রোগ নিরাময়ে কার্যকরী অলৌকিক ভেষজ গাছ শজনে

ফিচার ডেস্ক, ঢাকাটাইমস
| আপডেট : ১১ জুন ২০২৩, ১১:১১ | প্রকাশিত : ১১ জুন ২০২৩, ০৮:৪৫

প্রকৃতির মধ্যে কিছু ভেষজ গাছ আছে যা খেলে খুব সহজেই আমাদের বিভিন্ন রোগ নিরাময় হয়, এমন একটি ভেষজ গাছ শজনে। যার বৈজ্ঞানিক নাম মরিঙ্গা অলিফেরা। শজনে আমাদের সকলের কাছে অতি পরিচিত সুস্বাদু একটি সবজি।

খ্রিষ্টের জন্মের ১৫০ বছর আগের ভারতীয় প্রাচীন ভেষজ লেখনীতে শজিনার ঔষধি গুণের বর্ণনা পাওয়া যায়। সেই পুরাকাল থেকেই ভেষজ পন্ডিতগণ শজনে গাছের বিভিন্ন রকম গুণের কথা উল্লেখ করে আসছেন। শজিনার মূল, ছাল, ফুল, ফল, বীজ,পাতা সবকিছুতেই মহাঔষধি গুণ বিদ্যমান। এর প্রধান ঔষধি রাসায়নিক পদার্থ হচ্ছে,বিটা- সিটোস্টেরোল, এক্যালয়েডস-মোরিনাজিন। আর ফুলে আছে জীবাণুনাশক টিরিগোজপারমিন। এর মধ্যে আছে ভিটামিন এ, বি, সি,প্রোটিন ও চর্বি জাতীয় পদার্থ, কার্বোহাইড্রেট ইত্যাদি।

প্রায় চার হাজার বছর ধরে রন্ধন এবং নানা চিকিৎসায় শজনে গাছের ব্যবহার হয়ে আসছে। বাড়ির আনাচে-কানাচে, বনে-জঙ্গলে, পুকুরের ধারে এই গাছ দেখা যায়। সম্প্রতি অনেক দেশেই বাণিজ্যিকভাবে শজনে চাষ হচ্ছে । চাষও খুব সহজ। গাছের একটা ডাল পুতে দিলেই হলো। এই গাছ বাড়ে খুব দ্রুত আর দুই তিন বছরেই ফুল ও ফল দেয়। এর ফুল, পাতা, ডাঁটা সব কিছুই সুস্বাদু ও শরীরের জন্য বিশেষ উপকারী। শজনে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়িয়ে শরীরকে করে পূর্বের থেকেও বেশি স্বাস্থ্যকর।

শজনে গাছকে বিভিন্ন খাদ্য প্রজাতির মধ্যে সর্বোচ্চ পুষ্টিমানসম্পন্ন উদ্ভিদ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। দেশি-বিদেশি পুষ্টি বিজ্ঞানীরা শজনেকে অত্যাশ্চর্য বৃক্ষ বা অলৌকিক বলে অভিহিত করেছেন। এটি পৃথিবীর সবচেয়ে পুষ্টিকর হার্ব। গবেষকরা শজনে পাতাকে বলে থাকেন, নিউট্রিশন্স সুপার ফুড এবং শজনে গাছকে বলে থাকেন মিরাক্কেল ট্রি। কারণ এর সমস্ত অংশ যেমন ডাঁটা, পাতা, বাকল, শিকড় ইত্যাদি জুড়ে রয়েছে বিভিন্ন পুষ্টি উপাদান এবং ভেষজ গুণাবলী।

দক্ষিণ আফ্রিকায় এ গাছকে মায়েদের ‘উত্তম বন্ধু’ এবং পুষ্টির এক অনন্য সহজলভ্য উৎস হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। বর্তমানে শজিনা গাছের বিভিন্ন অংশ যেমন ফুল, পাতা, গাছের ছাল, বাকল, শিকড় ইত্যাদি প্রায় ২০০ প্রকার রোগের প্রতিষেধক হিসাবে ব্যবহার করা হয়।

