের মিনারা বেগম দেখতে থাকেন। বর্ষার বিলও আছে। সেখানে কোনো নববধূ নৌকায় করে শ^শুরবাড়ি যাচ্ছে না কারণ সবাই এখন দ্রুতগামী। শ্যালো ইঞ্জিনচালিত নৌকা এখন ওগুলোর বিকল্প। তবে কোথাও কোথাও কোনো জলাশয়ের পাড়ে ‘গামছা’র জালে ছোট মাছ ধরার দৃশ্য দেখা যাচ্ছে। মিনারার মনে পড়ে ১৯৪৬ সালে ক্লাস টেনে পড়ার সময় ‘বর্ষার বিল’ কবিতাখানি তাঁর পাঠ্য ছিল।

পৃথা একসময় শাশুড়ির বাঁ কাঁধে ওর বাঁ হাত রাখে। তিনি ঘুমিয়ে পড়েছেন।

সূর্য ডোবার পর দেড় ঘণ্টা পার হয়ে গেছে। মিনারা বেগম ধরমড় করে চোখ মেলে জিজ্ঞেস করেন,

‘পৃথা, কটা বাজে? আমরা কোথায়?

-আম্মা, চৌমুহনী পার হয়ে আমরা এখন ভাটিয়ারীর দিকে যাচ্ছি।

-তোমাকে না বলেছিলাম একটা স্টেশন এলে আমাকে বলতে।

তিনি প্রায় বলে ফেলতে যাচ্ছিলেন, তোমার মনে নেই? তবে তিনি তা বলেন না।

-আম্মা, দেখি আপনি এমন গভীর ঘুম দিয়েছেন। তাই আর ডাকিনি। আজ দুপুরের ঘুমটা তো আপনার ডিস্টার্ব হয়েছে।

-আচ্ছা ঠিক আছে। ভালোই করেছো। যাবার সময় কি আমরা একই পথে ফিরবো?

-হ্যাঁ, মা।

-তাহলে তখন বলো।

অনিক উল্টো চেয়ারে বসে ছিল। আর এক পরিবারের এক তের বছরের কিশোরের সঙ্গে। ও বলে, আম্মা, বিষয়টা আমারও মনে আছে। ভুল হবে না। তুমি গভীর ঘুমে ছিলে।

ফয়’স লেক পরিদর্শন হয়ে গেছে। রেড বাটন রেস্তোরাঁতে দুপুরের খাবারের অর্ডার দিয়েছে অনিক। বেশ ভালো খাবার কিন্তু মিনারা বেগমকে অন্যমনস্ক মনে হয়। অনিক বলে, রান্না কি তোমার ভালো লাগছে না মা?

‘না, লাগছে। আচ্ছা এরপর আমরা কোথায় যাবো?

-যদিও তাড়াতাড়ি হয়ে যায় তবে পতেঙ্গা যাওয়াই তো বাকি আছে আম্মা। আগ্রাবাদে শপিং করে ওগুলো রেস্ট হাউজে রেখে তারপরও পতেঙ্গা যাওয়া যেতে পারে। সূর্যাস্ত হতে দেরি আছে।

-আচ্ছা এখানে অফিস কটা পর্যন্ত।

পৃথা বলে, ঢাকার মতোই। কেন মা?

-আন্দরকিল্লার এসিল্যান্ড অফিসে...

পৃথা বিষয়টা জানে না। বলে, ওখানে কি কোনো কাজ আছে? কার কাছে যাবেন? আজ তো বন্ধ।

-তোমার শ^শুর ওখানে কাজ করেছেন ১৯৬০ সালে। আমরা কাছেই একটা বাসায় থাকতাম। এত কাছে এসেছি, একটু দেখে যেতাম। অনিকের জন্ম হয়েছিল এখানেই। ও বলে,

