দুবাই থেকে অনলাইন ক্যাসিনোর নিয়ন্ত্রণ!
কিশোরগঞ্জের বাজিতপুর উপজেলার গজারিয়া এলাকার এক কৃষকের ছেলে আবদুল কাইয়ুম মিয়া। ছিলেন বেসরকারি কোম্পানির শ্রমিক। মাত্র আড়াই থেকে তিন বছরের ব্যবধানে হঠাৎ করেই আঙুল ফুলে কলাগাছ বনে গেছেন তিনি। এলাকায় গড়ে তুলেছেন কোটি টাকা মূল্যের আলিশান বাড়ি, নামে-বেনামে রয়েছে বিপুল পরিমাণ সম্পত্তি। এলাকায় এ নিয়ে বেশ চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে। স্থানীয় লোকজনসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অনেককেই ভাবিয়ে তুলেছে কাইয়ুমের আয়ের উৎস নিয়ে।
এ বিষয়ে ঢাকা টাইমসের অনুসন্ধানে বের হয়ে এসেছে চাঞ্চল্যকর তথ্য। প্রাথমিকের গণ্ডি পার করতে না পারলেও মাত্র ৩০ বছর বয়সেই নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে তুলেছেন অনলাইন ক্যাসিনোতে। ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মকে পুঁজি করে বর্তমানে তিনি দুবাই বসেই বাংলাদেশে নিয়ন্ত্রণ করছেন অনলাইন ক্যাসিনো সিন্ডিকেট। অনলাইন ক্যাসিনোর এই গডফাদারের প্রধান টার্গেট দেশের উঠতি বয়সি যুবক ও শিক্ষার্থীরা।
দেশে থাকাকালীন সময়ে অনলাইন ক্যাসিনোর টাকায় নিজ এলাকায় হঠাৎ করেই অনেক সম্পত্তি গড়তে থাকেন। বিষয়টি নিয়ে এলাকায় বেশ চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। চায়ের দোকান থেকে শুরু করে খবর ছড়িয়ে পরে থানা পুলিশ পর্যন্ত। জুয়া ও ক্যাসিনোর বিষয়ে সরকার যখন জিরো টলারেন্স ঘোষণা করেন, ঠিক সেই মুহূর্তে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাত থেকে নিজেকে বাঁচাতে দুবাই পাড়ি জমান। বর্তমানে দুবাই বসেই কয়েক বছর যাবত ভেলকিবাজি ৩৬৫ ও লাকি উইনসহ বিভিন্ন নামের অ্যাপস বানিয়ে দুবাই থেকে অনলাইন ক্যাসিনোর সাইট পরিচালনা করে আসছেন কাইয়ুম। নিজেকে নিরাপদে রাখতে অনলাইন ক্যাসিনোতে আসক্ত ব্যক্তিদের সাথে তিনি যোগাযোগ রক্ষা করেন হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে। এমন বেশ কিছু তথ্য এসেছে ঢাকা টাইমসের কাছে।
অনলাইন ক্যাসিনো পরিচালনার বিষয়ে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আজাদ রহমান ঢাকা টাইমসকে বলেন, অনলাইন জুয়ার তথ্য পেলেই সিআইডি আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করে থাকে। অনেক সময় দেখা গেছে দেশের বাইরে থেকেই কেউ কেউ অনলাইন জুয়া পরিচালনা করে থাকে। সেই ক্ষেত্রে আমরা বিটিআরসিতে অবগত করে সাইটগুলো বন্ধ করার ব্যবস্থা গ্রহণ করি।
আজাদ রহমান বলেন, দেশের বাইরে থেকে কেউ এই ধরনের অপরাধের সাথে জড়িত থাকলে তাদেরকেও আইনের আওতায় নিয়ে আসা হয়। তাদের নামেও মামলা দায়ের করা হয়। এরপর তাদের কেউ দেশে আসলে আমরা গ্রেপ্তার করি। কিছুদিন আগে এয়ারপোর্ট থেকে অনলাইন জুয়ার এক নিয়ন্ত্রককে গ্রেপ্তার করেছে সিআইডি। যেখানে বসেই দেশে অপরাধ করুক না কেন তাদের আইনের আওতায় আনা হচ্ছে। আমরা অনলাইন ক্যাসিনোর গডফাদারদের খুঁজে খুঁজে বের করছি।
স্থানীয় সূত্র বলছে, কিছুদিন পরপরই কাইয়ুম দেশে আসেন। সিন্ডিকেটের প্রধানদের সাথে অনলাইন ক্যাসিনো ব্যবসার পরিধি বাড়াতে গোপন বৈঠক করে আবার দুবাই চলে যান।
বর্তমানে কাইয়ুমের নিজ এলাকা কিশোরগঞ্জের বাজিতপুর উপজেলাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে রয়েছে তার অনলাইন ক্যাসিনোর নেটওয়ার্ক। শুধুমাত্র বাজিতপুর উপজেলাতেই রয়েছে এই সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রক ১৫-২০ জন যুবক। এদের মধ্যেও অনেকেই অনলাইন ক্যাসিনো ব্যবসায় খুব অল্প কিছুদিনে কোটিপতি বনে গেছেন। সেখানে কাইয়ুমের প্রধান সহযোগী হিসেবে কাজ করছেন স্থানীয় হাবিবুর রহমান বকুল ও সোহাগ।