প্রতি ১০০ গ্রাম সতেজ শজনে পাতায় পুষ্টি উপাদান থাকে : শক্তি ৬৪ ক্যালরি, কার্বোহাইড্রেট ৮.২৮ গ্রাম, প্রোটিন ৯.৪০ গ্রাম, ফ্যাট ১.৪০ গ্রাম, ফাইবার ২.০ গ্রাম, পানি ৭৮.৬৬ গ্রাম, ভিটামিন এ ৩৭৮ মাইক্রোগ্রাম, ভিটামিন বি১ (থায়ামিন) ০.২৫৭ মিলিগ্রাম, ভিটামিন বি২ (রিবোফ্লেভিন) ০.৬৬০ মিলিগ্রাম, ভিটামিন বি৩ (নিয়াসিন) ২.২২০ মিলিগ্রাম, ভিটামিন বি৫, (প্যানটোথেনিক এসিড) ০.১২৫ মিলিগ্রাম, ভিটামিন বি৬ (পাইরিডক্সিন) ১.২ মিলিগ্রাম, ভিটামিন বি৯ (ফলেট) ৪০ মাইক্রোগ্রাম, ভিটামিন সি ৫১.৭ মিলিগ্রাম, ক্যালসিয়াম ১৮৫ মিলিগ্রাম, আয়রন ৪ মিলিগ্রাম, ম্যাগনেসিয়াম ১৪৭ মিলিগ্রাম, ম্যাঙ্গানিজ ০.৩৬ মিলিগ্রাম, ফসফরাস ১১২ মিলিগ্রাম, পটাশিয়াম ৩৩৭ মিলিগ্রাম, সোডিয়াম ৯ মিলিগ্রাম।

পুষ্টিগুণ বিবেচনায় শজনে পাতা আর শজনে ডাঁটা দুটোই মূল্যবান। এই দুই ধরনের খাবারের মধ্যেই কিছু বিশেষ গুণাগুণ রয়েছে যা শরীরের জন্য নানাবিধ উপকারিতা বয়ে আনে। আর তাই আপনার পছন্দমতো যে কোনো একটি খেতে পারেন। তবে শজনে ডাঁটার মধ্যে পাতার তুলনায় বেশি পরিমাণে ভিটামিন সি ও ফাইবার রয়েছে। শজনে পাতার মধ্যে ১৮ ধরনের এমিনো এসিড রয়েছে যা প্রোটিন গঠনের মূল উপাদান। প্রোটিনের একটি ভালো উৎস হিসেবে পুষ্টিবিদরা শজনে পাতা খাওয়ার পরামর্শ দেন। জেনে নিন সুপার ফুড শজিনা পাতার অত্যাশ্চর্য সব উপকারিতা-

পুষ্টির পাওয়ার হাউজ

প্রতি গ্রাম শজনে পাতায় একটি কমলার চেয়ে সাত গুণ বেশি ভিটামিন সি, ডিম থেকে প্রায় দুই গুণ বেশি প্রোটিন ও দুধের চেয়ে চার গুণ বেশি ক্যালসিয়াম ও প্রোটিন, গাজরের চেয়ে চার গুণ বেশি ভিটামিন এ এবং কলার চেয়ে তিন গুণ বেশি পটাশিয়াম বিদ্যমান। আয়রনের দিক থেকে এটি পালং শাকের চেয়ে ৫ গুণ বেশি শক্তিশালী।। ফলে এটি অন্ধত্ব, রক্তস্বল্পতাসহ বিভিন্ন ভিটামিন ঘাটতিজনিত রোগের বিরুদ্ধে বিশেষ হাতিয়ার হিসেবে কাজ করে।

ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করে

শজনে পাতার এন্টি-অক্সিডেন্ট এবং আইসোথিয়োকাইনেটস নামের উপাদানগুলো রক্তে সুগার লেভেল নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করে। প্রতিদিন মাত্র ৫০ গ্রাম শজিনার পাতা খেলে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে থাকে। বিশেষ করে ডায়াবেটিসের রোগীদের জন্য আদর্শ শজনে পাতার চা। এই পাতার মধ্যে ফাইটোকেমিক্যাল নামের একটি যৌগ রয়েছে যা রক্তে শর্করার মাত্রা কমাতে সাহায্য করে। পাশাপাশি এই পাতার চা পান করলে কোলেস্টেরলের মাত্রাও নিয়ন্ত্রণে থাকে এবং অক্সিডেটিভ চাপ নিয়ন্ত্রণে থাকে।