-আচ্ছা আম্মা, এত বছর পর পরিচিত কাউকে তো পাবেন না।

-পৃথা বলে, থামো তো তুমি। চলেন মা, ওটা দেখে যাই। এরপর আমরা সমুদ্র সৈকতে যাবো।

মান্ধাতা ও কুম্ভকর্ণ সরকারি কাজে অপরিচিত কোনো শব্দাবলী নয়। তাই দালানটা স্থানান্তর হয়নি। অফিসটা সহজেই পাওয়া গেল। মিনারা বেগম পুরোনো হলুদ টিনশেড বিল্ডিংটার সামনে ঘুরে দেখলেন। জমির কাজ, তাই এই বন্ধের দিনেও মানুষের হালকা ভিড় জায়গাটাকে কিছুটা ঘিরে রেখেছে। ‘আঁর, গম্ আছোনি?, কইয়ের, বদ দা’ জাতীয় কলকাকলী বারান্দার ওপর শোনা যাচ্ছে। তবে বাসাটার কথা মিনারা বেগম কোনোভাবেই মনে করতে পারলেন না। ছয়তলা, চারতলা দালান ও অফিসে জায়গাটা এমনভাবে ঢাকা পড়ে গেছে যে, তিনি টিনের চালের ওই ছোট্ট বাসাটা কোথায় ছিল তা পুত্র বা পুত্রবধূকে বুঝিয়ে বলতে পারলেন না। পৃথা বললো, আব্বা আসলে আনন্দ পেতেন। ওনাকে রাজি করাতেই পারলাম না।

-থাক, মানুষটা এত বেশি ট্যুর করেছে যে এখন আর বাইরে যেতে চায় না।

ঢাকাগামী আপ ট্রেনটা ছুটে চলেছে তীব্রবেগে। মিনারা বেগমকে কিছুটা ম্রিয়মাণ দেখা যাচ্ছে। সময় আর স্টেশন হিসাব করে অনিক সামনে তাকিয়ে ছিল। এখন অপরাহ্নের আলো ট্রেনের বাঁ দিকের জানালা দিয়ে মিনারা বেগমের ওপরে পড়ছে। বয়সের ভারে এবং মেদের কারণে তাঁর ফর্সা হাতের মাংস একটু ঝুলে গেছে। চিকন সোনার চুড়ির পার তাতে একটু ডেবে আছে। তিনি প্রায় তন্দ্রাচ্ছন্ন। হঠাৎ অনিক বলে, পৃথা, নেক্সট স্টেশন। আমরা আশুগঞ্জ এসে গেছি। এখনই ট্রেন ব্রিজে উঠবে। ট্রেনের মাইক্রোফোনেও বলছে, পরবর্তী স্টেশন ভৈরব বাজার জংশন। মিনারা বেগম চোখ মেলে তাকান। ত্রিভুজ আকৃতির বিশাল লোহার বিম দিয়ে তৈরি রেলিং ঘেরা ভৈরব ব্রিজের ওপর ট্রেন উঠেছে। গতি কমে গেছে। নিচে মেঘনা নদী আর রেলিংয়ের দিকে তাকিয়ে তিনি বলেন, জানো বউমা, ১৯৪৮ সালে ঠিক এখানে এই নদীর ওপর দাঙ্গাকারীরা তোমার শ^শুর আর আমাকে ধরে ছিল।

-বলেন কি?

-হ্যাঁ, আমরা কলকাতা থেকে প্রকৃত পরিচয়ে মানে মুসলমান হিসেবেই ফুলবাড়িয়া রেল স্টেশনে পৌঁছি। তারপর ওখান থেকে ভৈরব রওয়ানা দেই আরেকটা ট্রেনে। সারা রাস্তা নিরাপদ ছিল, এই ব্রিজে উঠা মাত্র কোথা থেকে পাঁচজন ষণ্ডামার্কা ধুতি পরা লোক আমাদের কম্পার্টমেন্টে উঠে তোমার শ^শুরের পরনে ধুতি দেখেও জিজ্ঞেস করে, কী? জাতি কী? তিনি বলেন, হিন্দু। আমি তাঁর স্ত্রী জেনে বলে দেখি ঘোমটা খোল। এর আগেই তোমার শ^শুর বুদ্ধি করে আমার কপালে বড় করে সিঁদুর পরিয়ে ঘোমটা লাগিয়ে দিয়েছিলেন। হাতের ব্যাগে তখন একটা সিঁদুরের কৌটা রাখতাম। তাদের একজন তখন তার হাতের ড্যাগারের মাথা দিয়ে আমার ঘোমটা খুলে দেখে এবং সšুÍষ্ট হয়ে চলে যায়।

-তো মা, আপনারা এদিকে আসছিলেন কেন?