কটিয়াদি থানা সূত্রে জানা গেছে, গত ২০ জুলাই ক্যাসিনো সিন্ডিকেটের সাথে গোপন বৈঠক করতে দেশে আসলে মাদক সেবন করা অবস্থায় তার সহযোগী হাবিবুর রহমান বকুলের ছেলে রাকিব ওরফে আরকানসহ গ্রেপ্তার হয় কাইয়ুম। এসময় কটিয়াদি থানা পুলিশের অভিযানে কাইয়ুমসহ ৬ জনকে গ্রেপ্তার করে থানা পুলিশ। জেল থেকে ছাড়া পেয়েই দ্রুত দেশ ত্যাগ করে দুবাই চলে যান তিনি। বর্তমানে সেখানে বসেই দেশের বিভিন্ন এলাকায় অনলাইন ক্যাসিনো পরিচালনা করছেন কাইয়ুম। বাজিতপুরের বাসিন্দা আরিফুল ইসলাম রোমান ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘কয়েক বছর আগেও কাইয়ুম এলাকায় একটি কোম্পানিতে শ্রমিকের কাজ করতো। অভাব-অনটনেই চলতো তাদের সংসার। হঠাৎ করে সে অনেক সম্পত্তির মালিক হতে থাকে। পরে আমরা জানতে পারি সে অনলাইনে ক্যাসিনো জুয়ার ব্যবসা করে এত বড়লোক হয়েছে। এলাকার অনেক যুবক এই অনলাইন জুয়া খেলে সর্বস্বান্ত হয়েছে। কাইয়ুমের বর্তমানে অনেক বড় প্রভাবশালী সিন্ডিকেট আছে, তাই ভয়ে কেউ প্রতিবাদ করার সাহস পায় না।’
আড়াই থেকে তিন বছর আগে শ্রমিকের চাকরি করা অবস্থায় অনলাইন জুয়ার বেটিং সাইট চালানো শুরু করেন কাইয়ুম। অল্প সময়ে বিপুল পরিমাণ টাকা হাতিয়ে নেওয়ার পর চাকরি ছেড়ে দিয়ে স্থানীয় কয়েকজনকে দিয়ে বিকাশের এজেন্ট নেওয়ায় এবং তাদের জুয়ার সিন্ডিকেটে অন্তর্ভুক্ত করেন। এরপর থেকেই কাইয়ুমকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। সেখান থেকেই তিনি অনলাইন জুয়া পরিচালনা সংক্রান্ত সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করছেন।
সম্প্রতি কোটি টাকা দিয়ে গ্রামে বিশাল পুকুরসহ একটি ফার্ম ক্রয় করেছেন কাইয়ুম। তার অনলাইন ব্যবসার অংশীদার হিসেবে পরিচিত হাবিবুর রহমান বকুল সেখানে বর্তমানে মৎস্য চাষ করছেন। তারও রয়েছে আরো একাধিক ব্যবসা।
নাম গোপন রাখার শর্তে কয়েকজন ভুক্তভোগী ঢাকা টাইমসকে জানান, সারাদেশে কাইয়ুমের অনলাইন ক্যাসিনোর বৃহৎ সিন্ডিকেট রয়েছে। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে থাকা লোকজন এই জুয়ায় আসক্ত হয়ে সর্বস্ব হারাচ্ছে। দেশে অনলাইন ক্যাসিনোর নিয়ন্ত্রণকারীরা হুন্ডির মাধ্যমে কাইয়ুমের সহকারীদের দিয়ে লাখ লাখ টাকা লেনদেন করে থাকেন। এসব অর্থ হুন্ডির মাধ্যমে পাচারের অভিযোগ রয়েছে কাইয়ুম মিয়া সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে। কাইয়ুম সিন্ডিকেট নামে-বেনামে বিকাশ এজেন্ট ও পার্সোনাল অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করে ক্যাসিনোর টাকা উত্তোলন করেন।
অপরাধ বিষয়ক বিশ্লেষক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান শাহারিয়া আফরিন ঢাকা টাইমসকে বলেন, দেশ যত ডিজিটালাইজেশন হচ্ছে অপরাধপ্রবণতা ততটাই বাড়ছে। আগে মানুষ অপরাধ করে সহজে পার পেয়ে যেত না, এখন ভার্চুয়াল মাধ্যমে অপরাধ করে নিজেকে নিরাপদ রাখতে পারে। তাই তাদের মধ্যে অনলাইনে অপরাধপ্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
মানুষ না জেনেই অনলাইনের ফাঁদে পা দিচ্ছেন। আবার অনেকের মাঝে লোভ কাজ করে। খুব অল্প সময়ে প্রচুর অর্থ পাওয়ার লোভ এবং নিরাপদ প্ল্যাটফর্ম মনে করে অনেকেই অনলাইন ক্যাসিনোর দিকে ঝুঁকছে। প্রশাসনকে এসব ক্যাসিনো বা জুয়া পরিচালনাকারী মূলহোতাদের আইনের আওতায় আনতে হবে।
অনলাইনে ক্যাসিনো পরিচালনা রোধের বিষয়ে তিনি বলেন, এ ধরনের অপরাধের শাস্তি দৃশ্যমান ও কঠোর হওয়া উচিত। এক সময় এসিড নিক্ষেপের প্রবণতা বেশি ছিল। যখন এই অপরাধের শাস্তি দৃশ্যমান হয়েছে, সকলে জেনেছে এসিড নিক্ষেপ করলে কঠোর শাস্তি পেতে হবে। এমনি করে অনলাইন ক্যাসিনো রোধে প্রশাসনের তৎপরতা আরও বাড়াতে হবে।
(ঢাকাটাইমস/১৯নভেম্বর/জেএ/এইচএম/কেএ)