রক্তস্বল্পতা দূর করে

সজনে পাতা রক্তস্বল্পতা দূর করে। শাকের তুলনায় পঁচিশ গুণ বেশি আয়রন রয়েছে এতে। কলা থেকে তিন গুণ বেশি পটাশিয়াম রয়েছে। শরীরের পুষ্টি চাহিদা পূরণ করতে শজনে পাতা দারুণ উপযোগী। তবে ভালো উপকার পেতে বেশ কিছুদিন নিয়মিত শজনে পাতা, ডাঁটা ও ফুল খাওয়া দরকার।

অ্যান্টি-অক্সিডেন্টের খনি

শজনে পাতাকে এন্টি-অক্সিডেন্টের খনি বলা হয়ে থাকে। যা ক্যানসার কোষ সৃষ্টিতে বাধা দেয়। তাছাড়া এ তে রয়েছে বেটা-কেরোটিন, কিউরেকটিন এবং ক্লোরোজেনিক অ্যাসিড যা মানবদেহের জন্য উপকারী। ক্লোরোজেনিক অ্যাসিড রক্তের চাপ ও শর্করা কমাতে সাহায্য করে।

রোগ প্রতিরোধ করে

শজনে পাতার শাক বা কাঁচা পাতার রস মানব শরীরের জন্য অনেক উপকারী। শজনে মানব শরীরে যেমন হরমোন বর্ধন করতে পারে, তেমনি পারে মায়েদের বুকের দুধ বাড়িয়ে দিতে। তাছাড়া শজনে পাতা শাক, ভর্তা বা পকোড়া করে খেলে মুখের রুচি আসে ও কোষ্ঠকাঠিন্য দূর হয়। ডায়রিয়া, কলেরা, আমাশয়, কোলাইটিস এবং জন্ডিসের সময় ও ব্যাপক কার্যকরী শজনে পাতা। শজিনার ডাঁটা ও পাতা কৃমিনাশক ও জ্বরনাশক হিসেবেও কাজ করে।

ব্ল্যাড প্রেসার নিয়ন্ত্রিত থাকে

ব্ল্যাড প্রেসার রোগীদের জন্য খাবার লবণ অর্থাৎ ‘সোডিয়াম ক্লোরাইড’ খুবই ক্ষতিকর। অপরদিকে, ‘পটাশিয়াম লবণ’ কোনো ক্ষতি করে না। শজনে ডাঁটাতে সোডিয়াম ক্লোরাইড নেই বললেই চলে। তাই এতে ব্ল্যাড প্রেশার নিয়ন্ত্রিত থাকে।

ত্বকের বার্ধক্য রোধ করে

শজনের তেল এবং শজনে পাতার গুঁড়া ত্বকের বলিরেখা এবং ত্বকের ক্ষত দূর করে। এছাড়াও শজনে আমাদের ত্বকের ঔজ্জ্বল্য বৃদ্ধি করে এবং ত্বকের কুঁচকানো ভাব, বলিরেখা এবং বিভিন্ন দাগ ছোপ দূর করে আমাদের ত্বকের উজ্জ্বল বজায় রাখতে সাহায্য করে। গুঁড়া কিংবা শজনের বীজ গ্রহণ করলে রক্ত পরিশ্রুত হয় যার ফলে ত্বক পরিষ্কার ও স্বাস্থ্যকর হয়।

কিডনি ভালো রাখে

কিডনি বা মূত্রাশয়ে পাথর জমার সম্ভাবনা অনেকটাই কমিয়ে দেয়। অ্যান্টি অক্সিড্যান্টে ভরপুর শজনে শরীর থেকে টক্সিন দূর করতে সাহায্য করে।

অ্যামাইনো অ্যাসিডের উৎস

শজনে পাতায় অ্যাসেনশিয়াল অ্যামাইনো অ্যাসিড আছে আটটি। ভিটামিন ‘এ’ এবং ভিটামিন ‘সি’ আছে। রয়েছে প্রচুর পরিমাণ ক্যালসিয়াম। ম্যাগনেসিয়াম, পটাশিয়াম, জিংক, আয়রন এবং অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট। এতগুলো নিউট্রিয়েন্ট থাকার কারণে বিজ্ঞানীরা বলছেন যে, শজনে পাতা একটি অলৌকিক পাতা।