-তোমার শ^শুরের পোস্টিং হয়েছিল এখানে। জয়েন করার জন্য আসছিলাম। কী ভয় যে পেয়েছিলাম সেদিন।

ট্রেন কিচ্ কিচ্ শব্দ করে থেমে যায়। তিনজন নেমে প্ল্যাটফর্মে দাঁড়ান। অনিক বলে,

আম্মা এবার কোন দিকে?

-স্টেশন তো ঠিক তেমনি আছে দেখছি। হ্যাঁ, বাঁ দিকে নিচে নেমে ঐ ডান দিকে।

মিনারা বেগম প্রায় হন্ হন্ করে হাঁটতে থাকেন। মনে হয় তাঁর বয়স কমে যেন পঁয়ত্রিশ হয়ে গেছে। ভৈরব শহর, মেঘনা নদীর পাড়। এখানে সংস্কৃতি অন্য রকম। রিকশা, ব্যাটারিচালিত স্কুটার এবং রিকশা ভ্যানের ভিড় রয়েছে স্টেশনের বাইরে তবে তারা ঢাকার মতো কোনো যাত্রীকেই একেবারে ঘিরে ধরছে না। ভ্যান চালকরা অনিকদের দিকে একবার তাকিয়েই বুঝেছে এরা তাদের যাত্রী নয়। ব্যাটারিচালিত স্কুটারের প্রথম ড্রাইভারটি অনিকের দিকে তাকিয়ে বলে, আপনারা কই যাবেন ও? তার কণ্ঠে ময়মনসিংহের উচ্চারণ। মিনারা বেগম জায়গাটার নাম বলেন। চালকের বয়স পঞ্চান্নর মতো হবে। চোখে মুখে সৌজন্যের লক্ষণ। একটু ভ্রু কুঁচকে বলে, শহীদ আনসার উদ্দিন সড়ক? মিনারা বেগম বলেন, নাম তো এরকম ছিল না। হাসান মোল্লার ঘড়ির দোকানের যে মার্কেট...।

-না ঠিকই আছে। ঘড়ির দোকানডাও আছে। তয় আরো দোকান হইছে। ’৭১ এ শহীদ আনসার উদ্দিনের নামে পরে ঐ রোডটার নাম হইছে। আমি চিনবার পারছি। ওঠেন। আপনারা অনেক আগের কথা কইছুন।

এ বাহনগুলো বেশ চওড়া। লাগেজসহ তিনজনের ভালোই জায়গা হয়ে যায়। স্কুটার নিঃশব্দে এগিয়ে চলে। মিনারা বেগম বাঁ দিকের দৃশ্যপট দেখতে থাকেন। মিনিট ছয়েক চলার পর পৌর মার্কেট দেখা যায়। তিনি ড্রাইভারকে মার্কেটের গেটে দাঁড়াতে বলেন। পৃথা ও ছেলেকে নামতে বলেন। স্কুটার চলে যায়। মালামালশুদ্ধ এরকম সুশ্রী, শহুরে মানুষ এ মার্কেটে সহসা দেখা যায় না। মার্কেটের গার্ড ওদের দিকে তাকালেও কোনো প্রশ্ন করে না। মিনারা বেগম চারদিক দেখতে থাকেন। তারপর উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বলেন, পেয়েছি, ঐ তো। ঐ ঘড়ির দোকান থেকেই তোমার শ^শুর মোট তিনটি ঘড়ি কিনেছিলেন। দুটো জাপানি সিটিজেন হাতঘড়ি আর একটা রেডিয়াম দেয়া পশ্চিম পাকিস্তানি টেবিল ক্লক। তখন একটা দোকানই ছিল। এই ‘ভুঁইয়া ওয়াচ’। এর মধ্যে চার-পাঁচটা বেড়েছে দেখছি। আর এই যে পাশের দোকান ‘চন্দ্রলেখা স্বর্ণকার’। এখান থেকে গহনা কিনেছি কিছু কিছু। পৃথা ও অনিক দোকানগুলোর সাইন বোর্ড পড়ে দেখে। সেখানে লেখা আছে ‘১৯৪৫ সালে প্রতিষ্ঠিত’। মিনারা বেগম বলেন, আশ্চর্য, সবই সে রকমই আছে দেখছি। ঐ যে ইটের ভাটা, মাছ বাজার, মনোরঞ্জন দত্ত গার্লস স্কুল, আফাজ উদ্দীন বস্ত্রবিতান। অথচ চিটাগাংয়ে তো অফিসটা ছাড়া আর কিছুই চিনতে পারলাম না। অনিক বলে, মা, ওটা বন্দর নগরী, পুরোনো জেলা শহর। আর এটা তো উপজেলা। আচ্ছা মা, বাসাটা কোন দিকে তা মনে আছে? আর কি কোনো গাড়ি বা রিকশা নিতে হবে, না হেঁটেই যাওয়া যাবে?

-না গাড়ি লাগবে না।

মিনারা বেগম বাঁ দিকে হাঁটতে থাকেন। পুত্র ও পুত্রবধূ চাকা লাগানো স্যুটকেস দুটো ইটের রাস্তার ওপর দিয়ে টেনে নিতে থাকে। বাঁশের খুঁটির ওপর মাচা বেঁধে সারি সারি দোকান ও বাসা বাড়ি। নিচে খালের পানি। মাছ বাজার, টাঙ্গাইলের চমচমের দোকান, হাজী আসমত কলেজ, শহীদ নেয়ামত আলী পৌর পার্ক, জিল্লুর রহমান স্টেডিয়ামের দেয়াল এবং থানা পার হয়ে একটা মহল্লার কাছে মিনারা বেগম থামেন। এমন সময় মাগরিবের আজান শোনা যায়। তিনি নিজের মাথায় ঘোমটা টেনে পৃথাকেও তা করতে বলেন। এখন তারা দাঁড়িয়ে আছেন সিমেন্টের বাঁধানো সিঁড়ি ঘর ও দেয়াল ঘেরা একটা দোতলা বাড়ির সামনে। সিমেন্টের গেটের ওপর লেখা ‘মনসুর মঞ্জিল’। মিনারা বেগম বলেন, হ্যাঁ এই বাড়ির নিচের তলাতেই আমরা ছিলাম। বাড়িওয়ালা সাহেবের নাম ছিল মনসুর রহমান। প্রায় অন্ধকার নির্জন গলির মুখে এমন মফস্বলে দুজন ভদ্র মহিলা ও তরুণ দাঁড়িয়ে থেকে বেশিক্ষণ মানুষের মনোযোগ আকর্ষণ না করে থাকতে পারবে- তা হয় না। মাথায় টুপি ও দামি লুঙ্গি পরা এক মাঝবয়সী লোক অনিকের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, আপনারা কাকে খুঁজতেছেন? মিনারা বেগম বলেন, এটা হাজী মনসুর সাহেবের বাড়ি না?

-জি, আপনারা কি এমপি সাহেবরে খুঁজতেছেন? এই বাড়ি তো তাঁর।

-আমরা মনসুর সাহেব ও তাঁর স্ত্রীকে খুঁজছি। তিনি এমপি কি না তাতো জানি না।

-ঠিকই আছে। ওনার ছেলেই বর্তমান এমপি মনজুর রহমান। ওনার বাবা মারা গেছেন কিছু দিন হলো।

মিনারা বেগম তার মা ও বড় ভাইকে যেন এখানে দাঁড়ানো দেখতে পেলেন। পরীর জন্ম হবার সময় তারা এ বাসায় এসেছিলেন।

দোতলার খোলা জানালার ফাঁক দিয়ে এক ভদ্রমহিলা এই দৃশ্য ও কথোপকথন মনোযোগ দিয়ে শুনছিলেন। মফস্বলে নিরাপত্তা তল্লাশি বা ‘আপনার পরিচয় দিন’ জাতীয় কোনো ব্যাকরণ এখনো তেমন প্রতিষ্ঠা লাভ করতে পারেনি। অতএব পঁয়তাল্লিশ বছরের এই ভদ্র মহিলা সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে এসে মিনারা বেগমকে সালাম দিয়ে খুব ভদ্রভাবে পরিচয় জিজ্ঞেস করলেন। মিনারা বেগম বললেন, চল্লিশ বছর আগে আমরা এই বাসায় ছিলাম। আজ এখান দিয়ে ঢাকায় ফিরছিলাম। অনেক দিনের ইচ্ছা ছিল একবার জায়গাটা দেখে যাই। সুযোগ হয়নি। বিয়ের পর আমার সংসারের জীবন আরম্ভ হয়েছিল এই বাসায়।