আর্থ্রাইটিস নিরাময়ে

গুণের কারণে আর্থ্রাইটিস নিরাময়ে শজনে পাতা দারুণ কার্যকর। যাদের হাঁটু ব্যথা আছে, শজনে পাতার জুস খান। শজনে পাতার ভর্তা খান অথবা গুঁড়া খান। ছয় মাস খান। দেখেন আপনার আর্থ্রাইটিসের ব্যথা ভালো যাবে।

শরীরকে ডিটক্সিফাই করে

শরীরকে ডিটক্সিফাই করতে সাহায্য করে শজনে পাতা। আমরা জানি যে, আমাদের শরীরে ৭০ থেকে ১০০ ট্রিলিয়ন সেল বা কোষ আছে। প্রত্যেকটা কোষের ভেতরে লক্ষাধিক রিঅ্যাকশন হয় প্রত্যেক দিন; প্রতি মুহূর্তে এবং এই লক্ষাধিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া, বিক্রিয়া হতে গিয়ে ভয়াবহ কিছু টক্সিন, কিছু বিষাণু, কিছু ক্ষতিকর পদার্থ সেলের ভেতরে তৈরি হয়। এগুলোকে আমরা বলি বর্জ্য পদার্থ, টক্সিন, ফ্রি রেডিক্যাল। এগুলো যদি সেলের ভেতরে থেকে যায়, আপনি কোনো দিন সুস্থ থাকতে পারবেন না। কেউ আপনাকে সুস্থ করতে পারবেন না।

শজনে পাতার চা ও গুঁড়া যেভাবে বানাবেন

শজনে বা শজিনা পাতা কাঁচা অবস্থায় রান্না করে বা শুকনো করার পর গুঁড়া করে পাউডার হিসাবে শজিনা চা খাওয়া যেতে পারে। নিয়মিত শজনে পাতার চা পান করলে শরীরে দুর্বলতা, ক্লান্তি আসবে না কখনো। শরীরে এনার্জি জোগাতে এক কাপ সজনে পাতার চা-ই যথেষ্ট। পাশাপাশি এই পাতার মধ্যে অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল এবং অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল বৈশিষ্ট্য রয়েছে যা শরীরকে যে সংক্রমণের হাত থেকে রক্ষা করে।

শজনে পাতার চা দুইভাবে তৈরি করা যেতে পারে। এক. সরাসরি কাঁচা শজনে পাতা লাল চায়ের মধ্যে মিশিয়ে খাওয়ার মাধ্যমে উপকারিতা পাওয়া যায়। দুই. এক্ষেত্রে প্রথমে শজনে পাতা শুকিয়ে নিতে হবে। অতঃপর তা হাতের মুঠোয় নিয়ে যতটুকু সম্ভব গুঁড়া করতে হবে। এবার তা গরম পানিতে মিশিয়ে চা বানাতে হবে। এই চায়ের সাথে পরিমাণ মতো চিনি, কুচি কুচি করে কাটা আদা ও লেবু ব্যবহার করা যেতে পারে।

শজনে পাতা গুঁড়া করে দীর্ঘদিন ঘরে সংরক্ষণ করে রাখা যায়। এক্ষেত্রে প্রথমে পাতা সংগ্রহ করে ধুয়ে নিতে হবে। অতঃপর রোদে দিয়ে ভালোভাবে শুকিয়ে নেওয়ার পর শক্ত কিছুর উপর রেখে পিষে অথবা গ্রিন্ডার মেশিনের সহায়তায় গুঁড়া করতে হবে। প্লাস্টিকের বোতল অথবা বাটিতে না রেখে কাঁচের পাত্রে রাখুন। তাতে গুনাগুণ সবচেয়ে ভালো থাকবে। পুষ্টিবিদদের মতে, দৈনিক এক চামচ শজনে পাতার গুঁড়া খেলেই দৈনন্দিন ভিটামিন এবং খনিজ পদার্থের চাহিদা পূরণ হবে। নিয়মিত ডায়েটে শজনে খান এবং সুস্থ থাকুন।

(ঢাকাটাইমস/১১ জুন /আরজেড)

সংবাদটি শেয়ার করুন

ফিচার বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

ফিচার এর সর্বশেষ

এই বিভাগের সব খবর

শিরোনাম :