বি-বাড়িয়া সরকারি মহিলা কলেজের অধ্যাপক এমপি-পত্নী জুন্নুন নাহার হেলেনা স্মিত মুখে বললেন, আপনারা আগে ওপরে তো আসুন। নিচে দাঁড়ানো একটা ছেলেকে তিনি বললেন, এই হাকিমুদ্দী, ওনাদের স্যুটকেসগুলো ওপরে নিয়ে আসো। ময়মনসিংহের মানুষ প্রমিত বাংলা বলার চেষ্টা করলে ঢাকার মানুষদের কানে যেমন শুনায় জুন্নুন নাহারের কথাগুলো তেমনি শোনা যাচ্ছে।

-তাহলে আপনি মনসুর সাহেবের পুত্রবধূ?

-জি।

-ওনার ছেলেমেয়ে তো ছিল সাতজন। তো আপনার হাজব্যান্ডের নাম কি?

-মনসুর রহমান।

-ডাক নাম? ভালো নামে চিনতে পারছি বলে মনে হয় না।

-কচি।

-আচ্ছা মনে পড়েছে। আমরা যখন এখানে আসি তখন ওনাদের পাঁচ বছরের দুই যমজ ছেলে ছিল। তাদের নাম ছিল কচি ও সচি। তাই না? এখন এই ১৯৯৩ সালে এত বছর পরে তাদের কাউকে বোধহয় চিনবো না।

-আপনি ঠিক বলেছেন। এই কচিই আমার হাজব্যান্ড। তবে উনি বাসায় নেই। গতকাল ঢাকায় গেছেন। আপনারা বসেন, আমার শাশুড়িকে ডাকছি।

-ওনাকে আমি চিনতে পারবো ঠিকই। আমার বয়স এখন ষাট। ওনার বয়স সত্তর বা বাহাত্তরের বেশি হবে না।

কিছুক্ষণ পরে জুন্নুন নাহার সাদা থান পরা বেগম মনসুরকে নিয়ে রুমে ঢুকে। দেলদুয়ার জমিদার বাড়ির কন্যা শামীমা মুমতারিনের রূপ ও রংয়ের কারণেই কেউ একবার তাকে দেখলে দীর্ঘদিন ভোলার কথা নয়। তিনি মিনারা বেগমকে দেখে চিনতে পারেননি। তবে পুত্রবধূর ব্রিফিংয়ের সূত্রে মনে করতে পেরেছেন। হাসি মুখে বললেন, হুরীর মা না?

অনিকের ভাইবোনদের মধ্যে সবার বড় হুরীর ও পরীর জন্ম হয়েছিল এই বাসায়।

-হ্যাঁ আপা চিনতে পেরেছেন?

-হ পারছি। পাঁচ-ছয় বছরের ঘটনা। আপনারা এই বাসায় রইলা। আপনার সাহেব বদলি হইয়া গেল, সবই মনে আছে। যাওনের পর কতদিন পর্যন্ত তো আমরা কতবার মনে করছি আপনাগো কথা। ভাবছি যদি কোনো দিন দেখা হয়। কিন্তু কেমনে? কোথায় ভৈরব আর কোথায় ঢাকা? তারপর মাঝখানে গেল ’৭১। বড় ভালো লাগলো দেখাডা হইয়া। লগে কি ব্যাডার বউ? এই পোলা তো এই বাসায় হইছে বইলা মনে হয় না।

মিনারা বেগম তার সব ছেলেমেয়ের বর্ণনা দেন। তারপর তিনি জুন্নুন নাহারকে বলেন, বাসাটা একটু ঘুরে দেখি?

রান্নার সুঘ্রাণ ও সংগীত ভেতর থেকে ভেসে আসছিল। রাত সাড়ে ৯টা বাজে। পৃথা জুন্নুন নাহারকে বলে, ভাবি আমরা এবার উঠি? ট্রেন সাড়ে দশটায় ছাড়বে।

জুন্নুন নাহারের শাশুড়ি বলেন, এইডা এমপির বাড়ি। যদি ইস্টিশনে ফোন করি, ট্রেন খাড়া কইরা রাইখা ইস্টিশন মাস্টার এখান থেইকা তোমরারে নিয়া গাড়িতে তুইলা দিব। চিন্তা কইরো না। তোমরা না খাইয়া যাইতারবা না। ঢাকায় যাইতে তো তিন ঘণ্টার বেশি লাগতো না। তোমার শাশুড়ির মনটা আমি বুঝতাম পারছি। অল্প বয়সেও হে এমন ভালো মানুষই আছিল। এদিকে ঐ যে আমরার বউয়ের বাবা কি কইরছুন তা বউর থেইকাই হুন।

জুন্নুন নাহার বলে, আমার আব্বার বয়স এখন ৭০-এর মতো হবে। বছর চারেক আগে একদিন উনি বলেন কলকাতা যাবেন। তো আম্মা আর আমরা বললাম, ওখানে আমরার কোনো আত্মীয়স্বজন নেই, ওখানে আপনি কোথায় যাবেন? কেন যাবেন? তিনি বললেন, ১৯৪৩ সালে তিনি যেখানে থেকে বিএসসি পড়তেন সেখানে যাবেন। আম্মা বললেন, পাগলামি। কিন্তু আমার হাজব্যান্ড বললেন, আম্মা, খুব ভালো মনের মানুষেরই এমন ইচ্ছা হয়। যেতে দেন, আমি ব্যবস্থা করবো। কলকাতার হাইকমিশন ওনাকে সাহায্য করবে। ছুটি নিয়ে আমিও সঙ্গে গেলাম। দেখলাম তিনি বেকার হোস্টেলের কত নম্বর রুমে থাকতেন, কোথায় ডাইনিং রুম ছিল, কোন হলে সিনেমা দেখতেন, সায়গলের গান শুনতে কোন থিয়েটারে যেতেন সব খুঁজে খুঁজে বের করছেন। ভালো ফটো তুলতে পারেন না, দেখলাম তাও তুলছেন। সাহিত্য পড়াই বলে নয়, এ বিষয়গুলো তো সব মানুষের মধ্যে থাকে না। কাজেই আমি বিষয়টা বুঝতাম পারছি।

ডাউন ট্রেনটার একটা কুপেতে ঢাকামুখী সিটের জানালার পাশে চোখ বুঁজে বসে আছেন মিনারা বেগম। উল্টো দিকে তাঁর পুত্র। পৃথা বসেছে শাশুড়ির পাশে। রুমের সব বাতি নেভানো। ট্রেন এখন গাজীপুর জেলায় ঢুকেছে। জোছনার আলো পড়েছে মিনারার মুখে ও চোখে। তার মুখে মেছতার কটি দাগ, তবু তাকে সুন্দর দেখাচ্ছে। মনে হচ্ছে যেন তিনি ঘুমাচ্ছেন। তাঁর মাথার ভেতর উড়ে বেড়াচ্ছে এক আকাশ প্রদীপ। তাতে তিনি দেখছেন অনেক বছর আগের মফস্বলের আলোকিত এক উঠোন, হাতচাপা কল, শেফালি ফুলের গাছ, তারে শুকাতে দেয়া কাপড়, রান্নাঘরে অ্যালুমিনিয়ামের হাঁড়ি-পাতিল, সুজির হালুয়ার বাটি, ডালডায় ভাজা লুচির বাসন, কাঁসার গ্লাস, তিনটি শিশুর কলকাকলী, নিপল লাগানো দুটি দুধের বোতল, সূর্যমুখী দুটি সেগুনকাঠের খাটে পাতা পরিষ্কার চাদর, তার ওপর ফ্রেমে নীল সুতোর ফুল তোলা বালিশের ওয়াড়, একজন যত্নশীল সুপুরুষ, ঘরের কোণে সাঁঝবাতির স্নিগ্ধ আলো, রঙিন বর্ণমালার এলোমেলো কটি বই আর খেলনার সমারোহ।

এক অনির্বচনীয় আনন্দানুভূতিতে মিনারা বেগম ভেসে যেতে থাকেন।

সংবাদটি শেয়ার করুন

ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :